সবুজের কার্পেট বিছানো পথে কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ জলধারা। সেই শরীর জুড়ানো ঠাণ্ডা পানিতে পা ডুবিয়ে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা ঝর্ণা আবিস্কার করতে চাইলে আপনাকে ছুটতে হবে সীতাকুণ্ড। ঝর্ণার রাজ্য সীতাকুণ্ড থেকে সম্প্রতি ঘুরে আসলাম আমরা কয়জন। বাংলা ট্রিবিউনের পাঠকদের শোনাবো সেই চমৎকার অভিজ্ঞতার গল্পই। যেখানে সবুজে ঘেরা ঝিরিপথ মেশে রহস্যময় অজানায়, পথচলার ক্লান্তি ধুয়ে দেয় ঝর্ণার উচ্ছ্বাস।
আমরা বেশ কয়েকজন ঝর্ণা দেখার উদ্দেশ্য নিয়েই রওনা দিলাম সীতাকুণ্ড। পৌঁছলাম ভোর চারটায়। অবশ্য ভোর না বলে তাকে রাত বলাই ভালো। বাস যেখানে নামিয়ে দিলো সৌভাগ্যক্রমে পাশেই ছিল যাত্রী বসার বেঞ্চ। অগত্যা সবাই ব্যাক-প্যাক নিয়ে সেখানেই আশ্রয় নিয়ে আলোর অপেক্ষা শুরু করলাম। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন অপু নজরুল ও মোসলেম উদ্দিনসহ তিনজন, সাকুল্যে আমরা ১৭ জন। ভোর পাঁচটা বাজতেই আমরা একটা লেগুনা থামিয়ে মিরসরাইয়ের দিকে রওনা হই। নামি ছোট দারোগার হাটে। এখানে এক ঘন্টা ট্রেক করে চলে আসি লবণাক্ষকুণ্ড হয়ে সূর্যকুণ্ড ও সহস্রধারা জলপ্রপাত। ঘন্টাখানেক এই জলপ্রপাতে কাটিয়ে রওনা হলাম বড়দারোগার হাট। এখানে এসে এক ফাঁকে সকালের খাবার খেয়ে নিই। তারপর শুরু হয় আমাদের মূল অভিযান পর্ব।
বড়দারোগার হাট থেকে হাইওয়ের অনেকখানি হেঁটে ছোট কমলদহ হয়ে বড় কমলদহের পথ ধরি। তারপর তো সারাদিন চষে ফিরি কমলদহ আপারস্ট্রিম ট্রেইল। মোটামুটি অপরিচিত ট্রেইল। বড়কমলদহ থেকেই মূলত ছড়ার শুরু। অসাধারণ এই ট্রেইলের আপারস্ট্রিমে আছে চার-পাঁচটি বড় ও মাঝারি আকারের ঝর্ণা ও অসংখ্য ছোট-বড় ক্যাসকেড। কমলদহ ঝর্ণাটি তিন স্টেপের। বিশাল আকারের এই ঝর্ণাটি দেখতে যেমন অসাধারণ, তেমনি বিপদজনকও। আমরা কমলদহ ঝর্ণাসহ দেখতে গিয়েছিলাম ছাগলকান্ধা ও পাথরভাঙ্গা ঝর্ণা, যে যাত্রা পথের শুরু সীতাকুণ্ডের বড়দারোগার হাট থেকে।
বর্ষাকাল, সারাদেশ বৃষ্টিতে ভিজে আছে। আমরা যখন কমলদহের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি আকাশ তখনও ঘনকালো মেঘে ঢাকা। সীতাকুণ্ডের বড় দারোগার হাট পেছনে ফেলতেই শুরু হয় অঝোর বৃষ্টি। ঝুম বৃষ্টিতেই আমরা এগিয়ে চলি। ছোট কমলদহ চলে আসতেই চারদিকে সবুজ দেখে মন ভালো হয়ে গেল।
আমরা এই পথে ঘন্টা দেড়েক হেঁটে পেয়ে যাই ঝিরিপথ। অপরূপ সুন্দর সে ঝিরিপথ। ঝিরি পথের দুপাশে কখনও ঘন জঙ্গল তো আবার কখনও ঘাসের ঢাল বেয়ে চলতে হচ্ছিল। কত নাম না জানা বুনো ফুল ও ফল চোখে পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আবার অর্কিডও চোখে পড়েছে মাঝেমধ্যে। অনেক পরিচিত দাঁতরাঙা বা প্রচুর ল্যান্টানা দেখে নাম জানার আনন্দে অনেকেই উচ্ছাসে ফেটে পড়েছে। বনকলা থেকে শুরু করে বনআদা সবই ছিল এই ট্রেইলে। ডুমুর ও কেওড়া ফলের স্বাদ নিয়েছি, সঙ্গে নিজেদের শুকনা খাবার। চা যে কত প্রয়োজনীয় এক পানীয় যাত্রা পথে বারবার তা টের পেয়েছি। তবে চায়ের ব্যবস্থা না থাকলেও এখানে প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল স্বর্গীয়। অসাধারণ ঝিরি পথ, এত এত গাছ ফুল দেখে বারবার ক্যামেরা তাক করতে হচ্ছিল। ফলাফল দলনেতা সোহেল পপাইর চোখ রাঙানি। এভাবেই এক সময় চলে আসি ছাগলকান্ধা ও পাথরভাঙ্গা ঝর্ণা।
এখানে ঝিরিপথ ইংরেজি ওয়াই আকার ধারণ করেছে, বিস্ময়কর বটে! আরও অপার বিস্ময় আর সৌন্দর্য নিয়ে বসে ছিল তার দুপাশের ঝর্ণা দুটি। প্রকৃতির কোলে ঝর্ণাধারা সুন্দর সাজে বসে যেন আমাদেরই অপেক্ষায়। ছাগলকান্ধা সহজ হলেও পাথরভাঙ্গায় যাওয়াটা খুব কঠিন ছিল। ঝারা দুই ঘণ্টা আমরা ঝর্ণাতেই কাটাই। কারোর কোনও ক্লান্তি ছিল না। ঝর্ণার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শেষবেলায় যখন পাহাড়ের ওপর উঠে পথ হারিয়ে ফেলি, তখনও সবাই দূর থেকে সমুদ্র উর্মিমালার এক ঝলক দেখে আনন্দে চিৎকার করে বলেছে, এ হলো শেষবেলার সুখ!
সহস্রধারা ঝর্ণা হয়ে পুরো কমলদহ আপারস্ট্রিম ট্রেইল টানা ১২ ঘন্টায় একাকার করেছি, পাহাড়ে চড়ার আনন্দটাও ছিল ষোলোআনা। এ যেন ছিল এক স্বর্গযাত্রা, স্বপ্নের ট্রেইল ধরে!
ছবি: লেখক
/এনএ/