স্বচ্ছ নীলে সবুজ দোলে...

স্বচ্ছ নীল জলে লাফিয়ে পড়ে আয়েশ করে ভেসে ভেসে মেঘ দেখার জন্য টাঙ্গুয়া হাওর যাওয়া আমাদের প্রতি বছরের অভ্যাস। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। শেষ বর্ষায় আমাদের ঘোরাঘুরির গ্রুপ ‘ওয়াইল্ড অ্যাডভেঞ্চার’ থেকে ২৭ জনের বিশাল দল নিয়ে রওনা দিলাম, উদ্দেশ্য সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়া হাওর।

টাঙ্গুয়া হাওরের পানি এমনই স্বচ্ছ নীল, ছবি: রাকিব কিশোর

সুনামগঞ্জ পৌঁছানোর পর যোগ দিলেন চট্টগ্রাম থেকে আসা আমাদের আরও ৫ বন্ধু। নাস্তা সেরে হাসন রাজা মিউজিয়ামে ঢুঁ মেরেই সোজা নৌকায় উঠে পরলাম বাজার ঘাট থেকে। সঙ্গে আগামী দুইদিনের আনাজপাতি। শুরু হলো আমাদের হাওর যাত্রা।

হাওরের কালচে পানি, ছবি: আদনান হোসেনঘোলা পানি কেটে নৌকা চলা শুরু হতেই সবাই সবার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কেউ ‘উনো’ নামক কার্ড খেলা নিয়ে মেতে উঠলো, কেউবা আয়েশি ভঙ্গিতে সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো। কেউ আবার কোনও কিছুই ভালো লাগে না ভঙ্গিতে উদাস হয়ে রইলো। কিছুদূর যেতেই অবশ্য বদলে যেতে শুরু করলো দৃশ্যপট। নৌকার পাটাতনে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকাদের পায়ে খোঁচা মেরে ঘুম ভাঙ্গালো পানির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের দল। বিস্মিত চোখ আঁটকে গেল ঘোলা পানির ফাঁকে ফাঁকে জেগে ওঠা সবুজ চরে। যেখানে আপন মনে চড়ে বেড়াচ্ছে গরু। এরকমই এক সবুজের আস্তানা খুঁজে নৌকা ভিড়িয়ে হইহই করে নেমে পড়লাম আমরা। ছুটোছুটি, হইহুল্লোড় শেষে স্থানীয়দের বিদায় জানিয়ে নৌকায় উঠে খেয়ে নিলাম দুপুরের খাওয়া।

টাঙ্গুয়া হাওর যাওয়ার পথে চোখে পড়বে এমন দৃশ্য, ছবি: নওরিন আক্তার

টাঙ্গুয়া হাওর যাওয়ার পথে চোখে পড়বে এমন দৃশ্য, ছবি: আদনান হোসেন

তারপর আবার সবুজ দেখতে দেখতে পথচলা। এরমধ্যেই বদলে যেতে শুরু করেছে পানির রং। মাঝি জানালেন আমরা টাঙ্গুয়া হাওরের কাছাকাছি চলে এসেছি। কালচে আর ঘোলা পানি একটু একটু করে নীলচে বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে। পানির এক হাত নিচে ছটফট করছে শ্যাওলা। আরেকটু সামনে এগোতেই পানির নিচে সবুজ গাছের ডগা দুলে দুলে স্বাগত জানালো আমাদের। যেন আস্ত একটা জঙ্গলই পানির নিচে ঘুমিয়ে আছে! রোদের দাপটে আয়নার মতো স্বচ্ছ জলে সেই জঙ্গলের প্রতিচ্ছবি দেখে আমাদের বিস্ময় আর কাটে না। লাইফজ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে টুপ টুপ করে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করলো সবাই। এ আনন্দ পানির বিছানায় ভেসে বেড়ানোর, বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে নীল-সবুজকে আলিঙ্গন করার।

এ আনন্দ বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে নীল-সবুজকে আলিঙ্গন করার, ছবি: রাকিব কিশোর

পানির নিচে সবুজ গাছের ডগা দুলে দুলে স্বাগত জানায় এখানে, ছবি: রাকিব কিশোর

রাতে সীমান্তঘেঁষা টেকেরঘাটে ভিড়লো নৌকা। ঝুম বৃষ্টির রাতটা কোনওভাবে পার করে পরদিন চোখ মেলতেই অপূর্ব এক দৃশ্য চোখে পড়লো। বিশাল বিশাল পাহাড়গুলো মেঘের চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে চুপটি করে। বৃষ্টি মেশানো স্নিগ্ধ বাতাসের সেই সকালটা ছিল শুধুই মুগ্ধ হওয়ার। সূর্যের সঙ্গে আড়মোড়া ভেঙে একটু একটু করে প্রকাণ্ড সবুজ পাহাড়গুলো জেগে উঠতেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম টেকেরঘাট ঘুরতে। মন জুড়ানো লাইমস্টোন লেকের টলটলে জলে কেউ নিজের প্রতিবিম্ব খোঁজা শুরু করলো, কেউ আবার ছোট ছোট সবুজ টিলার চূড়ায় উঠে এভারেস্ট বিজয়ীর ভঙ্গিতে ‘ভি’ সাইন দেখিয়ে ছবি তুলতে শুরু করলো।

বিশাল বিশাল পাহাড়গুলো মেঘের চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে চুপটি করে, ছবি: নওরিন আক্তার

সবুজে ঘেরা লাইমস্টোন লেক, ছবি: নওরিন আক্তার

টেকেরঘাট, সুনামগঞ্জ; ছবি: নওরিন আক্তার

চমৎকার একটা ভোর কাটিয়ে আবার নামলাম পানিপথে। এবার ফেরার পালা। তবে তার আগে দেখে নিতে হবে জাদুকাটা নদী, বারিক্কা টিলা আর বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট ঝর্ণা ‘বারিক্কা ছড়া।’

বারিক্কা টিলাতে নেমে জাদুকাটা নদীর রূপ দেখতে দেখতে রওনা দিলাম বারিক্কা ছড়ার উদ্দেশ্যে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে বেশ কিছুটা সময় হেঁটে সবাই ক্লান্ত হয়ে গেল। সামনে ঢালু পাহাড়ি পথ, যা গিয়ে মিশেছে বারিক্কা ছড়ায়। বর্ষা ভাবী ‘না, না, যাব না’ করতে করতে সুন্দর করে নেমে গেলেন ঝর্ণায়। ভ্রমণে গিয়ে ছবি না তোলা বিষয়ক বিরাট বক্তৃতা দেওয়া শাকিল ঝর্ণার পানিয়ে নেমে একের পর এক পোজ দিতে শুরু করলেন। ডাক্তার নাদিয়া ঝর্ণা দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে আঁজলা ভরে পানি মুখে দিতে গিয়েই আবিষ্কার করলেন ঠিক উপরেই সাবান-শ্যাম্পু দিয়ে খুব যত্ন করে গোসল করছেন স্থানীয় একজন। এরপর ঝর্ণার পানি না খাওয়ার একশ একটা উপকারিতা সবাইকে বুঝাতে বুঝাতে বের হয়ে আসলেন ঝর্ণা থেকে।

বারিক্কা টিলা থেকে চোখে পড়বে জাদুকাতা নদীর এই রূপ, ছবি: নওরিন আক্তারবারিক্কা ছড়া, ছবি: নওরিন আক্তার

সবাই নৌকায় উঠলো ক্লান্ত হয়ে। সেই ক্লান্তি দূর করতে জাদুকাটা নদীতে আরেক প্রস্থ সাঁতার কাটা হলো।

জাদুকাটা নদীর জাদুতে..., ছবি: ইমাম আহমেদ আরমান

সন্ধ্যা মিলাতেই আরেকটি চমৎকার দৃশ্য শেষ পূর্ণতাটুকু নিয়ে এলো আমাদের ভ্রমণে। আকাশ ভরা অজস্র তারা, যেন কেউ খুব যত্ন করে মোজাইক করেছে আকাশে। ঝিকমিকে তারার আলোতে নৌকা ভর্তি ক্লান্ত ভবঘুরের দল তখন মেতে উঠেছে বিষণ্ণ কোনও সুরে।

পড়ন্ত বেলায়..., ছবি: আদনান হোসেন

জেনে নিন
ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ যেতে পারবেন বাসে। সুনামগঞ্জের সাহেববাজার ঘাট অথবা বাজার ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করুন। ইঞ্জিনচালিত নৌকা আকৃতি অনুযায়ী ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেবে ভাড়া। প্রয়োজনীয় বাজার ও রান্নার ব্যবস্থা করে তবেই নৌকাই উঠবেন। লাইফজ্যাকেট সঙ্গে থাকা চাই অবশ্যই। পরিবেশ নোংরা হয় এমন কিছু করবেন না।

 

/এনএ/