গাজী কালু চম্পাবতীর মাজারে একদিন

ভোর ছয়টাই হবে। ঝিনাইদহের আগমুন্ডিয়ার রায়পুরা গ্রামে আমাদের প্রথম সকাল। রুমের জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি শান্ত চারদিক। আবছা সরের মত কুয়াশা লেগেছিল পুরো প্রকৃতিতে। মন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হতেই কিছু সময় জানলার পাশে দাঁড়িয়ে কুয়াশা উপভোগ করি। তারপর শুরু হয় ডাকাডাকি। ঠিক নয়টায় আমরা আগমুন্ডিয়ার পথে নামি। মিঠে সুরের মেঠো পথ। সেই পথে এখন আমরা হাঁটবো না। শামীমের মাইক্রোতে চেপে পুরো ঝিনাইদহ ঘুরবো। শুরতেই প্রজেক্ট অফিসার শাহিন হোসেন আমাদের মৌরি গাছের পাতা ধরিয়ে দিয়ে বললেন খেয়ে দেখেন। মৌরি আমাদের খুব পরিচিত। অনেকে তাকে মহুরি বলে ডাকেন। তবে গুয়োমুড়ি বললে সবাই তাকে এক নামে চেনেন।
মাইক্রোতে চড়ে বসলাম আমরা। পুরো এলাকা গাছ-গাছালিতে ঘেরা। কিছু কিছু জায়গায় সামাজিক বনায়ন চোখে পড়লো। অজস্র খেজুর গাছ এখানে। খেজুর গাছের আড়ালে পড়ে গেছে বাকি সব গাছ। শুরুর অনেকটা পথ আমরা মেঠো পথ ধরেই এগিয়েছি, তারপর পিচঢালা পথে চলা। এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনাবিল। সবুজের সমারোহ প্রচুর হলেও কাছাকাছি নদী চোখে পড়লো না। দুই কিলোর মতো চলার পর আমরা ছোট্ট একটা ঝুলন্ত সেতুর উপর দিয়ে যাওবার সময় নিচে ছোট্ট খালের মত দেখে মাইক্রো দাঁড় করালাম। সেতুর গায়ে লেখা ছিল বুড়া ভৈরব (মরানদী) নদী। নদীর এই করুণ অবস্থা দেখে আবার সেই প্রশ্ন সামনে চলে এল-কেন মরে গেল নদী! আধা ঘন্টার মত সেতুর উপর দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারপর চা পান করার জন্য চলে আসি এখানকার বারোবাজার এলাকায়।

গাজী কালু চম্পাবতীর মাজার
একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট নিরিবিলি যা বোঝায় বারোবাজার ঠিক তাই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু খাবারের দোকান। বেঞ্চপাতা সাধারণ ব্যবস্থা, খাদ্য তালিকা আরও সাধারণ। লাল চা আর কনডেন্স মিল্কের চায়ের সঙ্গে চম্পা কলা ভালোই চললো। দোকানি খুব আন্তরিক। তার আন্তরিকতার মুগ্ধতা নিয়ে আরও প্রায় দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চলে আসি যেখানে সে জায়গার নাম গাজী কালু। গাজী কালু চম্পাবতীর মাজার রয়েছে এখানে, সেজন্যই এলাকার এমন নামকরণ। ঝিনাইদহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য শুধু নয়, গাজী কালু চম্পাবতীর মাজারের জন্যও বিখ্যাত।

অশ্বত্থ গাছ
প্রতিদিন প্রচুর ভক্ত আর দর্শনার্থী আসেন মাজার দর্শনে। আজকে দর্শনার্থী বলতে আমরাই, বাকিরা ভক্ত। মাজারে প্রবেশের আগে পাশের দোকান থেকে আগরবাতি, মোমবাতি আর সুতা কিনে নিচ্ছেন এখানে আসা ভক্তরা। মোমবাতি মাজারের খাদেমের হাতে দেওয়ার জন্য। আর আগরবাতি প্রাচীন অশ্বত্থ গাছের ডালে বেঁধে মানত করে জ্বালিয়ে দেবেন। ভক্তদের বিশ্বাস মানত পূর্ণ হবে। আর সেদিন তারা এসে সেই সুতা খুলে নেবেন। কিন্তু আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। মানত পূর্ণ না হয় হলো, কিন্তু সেই হাজারো সুতার ভিড়ে নিজের বাঁধা সুতা চিনবে কী করে!

গাজী কালু চম্পাবতীর মাজার

শ্রীরাম রাজার দীঘির দক্ষিণ পাশে পাশাপাশি তিনটা কবর। মাঝের বড় কবরটি গাজীর, পশ্চিম দিকে কালুর কবর আর পূর্ব দিকের ছোট কবরটি চম্পাবতীর। পুরো মাজার ঘিরে আছে বিশাল একটি বটগাছ। এখানকার ভক্তকূল সেই অশ্বত্থ গাছে একটি ছোট্ট ফোঁকর দেখিয়ে দিলেন। অনেকে সেই ফোঁকরটিকে আরেকটি কবর বলে মানেন। কবরটি কার সে সর্ম্পকে জানতে না পারলেও গাজী কালু চম্পাবতীর গল্প বা জনশ্রুতি আমাদের সকলে অবগত। যারা জানেন না তাদের জন্য একটু বলি।

গাজী কালু চম্পাবতীর ইতিহাস

গাজী কালু চম্পাবতীর পরিচয় নিয়ে রয়েছে নানা রকম কাহিনি। প্রচলিত আছে বৈরাট নগরের রাজা ছিলেন দরবেশ শাহ সিকান্দর। তারই সন্তান বরখান গাজী। কালু হলেন রাজা দরবেশ শাহ সিকান্দরের পালিত পুত্র। কালুর সঙ্গে গাজীর দারুণ ভাব ছিল। কালু গাজীকে খুব ভালোবাসতেন। যেখানেই গাজী সেখানেই কালু, বিষয়টা এরকমই ছিল। চম্পাবতীর ভালোবাসার টানে গাজী ছুটে এসেছিলেন ছাপাই নগর। এই ছাপাই নগরই পরবর্তিতে বারোবাজার নামে পরিচিতি লাভ করে। সামন্ত রাজা রামচন্দ্র ওরফে মুকুট রাজার মেয়ে চম্পাবতীর প্রেমে পড়েন গাজী। হিন্দুরাজার মেয়ের প্রেম গাজীকে ভুলিয়ে দিল সে মুসলমান। গাজী ছাপাই নগর চলে আসার পর কালুও নিয়ম মতো বা গাজীর ভলোবাসার টানে তার সঙ্গী হয়ে ছিলেন। এখানে বলিহর বাওরের তমাল গাছতলায় গাজী নিয়মিত অবস্থান করতেন, আর অপেক্ষা করতেন চম্পাবতীর। এদিকে মুকুট রাজা তো রেগেমেগে আগুন। গাজীকে শায়েস্তার করার ভার দিলেন তার সেনাপতিকে। কিন্তু সেনাপতি দক্ষিণা রাও যুদ্ধে পরাজিত হয়ে গাজীর কাছে ইসলাম ধর্মের দীক্ষা নেন। অন্যদিকে রাজা রামচন্দ্র যুদ্ধে পরাজিত হয়ে চলে আসেন ঝিনাইদহের বাড়িবাথান। এখানে গাজীর সঙ্গী হয় কালু। শেষ পর্যন্ত চম্পাবতীকে উদ্ধার করে নিজের বাড়ি নিয়ে আসলেও বিষয়টা রাজা সিকান্দর মেনে নিতে পারলেন না, তিনি গাজীকে তার বাড়িতে উঠতে তো দিলেনই না। বিতারিত করলেন বলা চলে। শেষ পর্যন্ত গাজী প্রেমের জন্য দরবেশ হলেন। চম্পাবতীকে নিয়ে পথে নামলেন। এভাবেই শেষ পর্যন্ত গাজীর আস্তানা হয় সুন্দরবন এলাকায়। এখানে তার সঙ্গী যথারীতি কালু ও দক্ষিণা রাও। লেখার শুরুতেই বারোবাজারের গাজী কালু চম্পাবতীর মাজারে আরেকটি কবরের কথা বলেছিলাম। ধারনা করা হয়, সে কবরটি দক্ষিণা রাওয়ের।

পুকুর

গাজী-কালুর কথা দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে শোনেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। জনশ্রুতি আছে গাজী কালুর আধ্যাত্মিক প্রভাবে বাঘে ও কুমির একঘাটে জল খেত! গাজী কালু এমনই স্বনামধন্য ঐতিহাসিক চরিত্র। হিন্দু ধর্মবলম্বলীরা বনদূর্গার বদলে যাদের পূজা করে তাদের মধ্যে গাজী-কালু অন্যতম। গাজী-কালুকে নিয়ে অনেক মিথ বা গল্প প্রচলিত। অনেক কবিতা ও পুঁথির মাধ্যমে তার ভাব প্রকাশ হয়েছে যুগে যুগে আসলে ইতিহাস সন্ধান আমার কাজ না হলেও সে সব বাদ দিয়ে চলা মুস্কিল।
এখানে এলে গাজী কালু চম্পাবতীর মাজার দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীরাম রাজার দীঘিটির সৌন্দর্যেও মুগ্ধ হবেন। আমরা পুরো মাজার এলাকা ঘুরে দীঘির পাড়ে গিয়ে বসি। সেখানে গল্পে গল্পে কখন যে দুই ঘন্টা চলে গেছে বুঝতে পারিনি। জামান ভাইয়ের তাড়ায় টনক নড়ে। আজ আমাদের পুরো ঝিনাইদহ ঘুরে দেখার দিন। সেসব গল্প অন্যদিন!

গাজী কালু চম্পাবতীর মাজারের পথ
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ঝিনাইদহের বারোবাজার এলাকায় এলে গাজী কালু চম্পবতীর মাজারের দেখা পাবেন। ঢাকা থেকে ঝিনাইদহ সরাসরি বাস পাবেন। তবে ট্রেনে আসলে ভ্রমণ আরামদায়ক হবে। প্রতিদিন চিত্রা কমলাপুর থেকে খুলনা ছেড়ে যায় সন্ধ্যা সাতটায়। তবে ট্রেন বরাবরই লেট করে। আপনাকে নামতে হবে কোট চাঁদপুর বা মোবারকগঞ্জ। মোবারকগঞ্জে ট্রেন থামে না। সুতরাং কোট চাঁদটপুরই ভরসা, সময় নিয়ে যাবেন। এখানে খাওয়ার ব্যবস্থা ভালোই তবে থাকার ব্যবস্থা বলতে ঝিনাইদহ শহর। থাকা-খাওয়ার পর্যাপ্ত সুবিধা থাকলেও এখাবে দেখার আছে অনেক কিছু!

/এনএ/