৩ পেরিয়ে বাংলা ট্রিবিউন

‘ব্র্যান্ড দাঁড়াচ্ছে না ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে’

এই যে আপনি যা পরে আছেন, পোশাক, গয়না বা অন্যান্য অনুষঙ্গ এগুলো সবই বাহ্যিক। ভোগ্যপণ্যের মধ্যে আপনার শরীরে প্রবেশ করে শুধু খাদ্য। এই খাবারেই যদি ভেজাল থাকে, খাবার অস্বাস্থ্যকর থাকে তার ফল কী হতে পারে ভেবেছেন কখনও? ইদানিংকার অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের চুল পড়া, স্থুলতা, ত্বকে অসামঞ্জস্যতার কারণ কিন্তু এই অস্বাস্থ্যকর ভেজাল খাদ্যপণ্য। বাংলা ট্রিবিউনকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় এমন কথাই বললেন ফুড অ্যান্ড বেভারেজ অপারেটিং কোম্পানি অলিভ ট্রি ফুডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ আফতাব আহমেদ।

শেখ আফতাব আহমেদ

বাংলাদেশের ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে যুক্ত হওয়ার কথা...
অলিভ ট্রি ফুড অপারেটিং কোম্পানি শুরু হয়েছে ২০০৯ সালে। প্রথম অপারেশন শুরু হয় ২০১৩ সালে। অরেঞ্জ অ্যান্ড হাফ ছিল আমাদের প্রথম ভেঞ্চার। বাংলাদেশি ভোজনরসিকদের অথেনটিক কফির স্বাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যেই সে যাত্রা শুরু হলো। সে বছরই শুরু হয় ফাইন ডাইনিং ওয়াটার ক্রেস। ২০১৬ সালে আমেরিকান সুপার প্রিমিয়াম আইসক্রিমের স্বাদ দেওয়ার জন্য শুরু করা হয় বিশ্বখ্যাত আইসক্রিম ব্যান্ড ‘কোল্ডস্টোন ক্রিমারি’-এর বাংলাদেশ ব্রাঞ্চ।

ভবিষ্যতে আসছে...
এ মুহূর্তে আমেরিকান অরিজিনাল বার্গার, একদম খাঁটি ভারতীয় খাবার ও পিজ্জা নিয়ে কাজ করছে

অলিভ ট্রি। বাজারে যে কোনও পণ্য ছাড়ার আগে মার্কেট যাচাইসহ ক্রেতা ও ভোক্তাদের রুচি নিয়ে গবেষণা করা হয় এই প্রতিষ্ঠানে। তাই গবেষণা শেষ হওয়ার পরই খাদ্য ভোক্তাদের জন্য আসছে নতুন খাবার।

বাংলাদেশের বর্তমান মার্কেটের অবস্থা...
এ মুহূর্তে ফুড ইন্ডাস্ট্রি যে অবস্থায় আছে সেটিকে খুব অস্থিতিশীল বলা যায়। শুধু মার্কেট যাচাই না করে পণ্য ছাড়ার ফলে মুখ থুবড়ে পড়ছে অনেক হোটেল-রেস্তোরাঁর দারুণ কনসেপ্ট। তাই এখানে সফল হতে হলে বা টিকে থাকতে হলে খুব সতর্ক হয়ে পথ চলতে হয়। এ ব্যবসায় সফলতার হার খুব কম। বিশেষ করে কোনও ধরনের গবেষণা ও ব্যাকগ্রাউন্ড  যাচাই না করে কাজ করলে ধসের মুখে পড়তে হবে নিশ্চিতভাবে এবং এটিই হচ্ছে।

ওয়াটার ক্রেস রেস্টুরেন্টের খাবার

রেস্তোরাঁয় বাধা
রেস্তোরাঁ ব্যবসায় স্থান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখন যথাযথ মূল্যে যথাযথ স্থান না পেলে আপনি ব্যবসা দাঁড় করাতে পারবেন না। এর পর গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতার চাহিদা বা স্বাদ। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ব্যয়। খাদ্য  সম্পর্কিত ব্যবসা নিয়ে একটি কথা চালু রয়েছে ‘এতে ৫০ শতাংশ লাভ’। এ লাভ নিয়ে প্রশ্ন আছে। আপনি খাদ্যের যথাযথ মান বজায় রেখে উচ্চমূল্যের বাজারে অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় করে কোনোভাবেই পর্যাপ্ত লাভ রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
এরপর রয়েছে মানবসম্পদ সংকট। যোগ্য স্থানে যোগ্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না। আপনার দেশে ফুড অ্যান্ড বেভারেজে তরুণরা এখন আগ্রহ দেখালেও দক্ষ তরুণ নেই। যেমন আইসক্রিম বানানোর মতো দক্ষ কারিগর নেই। এটা আপনাকে মানতে হবে। এর সঙ্গে রয়েছে রসদ সংকট। আপনি একটি ব্যবসা শুরু করতে গেলে প্রথমে আবাসন সংকট এরপর পর্যাপ্ত পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস।

এগুলো পেলেও রয়েছে উচ্চমূল্যের ঝক্কি। আবাসনের উচ্চমূল্য পদে পদে আপনাকে পিছিয়ে দেবে। এরপর রয়েছে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো খাদ্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক। দুগ্ধজাত পণ্য আমদানি করতে গেলে আপনাকে প্রায় শতভাগ ট্যাক্স দিতে হয়। এর কারণ হিসেবে দাবি করা হয়, দেশজ শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতেই এই নিয়ম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, দেশে ১০০ ভাগ ফুলক্রিম দুধ পাওয়া যায় না। লো ফ্যাট দুধ দিয়ে ভালো মানের আইসক্রিম বানানো যায় না, সেক্ষেত্রে আমদানি ছাড়া উপায় নেই। একই সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে, দেশে অনেক খাদ্যপণ্য নেই। যেগুলো আমাদের আমদানি করতে হয় ১০০ ভাগ শুল্ক দিয়ে।
এর পরের গুরুত্বপূর্ণ বাধা হিসেবে রয়েছে সস্তায় খাবার দেওয়ার অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা। মানহীন চটকদার খাদ্য দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। যেখানে খাদ্যমান ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি মূল স্বাদও হারিয়ে যাচ্ছে। 
বাংলাদেশের রুচি...
এখানে ঐতিহ্যবাহী স্বাদ খুব গুরুত্বপূর্ণ। একদম সোজা কথা এটাই যে, বাংলাদেশের খাবার ভাত, বিরিয়ানি, কাবাব, থাই চাইনিজ। তবে তরুণদের রুচিতে ভিন্নতা আছে। শুধু তাদের স্বাদ বিবেচনা করে একটি ভিন্ন ফুড ইন্ডাস্ট্রি চালু হতে পারে। এক্ষেত্রে অনেক কিছু যাচাই করার রয়েছে। পিজ্জা-বার্গার করে সফলতা পাওয়া রেস্তোরাঁর সংখ্যা নেই বললেই চলে। তবে মুরগি ভাজা জনপ্রিয় হওয়ার ফলে কেএফসি সফল বাংলাদেশে। পাশাপাশি সেবা ও খাদ্যমান নিয়ে নিজেদের প্রমাণ করেছে পিজ্জা হাট। মডেল বলা যায় না সফল বলা যায় এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে। তবে দেশজ চাহিদা মেটাতে আইসক্রিম কিংবা কফি পার্লারেও ভাত রাখতে হয় আমাদের। 

ব্র্যান্ডিং...
এ দেশে খাদ্যপণ্যের ব্র্যান্ডিং দাঁড়াচ্ছে না। ব্র্যান্ড নিয়ে কাজ করছে খুব সামান্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তবে নানা সংকট ও অবকাঠামোগত ঘাটতির কারণে সেগুলোও প্রসারিত হতে পারছে না। একটা-দুইটা ব্র্যান্ড সফল হলেও সেগুলো ছড়িয়ে পড়তে পারছে না ভোক্তাদের অসচেতনতার কারণে। একই সঙ্গে আমাদের কোনও সংগঠন নেই। যারা নীতিমালা প্রণয়ন করবে, ব্র্যান্ডিং দাঁড় করাবে। একইসঙ্গে ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্য নিয়ে ভোক্তাদের সচেতন করবে।   

আউটলেট ভাবনা...

চট করে একটি ব্যাংকের অনেক স্থানে শাখা খুলতে পারলেও খাদ্যপণ্যের শাখা খোলা কঠিনই বলা চলে। বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থা, রসদ ঘাটতি, খাদ্য মানসহ নানা অবকাঠামোগত ঘাটতির কারণেই শাখা বা আউটলেট খোলা সম্ভব হয় না। গ্লোরিয়া জিন্সের মতো প্রতিষ্ঠানের শাখা নেই ঢাকার বাইরে। কারণ একটিই, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। একইসঙ্গে দেখভাল করার একটি বিষয় থাকে। সেটি একজনের পক্ষে করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে মান ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও থাকে।

অলিভ ট্রি ফুড...
পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে অলিভ ট্রি ফুড যাত্রা শুরু করেছে। সেটা করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক মানের ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ব্র্যান্ড বাংলাদেশে জন্ম দিয়েছে এবং বলা যায় সফলতার সঙ্গেই চলছে। তবে অনেক ঘাটতি রয়েছে। সেগুলো পূরণ করতে হবে।
অলিভ ট্রি দেশের মানুষকে পেট ভরার জন্য খাওয়া নয়, খাদ্যকে একটি অভিজ্ঞতার সমতুল্য করে তুলতে চায়। খাদ্যপণ্য গ্রহণের আগে মান, সেবা, নান্দনিকতাসহ আরও অনেক কিছু বোঝার বিষয় রয়েছে। সেগুলো বাংলাদেশিদের কাছে তুলে ধরতে চায়। মানুষকে সচেতন করে ব্র্যান্ডিং নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। না বুঝে খাওয়ার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে সেটি ভাঙাটাই প্রত্যয়।

/এনএ/