ভাষা ব্যবহারে হই সচেতন

ছোট চুল রাখতে পছন্দ করেন তাহমিনা সুলতানা মিলি। এ কারণে কমবেশি অনেকের কাছেই তাকে হতে হয় অপদস্থ। ছেলেদের মতো দেখাচ্ছে- এমন উক্তি মিলির নিত্যসঙ্গী। চুপচাপ স্বভাবের কারণে কলেজছাত্র রায়হানকে নিয়ে হাসাহাসি করে তার বন্ধুরা। ‘যাও মেয়েদের মতো চুড়ি পরে বসে থাকো!’- এই কথা তাকে শুনতে হয় প্রায়ই। এদিকে ব্যাংক কর্মকর্তা ফারহানা ইয়াসমিন জানালেন, প্রতিদিন কর্মস্থলে একদম সাধারণ সাজেই যান। কারণ মেকআপ তার পছন্দ না। একদিন শখ করে গাঢ় লিপস্টিক দিয়েছিলেন। ‘বিশ্রী’ লাগছে- সহকর্মীর এমন মন্তব্যে চুপসে গেছেন।
আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলা। সেই ভাষা ব্যবহারে আমরা কতোটুকু সচেতন? কাউকে অপমান করে কথা বলা, তাচ্ছিল্য করে লিঙ্গ বৈষম্য টেনে আনার পাশাপাশি শব্দ চয়নে মাধ্যমে আমরা প্রায়ই অন্যের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করে ফেলি। ‘অভ্যস্ত না এমন কিছু দেখলেই নিজের মতামত চাপিয়ে দিয়ে বলি বিশ্রী, অথবা জঘন্য। এই ধরনের ভাষা ব্যবহার না করে আমরা বলতে পারি ‘ব্যতিক্রমী।’ ভাষার ব্যবহারে এতোটুকু সচেতন তো আমরা হতেই পারি’- বলছিলেন কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের বাংলার প্রভাষক শাহানা বানু। শাহানা মনে করেন মানসিকতার পরিবর্তনও ভাষা পরিবর্তনের মতোই জরুরি। তবে ভাষা পরিবর্তন দিয়ে আমরা সচেতন হওয়ার প্রথম ধাপটা শুরু করতে পারি। মাতৃভাষা দিবসে এটাই হতে পারে আমাদের শপথ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরিন বলেন, ‘যোগাযোগের জন্যই তো ভাষা। একটি বৈষম্যমূলক সমাজে মানুষের ব্যবহারে যে ভাষা তৈরি হয়েছে, সেই ভাষাতে সেই বৈষম্য প্রকাশক নানা শব্দ থাকতে পারে। শ্রেণি, জেন্ডার, জাতি, ভৌগলিক অবস্থান কিংবা শারীরিক বৈশিষ্ট্যের জন্যও অসম্মানসূচক শব্দ ব্যবহৃত হয়। সেগুলো অনেক সময় সচেতনভাবে অপরকে অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা কিংবা আঘাত করার জন্যই ব্যবহৃত হয়। জসীম উদদীনের ‘কবর’ কবিতায় সেই “শত যে মারিত ঠোঁটে” – মনে আছে নিশ্চয়ই? যাকে অসম্মান করা হচ্ছে, শব্দের অপব্যবহার তাকে যতখানি আঘাত করে, যিনি ব্যবহার করছেন, তিনি হয়তো এই অসম্মানকে স্বাভাবিকভাবেই দেখে থাকেন। তাই প্রধানতঃ যেটি দরকার, সেটি হলো বাচনিক যোগাযোগে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহমর্মীতা প্রকাশের সংস্কৃতি গড়ে তোলা। শ্রদ্ধা ও পারস্পরিক সম্মান প্রকাশ করে, কিংবা বহুকে অন্তর্ভুক্ত করে, এমন অনেক শব্দই বাংলা ভাষায় রয়েছে। ভাষা প্রবাহমান, সুতরাং নতুন শব্দও ভাষায় ক্রমাগতভাবে যুক্ত হবে। ভাষার পরিবর্তন ঘটবে তো ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই।’

ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি অন্তরেও ধারণ করা চাই ভাষার প্রতি ভালোবাসা
কথা হলো প্রকৌশলী ও সংগঠক তৃষিয়া নাশতারানের সঙ্গে। বাংলাভাষী নারীদের নেটওয়ার্ক 'মেয়ে'র প্রতিষ্ঠাতা এবং সংগঠক তিনি। তৃষিয়া বলেন, ভাষা মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। মনে মনে আমরা যা ভাববো তা মুখের ভাষায় প্রকাশ পাবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দে ও বাক্যে মানুষের বর্ণ, শ্রেণি, লিঙ্গ, শারীরিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি কারণে বিদ্বেষ, তাচ্ছিল্য, অশ্রদ্ধা এমনকি ঘৃণাও প্রকাশ পায়। অনেক সময় না বুঝেই কথাগুলো বলে ফেলেন অনেকে। কাউকে রিকশাওয়ালা বলে অপমান করার চেষ্টা, অটিস্টিক বলে গালি দেওয়া, কারোর জাতিসত্তা নিয়ে ঠাট্টা করা, কোনও ব্যক্তির এমন কোনও বৈশিষ্ট্য যা তার নিয়ন্ত্রণাধীন নয় তা নিয়ে তার সমালোচনা করা, নারীদেরকে মেয়েমানুষ বলা ইত্যাদি আরও অনেক আচরণ যে অন্যায় সেটা বুঝতে পারেন না কিংবা স্বীকার করতে চান না অনেকেই। কারণ অতিব্যবহারে এই শব্দগুলো, এই প্রকাশভঙ্গিগুলো এতই সহজভাবে আমাদের চিন্তায় স্থান করে নিয়েছে যে শব্দচয়নের সময় নতুন করে আর চিন্তা করা হয়ে ওঠে না। ভাষার পরিবর্তনের সাথে সাথে তাই চিন্তারও পরিবর্তন ও সচেতনতা জরুরি বলে মনে করেন তৃষিয়া। ‘যা বলছি তা কেন বলছি, কী ভেবে বলছি তা নিয়ে যেন আমাদের চিন্তাভাবনা জারি থাকে। ভাবনায় সচেতনতা এলে ভাষায়ও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে’ বলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘কাজে, বাস্তব জীবনে তথা জীবনযাপনে পরিবর্তন না ঘটলে আসলে এ ধরনের ভাষার রাতারাতি বদল সম্ভব নয়। জীবনযাপন পরিবর্তিত হলে পরিবর্তন হবে ভাষার। তবে ভাষার মাধ্যমে জীবনযাপন পরিবর্তনের শুরুটা কিন্তু হতেই পারে। যদি শিক্ষিত মানুষরা এই প্র্যাকটিস শুরু করেন, অন্যরাও পরিবর্তন আনবেন তাদের ভাষায়। তবে এটি অনেক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আশার কথা হচ্ছে, সারা বিশ্বেই ভাষাসংক্রান্ত সচেতনতা বাড়ছে। নারী-পুরুষ বৈষম্য করে এমন অনেক ভাষা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যাচ্ছে। আমরাও শুরুটা করতে পারি একটু সচেতন হলেই।’