পাহাড়ে বৈসাবি আমেজ

নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে শুরু হচ্ছে প্রাণের উৎসব বৈসাবি। ইতোমধ্যেই উৎসবের আমেজ শুরু হয়ে গেছে। পাহাড়-হ্রদ আর অরণ্যের শহর রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ে বর্ষবিদায় এবং বর্ষবরণের উৎসব হচ্ছে বৈসাবি। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের কাছে এটি একটি সামাজিক উৎসব।

বৈসাবি উৎসব

গত বৃহস্পতিবার (৫ এপ্রিল) বিকেল থেকে শনিবার (৭ এপ্রিল) বিকেল পর্যন্ত বাংলা নববর্ষ, বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক ও বিষু উপলক্ষে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট এর যৌথ আয়োজনে বর্ণাঢ্য র‌্যালি, আলোচনা সভা, মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার (১০ এপ্রিল) সকালে পৌরসভা চত্বরে আদিবাসী ফোরামের আয়োজেন তিন দিনব্যাপী কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবার (১২ এপ্রিল) শহরের ত্রিপুরা পল্লী গর্জনতলীতে ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের উদ্যেগে পানিতে ফুল ভাসানো ও বয়স্কদের বস্ত্র দান অনুষ্ঠান হবে। অপরদিকে, আগামী ১৮ এপ্রিল (বুধবার) রাঙামাটি শহরের আসাববস্তি নারিকেল বাগান এলাকায় মারমা সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব ‘জল উৎসব’ অনুষ্ঠিত হবে।

আদিবাসি ফোরামের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা জনান, মঙ্গলবার (১০ এপ্রিল) সকালে পৌরসভা চত্বরে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে আনন্দ র‌্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিকেলে চিং হ্লা মং মারী স্টেডিয়ামে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়। পরে বুধবার (১১ এপ্রিল) বিকেলে চিং হ্লা মং মারী স্টেডিয়ামে ঐতিহ্যবাহী খেলা কাবাডি, খো খো, বলি খেলা, তুমরু খেলা খেলাধুলার আয়োজন করা হয়েছে। আার তৃতীয় দিন বৃহস্পতিবার (১২ এপ্রিল) সকাল ৬টায় রাজ বনবিহার ঘাটে ফুল ভাসানো হবে।

ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে মূলত বিজুর আনুষ্ঠিকতা শুরু হয়। তিন দিনব্যাপী এই উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমা ভাষায় ফুল বিজু, দ্বিতীয় দিনকে মূল বিজু এবং তৃতীয় দিনকে নুয়াবঝর বা গোজ্যা পোজ্যা দিন বলা হয়। এভাবেই ত্রিপুরারা প্রথম দিনকে হারিকুইসুক, দ্বিতীয় দিনকে বুইসুকমা এবং তৃতীয় দিনকে বিসিকাতাল নামে অভিহিত করে। বৈসাবি উৎসবকে ঘিরে তিনদিন পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। পাহাড়ের বাসিন্দারা মহা সমারোহে পালন করে তাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব বৈসাবি।

বৈসুক
ত্রিপুরাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবের মধ্যে সবচে আকর্ষণীয় এবং প্রধান উৎসব হলো বুইসুক বা বৈসুক। চৈত্র মাসের শেষের দুইদিন ও নববর্ষের প্রথম দিনসহ তিনদিন ধরে পালন করা হয় এই উৎসব। চৈত্রমাসের শেষ দুইদিনের প্রথমদিনটিকে ত্রিপুরারা হারি বুইসুক এবং শেষ দিনটিকে বুইসুকমা বলে। আর নববর্ষের প্রথম দিনকে তারা বলে বিসিকাতাল। উৎসবের প্রথমদিন ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা ফুল তোলে। ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। কাপড় চোপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে। ঝুঁড়িতে ধান নিয়ে তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেয়। গৃহপালিত সব প্রাণিকে খুব ভোরে ছেড়ে দেয়। পরিচ্ছন্ন কাপড় চোপড় পড়ে ছেলেমেয়েরা গ্রামের ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ায়। ছেলেমেয়েদের বিচিত্র পিঠা আর বড়দের পাহাড়ি মদ ও অন্যান্য পানীয় পান করানো হয়। বৈসুক শুরুর দিন থেকে গরয়া নৃত্য দল গ্রামের গ্রামে গিয়ে প্রত্যেক ঘরের উঠোনে নৃত্য করে। এই আনন্দদায়ক ও চিত্তাকর্ষক নৃত্যকে ত্রিপুরারা গরয়া নৃত্য বা খেরেবাই নৃত্য বলে।

বৈসাবি উৎসব

সাংগ্রাই
বৈসাবি উৎসবের সা আদ্যক্ষরটি অন্যতম পাহাড়ি জনগোষ্ঠী মারমাদের সাংগ্রাই উৎসব থেকে নেওয়া। মারমাদেরও অন্যতম সামাজিক উৎসব হলো সাংগ্রাই বা জল উৎসব। মারমারা সাধারণত মঘীসনের চান্দ্র মাস অনুসারে এই দিনটি পালন করে থাকে। বছরের শেষ দুইদিন এবং নববর্ষের প্রথমদিন এই তিনদিন পালিত হয় এই উৎসব। সাংগ্রাই উৎসব উদযাপনের সময় মারমা যুবক-যুবতীরা পিঠা তৈরি করা জন্য চালের গুঁড়া তৈরি করে। সাংগ্রাই উৎসব এবং পানি খেলার সময় এক জায়গায় পানি ভর্তি রেখে যুবক যুবতীরা একে অপরের দিকে পানি ছুঁড়ে মারে। স্নিগ্ধতায় ভিজেয়ে দেয় পরস্পরকে। এছাড়াও এই দিন মারমারা বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে ধর্মীয় বাণী শ্রবণ করে। ঘিলার বিচি দিয়ে ঘিলা খেলা এইসময় মারমাদের একটি প্রিয় খেলায় পরিণত হয়। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে সাংগ্রাই উৎসব পালন করা হয় বলে ধারণা করা হয় সংক্রান্তি শব্দ থেকেই সাংগ্রাই শব্দটি এসেছে।

বিজু
পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের প্রধান উৎসবেন নাম বিজু। উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমারা বলে ফুলবিজু। এদিন বিজুর ফুল তোলা হয় এবং ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়। পরে সে ফুল দিনান্তে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। বিজুর সময় ছোট ছেলে মেয়েরা পরিচ্ছন্ন কাপড় পড়ে দলবেধে বাড়ি বাড়ি বেড়াতে যায়। ঘরের হাঁস মুরগিকে ধান চাল ছিটিয়ে খাওয়ায়। এ সময় ঘরে ঘরে রান্না করা হয় পাঁচন নামের এক বিখ্যাত খাবার। হরেক রকম সবজি আর তরকারির সমন্বয়ে রান্না করা এই খাবারটি এই উৎসবের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার।