আড়ংয়ের কারিগরদের গল্প

পারুল বেগমবয়স প্রায় সত্তুর ছুঁই ছুঁই। যদিও এই সময়ে তার বাসায় বিশ্রাম করার কথা, পরিবার ছোট সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটানোর কথা। কিন্তু এই বয়সে এসেও ভালোবেসে আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনে ব্লক প্রিন্টের কাজ করে যাচ্ছেন দিব্যি। বলছিলাম পারুল বেগমের কথা। তিনি আজ থেকে ৪০ বছর আগে যুক্ত হয়েছিলেন এই কাজের সঙ্গে। কাজ শিখেছিলেন এই ফাউন্ডেশনে এসেই। তখন তার মুজুরি ছিলো গজে 'চার আনা'। বর্তমানে দিনে তিনি ৫০ গজ কাপড়ে ব্লক প্রিন্ট করতে পারেন। আর এখন প্রতি গজে পান পনেরো টাকা করে।

ঠিক এমনই হাজারও দুস্থ অসহায় নারীর গল্প রয়েছে আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনে। আর এই দুস্থ অসহায় নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প যিনি তৈরি করেছেন, তিনি হচ্ছেন মরহুমা আয়েশা আবেদ। যিনি ১৯৭৬ সালে ভেবেছিলেন গ্রামের অসহায় দুস্থ মহিলাদের কথা। তাদের কথা চিন্তা করেই তৈরি হওয়া আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনে এখন কাজ করছে প্রায় ৬০ হাজারেরও বেশি নারী কর্মী।

আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের প্রধান কেন্দ্র মানিকগঞ্জ ঘুরে দেখা যায়, এখানে এখনও প্রায় ৮০ উর্দ্ধ বয়সী নারীকর্মী কাজ করছে অনায়াসে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা এই বয়সেও কাজ করছেন ভালো লাগা থেকে। কাজ চালিয়ে যেতে চান মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, পুরো পরিবার এক সঙ্গে কাজ করছে এমনও আছে।

৮০ উর্দ্ধ বয়সী নারী কর্মী রত্না বিশ্বাস এখন অনেকটাই একা। পরিবার বলতে তেমন কিছুই নেই। পরিবারের সবাই মৃত। তিনি এই ফাউন্ডেশনে তাঁত সেকশনে কাজ করছেন ৩০ বছর যাবৎ। বলাই যায় এখন তার অবসরের সঙ্গী এই ফাউন্ডেশনের তাঁত সেকশনের কর্মীরা। ভাঙা কন্ঠে তিনি জানালেন এই ব্রাকই তার ঘর-বাড়ি।

রত্না বিশ্বাসতাঁত সেকশনে কাপড় বুননের কাজ করেন আনোয়ারা। তিনি এখানে কাজ করছেন ২৫ বছর যাবৎ। এই সময়ের মধ্যে তিনি জায়গা কিনে বাড়ি করেছে। বিয়ে দিয়েছেন মেয়েকে। এখন তার বেতন ৬ হাজার টাকা।

জিন্নাত আলী জানান, ১৯৮৮ সালে এই ফাউন্ডেশনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। বর্তমানে অনেকটাই স্বচ্ছন্দে দিন পার করছেন তিনি। এখানে কাজ করেই বিয়ে দিয়েছেন দুই মেয়েকে। কিনেছেন ১০ শতাংশ জমিও।

 মা রেনু বেগম ও মেয়ে মালা বেগম এক সঙ্গে কাজ করেন এই ফাউন্ডেশনের কারচূপি সেকশনে। পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে রেনু বেগম এখানে কাজ শুরু করেছিলেন ১৯৮৬ সালে। আর মেয়ে কাজ শুরু করেছেন বছর পাঁচেক হলো। সব মিলিয়ে এখন তাদের মাসিক আয় ১৭ হাজার টাকার মত।

IMG_20181021_124112২০০২ সালে এই ফাউন্ডেশনের ফার্নিচার সেকশনে কাজ শুরু করেন জালাল উদ্দিন। তিনি জানান, এখানে কাজ করে তিনি বেশ প্রশান্তি পান। কাজের কোন চাপ নেই। যতবেশি কাজ করি, ততবেশি মুজুরি পাই। ব্রাক থেকে আমি সব সুবিধাই পেয়ে থাকি।

বর্তমানে গ্রামের গরীব অসহায় মানুষ প্রায় অনেকটাই স্বাবলম্বী। যার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এনজিও ব্র্যাকের। কারণ, স্বাধীনতার পর থেকেই এদেশের অসহায় মানুষদের কর্মঠ ও স্বাবলম্বী করার প্রয়াস ব্র্যাকই প্রথম হাতে নিয়েছিলো। আর আড়ং হচ্ছে সেই ব্র্যাকেরই একটা অংশ। মূলত যার মাধ্যমেই বর্তমানে গ্রামের অসহায় মহিলাদের হয়েছে কর্মসংস্থান, পেয়েছে সমাজে কথা বলার সুযোগ। পূরণ হয়েছে মরহুমা আয়েশা আবেদের স্বপ্ন।