ঐতিহ্যবাহী ইফতার কতটা স্বাস্থ্যকর?

ঢাকার ইফতার মানেই চকবাজারের জমজমাট ইফতার বাজার। চকবাজারের শাহী মসজিদকে কেন্দ্র করে এর আশপাশেই বসা ইফতারির দোকানগুলো থেকে খাবারের মনকাড়া সুবাস আর বিক্রেতার চিরচেনা হাঁক, ‘বড় বাপের পোলায় খায় ঠোঙায় ভইরা লইয়া যায়’। ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ চকবাজারের ইফতারের খুবই জনপ্রিয় একটি আইটেম।

রঙ মিশ্রিত মসলা ব্যবহার করা হচ্ছে খাবারকে আকর্ষণীয় করতে
প্রায় ৭৫ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এই খাবারটি তৈরিতে  ডিম, গরু, মুরগী, ছোলাসহ ১৫ পদের খাবার ও ১৬ ধরনের মসলা প্রয়োজন। আর মোট ৩১টি পদের যে মিশ্রণ তৈরি হয় এই খাবার। এমন ঐতিহ্যবাহী খাবারের কী মেশানো হচ্ছে সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।  সরজমিনে জানা যায়; বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পোড়া তেল, অস্বাস্থ্যকর আর মেয়াদর্ত্তীর্ণ ঘি দিয়ে বানানো এই খাবার। এর সঙ্গে তীব্র দাবদাহের মধ্যে কারিগরেরা খালি গায়ে আর খালি হাতেই তৈরি করছেন খাবারগুলো। গরমে দরদর করে ঘামছেন আর তার মধ্যেই দুই হাত দিয়ে আনায়াসে তৈরি করা হচ্ছে এই খাবার।

ডালডা গলিয়ে ভাজা হয় জিলাপি
এত গেল এক ঐতিহ্যবাহী খাবারের কথা। শাহী মসজিদের আশেপাশে বেশ কয়েকটি হোটেলে বানানো হয় শাহী জিলাপি। যার একেকটির ওজন এক থেকে দেড় কেজি। অস্বাস্থ্যকর ডালডা গলিয়ে ভাজা হয় জিলাপি। এই জিলাপি মুচমুচে রাখতে ব্যবহার করা হয় সোডিয়াম হাইড্রোজেন সালফাইট বা ইউরিয়া।  ক্রেতাদের অভিযোগের ভিত্তিতে একাধিক তদন্তে খাবারে হাইড্রোজ ব্যবহারের প্রমাণও পাওয়া গেছে।


এছাড়া সুতি কাবাবের মতো খাবারে পোড়া তেল বা মোবিল ব্যবহার করা হয় চকচকে রাখার জন্য। খাবারের রঙ দিয়ে জিলাপি, রোস্ট, কাবাব, জর্দা ও দইবড়া ও শরবতের মতো খাবার রঙিন করার অভিযোগও ক্রেতারা করে আসছেন। অধিকাংশ ক্রেতাই  হতাশ হচ্ছেন ঐতিহ্যবাহী এসব ইফতার কিনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  শিক্ষার্থী মাহবুব জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই পুরান ঢাকার ইফতার নিয়ে আগ্রহ ছিল। বড় বাপের পোলায় খায়, জালি কাবাব, সুতি কাবাব, শাহী চপ সহ ইত্যাদি আইটেমের বেশ হাঁকডাক শুনে এসেছি। যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে পরিকল্পনা করে এখানে এসে ইফতার করে চরম হতাশ তিনি। তিনি বলেন, শুনতে আর দেখতে প্রচণ্ড লোভনীয় হলেও বাস্তবে রয়েছে বিস্তর ফারাক। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরির পাশাপাশি এতো এতো আইটেম আর মসলার মিশ্রণ খাবারগুলোর স্বাদ করে তুলেছে যা তা রকমের। সাইফুল নামে আরেক ক্রেতা জানান, স্বাদ যেমন তেমন হলেও নাম আর হাঁক ডাক শুনে অনেকেই এই খাবার কিনে বোকা বনে যাচ্ছেন।

অস্বাস্থ্যকর রঙ ও মসলামিশ্রিত খাবার
এখানে অধিকাংশ খাবারেই ব্যবহার করা হচ্ছে সস্তা আর পোড়া তেল, হাইড্রোজ আর ডালডা। বিভিন্ন রকম রোস্ট যেমন মুরগির রোস্ট, খাসির লেগ রোস্ট, কোয়েল পাখির রোস্টকে আকর্ষণীয় করার জন্য ব্যবহার করা হয় রঙ মিশ্রিত মসলা।

3
চকবাজারের ইফতার বাজার দুপুর থেকেই চালু হয়ে যায়। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসে দুপুরের মধ্যেই ইফতার কিনে নিয়ে যায়। তবে দুপুরের সময়ে বেশিরভাগ বিক্রি হয় আগের দিনের বেঁচে যাওয়া সব বাসি খাবার। বিকাল সাড়ে ৪ টা-৫ টা নাগাদ তৈরি হয় নতুন খাবার। দুপুরের তপ্ত রোদে খোলা আকাশের নিচে দীর্ঘ সময় মেলে রেখে ধুলাবালি আচ্ছন্ন হয়ে খাবারের স্বাদ আর মান অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। তবুও তেল আর রঙ মাখিয়ে অনায়াসে বিক্রি হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর এই ইফতার আইটেমগুলো।

7
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটি’র সদস্য জনাব মাহবুব কবির মিলন বলেন, ‘ভেজালবিরোধী খাবারের বিরুদ্ধে অভিযান আমাদের নিয়মিতই চলছে। রমজান ঘিরে আমরা আরো বাড়তি প্রস্তুতি নিয়েছি। তবে বড় বড় ইফতার বাজারে ভেজালবিরোধী অভিযান চললেও ছোট ছোট বাজার বা রাস্তায় বিক্ষিপ্তভাবে বসা ইফতারের দোকানগুলোয় সুষ্ঠুভাবে অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। নির্দিষ্ট কোনও বাজারে ইফতারে ভেজাল মেশানো হচ্ছে এরকম সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

4
এদিকে এসব খাবার কী ধরনের ক্ষতি করছে এ প্রসঙ্গে পুষ্টিবিদ সুস্মিতা হোসাইন খান বলেন, ‘খাবার তৈরি বা সজ্জায় ব্যবহৃত হাইড্রোজ বা কৃত্রিম রঙ হজম করতে পারার মতো কোনো এনজাইম মানবদেহের পাকস্থলিতে নেই।  যার ফলে হজমপ্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে অবশিষ্টাংশ হিসেবে এগুলো পাকস্থলিতেই থেকেই যায়। আবার আমাদের শরীরের ছাঁকনি হিসেবে কাজ করা কিডনিও এধরনের কেমিক্যাল ছাঁকতে পারে না। ইদানীং মানুষের শরীরে বেড়ে যাওয়া পাকস্থলি বা মলদ্বারের ক্যান্সারের সাথেও খাবারে এই ভেজাল অনেকটা সম্পৃক্ত। আবার দেশে হঠাৎ গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট বিক্রি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণও এই ভেজাল মিশ্রিত খাবার যা শরীরের স্বাভাবিক হজম প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাই রঙ বেরঙের সজ্জা আর ঐতিহ্যের স্রোতে ভেসে না গিয়ে আমাদের সবার উচিৎ অবিলম্বে এইসব অস্বাস্থ্যকর খাবারের ব্যপারে সচেতন হওয়া।’
উল্লেখ্য, বিগত মঙ্গলবার (৭ মে) বিকেলে পুরান ঢাকার চকবাজারের ইফতার বাজার পরিদর্শনে এসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, রমজান মাসে কোনও ব্যবসায়ী যদি ইফতার সামগ্রীসহ খাদ্যে ভেজাল দেন কিংবা পচা-বাসি খাবার বিক্রি করেন তাহলে তাকে কারাগারে ঈদ কাটাতে হতে পারে। অসাধু ব্যবসায়ীদের শুধু জরিমানা নয়, নিয়মিত আইনে কারাদণ্ডও দেওয়া হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। 

ছবি: নাসিরুল ইসলাম