বইপ্রেমীদের ফেসবুক জগৎ

সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে, আমাদের বইবিমুখ করে তুলছে। এ ধরনের কথা প্রায়ই শোনা যায়। তবে উল্টোটাও কিন্তু ঘটছে। বইয়ের প্রতি ভালোবাসার টানে অনেকেই জড়ো হচ্ছেন ফেসবুকে। বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে তারা এই ভালোবাসা ভাগ করে নিচ্ছেন, তৈরি হচ্ছে বইপ্রেমীদের কমিউনিটি।  

 

ফেসবুকে বাংলাদেশের বইপ্রেমীদের এমন অনেক গ্রুপ আছে, যেখানে তারা বইয়ের প্রতি নিজেদের ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেন, ভাগ করে নেন নিজেদের অভিজ্ঞতা। তেমনই একটি গ্রুপের নাম ‘বইলাভারজ পোলাপান।’ ২০১২ সালে যাত্রা শুরু করা এই গ্রুপের সদস্যসংখ্যা বর্তমানে প্রায় দেড় লক্ষ। দেশ ও দেশের বাইরে অবস্থানরত বইপড়ুয়ারা এই গ্রুপের মাধ্যমে একত্রিত হচ্ছেন।  

কেউ কোনও বই নিয়ে পাঠ-প্রতিক্রিয়া গ্রুপে পোস্ট করছেন, অন্য সদস্যরাও সেখানে নিজেদের মন্তব্য জানাচ্ছেন। আবার কেউ হয়তো জানতে চাইছেন কোনো পছন্দের বই কোথায় পাওয়া যেতে পারে, অন্য সদস্যরা তাদের প্রশ্নের উত্তর বা পরামর্শ দিয়ে সাধ্যমতো সাহায্য করছেন। অনেকে শেয়ার করেন নতুন কোনো বইয়ের খবর, মাস শেষে ঐ মাসে পড়া বইয়ের তালিকা, অথবা বছর শেষে পুরো বছরে পড়া বইয়ের তালিকা। নতুন কেনা বইয়ের ছবি বা বর্ণনা অথবা নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহের ছবিও পোস্ট করেন কেউ কেউ। আরও আছে প্রিয় বই, লেখক, বইয়ের প্রিয় লাইন, বই সংক্রান্ত নানা ট্রেন্ড ইত্যাদি নিয়ে আড্ডাপোস্ট। বইয়ের বাইরে রক্তদান, শীতার্তদের বস্ত্রদান, প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানবিক সাহায্য—এ ধরনের জরুরি বিষয়ে অফটপিক পোস্টও করা যায়।  

তবে শুরু থেকেই যে গ্রুপটি এত জনপ্রিয় ছিল, এমনটা নয়। গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নজরুল ইসলাম জানান, ২০১২ সালে ফেসবুক গ্রুপ ব্যাপারটি অতটা জনপ্রিয় ছিল না। সেই সময় বই নিয়ে বাংলাদেশি গ্রুপের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা, আবার সেসব গ্রুপের বেশিরভাগই ছিল একটু গভীর বিশ্লেষণধর্মী বইয়ের পাঠকদের জন্য। সব ধরনের বই নিয়ে আলোচনার সুযোগ সেখানে ছিল না। বইপড়ুয়া নজরুলের আশেপাশে বই নিয়ে আলোচনা করা যায় এমন বন্ধুর সংখ্যাও ছিল কম। তাই সমমনা পাঠকদের একটি কমিউনিটি তৈরির জন্য তিনি ফেসবুক গ্রুপের সুবিধাটা বেছে নিলেন। ধীরে ধীরে গ্রুপের সদস্য সংখ্যা বাড়তে লাগলো।  

 

পাঠকদের একটি আশ্রয়স্থলে পরিণত হলো এই কমিউনিটি, যেখানে একজন ইন্ট্রোভার্টও চাইলে মন খুলে আড্ডা দিতে পারছেন। এই গ্রুপের মাধ্যমে পছন্দের লেখকের সাথে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ পাওয়াটা অনেক পাঠকের জন্যই যেন স্বর্গ হাতে পাওয়া। পরবর্তীতে এই গ্রুপের আড্ডা অনলাইন থেকে অফলাইনেও স্থানান্তরিত হলো। নজরুলের মতে একজন পাঠকের জন্য এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে!  

পাঠকদের এই কমিউনিটির মধ্যে সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখার জন্য গ্রুপের অ্যাডমিন ও মডারেটররা সবসময় সচেষ্ট। এখানে অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিভিন্ন মানুষের পছন্দ বিভিন্ন রকম হবে, এটাই স্বাভাবিক। একই বই বা একই লেখকের লেখা সবার পছন্দ নাও হতে পারে, তাই নিজের মতের সাথে অন্য কারো মত না মিললেই তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। কোনো বই বা লেখকের সমালোচনা করার ক্ষেত্রেও শালীন ভাষায়, যৌক্তিক সমালোচনা করার কথা বলা হয়।   

বইলাভারজ পোলাপান ছাড়াও ফেসবুকে বই অনুরাগীদের আরো অনেক গ্রুপ আছে, যেসব গ্রুপের সদস্য সংখ্যা কয়েক হাজার থেকে শুরু করে কয়েক লক্ষ পর্যন্ত। এরকম কয়েকটি গ্রুপ হলো বইপোকা, বইয়ের পোকা, লিটমোস্ফিয়ার। গ্রুপগুলোর সদস্যরা নিয়মিত নিজেদের পছন্দের বই, কোনো বই বা লেখক নিয়ে ভালো লাগা, মন্দ লাগা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে থাকেন। কোনও সদস্য নিজের সংগ্রহের কোনো বই বিক্রি করতে চাইলে কিছু কিছু গ্রুপে সে সুযোগও আছে। 

এসব গ্রুপের সদস্যরা মানুষের মনে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে দিচ্ছেন, তাদের উৎসাহিত করছেন বই পড়ায়। আর বইপড়ুয়াদের মধ্যে সংযোগ ঘটানোর জন্য তারা মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন ফেসবুককে। উৎসাহী পাঠকদের কমিউনিটি গড়ে তোলার মাধ্যমে তারা বইয়ের প্রতি প্রেম জিইয়ে রাখছেন। তাদের অনুপ্রেরণায় বইয়ের প্রতি ভালোবাসা টিকে থাকুক সবার মাঝে, এবারের বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে এটাই কাম্য।