কানের কাছে ডানা মেলা ছোট্ট একটি পাখি। অথবা কবজির অংশে ফুটে ওঠা পাপড়ি মেলা একটি লাল ফুল। কখনও প্রিয় গায়কের গানের দুই লাইন। শরীরের ক্যানভাসে খোদাই করা পছন্দের পঙতি, ছবি কিংবা উদ্ধৃতি কেবল ফ্যাশন স্টেটমেন্টই নয়, এটি প্রকাশ করে একজনের ব্যক্তিত্বকেও। শরীরে ট্যাটু বা উল্কি আঁকার ইতিহাস বেশ পুরনো। হাজার হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রীক এবং রোমানরা ক্রীতদাস, অপরাধী এবং যুদ্ধবন্দীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ট্যাটু ব্যবহার করতো। ধর্মীয় উল্কি আঁকার প্রচলন ছিল মূলত মিশর এবং সিরিয়ায়। এক সময় পদমর্যাদার প্রতীক হিসেবে কিংবা অত্যাচারী রাজার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতেও উল্কি আঁকার প্রচলন ছিল। এরপর যুগে যুগে নানা কারণে শরীরকে ক্যানভাস বানিয়েছে মানুষ। কেউ প্রিয়জনের নাম লিখে ভালোবাসা প্রকাশ করতে শরীরে একে নেন উল্কি। কেউবা পছন্দের গায়কের গানের কথায় সাজান হাত কিংবা ঘাড়।
মিরপুর ডিওএইচএসে রয়েছে ইঙ্কপার্ক ট্যাটু স্টুডিও। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার অভিজিৎ সাহা জানালেন, সাধারণত ট্যাটুর ব্যাপারে তরুণ প্রজন্ম বেশি উৎসাহী হলেও ব্যতিক্রমও দেখা যায় বেশ। ৬৫ বছর বয়সী নারীর শরীরেও ট্যাটু আঁকার অভিজ্ঞতা রয়েছে এই শিল্পীর। তবে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীরাই মূলত ট্যাটু করেন বেশি।
কীভাবে ট্যাটু করা হয়?
অভিজিত জানালেন, আগে ট্যাটুর মেশিন ছিল না। গাছের কাঁটা বা বাঁশের আগা সূক্ষ্ম ও ধারালো করে কেটে সেটা দিয়ে চামড়ার ভেতর কালি প্রবেশ করানো হতো। তবে এখন ট্যাটু করার জন্য বেশ আধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে। ট্যাটু গান বা মেশিনে বিভিন্ন সাইজের সুঁই সেট করে সেটা দিয়ে ট্যাটু করা হয়। ট্যাটু করার ক্ষেত্রে কালি প্রবেশ করানো হয় চামড়ার দ্বিতীয় স্তরে। এই স্তরে পৌঁছে যাওয়া কালি বাকি জীবন একই রকম থেকে যায়।
ট্যাটু করার প্রস্তুতি কেমন হবে?
স্থায়ী ট্যাটু করার ক্ষেত্রে মনস্থির করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ঠিকঠাক। কারণ এই উল্কি বা ট্যাটু বাকি জীবন শরীরে থাকবে ঠিক এভাবেই। পরে পস্তানোর চাইতে তাই সিদ্ধান্ত বারবার ঝালিয়ে নেওয়াটাই শ্রেয়। অ্যালার্জি অথবা ডায়াবেটিস এগুলো আছে কিনা- সেটাও বিবেচ্য বিষয়। এগুলো থাকলে আগে থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। হতে হবে প্রাপ্তবয়স্ক।
ট্যাটু করার পর কী করণীয়?
অভিজিত জানালেন, ট্যাটু করার পরের যত্ন ভীষণ রকম জরুরি। একজন শিল্পী যত ভালো করেই ট্যাটু করে দিক না কেন, যার শরীরে ট্যাটু করা হয়েছে তার যত্নের উপরই নির্ভর করছে শেষ পর্যন্ত তা শরীরে কতো সুন্দরভাবে ফুটে উঠছে। ট্যাটু করার পর পাতলা প্লাস্টিকের সাহায্যে ঢেকে দেওয়া হয় অংশটি। বাড়ি ফিরে সেটা খুলে পরিষ্কার করতে হয়। তবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পানি লাগানো যাবে না। এরপর সামান্য পানি লাগানো যাবে। তবে ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত যত কম পানি লাগানো যায় ততই ভালো। ট্যাটু করার পর অয়েন্টমেন্ট দেওয়া হয় ১০ থেকে ১৫ দিন ব্যবহারের জন্য। এছাড়াও আরেকটি ব্যবস্থা রয়েছে। সেটাতে প্রোটেক্টিভ লেয়ার স্টিকারের মতো লাগিয়ে দেওয়া হয় ট্যাটুর উপরে। পানিরোধী এই স্টিকার ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত রাখা যায়। তবে এটার জন্য গুণতে হয় বাড়তি টাকা।
ট্যাটু করার পর পরই সরাসরি সূর্যের আলো, সুইমিং পুল, সমুদ্রের পানি, অ্যালার্জি হয় এমন খাবার, অ্যালকোহল এড়িয়ে চলতে হবে।
ট্যাটু করার সময় ব্যথা লাগে?
অনেকের মনেই এই প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। ব্যথার ভয়ে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেকে করেন না ট্যাটু। অভিজিৎ জানালেন, ট্যাটু করার ক্ষেত্রে কাজ করা হয় ডার্মেস এরিয়াতে। এটি ত্বকের দ্বিতীয় স্তর। এখানে খুব বেশি ব্যথা লাগে না কিংবা রক্তপাত হয় না। তবে ট্যাটু শরীরের কোন অংশে করাচ্ছেন সেটার উপরেও নির্ভর করে ব্যথা কতটুকু লাগছে। শরীরের কিছু অংশের ত্বক সংবেদনশীল বেশি। সেখানে উল্কি আঁকতে কিছুটা ব্যথা লাগতে পারে। আবার সহ্যক্ষমতার উপরেও এটি অনেকাংশেই নির্ভরশীল। তবে সূক্ষ্ম ব্যথাবোধ কিছুক্ষণের মধ্যেই সয়ে যায় সাধারণত।
খরচ কেমন?
রঙ ও নকশার উপরে নির্ভর করে খরচ। ইনকপার্ট ট্যাটু স্টুডিওতে ট্যাটু করাতে চাইলে সর্বনিম্ন ৩ হাজার থেকে লাখের উপরে পড়বে খরচ। পুরো হাত করার ক্ষেত্রে সেশনের উপরেও খরচ নির্ভর করে। ৯ ঘণ্টার প্রতি সেশনের জন্য গুণতে হতে পারে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। বেশ কয়েকটি সেশন লাগে বড় নকশা করতে চাইলে।
ঝুঁকি কতটুকু?
ট্যাটুর কালি থেকে ক্যানসার হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে অভিজিৎ বলেন, ‘ক্যানসার অনেক কিছু থেকেই হতে পারে। বাজারের নকল ও নিম্নমানের প্রসাধনী ব্যবহারেও হতে পারে। ট্যাটু করার ক্ষেত্রে মানসম্মত কালি ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটা যাচাই করে নিলে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।’ আমেরিকা ও লন্ডন থেকেই ট্যাটু করার বেশিরভাগ সামগ্রী তার স্টুডিওতে আসে বলে জানালেন এই শিল্পী।
ছবি: ইঙ্কপার্ক ট্যাটু স্টুডিও