বাবা মায়ের ঝগড়ায় কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু?

 

শিশুর জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে তার বাবা ও মা। তাই ভালো বাবা-মা হওয়ার পাশাপাশি ভালো স্বামী-স্ত্রী হওয়াও জরুরি। দেখা যায় সন্তান জন্মের পর দাম্পত্য বোঝাপড়া নিয়ে খুব একটা সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না নিজেদের মধ্যে। সন্তানের জন্য জীবন উৎসর্গ করে ফেলার চেষ্টাতেই যেন কেটে যায় দিন। কিন্তু শিশু আসলে বাবা-মাকে সুখী দেখতেই ভালোবাসে।

মা-বাবার সব কাজের প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। তাই ভালো-মন্দ যেকোনো কাজের আগে মা-বাবাকে ভাবতে হবে। শিশু বাবা মায়ের মধ্যে কোনও ধরনের সহিংস সম্পর্ক দেখলে মানসিক চাপের কারণে হরমোনজনিত সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এতে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ঘুমের সমস্যায়, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা ও বিষণ্ণতার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে শিশুর মধ্যে।

বাবা-মায়ের সম্পর্ক কীভাবে এবং কতটুকু প্রভাব ফেলে শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশে? এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বেশকিছু গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের ঝগড়ার প্রভাব পড়তে পারে ছয় মাস বয়সী শিশুর ওপরেও! শিশুর ওপর এর প্রভাব থাকতে পারে তার পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। এর ফলে শিশুরা শুধু তাদের নিজেদের জীবনেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, এর প্রভাব পড়ে প্রজন্মের পর প্রজন্মের ওপরেও। গবেষকরা বলছেন, এটা একটা চক্রের মতো। কারণ আজকে যারা শিশু, আগামীতে তারাই শিশুর পিতামাতা।

শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আহমদ মরতুজা বলেন, 'একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে শত শত সিসিটিভি যেমন ছোটখাট সবকিছুই রেকর্ড করে রাখে, তেমনি শিশু মস্তিষ্কের সিসিটিভি দিয়ে সবকিছু রেকর্ড করে রাখে। এমনকি নবজাতককে মা বিরক্তি নিয়ে দুধ খাওয়ালে, কাঁথা বা ডায়াপার বদলানোর সময় রাগ করলে বা বকা দিলে, তা তার ব্রেনের নিউরোনে জমা থাকে।'

ঘরে সহিংসতা দেখে বেড়ে ওঠা শিশু যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে-  

  • অনিরাপত্তা বোধ।
  • একাডেমিক কর্মক্ষমতা হ্রাস।
  • আচরণের সমস্যা।
  • খাবারে অনীহা এবং শারীরিক সমস্যা।
  • জীবনের ওপর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।
  • হীনম্মন্যতা ও বিষণ্নতা।
  • সম্পর্কে আস্থাহীনতা
  • বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাব।
  • মাদকাসক্তি।

দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, মনোমালিন্য হতেই পারে। কিন্তু কতটুকু সন্তানের সামনে প্রকাশ করবেন এবং কতটুকু করবেন না, সেটা জানা ভীষণ জরুরি।

কী করবেন?

  • সন্তানের সামনে পারতপক্ষে ঝগড়া করবেন না।
  • সন্তানের সামনে কখনোই পরস্পরের প্রতি খারাপ মন্তব্য, অশ্রদ্ধাপূর্ণ শব্দ, ভাষা ব্যবহার করবেন না।
  • ঝগড়ার সময় আতঙ্কপূর্ণ পরিবেশ যেমনভাঙচুর করা, গায়ে হাত তোলা, হুমকি দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
  • নিজেদের সম্পর্ক যাই থাকুক, সন্তানকে কখনও বাবা বা মা সম্পর্কে খারাপ ধারণা দেবেন না।
  • রাগ হস্তান্তর বা রাগ চক্রে পড়বেন না। মানে, পরস্পরের প্রতি রাগ বা ক্ষোভ সন্তানদের মধ্য দিয়ে মেটানোর চেষ্টা করবেন না।
  • তৃতীয় কোনও ব্যক্তির কারণে দাম্পত্য কলহ হলে সেটা সন্তানের সামনে আলোচনা করবেন না।
  • একে অপরকে দোষারোপ বা অভিযোগ পূর্ণ শব্দ ব্যবহার না করার চেষ্টা করুন। যেমন তুমি কেন এটা করেছ, না বলে বলুন তোমার এ আচরণ আমাকে কষ্ট দিয়েছে।

আমাদের মানসিক গঠনের ভিত মূলত তৈরি হয় জন্ম থেকে শুরু করে কৈশোরকাল পর্যন্ত। জন্মগতভাবে পাওয়া চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছেলেবেলার নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পরবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়ে বড় হওয়ার পর এক ধরনের সম্পূর্ণ মানসিক কাঠামো তৈরি হয়। বাবা-মায়ের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা তাকে যতটুকু শেখায়, তার চেয়ে সে অনেক বেশি দেখে শেখে। তাদের আচার-আচরণ, জীবনযাপন, ভাষার ব্যবহার—অনেক কিছুই শিশুরা বড়দের অজান্তে নিজেদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্য নিয়ে নেয়।সুতরাং বাবা-মায়ের খারাপ সম্পর্কের প্রভাব শুধু সন্তানের শৈশবেই আটকে থাকে না, বরং এর জের তাকে টানতে হয় সারা জীবনের পথচলায়, তার সামগ্রিক জীবনবোধে, এমনকি সম্পর্ক তৈরিতেও।