পর্দা নেমেছে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইকের

দ্বিতীয় দিনের আয়োজনের মাধ্যমে পর্দা নেমেছে ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের (এফডিসিবি) আয়োজনে অনুষ্ঠিত এফডিসিবি বাংলাদেশ ফ্যাশন উইকের। গতকাল ১৭ মার্চ সমাপনী অনুষ্ঠানটি শুরু হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে। এরপর চোখ ধাঁধানো ফ্যাশন শো পরিবেশিত হয় আয়োজনে।

মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে এফডিসিবির সভাপতি মাহিন খান তার বক্তব্যে তুলে ধরেন সূচনালগ্ন থেকে এফডিসিবির যাত্রা। প্রদর্শনীর পাওয়ার পার্টনার এপেক্স তাদের পণ্যের কালেকশন দর্শকদের সামনে তুলে ধরে। এরপর ছিল চুলের যত্নের ব্র্যান্ড স্ট্রিক্সের পরিবেশনা।

এফডিসিবি বাংলাদেশ ফ্যাশন সপ্তাহের দ্বিতীয় ও শেষ দিনের আয়োজনের শুরুতেই মাহিন খান তার ফ্যাশন সংগ্রহ তুলে ধরেন দর্শকদের সামনে। পুরো কালেকশনের প্রাণ ছিল বাংলার ঐতিহ্যবাহী কারু এবং হস্তশিল্প। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যের ধারক কারিগরদের সাথে কাজ করা, প্রাকৃতিক উপকরণ ও কাপড়ের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নিজের সৃষ্টিশীল ভাবনা ও প্রয়োগের জগতে তিনি ফিরে ফিরে দেখেছেন।

পরের কালেকশনটি ছিল ডিজাইনার শাহরুখ আমিনের। তিনি উদযাপন করেছেন শাড়ির চিরন্তনী আবেগকে। ব্যবহার করেছেন সূক্ষ্ম মসলিন, ক্রেপ সিল্কের মতো উপকরণ। কালো এবং সাদা শাড়ির বিপরীতে রহস্যময় অথচ একইসাথে আবেগী- সরলতায় নিখাদ এক মেলোড্রামা ফুটিয়ে তুলেছেন শাহরুখ আমিন।

এরপর কলকাতার ডিজাইনার পারমিতা ব্যানার্জির সাজ ২.০ কালেকশনটি প্রদর্শিত হয়। জামদানির বুননে বিন্দি বা বিন্দুর ভ্রমণ ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। কোলকাতার দুর্গোৎসবের সাদা- লাল রঙয়ের পাড়ের বহুল ব্যবহারে যা পরিণত হয়েছে রঙিন এক গীতিকাব্যে। এ কালেকশনে ব্যবহৃত হয়েছে বিভিন্ন ভারতীয় তাঁতি সম্প্রদায়ের হাতে বোনা মটকা ও লিলেন কাপড়।

এরপর প্রদর্শন করা হয় তেনজিং চাকমার বাসন্তী রঙের কালেকশনটি। ডিজাইনার হিসেবে তেনজিং চাকমা সবসময় রঙ, সৌন্দর্য ও সুগন্ধে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের স্বরূপ অন্বেষণে উৎসাহী। তেনজিংয়ের সমগ্র সৃষ্টিই তার সেই অন্বেষণের কাব্যিক পরিস্ফুটন।

সমাপনী প্রদর্শনীর পঞ্চম ডিজাইনার ছিলেন রুখসানা এসরার রুনি। তার কালেকশনটি অনাহত প্রকৃতির বিশুদ্ধতা ও লালিত্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় উপস্থিত দর্শকদের। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের অপূর্ব সৌন্দর্যে প্রাণিত হয়ে রুনি নিজের সুতোর কাজে যুক্ত করেছেন সমুদ্রের ফেনা, হাতে আঁকা কাজে প্রতিভাত হয়েছে জ্বলন্ত সূর্য। তার রঙের প্যালেটে সেজেছে নিরপেক্ষ ও তামাটে রঙে।

ডিজাইনার মাধুরী সঞ্চিতা স্মৃতি এরপর প্রদর্শন করেন তার ‘দ্য সেন্ট অব স্প্রিং’ কালেকশনটি। বসন্তের সতেজতাকে ধারণ করেছে তার প্রতিটি কাজ। প্রতিটি নতুন ফুল যেমন তাদের সুগন্ধে আমাদের মোহিত করে ঠিক তেমনই স্মৃতির সৃষ্টি দর্শকদের মোহিত করে। বসন্তের সতেজতা তুলে ধরে।

পরবর্তী কালেকশনটি ছিল ভারতে মিজোরামের ডিজাইনার চার্লি ম্যাথলেনার। সংস্কৃতি এবং চেতনার গভীরে প্রোথিত ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষার দায় প্রকাশ পেয়েছে চার্লির কাজে। ডিজাইনের আবেদনময়তার পেছনে কাজ করেছে মিজোরামের রহস্যময় পাহাড়ের মোটিফ এবং তাঁতিদের সহজাত নিজস্ব দক্ষতা। প্রতিটি কাজেই নিহিত ছিল দায়িত্বশীল ফ্যাশনের শক্তিশালী বার্তা।

লিপি খন্দকারের কালেকশন ‘বেইজ মুড’ এর প্রেরণা বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাপড়ের রঙ এবং গড়নে। তৈরি করেছেন বস্ত্র এবং অপ্রতিসম ছায়া অবয়ব। বাংলাদেশের নিজস্ব সিল্কের উপর সুঁই সুতার কাজ ছিল। ছাপায় ব্যবহৃত হয়েছে জ্যামিতিক মোটিফ। ফুলের মতো মোটিফগুলো ফুটে উঠেছে হাতে করা অ্যাপ্লিকের ব্যবহারে।

পরবর্তী ডিজাইনার কামরুল হাসান রিয়াদ উপস্থাপন করেন ‘বিউটি অব গ্র্যাভিটি’ কালেকশন। নিজের কাজে তিনি ব্যবহার করেছেন ফুল, পাখি এবং চাঁদের প্রতীক। চোখে পড়েছে গোলাপের ব্যবহার। দেশীয় কাপড়ে হাতে করা সেলাই ছিল এই সংগ্রহের বিশেষত্ব। 

অনুষ্ঠানের পরবর্তী ডিজাইনার ছিলেন ফাইজা আহমেদ। তার ‘দেশভক্তি’ শীর্ষক কালেকশনে উঠে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ‘ও আমার দেশের
মাটি’- বাক্য। ক্যালিগ্রাফি মোটিফে গ্রামের মাটির টোনের পটভূমিতে হাতে ডাই করা দেশীয় কাপড় নিয়ে কাজ করেছেন ফাইজা।

আয়োজনের শেষ ভারতীয় ডিজাইনার ছিলেন সৌমিত্র মণ্ডল। তার কালেকশনটির নাম ‘মুসাফির।’ সমকালীন এক ভ্রমণকারী যিনি ইতিহাসকে অটুট রেখে সমসাময়িক ফ্যাশনকে ভালোবাসেন এবং জীবনকে বর্তমানেই যাপন করেন- এই মূলমন্ত্রে সৌমিত্র সোজা ও আড়াআড়ি রেখাকে নিজের ডিজাইনের প্রধান উপাদান হিসেবে বেছে নিয়েছেন। রঙগুলো বেছে নেওয়া হয়েছে চারপাশের প্রকৃতি থেকে। এসেছে নানা ধরনের সবুজ, বাদামি এবং আকাশি রঙ। তাঁতে বোনা বিশেষ সূক্ষ্ম লিনেন সুতায় তৈরি হয়েছে সৌমিত্রের শাড়ি এবং কাপড়গুলো।

রাতের শেষ আয়োজনটি ছিল বাংলাদেশের অসামান্য ডিজাইনার শৈবাল সাহা’র। ‘ব্যাক টু মাদার নেচার’ কালেকশনে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন প্রকৃতির সহজাত ধারাবাহিকতাকে। পুরুষের পোশাক তৈরিতে তিনি ব্যবহার করেছেন হাতে বোনা খাদি। রঙ লেগেছে শিবরি, খয়ের এবং হরিতকি’র মতো
প্রাকৃতিক রঙ থেকে।

সবশেষে এফডিসিবি’র সাধারণ সম্পাদক শৈবাল সাহার ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মাধ্যমে শেষ হয় দুইদিন ব্যাপী এই ফ্যাশন আয়োজন। এফডিসিবি বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক ২০২৩-এর এবারের আয়োজনে প্রদর্শিত হয়েছে কাউন্সিলের ১৮ জন সদস্যের কালেকশন। একইসাথে প্রদর্শিত হয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে আগত ছয় ডিজাইনারের রোমাঞ্চকর সৃষ্টি। গতকাল প্রথম দিনের আয়োজনে ডিজাইনার চন্দনা দেওয়ান, গুঞ্জন জৈন, আফসানা ফেরদৌসী, রিফাত রহমান, তাসফিয়া আহমেদ, সাদিয়া রূপা, ইবা মাল্লাই, নওশীন খায়ের, ইমাম হাসান, তানহা শেখ, রিমি নায়ক ও কুহু প্লামন্ডন তাদের চমৎকার সব কালেকশন তুলে ধরেন।  

এ আয়োজনের লক্ষ্য ‘টেকসই এবং দীর্ঘমেয়াদি ফ্যাশন’ এই মূলমন্ত্রে ফ্যাশন ডিজাইনার, বিক্রেতা ও ভোক্তাদের একই প্ল্যাটফর্মে একত্রিত করা। পরিবেশ সম্পর্কে সকলের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ফ্যাশন সপ্তাহ ২০২৩-এর প্রতিপাদ্য ছিল ‘পোশাক ও পরিবেশ এক সুতোয় গাঁথা।’

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল একটি অলাভজনক সংগঠন। বাংলাদেশের লোকজ ঐতিহ্যকে পুনর্জীবিত করার লক্ষে টেকসই ফ্যাশন এবং কারিগরদের শৈল্পিক চর্চার প্রসারের উদ্দেশ্য নিয়ে এই সংগঠনটি কাজ করে যাচ্ছে। মাহিন খানের নেতৃত্বে এই সংগঠনে বাংলাদেশ মেধাবী ফ্যাশন ডিজাইনাররা একত্রিত হয়েছেন। 

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন