‘নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হয়’

প্রশ্ন: আমার বয়স ৩০ বছর। আমি একটি নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষ করে সরকারি চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত পরিবার থেকেই আমার সমস্ত খরচ জোগাতো। বর্তমানে আমি ছোট একটা সরকারি চাকরি করি। স্ত্রীকে নিয়ে কর্মস্থলের কাছাকাছি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি। যা বেতন পাই তার প্রায় অর্ধেক বাড়ি ভাড়া দিতেই চলে যায়। এছাড়া খাওয়াদাওয়া তো আছেই।আমার বৃদ্ধ মা-বাবা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। বাবা কৃষি কাজ করেন। কিন্তু এই বয়সে বাবা ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না। জমিজমা লিজ রেখে আমার সাথে বাসায় থাকতে বলি। আমার স্ত্রীও এ ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। আমার স্ত্রীও চান বাবা-মা আমাদের সাথেই থাকুক। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে বাবা-মা থাকতে চান না। এমনকি আমি এবং আমার ভাই এটাও বলেছি সব জমি লিজ রেখে দিতে। আর বাজার সদায় যা লাগে আমরা দুই ভাই মিলে সেটা দেখবো। কিন্তু বাবা-মা আমাদের কথা শোনেন না। জমি আবাদ করতে গিয়ে আরও ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন। আমি এবং ভাই প্রতি মাসে যে টাকা দিই, সেটা না খেয়ে জমিতে খরচ করেন অথবা অন্য কিছু করেন। কিন্তু নিজেরা খান না। আবার টাকা দেওয়ার বদলে আমি নিজে বাজার করে দিতে চাইলে মন খারাপ করেন।আমার যা বেতন তাতে বেশি টাকা বাড়িতে দিতে পারি না। বাবা-মাও এটা বোঝেন সেজন্য কখনও চান না। কিন্তু আমার নিজের কাছে খুব খারাপ লাগে। আমার ইচ্ছে করে বাবা-মা এসে আমার সাথে থাকুক অথবা আমি তাদের প্রয়োজনীয় টাকা দেই। কিন্তু পারি না। এদিকে আমার স্ত্রী গর্ভবতী। তারও পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন কিন্তু দিতে পারছি না। আবার বাবা-মার খেদমত করতেও পারছি না। এসব কারণে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছি দিনদিন। খুব দুশ্চিন্তা হয়, খারাপ লাগে, নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হয়। সরকারি চাকরির বয়স এখনও ১০ মাস আছে। আগের অনেকগুলো সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করা আছে এবং ৪৬ তম বিসিএস আমার শেষ বিসিএস। কিন্তু আমি মোটেই পড়াশোনা করতে পারছি না। বই নিয়ে বসতেই ইচ্ছে করে না। আমি এখন কী করব?

উত্তর: আপনার বাবা-মার কাছে তাদের ভিটেমাটির টান নাড়ির টানের মতো। উনাদেরকে ওখান থেকে স্থানান্তর করা একটি বৃক্ষকে সমূলে উৎপাটন করার মতোই। এতে আপনারা কেউই স্বস্তি পাবেন না। আপনার গর্ভবতী স্ত্রীর জন্য যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিত করুন, ভিটেমাটি থেকে বাবা-মার স্থানানন্তরের চিন্তা বাদ দিয়ে। আমাদের সবাইকেই জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এরকম কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এ অবস্থায় পড়াশোনা করার উৎসাহে ঘাটতি আসাটাই স্বাভাবিক। এ রকম স্থবিরতার মধ্য দিয়ে আপনার জীবনের এ পর্যায়ে যাওয়াটা আপনার জন্য প্রাকৃতিকভাবেই নির্ধারিত ছিল। এটা আপনার জীবনপ্রবাহের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখন যে কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করে আত্মস্থ করার চেষ্টা করুন, নিজেকে সান্ত্বনা বা মিথ্যা আশ্বাস না দিয়ে কষ্টকে আপন করে নিতে পারলে সহনশীলতা বৃদ্ধি পাবে এবং একদিন আপনার এই কষ্টকর অবস্থাকে অসম সাহসিকতা এবং ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার মাধ্যমে অন্যদেরকে অনুপ্রাণিত করতে পারবেন। আজকের অবিচল আস্থার জন্য ভবিষ্যতে নিজের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি, স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন। এই ক্রান্তিকাল অতিক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক দৃঢ়তা কামনা করে আপনার প্রতি আমার আন্তরিক সহমর্মিতা জ্ঞাপন করছি।

প্রশ্ন: আমার মা মারা গেছেন কিছুদিন আগে। এরপর থেকেই আমি বিষণ্ণতায় ভুগছি। কিছুতেই এই ডিপ্রেশন কাটাতে পারছি না। কী করবো?

উত্তর: আপনজনের মৃত্যুশোক দীর্ঘমেয়াদী বিষণ্ণতায় পরিণত হতে পারে। আপনজনের উপস্থিতি আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য মনে করে। ফলে তাদের মৃত্যুতে আমাদের বাস্তবতার অনুভূতি (পারসেপশন অব রিয়ালিটি) আহত হয় এবং নিজ সত্ত্বার একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এ রকম মনে হয়। আপনার মায়ের মৃত্যু হলেও উনার ভালোবাসা সবসময় আপনাকে মায়ার বন্ধনে আগলে রাখছে এই বিশ্বাস মনের মধ্যে ধারণ করতে পারলে আপনার কষ্ট অনেকটা প্রশমিত হবে। আপনজনের মৃত্যুর জন্য অনেক সময় নিজেকে দায়ী মনে হয় যা মৃত্যুশোকের অপরিহার্য অংশ। এরকম মনে হলে সে দায়ভার এড়ানোর চেষ্টা না করে গভীরভাবে আত্মস্থ করার চেষ্টা করুন। মৃত্যুশোকের অনুভূতিকে নিজের আপন করে নিতে পারলে এর তীব্রতাও কমে যাবে। মৃত্যুর মাধ্যমে আমাদের জীবন পরিপূর্ণতা পায়। অন্ধকার ছাড়া যেমন আলোর অস্তিত্ব নেই, মৃত্যু ছাড়াও তেমনি জীবন অস্তিত্বহীন। জীবন বংশ পরম্পরায় পুনরাবৃত্ত হয়।