রাজশাহীর সাপের খামারে একদিন

সাপের খামার

 

এবারের রাজশাহী সফর হুট করেই। একেবারে কোনওরকম প্রস্তুতি ছাড়াই। সন্ধ্যায় আসাদ গেট এলাকায় হাঁটছিলাম। রাজীব ভাই ফোন করলেন ‘রাতে রাজশাহী যাব রেডি থাকবেন’। বলে কি!

কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলাম। রাজীব ভাই ফোন কেটে দিয়েছেন। উনি এরকমই। উঠ ছুরি তোর বিয়ে টাইপ আচরণ। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম,রাত বলতে রাত কয়টা  সেটাই তো বললেন না। আর রাজশাহীই বা কেন ? 

রাত এগারোটায় আমরা  কল্যাণপুর বাস স্ট্যান্ডে এসে হাজির হলাম। কোন গাড়িতেই সিট নেই। অবশেষে গতি হল। ন্যাশনাল পরিবহনের শেষের দিকে দুটো সিট পাওয়া গেল। গাড়ি ছাড়ল রাত বারোটায়।  প্রায় ৫ বছর পর রাজশাহী যাচ্ছি। রাজীব ভাই এখনও আমাকে  এই ভ্রমণের কারণ বলেননি। শুধু বললেন দুপুর পর্যন্ত কোন কাজ নেই। এই সময়টুকু আপনার জন্য। এরপরে আমার কাজ শেষ করেই রাতে ফিরব। ভাবছি দুপুর অবধি সময়টা কি কাজে ব্যয় করব। এই মুহূর্তে রাজশাহীতে পরিচিতজন কে আছে সেই তালিকা করতে গিয়ে ডাঃ জুঁই এর নাম সবার আগে চলে এল। ফোন করলাম। সেতো খুশিতে নেচে উঠল। কারণ অনেকবারই আমাকে যেতে বলেছে সে। সময়ের অভাবে যাওয়া হয়নি।

সাপের ডিম

সকাল সাতটা নাগাদ আমরা রাজশাহী পৌঁছলাম। নেমেই দেখি জুঁই  অপেক্ষা করছে। রাজীব ভাই বেশ অবাক হলেন। আমার দিকে একবার তাকালেন। শহরের গনকপাড়ায় রহমানিয়া হোটেলের খিচুড়ি বেশ নামকরা। পেটপুরে খেলাম সেই খিচুড়ি। রাজীব ভাইকে দেখে মনে হল সারাদিনের জ্বালানি একেবারেই নিয়ে নিলেন। জুঁইকে আগেই বলেছিলাম আমাদের সময় সংকটের কথা। ওকে অনুসরণ করেই আমরা পথ ধরলাম।

সাপের বাচ্চা

গন্তব্য পবা উপজেলায় সাপের খামারে। সাপের খামার কখনও দেখা হয়নি।তাই জুঁইকে আগাম ধন্যবাদ দিলাম আমরা। ব্যাটারিচালিত অটো রিকশা  নিলাম। রাজশাহী নগর থেকে নওগাঁ রোডে  আমচত্বর পার হয়ে বায়া বাজার। সেখান থেকে বামের সরু পথে প্রায় ত্রিশ মিনিট পাড়ি দিয়ে আফিনেপাল পাড়ায় এসে  ধর্মহাটা  প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখান থেকে আরও একটু বামে এগিয়ে গিয়ে ওঁরাও (সাঁওতাল)বসতি। আমরা অটোরিকশা ছেড়ে দিলাম।  সামনে মাঝ বয়সী শীর্ণকায় একজনকে সাপের খামারের কথা জিজ্ঞেস করতেই হাত উঁচিয়ে দেখিয়ে দিলেন। জানালেন খামারের  তত্বাবধায়কের নাম ফরিদ।  সাঁওতাল বসতিতে আমাদের সঙ্গী হিসেব পেলাম ধীরেন ওঁরাও আর ভারতি সাঞ্চীকে। বেশ কয়েকটি তাল গাছ ঘেরা এক চিলতে উঠোন। উঠোনের পূর্ব পাশে টিনের চালা দেয়া ছোট ইটের ঘর। দরজায় তালা। এখন তো ফরিদকে দরকার। ঢাকা থেকে এসেছি শুনে কেউ একজন ছুটে গিয়ে ফরিদকে ডাকতে।   ফরিদ এল প্রায় মিনিট দশেক পরে। ঘরের  বিভিন্ন ফাঁক ফোঁকর দিয়ে  আমরা  উঁকি ঝুকি  মেরে সাপ দেখার চেষ্টা করছিলাম। এটা বোধ হয় ঠিক কাজ ছিলনা। ফরিদের পিছু পিছু  আমরা ভেতরে ঢুকলাম। বেশ ভয় ভয় করছিল। সাপের কাছাকাছি জীবনেও যাইনি। সিমেন্টের তৈরি ছোট ছোট খোপে  একেক প্রজাতির  সাপ রাখা হয়েছে। ২০০৯ সালে এই গড়ে তুলেছেন তরুণ গবেষক বোরহান বিশ্বাস  রুম্মান। ফরিদের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে খামারের উদ্যোক্তা বোরহান বিশ্বাসের সাথে কথা বললাম। তিনি জানালেন ২০০৯ সালে মাত্র ৫ টি সাপ নিয়ে এই খামার শুরু করেছেন তিনি।  সাপ সম্পর্কে মানুষের অনেক ভ্রান্ত ধারনা রয়েছে।

সাপের বিশ্রাম

এই বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন   রকমের সাপ চোখে পরলে গ্রামের মানুষ জন আতঙ্কে সেগুলোকে নির্বিচারে মেরে ফেলত। বিষাক্ত সাপের কামড়ে অনেক মানুষ মারাও যেত। সাপ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে এবং সাপ  সংরক্ষণের উদ্দেশ্য নিয়েই  এই খামারের শুরু। এই খামারের নাম ‘স্নেক রেস্কিউ অ্যান্ড  কনজারভেশন সেন্টার’। এখন কোথাও সাপ ধরা পরলেই সেখান  থেকে সাপ  সংগ্রহ  করে এই খামারে আনা হয়।  সাপের উৎপাদনও করা হয় এখানে। ফরিদ একে একে অনেকগুলো সাপ, সাপের ডিম দেখাল। খোপগুলোর নাম্বার দেয়া আছে। কোন খোপে কয়টি সাপ রাখা আছে সেটাও স্পষ্ট করে লেখা।  কাঁচের  বোতলে সাপের ডিম সাজানো।

এখন এই খামারে রয়েছে বাসবোরা,আইল বোরা,মাইছা আলাদ,বাতাচিতা,শঙ্খিনী,রাসেল ভাইপার,গোরাস,বাসুয়া,চন্দ্রবোরা,ডারাস,ভেমটা ও ঢোড়া সহ  প্রায়  ১৫ প্রজাতির ৯০টি সাপ। বোরহান বিশ্বাস এই খামার নিয়ে অনেক পরিকল্পনার কথা শোনালেন। বাণিজ্যিক ভাবে সাপের বিষ উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি,বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির  বিভিন্ন সাপ সংরক্ষণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তিনি ভারত থেকে সাপ বিষয়ে প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। সাপের রাজ্যে প্রায় দু ঘন্টা কেটে গেছে। এক দারুণ অভিজ্ঞতা  সঙ্গে করে  ফরিদকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা নগরের পথে পা বাড়ালাম।  

 সাপের ঘরসাপ

ঢাকা থেকে যোগাযোগ-

শ্যামলী অথবা কল্যাণপুর থেকে রাজশাহীগামী বাস কিছুক্ষন পরপর ছেড়ে যায়। এছাড়া কমলাপুর স্টেশন থেকে ধুমকেতু একপ্রেস,পদ্মা  এক্সপ্রেস, সিল্কসিটি এক্সপ্রেসে রাজশাহী স্টেশনে নেমে অটোরিকশায়  ৮০ থেকে একশ টাকায় আফি নেপালপাড়া। 

/এফএএন/