পাহাড়, হ্রদ আর মেঘ-বৃষ্টির গল্প

পাহাড়, হ্রদ আর মেঘ-বৃষ্টির গল্প

রাস্তার দু’পাশে ঘন জঙ্গল। সারি সারি গাছপালা আপনার ভালো লাগাকে দিয়ে যাবে অন্য মাত্রা।  সেসব গাছপালা সরালেই দৃষ্টি ছড়িয়ে পড়বে পথের দু’পাশে কিংবা নিচের চমৎকার লেকের দিকে। পাহাড়ের ধাপে ধাপে চোখ জুড়ানো জুম। অসাধারণ পাহাড়ি সে পথ দুর্গম কিংবা বিপদসংকুল নয়। সবুজ বুক চিরে চলে যাওয়া এ পথ আপনাকে ভালো লাগার আনন্দ ভরিয়ে রাখবে সারাক্ষণ। বলছিলাম রাঙামাটির নতুন রাস্তাটির কথা। কাপ্তাই থেকে রাঙামাটি যেতে সময় বাঁচানোর জন্য আমরা এ পথটাই বেছে নিয়েছিলাম। আজকে বলবো সে পথচলার গল্পই।

পাহাড়, হ্রদ আর মেঘ-বৃষ্টির গল্পতখন আগস্ট মাস। যাত্রা শুরু হলো চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। এক সময় প্রতি সপ্তাহে যাতায়াত ছিল চট্টগ্রাম। এবার অনেকদিন পর আসা হল। সব কিছুই অচেনা লাগছিল যেন। পথেই প্রাতরাশ সেরে এবার আমরা যাত্রা করলাম কাপ্তাইয়ের উদ্দেশ্যে। একে একে চট্টগ্রামের বাজার মহল্লা পেছনে ফেলে এক সময় শেখ রাসেল সাফারি পার্কে যাত্রা বিরতি নিলাম। সাফারি পার্ক ঘোরা শেষ করে আবার কাপ্তাইমুখী হই। এক সময় পৌঁছে যাই কাপ্তাই বনবিভাগের বিশ্রামাগার বনফুলে। তারপর কাপ্তাই ফরেষ্ট। কাপ্তাই ফরেষ্টের গল্প অন্যদিন। আমরা সেদিন ফরেষ্টে থেকে ফিরে কর্ণফুলী তীরে বনবিভাগের বিশ্রামাগার বনফুলে অবস্থান নেই। একবার রাত না কাটালে বোঝানো যাবে না বনফুলের অসাধারণত্ব। আমরা মন ভালো করা একরাত সেখানে কাটিয়ে পরদিন সকালে বের হলাম রাঙামাটির উদ্দেশ্যে।

 

পাহাড়, হ্রদ আর মেঘ-বৃষ্টির গল্পসেদিন মেঘ-বৃষ্টির লুকোচুরির দিন। ভোরবেলা ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি অঝোর ধারায় বৃষ্টি। পথে নেমে অবশ্য কড়া রোদের মুখোমুখিই হতে হল। তারপর আমাদের এগিয়ে চলা। প্রথম আমাদের যাত্রা বিরতি ছিল খালেকের দোকানে। পাকা পেঁপে আর কলা দেখে সঙ্গে চায়ের পিপাসা মিলিয়ে বিরতি একটা দিতেই হল। খালেকের দোকান নামে বেশ পরিচিত হলেও যায়গার নাম আমাদের কাভারভ্যান চালক জানালেন কামাইল্লাছড়ি। আমাদের জলদি পৌঁছানোর তাগিদ মোটামুটি এখানেই অনেকটা শেষ। কলা, পেঁপে খেয়ে এখানকার প্রচলিত হুঁকো ও ডাবা হাতের কাছে পেয়ে সম্রাট ও শরীফ তাতে দু’টান লাগালো। আর কত ঢংয়ে ছবি তোলা যায় সেসব গল্প লিখে শেষ করা যাবে না। কাভার ভ্যান চালকের তাড়ায় আমরা যাত্রা শুরু করি। কিছু দূর যেতেই আবার যাত্রা বিরতি। এবার জুম চাষ দেখতে হবে। নামলাম পথে। হঠাৎ শুরু হলো বৃষ্টি। পাশেই একটা অস্থায়ী বাঁশ-বেতের ঘর পেয়ে গাড়িতে না উঠে সেই ঘরে গিয়ে বসলাম। সবুজ ভরা পুরো এলাকা দেখলাম প্রাণভরে। পাশেই কাপ্তাইলেকের জল। সব মিলিয়ে সময়টা ছিল অসাধারণ। ঝুপ করে যেভাবে বৃষ্টি নেমেছিল, টুপ করে সেভাবেই সূর্য আলো ঢেলে দিল। আবার পথ আমাদের সঙ্গী হলো। চালক জানালেন সে যায়গার নাম ভরাদোম। ২৮ কিলো দূরত্বের ৪৫ মিনিটের রাস্তায় ইতিমধ্যে আমরা এক ঘন্টা ব্যয় করেছি। তখন আমরা মানিকছড়ি চলে এসেছি। আকাশ মেঘে ঢাকা, বৃষ্টি নামবে যখন তখন। সে সম্ভাবনা দেখেই কি-না ফারাবী হাফিজ গাড়ি থামাতে বললেন। আমরা ছোট্ট একটা সেতুর ওপর গাড়ি থামালাম।

পাহাড়ি ব্যস্ততা

এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। মেঘের আড়ালে সূর্য মুখ লুকালেও অসাধারণ আলোর মায়াবী ঝলকানিতে পুরো এলাকা হয়ে উঠেছে ঘোরলাগা আলোকময়। পাহাড় পাঁচিল হয়ে আছে বিশাল জলাশয়ের কোল, প্লাবনের উচ্চারণ- ‘আহা কাপ্তাই হ্রদ।’ হঠাৎ সে আলোর ঝলকানিতে আমার ছবি তোলার আনন্দ বেড়ে গেল বহুগুণ। দুই শিশুর আনন্দ উল্লাস দেখে ছুটে যাই তাদের কাছে। এরই মধ্যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি দেখে বোরহানুল হক সম্রাট আর ফারাবী কাভার্ডভ্যানের ছাদে উঠে দাঁড়ায়। প্লাবন আর শরীফও একইভাবে দাঁড়িয়ে গেলে আমি এবার তাদের ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু তখনই প্রকৃতির রুদ্রমূর্তি ধারণ! শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। আমি চালকের সঙ্গে কাভার্ডভ্যানের সামনের সিটে গিয়ে বসি। পেছনে তাকিয়ে দেখি গাড়ির কভার খুলে ফেলেছে সম্রাট বাহিনী। ঝুম বৃষ্টিতে সবাই ভিজছে। বৃষ্টি ভেজার আনন্দে ও সবুজ সমুদ্রে হাবুডবু খেতে খেত সেই পাহাড়ি ঢালুপথ পেড়িয়ে ৪৫ মিনিটের রাঙামাটির নতুন রাস্তার ভ্রমণ শেষ করলাম দুই ঘন্টায়।

পাহাড়, হ্রদ আর মেঘ-বৃষ্টির গল্প

আমরা যখন মানিকছড়ি ছেড়ে আসি তখন দূর থেকে দেখেছি হাঁসের মত একঝাঁক পাখি কাপ্তাই লেকে বৃষ্টিতে খেলা করছে। খেলার ছলে হঠাৎ হঠাৎ ডানা মেলে আকাশে উড়ছে আবার গোত্তা মেরে পানিতে ডুবছে। সে দৃশ্যে মনে হয়েছিল- আহা! আমরাও যদি এমন উড়তে পারতাম!

ছবি: লেখক

/এনএ/