হক ভাই দরজার সামনে দাঁড়ালেন, কিন্তু কুকুর চুপ থাকতে পারলো না, সে সমান তালে ঘেউ ঘেউ করেই যাচ্ছে। শেষে একজন গৃহকর্মী এসে আমাকে সঙ্গে নিয়ে তার বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। মনে মনে বললাম, যাক বাবা বাঁচা গেলো।
এটা আমার একটা শাস্তিই বটে। কারণ আমি হক ভাইয়ের একটি সাক্ষাৎকার নেবার জন্য এসেছিলাম। মনে মনে তাকে বিব্রত করার বাসনা ছিল। একজন জ্যেষ্ঠ যেন তার কুকুর দিয়ে আমাকে শাসিয়ে দিলেন যে, তুমি এখনও কুকুর সামলাতে পারো না, আমাকে বিব্রত করবে! আমি তার সামনে আর প্রশ্নের কাগজ খুলতে পারলাম না। চা-নাস্তা এলো। ঘরে ভাজা সমুচা আর কী কী যেন। সেদিন ছিল প্রচণ্ড মশার উৎসব। তার বসার ঘরে আমরা বসতে পারছিলাম না মশার জ্বালায়। শীতের কারণে ফ্যান চালানো যাচ্ছে না। হক ভাই একটা মশা মারার ব্যাট নিয়ে মশা মারতে শুরু করলেন। তারপর কথা শুরু হলো। মনে হলো আজকে তার মুড অফ। যে প্রশ্নই করি তার সংক্ষিপ্ত উত্তর দেন। ইয়েস নট ভেরি গুড টাইপের।
এরপর আরও কয়েকবার গিয়েছি বাসায়। তখন মুড ভালো ছিল। ভেতরের ঘরে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে চা খেতে দিয়েছেন। আনোয়ারা আপা আমাকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করলেন। আমি তখন তার রোগী ছিলাম। চেম্বারে একবার এসে পরে কেনো লাপাত্তা হলাম তাও জিজ্ঞেস করলেন। সেদিন ভয়ে ভয়ে আমার কবিতার বইটি হক ভাইর হাতে দিলাম। তিনি উল্টেপাল্টে দেখে বললেন ভেতরে একটি ভিজিটিং কার্ড রেখে দাও। ভাবলাম হয়ত ফোন করবেন।
তবে একটা ঘটনা আমাকে এখন পীড়া দিচ্ছে, তার মৃত্যু সংবাদ শোনার পর মনে হচ্ছে ওইদিন আমরা ছেলেমানুষি করেছিলাম। জিগাতলায় কাগজ প্রকাশনের অফিসে একটি কবিতা পড়ার অনুষ্ঠানে হক ভাই ছিলেন প্রধান অতিথি। তখন সারাদেশে মুক্তমনা ব্লগার, লেখকদের হত্যার মৌসুম চলছে। হক ভাই এ ব্যাপারে নিশ্চুপ কেনো এটা আমাদের মনে যন্ত্রণা দিচ্ছিল। সাকিরা পারভীন হক ভাইর নাম উল্লেখ করে একটি কবিতা লিখেছেন। আমাকে দেখালে আমি তাকে ওই কবিতাটি পড়ার জন্যই বললাম। কিন্তু তিনি মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়াতেই কাঁপতে শুরু করলেন। সাকিরা আপা ভালো আবৃত্তি করতে পারলেও সেদিন তার গলা দিয়ে কথাই বের হচ্ছিল না। হক ভাই কবিতা শুনে চুপ হয়ে রইলেন। কোনো কথা বললেন না।
সৈয়দ হক আমার কাছে দু’টি কারণে বিস্ময়। একটি তার সাধনা, অন্যটি নিজেকে অতিক্রম করার আকাঙ্ক্ষা। এতে তিনি কখনোই পরাস্ত হননি। সাহিত্যকে তিনি নির্দিষ্ট ফর্মের মধ্যে বা নিজেকে একমূখী করে রাখেননি। রবীন্দ্রনাথের পর আমরা বুদ্ধদেব বসুকে দেখি নানান ক্ষেত্রে কাজ করতে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখেছি; এরপরে সম্ভবত সৈয়দ শামসুল হকই আছেন বহুমাত্রিকতা নিয়ে। তার কাজের এই পরিধি তরুণ লেখকদের সামনে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে রইলো। তার জীবন-যাপন, কথা বলার স্টাইল এমনকি তার পোশাক-সবসময় তাকে তারুণ্যের মধ্যেই বেষ্টিত রেখেছে। অনেক জ্যেষ্ঠকে দেখেছি আড্ডার কোনো এক মুহূর্তে তারা ভেতরকার আঞ্চলিকতায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন, বা নিজের ওজন রক্ষা করতে পারেন না, কিন্তু হক ভাই সব সময়ই ফিট। আমি তাকে ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’ পড়তে শুনেছি। কী তার গলা! ভাবা যায় না! তাকে, তার তারুণ্যকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো তরুণ বাংলাদেশে ছিলো না। ফলে তিনি শুধু সাহিত্যেই সব্যসাচী নন, জীবনেও সব্যসাচী। এক এবং অদ্বিতীয়।