ভূমিকা ও ভাষান্তর : বিধান রিবেরু ||
মার্কিন পত্রিকা দ্য নিউ ইয়র্কার ২০১০ সালের ২৯ জুলাই ত্রুফোর সর্বশেষ সাক্ষাৎকারটি পুনঃপ্রকাশ করে। সেই সংস্করণে উল্লেখ করা হয়, সাক্ষাৎকারটি বেশ ভালোভাবেই নিয়েছিলেন বের্ট কারদুলো। এই পত্রিকার আগে সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয় গ্যারি মরিস সম্পাদিত ‘এ্যাকশন! ইন্টারভিউজ ইউদ ডিরেক্টরস ফ্রম ক্লাসিক্যাল হলিউড টু কনটেম্পরারি ইরান’ নামক বইতে। নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় বলা হয়, এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে ত্রুফোর জীবন ও কর্ম, দুটোই বেশ স্পষ্টভাবে ধরা যায়।
প্রভাবশালী চলচ্চিত্রকার ফ্রাসোয়াঁ ত্রুফো আমার ভীষণ পছন্দের একজন নির্মাতা। তাঁকে আমি বলি প্রেম ও নারীদের নির্মাতা। প্রেম ও নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রে ত্রুফো যেমন পরিপক্ক, তেমনি তিনি শিশুর মনস্তত্ব উন্মেষেও অসাধারণ। ‘জুলে এন্ড জিম’, ‘টু ইংলিশ গার্লস’, ‘দি স্টোরি অব এ্যাডেল এইচ’, ‘দি ম্যান হু লাভড ওম্যান’– এসব ছবিতে ত্রুফো আবির্ভুত হন প্রেম ও নারীভিত্তিক গল্পকার হিসেবে। আবার প্রথম ছবি ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’ কিংবা ‘দি ওয়াইল্ড চাইল্ড’ ছবিতে বালক মনের বহিঃপ্রকাশেও আমরা তাঁর দক্ষতার প্রমাণ পেয়েছি। ‘দি ওয়াইল্ড চাইল্ড’ ছবিতে অভিনয়েও তিনি ছিলেন অনবদ্য।
যাহোক, বের্ট কারদুলোর সাক্ষাৎকারটি নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় ছাপা হয় ‘অল্টার ইগো, অটোবায়োগ্রাফি, এ্যান্ড অতরিজম: ফ্রাসোয়া ত্রুফোস লাস্ট ইন্টারভিউ’। বাংলা করলে এই শিরোনাম দাঁড়ায়: ‘পরানের দোসর, আত্মজীবনী ও লেখকবাজি: ফ্রাসোয়া ত্রুফোর শেষ সাক্ষাৎকার’। ইংরেজি ও ফরাসি- দুই ভাষাতেই এই সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয় ১৯৮৪ সালের মে মাসে প্যারিসে, ত্রুফোর নিজের প্রযোজনা সংস্থা ‘লে ফিল্ম দ্যু ক্যারোস’-এর কার্যালয়ে। এর আগে একই বছরের ১৩ এপ্রিল ত্রুফো শেষবারের মত টেলিভিশনে বারনার্ড পিভোটের সঞ্চালনায় ‘এ্যাপোস্ত্রোফ’ অনুষ্ঠানে একটি সাক্ষাৎকার দেন। এরপর ২১ অক্টোবর মস্তিষ্কে কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।]
প্রশ্ন: ছেলেবেলায় কোন ছবিটি আপনার নজর কেড়েছিল? যে ছবির কারণে আপনি সিনেমার নিয়মিত দর্শক হয়ে গেলেন?
ত্রুফো: ফরাসি ছবিগুলোই প্রথমে ভালো লাগত, যেমন অঁরি-জোর্জ ক্লুজোর ‘দি র্যাভেন’ (১৯৪৩), মারসেল কারনের ‘দি ডেভিলস এনভয়জ’ (১৯৪২)- এই ধরনের ছবিগুলো তখন বেশি দেখতে চাইতাম। একই ছবি বারবার দেখার এই অভ্যাস আমার দুর্ঘটনাবশত হয়েছে, প্রথমে আমি চুপিচুপি ছবিগুলো দেখতাম। এরপর বাবা মা বলতেন, ‘চল আজ রাতে সিনেমা দেখতে যাই’, কাজেই একই ছবি এভাবে আবার দেখা হয়ে যেত, আর আমি তো বলতে পারতাম না যে এই ছবি আগে একবার দেখেছি। যাক, এই কারণে একটি চলচ্চিত্র বারবার দেখার অভ্যাস হয়ে গেল- যুদ্ধ শেষের তিন বছরের মাথায় ‘দি র্যাভেন’ ছবিটি আমার দেখা হয়ে যায় নয় বা দশবার। কিন্তু ‘কাইয়ে দ্যু সিনেমা’র সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার পর ফরাসি চলচ্চিত্র দেখা বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকার বন্ধুরা, যেমন জাক রিভেত তো ব্যাপারটা অসম্ভব ভাবতো যে আমি ‘দি র্যাভেন’ ছবির সব সংলাপ গড়গড় করে বলে দিতে পারতাম, মার্সেল কার্নের ‘দি চিলড্রেন অব প্যারাডাইস’ দেখেছি চৌদ্দবার।
প্রশ্ন: কিছুক্ষণ আগে আপনি রেনোয়ার দুটি চলচ্চিত্রের কথা বললেন, ডজন-খানেকবার দেখেছেন সেসব ছবি। আপনার উপর রেনোয়ার প্রভাব সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
ত্রুফো: আমি মনে করি, রেনোয়াই একমাত্র পরিচালক যিনি হাতে-কলমে বেশ নির্ভুলভাবে কাজ করেন, চলচ্চিত্রে তিনি কখনো ভুল করেননি। তিনি যদি কখনো ভুল না করে থাকেন, আমার মনে হয়, সেটার কারণ তিনি সবসময় সারল্যের উপর ভর করে সমাধান খুঁজতেন- মানব সমাধান। তিনিই একমাত্র পরিচালক যিনি কখনো ভান ধরেননি। নিজের স্টাইল নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না, আর আপনি যদি তাঁর সম্পর্কে জানেন- দেখবেন সেগুলো বেশ বিস্তৃত, যেহেতু তিনি সব বিষয় নিয়েই কাজ করেছেন- যখন আপনি আটকে যাবেন, বিশেষ করে যারা তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক, তারা শিখতে পারবেন রেনোয়ার কাছ থেকে- কি করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়, রেনোয়ার কাছ থেকে সমাধান আপনি পাবেনই।
রবার্তো রসেলিনি, উদাহরণ দিচ্ছি, একেবারে অন্যরকম। চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে পুরোপুরি তিনি যান্ত্রিক ও প্রযুক্তিগত দিকগুলো এড়িয়ে যেতে পারতেন, এখানে তিনি বেশ শক্তিশালী ছিলেন। ওসব যন্ত্রপাতির কোনো অস্তিত্বই উনার কাছে ছিল না। চিত্রনাট্য নিয়ে তিনি একবার মন্তব্য করেছিলেন, সেখানে দুনিয়ার যত বাড়তি কথা, যেমন- ‘ইংলিশ আর্মি অরলেয়ান্সে ঢুকেছে’, আপনি হয় তো ভাবছেন- ‘ঠিক আছে তাঁর হয় তো অনেক বাড়তি লোক দরকার।’ আপনি এবার ‘জোয়ান অব আর্ক এ্যাট দ্য স্ট্যাক’ (১৯৫৫) দেখুন, সেখানে দেখবেন একটা ছোট্ট সেটের ভেতর গাদাগাদি করে কার্ডবোর্ড দিয়ে বানানো সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে। রসেলিনি যখন চলচ্চিত্রে প্রশান্তিভাব আনেন, এমনকি একটি উদ্দেশ্যহীনভাবও আনেন, যেমনটা তিনি করেছিলেন ভারত নিয়ে, সেটা একই সাথে বিস্ময়কর, আবার বর্ণনাতীতও বটে। এই যে চলচ্চিত্রে আড়ম্বর না করা, বিষয়ের প্রতি নম্রতা নিয়ে থাকা, এসবই শেষ পর্যন্ত কাজটাকে মহৎ করে তোলে। রসেলিনির ‘জার্মানি ইয়ার জিরো’ (১৯৪৭) চলচ্চিত্রটি আমার ভাল লাগে, এটার কারণ সম্ভবত, শৈশব বা শিশুকিশোর ভিত্তিক চলচ্চিত্রের প্রতি আমার দুর্বলতা। এটা ছাড়াও রসেলিনিই প্রথম সততার সাথে, প্রায় প্রামাণ্যচিত্রের মত করে বাচ্চাদের তুলে ধরেছেন চলচ্চিত্রে। বাচ্চাদেরকে তিনি গুরুত্ব সহকারে, চিন্তাশীল হিসেবে তুলে ধরেছেন- বাচ্চাদের আশপাশে থাকা বড়দের তুলনায়- ক্যানভাসে যেমন থাকে- ছবির ছোট উপাদান বা পশুতে পরিণত করেননি শিশুদের। ‘জার্মানি ইয়ার জিরো’ ছবিতে বাচ্চাটি নিজের সারল্য ও সংযম প্রদর্শনে ছিল অসাধারণ। এই চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়েই কোনো বাচ্চা সিনেমার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছে, আর এটা হয়েছে এমন এক সময়ে যখন তাদের চারপাশের পরিবেশ ছিল বেশ অস্থির।
রেনোয়ার ভেতর রসেলিনির একটি বৈশিষ্ট্য কিন্তু বেশ স্পষ্ট: কাহিনীচিত্রে যতটুকু পারা যায় জীবনের কাছাকাছি থাকার বাসনা। রসেলিনি তো একবার এও বলেছিলেন, আপনার চিত্রনাট্য লেখার দরকার নাই- একমাত্র শুকরেরাই চিত্রনাট্য লেখে- চলচ্চিত্রে দ্বন্দ্ব হাজির হবে স্বাভাবিক নিয়মেই। একটি নির্দিষ্ট স্থান ও কাল থেকে উঠে আসা চরিত্র মুখোমুখি হবে ভিন্ন আরেক স্থান থেকে উঠে আসা চরিত্রের: আর এখানেই তো, তাদের মধ্যকার স্বাভাবিক দ্বন্দ্ব আপনি আবিষ্কার করবেন, এখান থেকেই শুরু করুন। অন্যকিছু আবিষ্কারের কোনো দরকার নাই। আমি রসেলিনির মত মানুষের দ্বারা খুবই প্রভাবিত- এবং রেনোয়া- যাঁরা সিনেমার জটিলতা থেকে নিজেরদের মুক্ত করতে পেরেছিলেন, যাঁদের জন্য চরিত্র, গল্প কিংবা মূলভাব দুনিয়ার অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: আপনার উপর মার্কিন সিনেমার প্রভাব নিয়ে কিছু বলুন।
ত্রুফো: আপনি জানেন, আমাদের অনেক ঋণ, ফ্রান্সে, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেমার কাছে, এটা মার্কিনীরা নিজেরাই জানেন না ভালো করে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ করে শুরুর দিককার সিনেমাগুলো, এগুলোকে এখনকার মার্কিনীরা বিশেষ পাত্তাটাত্তা দেন না, এ বিষয়ে জানেনও না। অথচ ফরাসি নবতরঙ্গের সময় মার্কিন অনেক পরিচালক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, আমার মনে পড়ছে সিডনি লুমেট, রবার্ট মুলিগান, ফ্যাঙ্ক ত্যাশলিন এবং আর্থার পেনের কথা। তাঁরা আমেরিকান চলচ্চিত্রের খোলনলচে পাল্টে দিয়েছিলেন, অনেকটা ফ্রান্সের নবতরঙ্গের সময়কার পরিচালকদের মত। তাঁদের জীবন ছিল ভীষণ সতেজ, তাঁদের প্রথম চলচ্চিত্র, মানে প্রথম দিককার চলচ্চিত্র, যুক্তরাষ্ট্রের সূচনালগ্নের চলচ্চিত্র ছিল সজীব, একইসাথে এই মানুষগুলো ছিলেন দারুণ মেধাবী। তাঁদের চলচ্চিত্র দুই গুণকেই একত্র করতে পারত। একটা সময় পর মার্কিনীরা তাঁদের আর মূল্য দিত না, যেহেতু তাঁরা অতটা পরিচিতি পাননি আর বাণিজ্যিকভাবেও তেমন সফল নন। যুক্তরাষ্ট্রে সাফল্যই সবকিছু, আপনি তো আমার চাইতেও এটা ভালো জানেন।
প্রশ্ন: ফরাসি নবতরঙ্গ কেন শৈল্পিকভাবে সফল হয়েছিল?
ত্রুফো: নবতরঙ্গের সূচনালগ্নে লোকজন তরুণ নির্মাতাদের নতুন চলচ্চিত্রের সমালোচনা করত, তারা বলত, “সর্বেসর্বা হয়েছে, এ আর এমন ভিন্ন কি, আগেও তো এমন ছবি হয়েছে।” আমি জানি না নবতরঙ্গের পেছনে যদি কোনো পরিকল্পনা থাকত তাহলে কি হত, কিন্তু যতদূর বুঝি, এই নবতরঙ্গ কখনোই সিনেমার বিপ্লব ঘটাতে আসেনি, এমনকি আমার আগের পরিচালকদের থেকে আলাদা করে আমাকে প্রকাশ করার জন্যও আসেনি। আন্তরিকতার ঘাটতি না থাকলে সিনেমা সবসময় চমৎকার এক বিষয়, আমি এভাবেই চিন্তা করেছি। আমিও অন্যদের মত ছবিই বানাবো, তবে তাদের থেকে ভালো বানাবো, এটাই ছিল মনে।
আঁদ্রে মালরু (ফরাসি লেখক ও তাত্ত্বিক) সুন্দর একটা কথা বলেছেন, “সেরা শিল্পকর্ম উৎকৃষ্ট আবর্জনা নয়।” (কিন্তু আবর্জনা বা বাজে ছবি আরেকটু ভালো করে বানালেই সেটা শিল্পে উন্নীত হয় বলে মনে করতেন ত্রুফো) এখনো আমি মনে করি, ভালো চলচ্চিত্র হল খারাপ চলচ্চিত্রকেই আরেকটু ভালো করে বানানো। ঘুরিয়ে বললে, আনাতোল লিতভাকের ‘গুডবাই এ্যাগেইন’ (১৯৬১) আর আমার ‘দ্য সফট স্কিন’ (১৯৬৪) ছবির মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখি না। একই জিনিস, একই চলচ্চিত্র, শুধু ‘দ্য সফট স্কিন’ ছবিতে যারা অভিনয় করেছেন তাদেরকে চরিত্রগুলো মানিয়েছিল। আমরা সত্যি সত্যি ঘণ্টা বাজাতে পেরেছিলাম, কমপক্ষে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অন্য ছবিতে যা হয়, ঘণ্টা বাজে না ঠিকঠাক ভাবে, কারণ ওটা ইনগ্রিদ বেরিম্যান বা এ্যান্থনি পারকিন্স অথবা ইভ মঁতাঁর জন্য যুৎসই চলচ্চিত্র ছিল না। কাজেই “গুডবাই এ্যাগেইন” শুরু থেকেই এক মিথ্যার উপর ভর করে এগিয়েছে। নবতরঙ্গে নতুন ও ভিন্ন ধরনের সিনেমা বানানোর ভাবনা ছিল না, কিন্তু বাস্তবকে সত্যি সত্যি তুলে ধরার প্রয়াস ছিল। যখন চলচ্চিত্র বানানো শুরু করি তখন এটাই ছিল মাথার ভেতর। জঁ দোলানয়ের “দ্য লিটিল রেবেলস” (১৯৫৫) ছবির চেয়ে “দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ” (১৯৫৯) তেমন বিশাল ভিন্ন কিছু নয়। এ দুটো একই, যে কোনো বিচারে বেশ কাছাকাছি। আমি আমারটা বানাতে চেয়েছি কারণ আমি অন্যটার কৃত্রিমতাকে পছন্দ করিনি- এটুকুই।
প্রশ্ন: আমরা জানি, আপনি পরিচালক হওয়ার আগে চলচ্চিত্র সমালোচক ছিলেন। আপনার প্রথম প্রবন্ধ কোন চলচ্চিত্রকে নিয়ে ছিল?
ত্রুফো: চার্লি চ্যাপলিনের “মডার্ন টাইমস” (১৯৩৬), ফিল্মক্লাবে একটি পুরনো প্রিন্ট দেখেছিলাম ছবিটার। পরে পুলিশ অবশ্য ওই কপিটা নিয়ে নেয়, কারণ ওটা চুরি করা কপি ছিল! এরপরই আমি কাইয়ে দ্যু সিনেমায় লেখা শুরু করলাম, ধন্যবাদ আঁদ্রে বাজাঁকে। জঁ অরেঁস ও পিয়ের বোসদের মত যারা চিত্রনাট্য লিখতেন, ফরাসি চলচ্চিত্রের ফসিল, তাদের একঘেয়ের কাজের উপর কাইয়ে পত্রিকায় আগুন লাগানো এক প্রবন্ধ লিখে ফেলি সেসময়। এই এক প্রবন্ধের জোরে আমি কাজ পেয়ে যাই সাপ্তাহিক শিল্প ও বিনোদন পত্রিকায়। সেখানে আমি টানা চার বছর চলচ্চিত্রের উপর কলাম লিখেছি।
আমি মনে করি চলচ্চিত্র সমালোচক হওয়ার বিষয়টি আমাকে সাহায্য করেছে, কারণ এই কারণে আমি চলচ্চিত্রকে ভালোবেসেছি, প্রচুর চলচ্চিত্র দেখাও হয়েছে এ কারণে। আপনি যদি চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখি করেন তো সেটা আপনাকে চলচ্চিত্র বোঝার ক্ষেত্রে অনেক সহায়তা করবে। এই লেখালেখিটা বুদ্ধিচর্চায় আপনাকে বাধ্য করবে। আপনি যখন একটি চিত্রনাট্যকে দশ লাইনের সারসংক্ষেপে পরিণত করেন, তখন ওই চিত্রনাট্যের সবল ও দুর্বল দুই দিকই ধরা পড়ে। সমালোচনা ভালো চর্চা, কিন্তু এই কাজ আপনার বেশিদিন করা ঠিক নয়। ফিরে দেখলে দেখি, আমার সমালোচনাগুলোর বেশিরভাগই নেতিবাচক, ওগুলোতে প্রশংসার বদলে নিন্দা করার প্রবণতাই ছিল অধিক; আমি কারও পক্ষে লেখার চাইতে আক্রমণেই ছিলাম বেশি সাবলীল। এবং এটা নিয়ে এখন আমার আক্ষেপ হয়। আমি এখন আর ওরকম উদ্ধত নই। তবে সমালোচনামূলক অভিব্যক্তি আমার ভালো লাগে।
প্রশ্ন: একজন লেখক-পরিচালকের জন্য প্রথমে সমালোচক হওয়া কি একটু বেমানান? যখন আপনি কোনো দৃশ্য শুট করতেন, তখন কি আপনার সমালোচক সত্তা আপনার ঘাড়ে চেপে বসত, বলত: ‘এটা কি ঠিক হচ্ছে?’
ত্রুফো: নিজের ভেতর একটা অস্বস্তি কাজ করে বৈকি, কারণ আমি শুধু সমালোচকই ছিলাম না, প্রায় তিন হাজারের কাছাকাছি চলচ্চিত্রও দেখেছি। কাজেই আমি সবসময়ই ভাবতাম, ‘এই কাজটা তো ওমুক-ওমুক সিনেমায় করা শেষ’, ‘পর্নো ছবির চেয়েও এটা খারাপ হয়েছে’, ইত্যাদি। তাছাড়া আদৌ এটার গুরুত্ব থাক, না থাক, কাহিনীসূত্র ঠিকঠাকভাবে এগুচ্ছে কি না, সেটা নিয়ে আমার সংশয় কাটতো না। আমি সারাক্ষণই একটা চিত্রনাট্যকে কাটাছেঁড়া করতে থাকতাম মাথার ভেতর, হয় তো একটা দাঁড় করালাম, শেষ মুহূর্তে দেখ গেল সেটা আর ক্যামেরাবন্দি করতে চাচ্ছি না।
প্রশ্ন: তাহলে কিভাবে একটি চলচ্চিত্রের কাজ শেষ করতেন?
ত্রুফো: উপন্যাসের উপর সিনেমা বানালে, উদাহরণস্বরূপ বলছি, আপনি চাইলে চলচ্চিত্র বানানো দুম করে বন্ধ করে দিতে পারবেন না। যন্ত্রপাতি যখন চালু হয়ে যায়, চুক্তি স্বাক্ষর হয়ে যায়, তখন চাইলেই কাজ বন্ধ করে দেয়া যায় না। আর আমি অভিনেতাদের খুব পছন্দ করি, অন্তত কয়েক জন আছে- যাদের আমার ভালো লাগে, তাদের সঙ্গে কথা দিলে সেটা তো রাখতে হয়, তারাই হল কথা না ভাঙার অনুপ্রেরণা। কিন্তু একবার যখন আপনি শুরু করে দিলেন, ওই ধরনের সমস্যা আসলে দূর হয়ে যায়, ওই যে কাহিনীসূত্র নিয়ে সন্দেহপ্রবণতা, এ ধরনের সন্দেহ করা কিন্তু স্বাভাবিক ব্যাপার। তখন শুধু ছবি বানানোর যে প্রতিদিনকার ঝক্কি সেটাই থাকে। সেগুলো পুরোপুরি প্রযুক্তিগত সমস্যা, আর সেসব হাসিখেলার মধ্যেই সমাধান হয়ে যায়- বিষয়টি কিন্তু বেশ আনন্দের। যখন শুটিং শেষ, তখনও কিন্তু ওসব সন্দেহ ফিরে ফিরে আসে।
প্রশ্ন: ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’ ছবির চিন্তা কখন এলো?
ত্রুফো: ‘লে মিসতোঁ’ ছবির শুটিং যখন করছি, তখন থেকেই ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’ (বাংলায় বলতে পারেন ‘চারশো আঘাত’) আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে, তখন ছবির নাম ঠিক করে রেখেছিলাম ‘আন্তোয়ান রানস আওয়ে’।
(আংশিক)
দ্রষ্টব্য : সাক্ষাৎকারে প্রথম বন্ধনীর ভেতরকার কথাগুলো অনুবাদকের।