X
মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪
৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা

গৌতম গুহ রায়
৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭:১২আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭:১২

১৩তম পর্ব

মেয়েকে বলা আগুন ও উৎসবের গল্প

উদ্বাস্তু কলোনির আস্থানা থেকে একদিন আমাদের চলে আসতে হয় শহরের অন্য প্রান্তে। সেখানে বাড়িতে বাড়িতে দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর। নতুন আস্থানার এই কংক্রিট জঙ্গলের শহরে ‘বুড়ির ঘর’ পোড়ানোর জায়গা নেই। এখানে ‘রঙ খেলা’ মানে আরও একটা পার্টি, সাদা ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবি, আভা আবির, পাঁঠার মাংস, দামি সুরা ও রবীন্দ্র গান ও সিনেমার নাচ। ‘বুড়ির ঘর’ পোড়ানো নিয়ে উৎসাহ নাই, এখানের কেউ আগ্রহীও নন। তাই মেয়ের বায়নায় তাকে নিয়ে আমাদের কলোনি ছাড়িয়ে শহর উপকণ্ঠের মণ্ডলঘাটে এক বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম সেবার। মেয়েরই উসকানিতে ‘বুড়ির ঘর’ ঘিরে থাকা ছেলেমেয়েরা বায়না ধরলো ‘গল্পশোনাও, এই হোলির গল্প’।

‘বুড়ির ঘর’ পোড়ানোর গল্প প্রসঙ্গে সেই সন্ধ্যায় এই আগুনকে ঘিরে বিশ্বের আরো কিছু উৎসবের গল্প শুনিয়েছিলাম। এমন বহ্নিউৎসব আমাদের এখানেই কেবল নয়, গোটা পৃথিবীর নানা জায়গায় যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে। এশিয়া, আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মতো ইউরোপেও অনেক পুরোনো কিছু উৎসবে এমন অগ্নিদহন ও আগুনকে ঘিরে উল্লাসের খোঁজ পাওয়া যায়। স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজার এমন বেশ কিছু উদাহরণ রেখেছেন তাঁর ‘গোল্ডেন বাউ’তে।

ইতালি সন্নিহিত ল্যাটিয়াম রাজ্যের মানুষেরা ‘রয়াদিকা’ বা গাছে মূল নিয়ে একটি উৎসব পালন করে। একটি বিরাট মাপের কুশপুতুল নিয়ে শোভাযাত্রা বের হয় সেদিন। সেই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকে হাজির হন তাদের হাতে একটি শেকড় বা ঘাসের বেণি নিয়ে। নগরের সর্বত্র সেই শোভাযাত্রা প্রদক্ষিণ করে। শোভাযাত্রা শেষ হয় নগর চত্বরে। সেখানে কুশপুতুলটিকে একটি কাঠের চিতার উপর শোয়ানো হয়। এরপর অগ্নিসংযোগ। প্রত্যেকে তাদের হাতের শেকড়টি সেই চিতায় ছুড়ে দেয় আর বাঁধান ছাড়া উল্লাসে সবাই মিলে নেঁচে ওঠে, গেয়ে ওঠে। এটি সেখানকার কৃষকদের বসন্তকালীন উৎসব।

ফ্রান্সের প্রোভেন্সেও অ্যাশওয়েনেসডের দিনে একই রকমের উৎসব পালন করা হয়। একটি কুশপুতুলকে ইচ্ছে মতো সাজিয়ে ওই দিন ঘোড়ায় টানা রথে বা পালকিতে চড়িয়ে নিয়ে শোভাযাত্রা করা হয়। শোভাযাত্রার মানুষেরা আজব সব পোশাক পরে,  কুমড়োর খোল ভর্তি মদ নিয়ে তা খেতে খেতে নাচতে নাচতে যায় তারা। শহরের প্রধান চত্বরে গিয়ে শোভাযাত্রাটি থামে। সেখানে একটি নকল বিচারের আয়োজন করে ‘অপরাধী’ সেই কুশপুতুলকে সাজা দেওয়া হয়। সেই পুতুলে আগুন ধরিয়ে পোড়ানো হয়। অর্ডেন বনাঞ্চলের প্রায় সর্বত্র এই দহনের উৎসব প্রচলিত আছে। এই দাহের সময় প্রজ্বলিত আগুন ঘিরে সেই আনন্দ উল্লাসের উপযুক্ত গানও গাওয়া হয়। এই গানের কথার প্রতিধ্বনি আমাদের এখানের গানেও খুঁজে পাওয়ায় যায়। গল্প শুনতে শুনতে মগ্ন হয়ে যাওয়া মেয়েকে তাই বললাম—কৃষিকেন্দ্রীক যাবতীয় উৎসব যেমন প্রজনন জাদুকে কেন্দ্রে রাখে, তেমনি বিশ্বের যাবতীয় গান আর্তিকে কেন্দ্রে রাখে। ক্ষুধা নিবৃত্তির ফসলের জন্য আর্তি, ভালোবাসার জন্য আর্তি, বিপ্লবের জন্য আর্তি, অধিকার রক্ষার আর্তি, মৃত্যুকে জয় করার আর্তি।  

নরম্যান্ডিতে অ্যাশওয়েনেসডের সন্ধ্যায় একটা উৎসব পালন করা হয়, তার নাম স্রোভ টুইসডের দাফন। একটা কুশপুতুলকে ছেঁড়া ন্যাকড়া, খড়কুটো ভরে, মাথায় বিরাট একটা টুপি পড়িয়ে তাকে একজন দাগি লম্পটের চেহারা দেওয়া হয়। একজন সেই পুতুলটি কাঁধে নিয়ে হাঁটেন, এবং সবাই তাকে অনুসরণ করতে থাকে। রাস্তার মানুষজন সেই লোকটার সঙ্গে শোভাযাত্রায় যোগ দেয়। মূর্তিটাকে নিয়ে সবাই হাঁটতে থাকে, সঙ্গে মশাল, এবং বেলচা, হাঁড়ি-পাতিল আর ঘটি-লোটা-বদনা-কেটলি প্রভৃতি বাজানো হতে থাকে। শহরের কেন্দ্রস্থলে গিয়ে মিছিলটি থামে। সেখানে বিচারক পুতুলটিকে তার সারা জীবনের পাপের বয়ান করেন ও অভিযুক্ত করেন। শাস্তি ঘোষিত হয়, পুড়িয়ে মারার। মশালের আগুনে সেই পুতুলটিকে পুড়িয়ে উৎসব করা হয়। সবাই মিলে সেই সময় উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে, এরপর কার্নিভালের মৃত্যু বিষয়ক কোনো গান গাওয়া হয় ।   
পূর্ব-মধ্য ইউরোপের সাইলেসিয়াতে নারীরা একটি কুশপুতুল বানায়, জনপদের সীমান্তে গিয়ে সেই পুতুলের জামাকাপড় খুলে নিয়ে সেগুলো ছিঁড়ে জমিতে ফেলা হয়। একে তারা বলে ‘মৃত্যুর দাফন’। উত্তর সাইলেসিয়ায় পোলিশরা একে সাক্ষাৎ মরণদেবী মান্য করে। যে বাড়িতে মৃত্যু ঘটেছে সেই বাড়িতে পুতুলটি বানানো হয়। এরপর সেটি একটি লাঠির মাথায় বেঁধে জনপদের সীমান্তে নিয়ে গিয়ে পুকুরের জলে ডোবানো হয় অথবা পুড়িয়ে ফেলা হয়। বোহেমিয়াতে লোকে মরণের মূর্তি বানায় খড়বিচালি দিয়ে। সেটি গ্রামের বাইরে নিয়ে গিয়ে পোড়ানোর সময় তারা গান গায়—

‘গ্রাম থেকে আজ বার করি মৃত্যুকে
বসন্ত ফের পড়ুক ঢুকে গ্রামে
স্বাগতম, প্রিয় বসন্ত, স্বাগতম
স্বাগতম খুদে হরিদ্র মিঠে গম।’

এমনভাবেই মৃত্যুকে বিদায় দিয়ে বসন্তকে বরণ করে নিয়ে আসে মোরাভিয়ার জার্মানি অধ্যুষিত জাসনিৎস ও সেইটেনডর্ফের মানুষেরা। সেখানে সবাই মিলে গান গাইতে গাইতে শোভাযাত্রা করে এবং তখন শোলায় বানানো একটি পুতুলকে বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়। গানের কথায় থাকে যে তারা মৃত্যুকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে এবং প্রিয় বসন্তকে নিয়ে আসছে ঘরে এবং বসন্তের সঙ্গে আনছে ফাগুন আর ফুলের সমারোহ। নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে মূর্তিটি তারা ভেঙে ফেলে এবং সেই বাঁশের লাঠিটিও ভেঙে সেখানে ছুঁড়ে ফেলে। এরপর সেই জঞ্জালে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তাকে ঘিরে নাচ-গান করতে থাকে। এই বসন্ত আবাহনের সঙ্গে আমাদের হোলিতে ‘বুড়ির ঘর পোড়ানো’-এর মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

এবার আমাকে থামিয়ে দিয়ে মেয়ে বলে— ‘ঠাম্মা যে বললেন, বসন্ত রোগের জীবাণুকে হারানোর জন্য আবির মেখে আমাদের এই দোল খেলা।’ আমি ওকে বললাম— তবে দেখো, রোগ থেকে সুরক্ষার মূলকথা তো অসুস্থতাকে, মরণকে পরাভূত করা। সেভাবে দেখলে এই দোল তো আসলে জীবনের জন্য উৎসব। অশুভকে পরাভূত করার আনন্দের এক সমবেত উৎসব।

সেই ‘হোলি’-এর অনেক বছর পরে, ১৯৮৬ এর পঁচিশ বৈশাখ। কবিগুরুর ১২৫। সরকারি উদ্যোগে বড় করে উদ্‌যাপনের উদ্যোগের সঙ্গে নানা প্রতিষ্ঠান সেই উদ্‌যাপনের চাকচিক্যে মাতোয়ারা সেবার। আমরা, বিজয় দে, সমর রায়চৌধুরী, শ্যামল সিংহ, ‘ক্রুশেড’-এর, ‘পাগলাঘোড়া’-এর, ‘দ্যোতনা’-এর আমরা একটু অন্যভাবে ভাবছিলাম সেবার। জলপাইগুড়ি শহরের এক আধো অন্ধকারে মাটিতে চাটাই পেতে আমাদের আড্ডা ছিল। মিউনিসিপ্যালটি মার্কেটের সামনের বাঁশের চাটাই, ধামা কুলা বানাত নিশি বেলদার। সেই চাটাইয়ের আড্ডা থেকেই আমাদের সেই ‘মানুষের রবীন্দ্রনাথ’-এর পরিকল্পনা রচিত হল। প্রতিষ্ঠানের এই তীব্র কৃত্রিম আলোর বাইরের রবীন্দ্রনাথ, শ্রমিকের রবীন্দ্রনাথ, কৃষকের রবীন্দ্রনাথ, ক্ষুধা ও আগুনের রবীন্দ্রনাথ। ২৫ বৈশাখ সন্ধ্যায় হবে মশাল নিয়ে মিছিল। সারারাত বাঁশ কেটে মশাল বানানো হল। মশাল জ্বালানোর জন্য পরিচিত এক পরিবহণ শ্রমিক নেতা এনে দিলেন পোড়া মবিল। ‘মানুষের রবীন্দ্রনাথ’-কে কেন্দ্রে রেখে আলতা রঙে রবীন্দ্র কবিতা— কথাকে বেছে নিয়ে পোস্টার করা হল। মিছিলের শুরু থেকে শেষ, একটাই ছবি - রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মপ্রতিকৃতি’ রাখা হল। পোস্টারের দায়িত্বে বিজয় দে ও সুশান্ত নিয়োগী। মশালের দায়িত্বে আমি ও শ্যামল সিংহ। পঁচিশে বৈশাখ সন্ধ্যায় আমাদের জলপাইগুড়ি শহরের ও সম-মনের কবি সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পীদের এই মশাল মিছিল। গয়েরকাটার বিকাশ সরকার, শিলিগুড়ির শুভময়, কামাখ্যাগুড়ির কৃষ্ণপ্রিয়, আলিপুরদুয়ারের দিবাকর ভট্টাচার্য্য সহ আনন্দ চন্দ্র কলেজের, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শতাধিক কবি সাহিত্যিক নাট্যকর্মীর সেই মিছিল নিয়ে শহর তেঁতে উঠল। বহুব্যায় ও বাহুল্য মণ্ডিত প্রাতিষ্ঠানিক রবীন্দ্রজয়ন্তীর পালটা ‘মানুষের রবীন্দ্রনাথ, শ্রমিকের রবীন্দ্রনাথ’। সেই মিছিলে একটাই গান বেজেছিল, সুচিত্রা মিত্রের গলায়— ‘ওরে, আগুন আমার ভাই/ আমি তোমারি জয় গাই। তোমার শিকল-ভাঙা এমন রাঙা মূর্তি দেখি নাই ...’। সমরদা ‘পিয়ালী সাউন্ড সাপ্লাই’ থেকে ক্যাসেটে গানটি রেকর্ড করিয়ে এনেছিলেন।
‘শেকল ভাঙা’ বৃত্ত-ভাঙা আগুনকে ঘিরেই আমাদের বৃত্তে বৃত্তে নাচ, জীবনের জন্য। নিজেকে, সবাইকে রাঙিয়ে দিয়ে আমাদের এই বহুবর্ণের উদ্‌যাপনের আলো।

শহরের পশ্চিমপ্রান্তে প্রাচীনতম মসজিদ, দরবেশ কালু সাহেবের মাজার— এর মধ্যখানে দিঘি। মিছিল শেষ হয় শহরের পশ্চিম প্রান্তের এই মাজারের কাছে এসে। মসজিদের দিঘির জলে মিছিলের মশালের আগুন নিভিয়ে রাখি আমরা। মসজিদের দিঘির জলে দেখি ভাসছে প্রদীপ ও মনসার ভেলা, বারান্দায় নমাজ পড়ছেন লান্টু মিয়া।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
প্রথম দুই ঘণ্টায় গড়ে ভোট পড়েছে ৭ শতাংশ
প্রথম দুই ঘণ্টায় গড়ে ভোট পড়েছে ৭ শতাংশ
দুই ঘণ্টায় ৬৬ ভোট
দুই ঘণ্টায় ৬৬ ভোট
ভোটারের অপেক্ষায় কুমিল্লার একটি কেন্দ্র
ভোটারের অপেক্ষায় কুমিল্লার একটি কেন্দ্র
অবশেষে অজিদের হয়ে বিশ্বকাপে যাচ্ছেন ফ্রেজার ম্যাকগার্ক 
অবশেষে অজিদের হয়ে বিশ্বকাপে যাচ্ছেন ফ্রেজার ম্যাকগার্ক 
সর্বাধিক পঠিত
ঢাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলবে
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, জানালেন ওবায়দুল কাদেরঢাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলবে
ইরানের প্রেসিডেন্ট নিহতের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে শোকের ছায়া
ইরানের প্রেসিডেন্ট নিহতের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে শোকের ছায়া
ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নিহত হলেন যারা
ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নিহত হলেন যারা
পাউবোর দুই প্রকৌশলীসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
পাউবোর দুই প্রকৌশলীসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
‘বাংলাদেশ দলে খেলতে না পারলে আমি মরে যাবো না’
‘বাংলাদেশ দলে খেলতে না পারলে আমি মরে যাবো না’