নিভৃত যতনে..

সেরা দশ গল্প

“তর বাপে খাইছে?”

অরুণকে একটা চিঠি লিখছিলাম। মা’র গলা শুনে চিঠিটা সাঁট করে বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে ফেললাম। ব্যস্ত ভঙ্গিতে পাতা উল্টাতে উল্টাতে বিরক্ত কণ্ঠে বললাম, “আপনে গিয়া জিগাইতে পারেন না?”

মা ঘরে ঢুকে বিছানাটা গোছানো শুরু করলেন। ময়লা চাদরটা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, “বেশি প্যাঁচাবি না। যা জিগাইছি, তার উত্তর দে।”

মা অসম্ভব রাগী মানুষ। আর কিছু বললে পিঠের উপর দুমদাম দুটো পড়তে পারে। তবুও..

“ক্যান? আমি কমু ক্যান? দুইজন দুইবেলা ক্যাওয়াজ করবেন, আর আমি দুইবেলা পাড়াপ্রতিবেশী নিয়া শুনুম? বুইড়া বয়সে পাইছেন কি? এ্যা?”

মা’র চোখটা দপ করে জ্বলে উঠল। চাদরটা ফেলে প্রায় চিৎকার করে বললেন, “কি ‘অসব্য’ মাইয়ার জন্ম দিছি! একটা কথা জিগাইলে দশটা কথা শুনায়! এগুলারে বিয়া দিমু ক্যামনে? আমারে উডায় নেয় না ক্যান! ও ভগবান!”

“ধুর!”..বলে খাতাপত্র ব্যাগে ছুঁড়ে দিয়ে ব্যাগটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। প্রাইভেট পড়তে যাবো। স্যারের বাসা বড়জোর বিশ পঁচিশ মিনিটের হাঁটাপথ। দ্রুত পায়েই যাচ্ছিলাম। আগে গেলে অরুণের হাতে চিঠিটা নিজেই গুঁজে দিতে পারব। অবশ্য গাধাটা যদি আগেভাগে আসে। দুপুরে পড়ে পড়ে ঘুমোয়। প্রায়সময়েই দেরিতে ক্লাসে ঢোকে। স্যার কানে ধরিয়ে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখেন। বেচারা লজ্জায় লাল হয়ে যায় তখন। সে অবশ্য আমার সামনে অমনভাবে কান ধরে থাকার জন্যে। একবার লিখেছিল চিঠিতে, “তুমি অত ভালো ‘ছাত্রি’, তোমার ‘শামনে’ কান ধরে থাকতে ‘লজ্জ্বা’ করে”। আসলেই গাধা। একলাইনে তিনটা শব্দ ভুল।

স্যারের ক্লাসে মন বসলো না একদম। গাধাটা আসেনি আজকে।

আচ্ছা, কিছু করে ফেললো না তো? খুব অভিমানী ছেলেটা। পরশুদিন তুমুল ঝগড়া হল যে আমাদের। কাকুর টাকা চুরি করে দুটো দামি নিবের কলম কিনে এনেছিল অরুণ। বকেছিলাম খুব। বকার মাঝে ‘চোর’ বলে দু’একবার গালি দেওয়াটাও অস্বাভাবিক না। রাগলে মাথা ঠিক থাকে না আমার। মা’র মত।

অপুকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে। একই স্কুলে পড়ে ওরা। কী যে হল..

“রোল ৬ কে?”

স্যারের কণ্ঠে সচকিত হয়ে উঠলাম। উঠে দাঁড়ালাম। আমিই।

খাতাটা উলটে রেখে বললেন, “তিনটা অংকই ভুল। কান ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড়া।”

চোখে পানি চলে এলো মুহূর্তে।সব গাধাটার দোষ। আসলো না কেন আজকে? অন্যমনস্ক ছিলাম, আর সব অংক ভুল!

টানা দুটো ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। স্যার লসাগু গসাগু আর কি সব অংক করিয়ে ফেললেন। ক’বার টলটলে চোখ করে তাকিয়েও মন গলাতে পারলাম না।

ক্লাস শেষে বইপত্র গোছানোর ভান করে সবার বের হয়ে যাবার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। অপুকে অরুণের খবর জিজ্ঞেস করতে হবে। নয়তো আজ আর পড়া হবে না।

“এই দাঁড়া, অপু!”

অপু প্রায় বেরিয়েই যাচ্ছিল। কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে।নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “অরুণ আসল না যে আজকে? জানোস কিছু?” অপু ভেংচি কাটল, “মইরা গেছে। জানোস না!?” “ইয়ার্কি করিস না। সত্যি বল তো?” “আরে, জ্বর একটু। এমনেই ফাঁকিবাজ। বুঝোস না?”

মুহূর্তে মনটা কেমন মেঘে ঢেকে গেল। অরুণের মা নেই। দুপুরে কী খেয়ে থাকবে, কে জানে। ওর কাকীমাও শুনেছি বাড়ি নেই।

“তুই একটু জেনে আসতে পারবি, দুপুরে খাইছে কি না? বাড়ি তো কেউ নাই।”

“আর কেউ হইলে করতাম না। অরুণের জন্যে করতেছি। তুই এইখানেই দাঁড়া। যাইতে পনের, আসতে পনের। আধা ঘণ্টা। একছুটে যাব আর আসব।”

সিঁড়ির নিচে বসে সময় গুণতে শুরু করলাম। এক মিনিট, দুই মিনিট, তিন মিনিট..

আধ ঘণ্টা তো হয়ে গেছে মনে হয়। অপু আসছে না কেন এখনও? বুকটা ঢিপঢিপ করছে।

“নিজে আসতে পারতা না?”

চমকে উঠলাম। অরুণ!

“খাইছ দুপুরে? কাকীমা বাড়ি নাই, না? সকালে তো খাও না। দুপুরে খাইছ?”

“কমু ক্যান? আমি তো চোর। আমার কথায় বিশ্বাস কি?”

মাথায় কেমন আগুন ধরে গেল। আমি মরি এক চিন্তায়, আর সে..

“বাড়ি যাইতে হবে। সন্ধ্যা হইতেছে। খাইছ দুপুরে?”

“কমু না।”

ব্যাগটা তুলে ধরে ছুঁড়ে মারলাম অরুণের দিকে। তারপর দুমদাম করে হাঁটা শুরু করলাম উলটো পথে। কিচ্ছু বোঝে না গাধাটা। আমি দুশ্চিন্তায় অস্থির, আর ও..অপদার্থ কোথাকার..!

কিছুদূর যেতে যেতে মনে হল হঠাৎ, বাবা দুপুরে না খেলেও কি মা’র এমন দুশ্চিন্তা হয়? এমনই কি রাগ হয়েছিল মা’র?

আচ্ছা, ব্যাগটা বেচারার গায়ে লাগেনি তো? এমনিই জ্বর। ব্যাগটা ভারি ছিল খুব। মাথায় লাগলে? পেছন ফিরে তাকাবো একবার? গোপনে?

মা যেভাবে জিজ্ঞেস করে, বাবা খেয়েছে কি না...