বইগুলো সাজিয়ে রেখেছি, শুধু তিনি নেই : লতিফা কোহিনূর

লতিফা কোহিনূর প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের স্ত্রী। তিনি পেশাগত জীবনে ছিলেন BIISS-এর কর্মকর্তা।
সাক্ষাৎকার দিতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, সবসময় থাকেন আড়ালে। হুমায়ুন আজাদের জন্মদিন উপলক্ষ্যে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হন। কোভিড পরিস্থিতির কারণে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন তাঁর মেয়ে মৌলি আজাদ।


মৌলি আজাদ :
আম্মা, তোমার সঙ্গে আব্বার কবে পরিচয় হয়েছিল?
লতিফা কোহিনূর : ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে এমএ ক্লাসে পড়ার সময় পরিচয়। সেই সূত্র ধরেই আমাদের পথচলা শুরু। তখন আমরা একবার টাঙ্গাইলের এক জমিদার বাড়িতে পিকনিকে গিয়েছিলাম। পিকনিকে আমি হুমায়ুনের লেখা ‘শোক’ কবিতাটি আবৃত্তি করি। তারপর থেকে আমাদের কথা হতো। ক্লাসের ফাঁকে কথা বলার জন্য হুমায়ুন খুব উদগ্রীব হয়ে থাকত। তখন আমার ভীষণ রাগ হতো। অবশ্য কী করে যেন আস্তে আস্তে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়।

মৌলি আজাদ : কী কারণে তাঁকে তোমার পছন্দ হয়? তোমার ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্র ছিল বলে?
লতিফা কোহিনূর : সাহিত্যের নানান বিষয় নিয়ে কথা হতো। ওই সময়ে ‘সমকাল’, ‘কণ্ঠস্বর’, নারীদের ‘ললনা’ পত্রিকায় বিখ্যাত লেখকরা লিখতেন। ওইসব লেখা নিয়ে আলোচনা করতাম, দেখতাম সে খুব পছন্দ করত। এসব কারণেই।

মৌলি আজাদ : কত সালে তোমাদের বিয়ে হয়?
লতিফা কোহিনূর : ১৯৭৫ সালের ১২ অক্টোবর পারিবারিক সম্মতির মাধ্যমে আমাদের বিয়ে হয়। দীর্ঘ ৭ বছর অপেক্ষার পর আমাদের বিয়ে হয়েছে।

মৌলি আজাদ : তোমাদের বিয়ে তো অন্যরকমভাবে হয়েছে, ফোনের মাধ্যমে, তাই না? ওইসময়ে তো এধরনের বিয়ের চল ছিল না?
লতিফা কোহিনূর : হুম, সেটা ঠিক।

মৌলি আজাদ : এভাবে যখন বিয়ে হয়েছে তাতে তোমার ভয় বা দ্বিধা ছিল কী?
লতিফা কোহিনূর : না, তা নয়। বিয়ের পরপরই আমি স্কটল্যান্ডে চলে যাই হুমায়ুনের কাছে। সেখানে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে সে গিয়েছিল পিএইচডি করার জন্য। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়ালেখা করতেন, সেখানে দিনরাত পড়াশোনার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। আর আমি সুখস্বপ্ন দেখে দেখে সময় কাটাতাম। শুধু উইকেন্ডেতেই দুজনে সারা দিন ঘুরে বেড়াতাম।

মৌলি আজাদ : তাহলে তো ওই সময়ে অনেক সুখস্মৃতি তোমার? এখনো কি মনে পড়ে?
লতিফা কোহিনূর : তা তো মনে পড়েই। সুখে-দুঃখের অনেক কিছুই মনে পড়ে। এডিনবার্গ যখন ছিলাম তিন বছরের মধ্যে তার পিএইচডি শেষ হয়। ওই ডিগ্রি নেওয়ার পরের দিন হুমায়ুন আমাকে বলে আগামীকাল আমরা দেশে চলে যাব! আমি বললাম, কেন? এত তাড়াতাড়ি কেন? ডিগ্রি শেষ হলো মাত্র! তুমি এখন বিশ্রাম নেবে, ঘোরাঘুরি করবে, দেখবে, তারপর দেশে ফিরবে। তোমার সঙ্গে যারা এসেছে, তারা তো এখনো ডিগ্রি নেয়নি। আমি আপত্তি করার পর তখন হুমায়ুন আমাকে বলে, আমি তো ডিগ্রি নিতে এসেছি, থাকতে আসিনি, আমি কালই চলে যাব। এর দু-চার দিন পর আমরা দেশে চলে আসি। দেশে যখন আসি তখন তার সাথে ছিল বাক্সভর্তি বই।

মৌলি আজাদ : হুমায়ুন আজাদের তো লেখক হিসেবে অনেক সুনাম। তিনি সাহিত্যের নানান শাখায় কাজ করেছেন। সে তো তোমার কাছের মানুষ ছিল, সেই হিসেবে তার কোন মাধ্যমটা বেশি ভালো লাগে?
লতিফা কোহিনূর : কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ সব শাখাতেই তিনি লিখেছে। তবে তার কবিতাই আমার বেশি ভালো লাগে। কাছে থেকে যা দেখেছি তা হলো তিনি খুব সিরিয়াসলি পড়াশোনা করতেন, সবকিছুর গভীরে যেতেন। মনে পড়ে, দেশে ফেরার পর আমাদের দেশের বিখ্যাত কবি শামসুর রাহমানের ওপর তিনি একটি বই লিখেছেন, সেই বইটির নাম ‘শামসুর রাহমান নিঃসঙ্গ শেরপা’। এই বইটি লিখে তিনি খুব নাম করলেন। বইটি লেখার সময় তিনি দিনরাত পরিশ্রম করতেন। তখন কম্পিউটারের ব্যবহার বাংলাদেশে তেমন ছিল না। সেই সময় তাঁর একটি বাংলা টাইপরাইটার ছিল। সেটি ব্যবহার করতেন। তখন আমাদের বয়স খুব অল্প ছিল। আমি তার অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে যেতাম। হঠাৎ করে ঘুম ভাঙত। দেয়ালঘড়িতে দেখতাম রাত ২টা-৩টা বাজে। অথচ তার ঘুম নেই। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, যার এত সাধনা, পরিশ্রম, সাহিত্যের জগতে সে একদিন নাম করবেই। লেখার কাজে তাকে কখনো আমি ব্যাঘাত সৃষ্টি করিনি। বরং, তাকে আমি নানাভাবে সাহায্য করেছি।

মৌলি আজাদ : কোনো কবিতার বই কি তোমাকে উৎসর্গ করেছে?
লতিফা কোহিনূর : হুম, করেছেন। প্রথমে করেছে ‘জ্বলো চিতাবাঘ’, তারপর ‘যতই গভীরে যাই মধু, যতই উপরে যাই নীল’, ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’ এবং এর কয়েকবছর পর আবার করেছেন ‘হুমায়ুন আজাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইটি। কখনো আমাকে বই উৎসর্গ করতে তাঁকে বলিনি, নিজে থেকেই দিয়েছেন। কোনো লেখা লেখার সময় খুব একটা আমার সাথে আলোচনা করতেন না। বই বের হলে সিগনেচারসহ দিতেন, মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। বেশিরভাগ বই-ই খুব ভালো লাগত।

মৌলি আজাদ : স্বামী হিসেবে তাঁর কোন বিষয়টা ভালো লাগত তোমার?
লতিফা কোহিনূর : সে সংসারের প্রতি ভীষণ কেয়ারিং ছিল। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, সংসারে কী প্রয়োজন এসব দিকে তাঁর খুব খেয়াল ছিল, বাইরের হুমায়ুন আজাদ থেকে এ হুমায়ুন আজাদ ছিল একেবারেই ভিন্ন।

মৌলি আজাদ : তিনি তো বিখ্যাত মানুষ। বিখ্যাত হলেও দোষত্রুটি থাকে। তাঁর কোন দিকটা তোমার খারাপ লাগত?
লতিফা কোহিনূর : তিনি একটু মেজাজি মানুষ ছিলেন। মনে হতো সবসময় আলোচনায় থাকতে চাইতেন, সমালোচনা খুব একটা নিতে পারতেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজের মত বহাল রাখতে চাইতেন।

মৌলি আজাদ : তোমার কী তখন রাগ হতো?
লতিফা কোহিনূর : হাসি।

মৌলি আজাদ : ষোলো-সতেরো বছর হয়ে গেল, তিনি নেই। আমি যতদূর বুঝি, তাঁকে তুমি খুব মিস করো।
লতিফা কোহিনূর : হুম, প্রতিটা মুহূর্তেই তাঁকে মিস করি। অনেক স্মৃতি মনে পড়ে। তিনি বেঁচে থাকলে আমার ছেলেমেয়েরা তাঁর যত্ন নিত। তিনি সবসময় বলতেন, আমার বুকের একদিকে বই, আরেকদিকে আমার ছেলেমেয়ে। তিনি বেঁচে থাকলে জীবন হয়তো এখন অন্যরকমভাবে কাটত।

মৌলি আজাদ : কোনো একটা কারণে তিনি তোমাকে খুব সম্মান করতেন। তুমি ভালো একটি চাকরি করতে। কারণ, আব্বা সবসময় চাইতেন তাঁর স্ত্রী, মেয়ে বা ছাত্রীরা চাকরি করুক। যতদূর আমি জানি, আব্বার যে গাড়ি ছিল সেটা তুমি কিনে দিয়েছ?
লতিফা কোহিনূর : আমি বাংলা থেকে এমএ পাশ করেছি এবং পরে লাইব্রেরি সায়েন্স থেকে ডিগ্রি নেই। অর্থাৎ, দুটি ডিগ্রি অর্জন করেছি। তাই তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। আমিই তাকে গাড়ি কিনে দেই। তিনি মাঝে মাঝে গাড়ি নিয়ে এদিক সেদিক বিশেষ করে রাড়িখাল যেতেন। অকাল মৃত্যুর কারণে অবশ্য বেশিদিন গাড়িটি ব্যবহার করতে পারলেন না। তিনি বৈষয়িক ছিলেন না, তবে জীবনের শেষ দিকে এসে ফ্ল্যাট কিনলেন। ফ্ল্যাটের একটা রুম তাঁর পড়ালেখার জন্য রাখলেন, কিন্তু একদিনও সে ফ্ল্যাটে তিনি থাকতে পারলেন না। যখন এসব ভাবি, তখন আমার খুব কষ্ট হয়। সেখানে তাঁর লেখা বইগুলো আমি যতনে সাজিয়ে রেখেছি, শুধু তিনি নেই।