‘মা! মা! আমার এ কী হচ্ছে!’ আমি চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলাম।
পেঁয়াজ কাটার ছুরি হাতে নিয়ে মা রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এলেন। ‘কী হয়েছে?’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন। তার কাজে ব্যাঘাত ঘটানোয় তাকে খুব বিরক্ত বলে মনে হলো। মুহুর্তেই মেঝেতে তার নজর গেল—যেখানে আমার চোখের গোলক পড়ে আছে। মা আর্তনাদ করে উঠলেন, “হায় আল্লাহ!”
মা এটি স্পর্শ করার সাহস পেলেন না। দুটি চামচ দিয়ে আমার পড়ে যাওয়া চোখ তুলে নিলেন তিনি। চোখের গোলকটি নিয়ে আমরা এখন কী করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। অগত্যা পোলাও এ ব্যবহার করার জন্য হিমায়িত মটরশুটির প্যাকেটে আমরা এটি ঢুকিয়ে দিলাম। পুরো সময় আমি এক হাত দিয়ে আমার চোখের গর্ত ঢেকে রেখেছিলাম।
বাবাকে ফোন করলাম। তিনি সকালেই অফিসে গিয়েছেন। মা স্পিকারফোন অন করে রাখলেন যাতে আমি পুরো ব্যাপারটা তাকে বুঝিয়ে বলতে পারি।
‘আমার চোখ পড়ে গেছে বাবা।’ আমি বললাম।
বাবা তৎক্ষণাৎ বাড়ি ফিরে এলেন। মা পাগলের মতো হয়ে এদিক-ওদিক হাঁটছিলেন। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনদের ফোন করছিলেন একের পর এক।
দিনটা অন্য যেকোনো দিনের মতোই শুরু হয়েছিল। বাবা সবার আগে ঘুম থেকে ওঠেন। যথারীতি তিনি বাথরুমের সিঙ্কের উপর জোরে জোরে গলা খাঁকারি দিয়ে ফ্রেশ হওয়ার মাধ্যমে সবাইকে জাগিয়ে তোলেন। মা কিছুক্ষণের মধ্যেই উঠে রান্নাঘরে গিয়ে বাসি ডাল চুলায় তুলে দিয়ে রুটি ভাজেন। মাঝে মাঝে আমি তার কাছে একটি তাজা ডিম চাইতাম। সেদিন তাও করিনি।
আমার স্পষ্ট মনে আছে সকালবেলা বাবাকে রিকশায় উঠতে দেখেছিলাম। তিনি অফিসে গেলেন যথারীতি। তারপর আমি হারমোনিয়াম নিয়ে গান গাইতে শুরু করলাম। মায়ের মনটা খুব ভালো ছিল। আমাকে একপলক দেখে তিনি তার ঘরকন্নার কাজে চলে গেলেন। তিনি সবসময় বলতেন আমার গান তাকে খুব শান্তি দেয়।
এর কয়েকঘণ্টা পর যখন আমি একজন ছাত্রীর সাথে দেখা করার জন্য প্রস্ততি নিচ্ছিলাম তখনই ঘটনাটা ঘটল।
বাবা আমাদের পারিবারিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন, যিনি দেখতে খুব মোটাসোটা আর বাচাল। আমার বয়স যখন বারো বছর তখন থেকেই তার কাছে আমরা নিয়মিত যাই। আমার মনে হয় তিনি আমার বাবার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। চাচাতো ভাইয়ের চাচাতো ভাই এরকম হতে পারে। নাও হতে পারে। আমি নিশ্চিত নই। বর্ধিত পরিবারের সমস্যা নিয়ে আমি মাঝে মাঝে তাদেরকে আলোচনা করতে শুনেছি। এগুলো ছাড়া সবকিছু ঠিকই ছিল।
মা আমার চোখটি মটরশুটির প্যাকেটে করে নিয়ে এসেছিলেন, যা থেকে এখন জল ঝরছে।
“আমি ঠিক জানি না কেন এটা হচ্ছে।” ডাক্তার প্রায় চিৎকার দিয়ে বললেন, “তোমাকে অবশ্যই তাকে বিয়ের বাজারে তুলতে হবে।”
একথা বলায় সবার মনোযোগ আমার দিকে নিবদ্ধ হলো।
“বাজার?” মা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। অস্ফুট স্বর বের হয়ে এলো “কিন্তু...”
“তুমি একজন মেয়াদোত্তীর্ণ মহিলা হয়ে গেছ।” ডাক্তার আমার দিকে চেয়ে বললেন। “এটা একটা নির্দিষ্ট বয়সের মহিলাদের ক্ষেত্রে ঘটে। তুমি ভালো করেই জানো যারা বিভিন্ন কাজ বা স্কুল বা যেকোনো কারণে বিয়ে স্থগিত করে।” তিনি পেছনে ফিরে বাবার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকলেন, “ও এখন পঁচে গেছে। অনেক দেরি হওয়ার আগেই তোমার উচিৎ তাকে বাজারে তোলা।”
“আমাদের হাতে আর কত সময় আছে?” বাবা জিজ্ঞেস করলেন।
“তুমি কত সময় চাও? চৌত্রিশ বছর বয়সী একটা মেয়ে এখনো যুবতী হয়নি তাই না? আমার মনে হয় না যথেষ্ট সময় আছে।”
“আর চোখ? আপনি কি এটা আগের জায়গায় স্থাপন করতে পারবেন?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“আমি দুঃখিত। সম্ভব নয়।” ডাক্তার উত্তর দিলেন।
ডাক্তার আমাকে একটা আইপ্যাচ পরতে দিলেন এবং জায়গাটা পরিষ্কার রাখতে বললেন। ট্যাক্সিতে করে বাড়িতে ফেরার পুরোটা সময় বাবা বেশ নীরব ছিলেন। আমি গাড়ির বামপাশে বসার জন্য মায়ের কাছে অনুরোধ করলাম। যাতে আমি আমার বাকি একটা চোখ দিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখতে পারি।
“কিছু বলো। তোমার মেয়ে ভেঙে পড়েছে।” মা চিৎকার দিয়ে বললেন।
বাবা বিড়বিড় করে বললেন, “ডাক্তার যা বলেছেন তা তুমি শুনেছো। সে আর ছোট নেই। সম্ভবত আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। আমাদের অনেক আগেই দেখা শুরু করা উচিৎ ছিল।”
“আমরা এখন দেখা শুরু করতে পারি।”
“না, একচোখা মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে না। ডাক্তারের কথামতো আমাদের বিয়ের বাজারে যেতে হবে।”
সেই রাতে মা আমার পাশেই ঘুমাচ্ছিলেন। আবার যদি অন্যকিছু ঘটে যায়! অস্থির হয়ে আমি বারবার তার দিকে ফিরে তাকাচ্ছিলাম। এসির লাইটের আলোয় এক চোখ দিয়েই আমি তার রূদ্র মূর্তি দেখতে পাচ্ছিলাম। তিনি উল্টোদিকে পাশ ফিরে শুয়েছিলেন। আমার দিকে ফিরে তাকাচ্ছেন না। রাতটা খুব ঠান্ডা ছিল। আমি একইসাথে কাঁপছিলাম ও ঘামছিলাম। শীতের কাঁথা দেওয়ার পরেও শরীরের ভেতরে কঠিন শীত এমনভাবে প্রবেশ করছিল যেন হাড়ের গভীরেও ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছিল। মা জেগেছিলেন বলে মনে হচ্ছিল।
“মা, এখন আমার কী হবে?”
তিনি আমার হাত ধরে রাখলেন। “এতো চিন্তা করো না। তোমার বাবা আগামীকাল ছুটি নিয়েছেন। সকালে সিদ্ধান্ত নেব।”
“তুমি কি সত্যিই আমাকে বাজারে নিয়ে যাবে?”
“আমি জানি না।”
“আমি কি এখনও হারমোনিয়াম বাজাতে পারব?”
মা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“আমি জানি না।”
সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানা ছাড়ার সময় কম্বল খুলে দেখতে পেলাম আমার একটি পা কুঁচকে কালো হয়ে হাঁটুর নিচ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ঘৃণা, ভয় ও বিস্ময় মিশ্রিত এক অনুভূতির সৃষ্টি হলো আমার ভেতরে। প্রথম কারণ সামগ্রিকভাবে বিষয়টি ছিল ভয়ংকর। দ্বিতীয় কারণ আমার শরীরে আত্ম-ধ্বংস শুরু হয়ে গেছে। আমাদের ফ্ল্যাটে টিকটিকিদের কথা মনে পড়ল। একবার, প্রায় কুড়ি বছর আগে, মা আমাদের বাসার ঘরের দেয়ালে একটা বই ছুঁড়ে মেরে তার লেজ কেটে ফেলেছিলেন। কাজটা করতে পেরে তিনি বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠেছিলেন। তিন সপ্তাহ পরে আমি আবার আমাদের সমতল দেয়ালে ওই একই টিকটিকিকে ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। দেখলাম তার ছোট্ট শরীর থেকে লেজ গজাচ্ছে। আমি ভাবলাম আমার পা যদি ওরকমভাবে ফিরে আসত!
যখন আমার বাবা-মা আমার মৃত গ্যাংগ্রিনযুক্ত পা দেখছিলেন, তখন আমার পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ ছিল তা বুঝতে পেরেছিলেন। আমার বাবা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন অথচ তিনি ছিলেন ভোজনরসিক। আর সর্বদা ক্ষুধার্ত একজন মানুষ। তিনি ডাক্তারকে আবার অনুরোধ করলেন বাড়িতে আসার জন্য।
মা দাদীকে ফোন করেছিলেন। এক ঘণ্টা পরে গরম গরম শিঙাড়া নিয়ে তিনি বাসায় এলেন।
“তোমার অবস্থা কী?” বিছানায় আমার পাশে বসতে বসতে বললেন।
“হাই, দাদী কেমন আছো?”
“ওহ এখন তোমাকে কে বিয়ে করবে?” তিনি কেঁদে উঠলেন। তিনি আমার মায়ের দিকে ভস্মদৃষ্টিতে দিয়ে বললেন, “তোমার জন্য এসব হয়েছে।”
মা আমার পায়ের দিকে তাকালেন। আমি দাদীর আনা কাগজের ঠোঙা থেকে শিঙাড়া বের করে নিলাম। এটি আমার খুব প্রিয়। মাংসের টুকরো দিয়ে ভরা আর খুব মুচমুচে।
“আম্মা আমি জানতাম না।”
“আম্মা বলবে না আমাকে। আমার দেবরের মেয়ের কী হয়েছিল তা তোমাকে আমি আগেই বলেছিলাম। সে বেশিদিন অপেক্ষা করেছিল। বিয়ের পরিবর্তে তাকে পড়াশুনা ও কাজ করতে উৎসাহিত করা হয়েছিল।”
“আম্মা আমি ঠিক থাকলাম আর সে পঁচে গেল।”
“তুমি আধুনিক নারী। তোমরা আধুনিক আদর্শ ধারণ করো। এখন দেখো এটা তোমাদেরকে কোথায় নিয়ে গেল। এক চোখ এক পায়ের মেয়ে! কেউ বিয়ে করবে না। মেয়েদের পড়াশুনো আর কাজ করার মধ্যে এত আধুনিকতা কী তা আমি বুঝতে পারি না। পুরুষরা হাজার বছর ধরে এই কাজগুলো করে আসছে।”
আমি নীরবে শিঙাড়া চাবাচ্ছিলাম। আমার খুব খারাপ লাগছিল। তাছাড়া আমার উপস্থিতিতেই তাদের মধ্যে এই কথাবার্তা চলছিল। আমার মনে হচ্ছিল এর সাথে আমার খুব একটা সম্পর্ক নেই।
“তার স্বপ্ন ছিল।” মা কাঁদতে শুরু করলেন। “সে একজন চমৎকার হারমোনিয়াম বাদক। কী চমৎকার বাজায়! টিভিতে রেডিওতে কী সুন্দর প্রোগ্রাম করে। সেখান থেকে ভালো ইনকামও করে। মানুষ তাদের বাচ্চাকে পড়াতে চায় ওর কাছে তা আপনি জানেন? আমি তাকে স্বাধীনতা দিয়েছিলাম, হারমোনিয়াম কিনে ক্লাসে ভর্তি করে দিয়েছিলাম। প্রতি সপ্তাহে তাকে আমি সেখানে নিয়ে যেতাম। তার বাবাও এ ব্যাপারে কোনো সাহায্য করেনি...
আমার বাবা তখন ভেতরে ঢুকলেন।
“মা এসেছেন? ধন্যবাদ। তোমাদের কথা শেষ হয়ে থাকলে ডাক্তারকে ডাকব। ডাক্তার চলে এসেছে’ বাবার দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ হলো। আমি লক্ষ্য করলাম তিনি আমার চোখের দিকে ঠিকভাবে তাকাতে পারছেন না।
“আগামীকাল আমরা তাকে বাজারে নিয়ে যাচ্ছি।”
আমাদের পারিবারিক ডাক্তার প্রায় এক ঘণ্টা দেরি করে এসেছিলেন। আমরা যখন তাকে তার চেম্বারে দেখাতে যেতাম তখন তিনি আমাদের অপেক্ষা করাতেন। তাই আমি অবাক হইনি। তিনি আমার দিকে করুণার ভাব নিয়ে তাকালেন যা একই সাথে আত্মতৃপ্তিতে ভরা ছিল। যেন তিনি খুব দৃঢ়তার সাথে যা বলেছিলেন, তা না শোনার উপযুক্ত পরিণতি কেমন হয় তা এখন বুঝো।
তিনি আমাকে একটি কৃত্রিম যন্ত্র লাগিয়ে দিলেন। কিছু ওষুধপত্র লিখে দিলেন। এবং আমার বাবা-মাকে বললেন যে আর দেরি করা যাবে না। আমাকে অবিলম্বে বিয়ের বাজারে নিয়ে যেতে হবে। নইলে দ্রুত অবনতির ফলে মৃত্যু হয়ে যাবে। সম্ভবত আগামি দুইদিনের মধ্যে। মা ও দাদী চিৎকার করে কান্না শুরু করলেন। আর বাবা মৃদু মাথা নাড়লেন।
আমি একটু একটু করে হাঁটতে পেরে খুশি হলাম যদিও এখানে সেখানে হোঁচট খাই। পরের দিন সকালে মা-বাবা আমাকে বিয়ের বাজারে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। আগে থেকে কিছুটা প্রস্ততির প্রয়োজন ছিল। কৃত্রিম পায়ের সাহায্যে আমি বাথরুমে যেতে পেরেছিলাম স্নানের জন্য। আমি আমার চোখের প্যাঁচ খুলে ফেললাম এবং আমার মুখে হালকা গরম জল ঢেলে দিলাম। গত দুই দিনের ময়লা ধুয়ে ফেললাম। পরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠার পর মা আমার চুল শুকিয়ে খুব সুন্দর করে বেঁধে দিলেন। মুখে ভারি মেকআপ করে দিলেন। আর সবচেয়ে সুন্দর শাড়িটা পরিয়ে দিলেন। বাবা ফার্মেসি থেকে নতুন আইপ্যাচ কিনে আনলেন।
নামের অর্থ অনুযায়ী বিয়ের বাজার ছিল এমন একটি সমাবেশ যেখানে শহরের অবিবাহিত মহিলারা যোগ্য অবিবাহিতদের জন্য নিজেদের প্রদর্শন করে। এটি একটি কনভেনশন সেন্টারে অবস্থিত। মহিলাদের দাম নির্ধারণ করে বিশাল বিস্তৃত মেঝেতে বুথ বরাদ্দ করা হয় যেখানে পুরুষেরা অবাধে ঘুরে ঘরে কথা বলে জীবনসঙ্গী বেছে নিতে পারে। বিষয়টা তাৎক্ষণিক ঘটত। যারা একা একা ঢুকেছিল, দেখা যায়, তাদের বেশিরভাগই পছন্দের স্ত্রী নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। বাজারে পুরুষদের সাথে তাদের পরিবারের সদস্যরাও আসত। সন্তানদের জন্য যোগ্য সঙ্গী বেছে নিতে, পরীক্ষা-নীরিক্ষা করতে সাহায্য করত। বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের কাছ থেকে আমি বিয়ের বাজারের গল্প শুনেছিলাম বিচ্ছিন্নভাবে। আমি কখনো কল্পনাও করিনি যে আমি বাজারের একটি পণ্য হয়ে যাব। আমার মনে হয় এক অর্থে আমি কিছুটা বোকা ছিলাম। ভাবছিলাম আরও সময় আছে।
আমরা পৌঁছানোর পর, আমার বাবা-মা আর আমি একটি বুথেসা ইনমেন্টের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। এক চোখ দিয়ে যতটা পারা যায় তাই দিয়ে আমি চারপাশ দেখতে থাকলাম। বিভিন্ন ধরনের মহিলার উপস্থিতি ছিল। সতেজ মুখ, সদ্য যুবতী, মধ্য বয়সী, বয়স্কা এমনকি বার্ধক্যজনিত রোগী মহিলারাও। আমি আরও লক্ষ্য করলাম যে, আমার মতোই কয়েকজন মেয়াদোত্তীর্ণ মেয়ে এসেছে। কেউ কেউ টাক লুকানোর জন্য পরচুলা ব্যবহার করছে। কেউ ক্রাচ ব্যবহার করছে।
লাইনে দাঁড়িয়ে সামনে আসার পর, টিকিট কাটার কর্মী আমার দিকে একবার তাকালেন এবং জিজ্ঞাসা কররেন, “মেয়াদ শেষ হচ্ছে?”
“হ্যাঁ। তবে খুব আর্লি স্টেজে আছে। সে খুব ভালো হারমোনিয়াম বাদক। আপনি হয়ত মাঝে মাঝে তাকে টেলিভেশনে দেখেছেন” বাবা বললেন।
“আর বয়স?”
“চৌত্রিশ। কিন্তু দেখতেও কময় বয়সী। তাই না?”
একজন অ্যাটেনডেন্ট যার বয়স বিশের কম বলে মনে হলো, বলল, “তার একটা ডিসকাউন্ট স্টিকার লাগবে।”
সে তার ডেস্কের উপর একটা উজ্জ্বল কমলা রঙের স্টিকার ধরল এবং তার পিছন থেকে তা খুলে ফেলল। উঠে দাঁড়িয়ে আমার কপালে লাগালো।
“এর মানে কী?” আমি বাবাকে জিজ্ঞাসা কলাম।
“ডিসকাউন্টেড”
আমরা ভেতরে গেলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম আমার বাবা-মা আমার জন্য উপযুক্ত দাম নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু সেটা কত তা জানতে আমি আগ্রহী ছিলাম না।
যা হোক ডিসকাউন্ট স্টিকার। আমার চোখ ও পা হারিয়ে যাওয়ায় আমার মূল্য হ্রাস পাচ্ছে বলে আমি মনে করলাম। এমন নয় যে সেগুলো আমি পুরোপুরি হারিয়েছে। আমি জানতাম ওরা কোথায়? চোখটা তখন মটরশুটির ব্যাগে ছিল। এখন তো ফ্রিজে। আর পা? আচ্ছা বাবা সেটা আবর্জনার বাক্সে ফেলে দিয়েছিলেন?
বছরের পর বছর ধরে তোলা ছবি দিয়ে মা বুথটি সাজালেন। বিজনেস কার্ড বের করা হলো। আমার পড়াশুনা, অভিজ্ঞতা এবং সঙ্গীত সম্পর্কিত তথ্য সম্বলিত লিফলেট প্রস্তত করলেন বাবা। আমার মনে পড়ে না আমি কখনও এরকম কিছু তৈরি করেছি।
মা আমাকে বুথের সামনে বসালেন। আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়াচড়া করিয়ে আমার শাড়িটি ঠিক করে দিলেন, যেভাবে একজন দোকানদার একটি ম্যানিকুইনকে সাজায়। আর তা করা হয় ক্রেতাদের কাছে সর্বাধিক আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য।
আমি যখন দাঁড়িয়েছিলাম তখন একের পর এক লোক কে আমার বুথের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলাম। আমার চোখের পাতার দিকে একবার তাকিয়েই দ্রুতই ছুটে চলে যায় তারা। এরপরের জীবন কেমন হতে পারে তা নিয়ে ভাবছিলাম। আমার কি তখন গান গাওয়ার আর হারমোনিয়াম বাজানোর স্বাধীনতা থাকবে। যা আমি আমার বাবা মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলাম? ভাবছি আমি, আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে। কারণ আমার সব কাজকে পেছনে ছুঁড়ে ফেলে যেতে হবে। আমি সম্পূর্ণ অর্ধেক হয়ে যাব। একজন স্বামীর স্ত্রী হব। একজন সন্তানের মা হব যা আমার ভাঙা শরীরে শিকড় গেড়ে বসবে। হঠাৎ আমি আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। এক গভীর দুঃখে আক্রান্ত হলাম যা ইতোপূর্বে আমাকে স্পর্শ করেনি। আমার পা, মানে কৃত্রিম পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য ব্যথা করছিল। আর পরিবেশটা খুম গরম ও গুমোট ছিল। আমার কান্না পেল খুব।
“কাঁদো না।” বাবা আমাকে সতর্ক করলেন। “এতে তোমার সম্ভাব্য প্রার্থীরা ভয় পাবে।”
মা আলতো করে নীরবে আমার চোখের জল মুছে দিলেন। আমার বাবা-মায়ের সাথে প্রথম যে পুরুষ কথা বললেন তিনি ছিলে ইন্টার্ন ডাক্তার। ত্রিশোর্ধ্ব লোকটি পূর্বে বিবাহিত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে তার প্রথম স্ত্রী স্বাভাবিক কারণে মারা গেছেন। যদিও কারণগুলো স্পষ্ট মনে হচ্ছিল না।
“ওহ, তার আত্মা শান্তিতে থাকুক। তিনি কবে মারা গেছেন?” মা জিজ্ঞাসা করলেন।
“গত সপ্তাহে।” তিনি উত্তর দিলেন।
দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি আমাদের বুথের সামনে এলেন তার বয়স আমার বাবার চেয়ে বেশি। বাবার চেয়েও তার চুল বেশি পাকা। আমার দিকে একটু তাকিয়ে তিনি বায়োডাটা মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলেন। আমার কিশোর বয়সের ছবিগুলোর দিকে অনেকক্ষণ ধরে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি ব্যবসায়ী ছিলেন। আর তার বেশিরভাগ সময় কাটতো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।
“কী ধরনের ব্যবসা?” বাবা জিজ্ঞেস করলেন।
“ওহ আপনি জানেন না? শিপিং এন্ড ট্রেডিং”
আমার বাবা আসলেই জানেন না।
তৃতীয় ব্যক্তিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমার সাথে সরাসরি কথা বলেছিলেন। আমার মনে হয় টেলিভিশনে আমার প্রোগ্রামের জন্য আমাকে চিনতে পেরেছিলেন। কয়েকটি চ্যানেলে একযোগে সম্প্রচারিত হওয়ার জন্য হয়তোবা এমনটি হয়ে থাকতে পারে।
আমি প্রোগ্রাম থেকে বেশ সম্মানি পেতাম এবং সেটা দিয়ে বাবা-মায়ের জন্য উপহার কিনতাম। বন্ধুদেরকে নিয়ে ঘুরতে যেতাম। তাদেরকে ট্রিট দিতাম।
“ডিসকাউন্টেড?” তৃতীয় ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন। তারপর বললেন, “তারা জানে না যে এখানে কোন তারকা রয়েছে”
আমার বাবা এই মন্তব্যে খুব খুশি হলেন।
“আমি এটাই তাদের বলেছিলাম। সে এক সঙ্গীত প্রতিভা.” বাবা বললেন। “অলরেডি হাফ স্টার।”
তৃতীয় ব্যক্তি আমার দিকে তাকালেন। তার দৃষ্টি তীব্র কৌতুহলে ভরা।
“সময় তো তোমারই। তাই না?”
আমি কাঁধ ঝাঁকালাম।
আমার ভালো লাগছিল এজন্য যে তিনি আন্তরিক ছিলেন যদিও বিষয়টা সামগ্রিকভাবে হতাশার ছিল।
আমি তৃতীয় ব্যক্তির দিকে নিবিড়ভাবে তাকালাম। তার মুখটি সুন্দর ছিল। হাসি কিছুটা অদ্ভুত হওয়া সত্ত্বেও স্নেহময় ছিল। আর অভিব্যক্তি এমন ছিল যে তিনি এমন কিছু জানেন যা অন্যরা জানে না।
তৃতীয় ব্যক্তি সেই সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে গেলেন। আনুষ্ঠানিকতা খুব সহজভাবে তাড়াতাড়ি সম্পন্ন হলো। কিছু কথাবার্তা (বিয়ের কবুল পড়া), কাগজপত্রে স্বাক্ষর করা এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একে অপরের সাথে থাকার প্রতিশ্রুতির আনুষ্ঠানিকতা ছিল। আমি যখন আমার নতুন বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম তখন আমার বাবা-মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন। রাতের শেষভাগে মনে হলো এই ব্যক্তির সাথে আমার জীবন সুখের হবে। যেহেতু তিনি আমার স্বামী।
শুরুর দিকের ভালোবাসা ছিল এমনই। কিন্তু বৈবাহিক জীবনে কিছু সমন্বয়ের ব্যাপার থাকে। আমি অনুভব করা শুরু করলাম বছরের পর বছর স্বাধীনতা ভোগ করার কথা। দুটো চোখ, পা এবং অবিবাহিত হওয়ার জন্য এই স্বাধীনতা ভোগ করতে পেরেছি। আর বাবা-মা আমাকে তা অনুমোদনও করেছিলেন। শুধু এজন্যই। এজন্য না যে তারা আমার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আমি স্বাধীন ছিলাম। হঠাৎ করে যদি মনে হতো আমি আমার কোনো বন্ধুর সাথে রাত দুপুরে চা-পুরি খাব, চলে যেতাম। যেতে পারতাম। কোনো বাধা ছিল না। এমনকি শহরের শেষ প্রান্তে প্রদর্শিত কোনো নাটক বা সিনেমা দেখতে চাইতাম বাবা আমাকে সঙ্গে নিতেন। আমি যদি চাইতাম খুব ভোরে টিভিতে নাটক দেখতাম বা হারমোনিয়ামে গান করতাম—কেউ কিছু বলতো না। আমার একটি চমৎকার ফ্রেন্ড-সার্কেল ছিল। যাদের সাথে আামি মনোরম সময় কাটাতাম। আমার জীবনটা আমার কাছে ছিল। আমি ছিলাম মুক্ত বিহঙ্গ।
অন্যদিকে, এখন আমি একজনের স্ত্রী হওয়াতে জীবনটা জটিলতায় পূর্ণ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আমি যেন সময়ের বাহিরে অবস্থান করছি।
আমার স্বামী ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। আমার মনে হয় তিনি শিক্ষাদান বিষয়টিকে তার জীবনে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। গণিত পড়াতেন। আমার মনে হয় সে-কারণেই তিনি সবসময় ফর্মুলা মেনে চলতেন। তিনি চাইতেন আমরা সকালে একসাথে উঠব। তারপর খাব, তারপর কিছু সময় কাটাব। তিনি চাইতেন বাসাটি স্পটলেস থাকবে। যখন চাইবেন কাগজের পৃষ্ঠা এগিয়ে দিতে হবে এবং দীর্ঘ পাঠদানের পর তিনি ঘুমাবেন। আমি বুঝি না এরকম একটা বদ্ধসূত্রে কীভাবে জীবন যাপন করা যায়। কিন্তু আমি শীঘ্রই জানলাম যে এটা শুধু আমার জন্যই নয়, সবার জন্যই হওয়া উচিৎ।
আমি সন্তুষ্ট এজন্য যে তার স্ত্রী হিসেবে জীবন শুরু করার সময় তিনি আমাকে এসব বিষয়ে ছাড় দিতেন এবং অভ্যস্ত হতে সহযোগিতা করতেন। তিনি আমাকে শেখাতেন কীভাবে তার প্রিয় খাদ্য রান্না করতে হবে। কীভাবে কাপড় ধুতে হবে। রাতে তিনি যখন আমার উপরে উপগত হবেন তখন কী আচরণ করতে হবে। এমনকি আমার যখন খুশি তখন হারমোনিয়াম বাজাতে দিতেন। হারমোনিয়ামটি বাবা-মা আমার কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসের সাথে দিয়ে গিয়েছিলেন।
আসলে তিনি এগুলো এনজয় করতেন। এর একটি কারণ ছিল তিনি আমাকে বিবাহ করেছেন। যখন আমি গাইতাম তখন আমার স্বামী প্রশংসায় ভাসিয়ে দিতেন। বলতেন, তোমার কণ্ঠ অ্যানজেলের মতো। সেইসব দিন খুব সুন্দর ছিল। কিন্তু আমি জানি না আমাদের এটা ভালোবাসা ছিল কি-না। আমি নিশ্চিত এটা ছিল ভালোবাসার মতো কিছু একটা।
বিয়ের ছয়মাস পর আমার কিছু ছাত্রের অভিভাবক যোগাযোগ করেছিলেন যাতে আমি পুনরায় তাদের ছেলেমেয়েদেরকে হারমোনিয়াম শেখাই। আমার স্বামীকে সেটা জানিয়েছিলাম।
“আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত শিক্ষার্থীদের পড়াই। বাড়িতে এর কোনো প্রয়োজন নেই। যদি না তুমি সন্তান নিতে চাও।”
আমি তার পরামর্শ উপেক্ষা করলাম। বললাম, “আমি তাদের কাছে যেতে পারতাম। আগে তো তাই করতাম।”
আমার পাল্টা প্রস্তাবে তিনি বললেন, “তোমার এক পা নিয়ে?”
আমি এটা নিয়ে আর কোনো কথা বলিনি। আমার ছাত্ররা তার মতো নিচু মানুষের সাথে থাকার কথা কল্পনাও করতে পারবে না। হয়ত তিনি যা বলেছিলেন সত্যই—আমি একজন অর্ধ-নারী। আমার এক পা নেই। এক চোখও নেই। কিন্তু আমার স্বামী তো বিয়ের বাজারে গিয়ে আমাকে কেনার আগেই জানতেন। এখন আমাকে ঠাট্টা করে তার কী লাভ?
আমি ভাবতে লাগলাম আমার স্বামী কেন আমার মতো একজন ডিসকাউন্টেড মহিলাকে কিনেছেন। তিনি বেশ তরুণই ছিলেন। পুরুষের বযস পঁয়ত্রিশ অবশ্যই নারীর পঁয়ত্রিশের তুলনায় তরুণ। সুদর্শন। ভালো চাকরি করে। তার পরিবারের লোকদেরকেও যথেষ্ঠ ভদ্র ও সৌহার্দ্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল। কেন আমার মতো একজন অর্ধ-মহিলাকে অর্ধ-পুরুষদের (পুরুষদের অবশ্য অর্ধ-পুরুষ বলা হতো না। কেবল পুরুষ বলা হতো।) জন্য বরাদ্দ করা হলো না? মাঝে মাঝে মনে হতো আমি ত্রুটিপূর্ণ বলেই হয়ত তিনি আমাকে পছন্দ করেছেন। যা তাকে তার বিষয়ে খুশি করেছিল।
আট মাসের কাছাকাছি সময়ে আমি আবার সম্পূর্ণ নারী হয়ে উঠি। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার ডান চোখ ফিরে এসেছ একদম আগের রূপে। আমার মনে হয় নতুন চোখের দৃষ্টিশক্তি পুরনো চোখের চেয়েও ভালো। আমার পাও তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে। ঠিক শৈশবে দেখা ওই টিকটিকির মতো। এতদিন ধরে চোখছাড়া থাকার পরও একটা কার্যকরী চোখ এবং পা ফিরে পাওয়ায় আমার ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি করল। ঠিক যেন পুনর্জন্ম। আবার এক ধরনের মৃত্যুও। আমার বাবা-মা আনন্দিত হয়ে মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন। রসগোল্লা এবং সন্দেশ আমার খুব প্রিয়।
“আমি জানতাম”। বাবা গর্ব করে বললেন। “বিয়ের বাজারে দেখা মাত্রই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তোমার স্বামী তোমার জন্য কত উপযুক্ত! দেখো আমার মেয়ে, আবার সুস্থ হয়ে উঠো!”
আমার স্বামী আগে সদয় ছিলেন, এখন না। একসময় হারমোনিয়াম বাজাতে উৎসাহিত করলেও এখন খুব বিরক্ত হন। বলেন, “চুপ থাকো তো। আমি পরীক্ষার খাতা দেখছি।”
বিয়ের দেড় বছর পর্যন্ত আমার জন্য আকর্ষণ থাকলেও তা ধীরে ধীরে মুছে গেল। পরিবর্তনটা নজড় এড়ায়নি। আমার স্বামী ক্রমশঃ রাগী হয়ে উঠল। বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় কাটাতে লাগল বেশি। বন্ধু-বান্ধব বা সহকর্মীদের সাথে রাত পর্যন্ত বাহিরে কাটাতে লাগল। আমি সন্দেহ শুরু করলাম। কিন্তু কখনও ঈর্ষান্বিত হইনি। আমার মনে হতে থাকল, এই সেই মানুষ যাকে আমি আমার শরীরের ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বিয়ে করেছিলাম—সে আসলে এক অচেনা মানুষ। সে কখনই আমার ছিল না। আমিও তার। আমি জানতাম সে নিজেকে এমন একটা গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিল যার নাগাল আমি কোনোদিন পাইনি।
একবার গভীর রাতে আমি আমার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে অন্য কেউ আছে কিনা। বলেছিলাম আমি একটুও রাগ করব না। কেবলই কৌতূহল।
তিনি বললেন, “না”। তার স্বরে যথেষ্ট দ্বিধা ছিল। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম যে আমি সন্দেহপ্রবণ নই।
“তোমরা নারীরা সবসময় সন্দেহপ্রবণ। আর বেশি বোঝ। এখন ঘুমাও।”
আমি আমাদের বিবাহকে একটি ডিমের মতো কল্পনা করেছিলাম। প্রথমে ক্রুটিহীন এবং মসৃণ যতক্ষণ না ধীরে ধীরে ফাটল দেখা দিতে শুরু করে। এর কারণ কী আমি জানি না। আমি কল্পনা করেছিলাম কুসুমের মতো। কিন্তু আমার স্বামীর গোপন কথা, আমার প্রতি বিরক্তি যেন আমাদের সাধারণ অসুখ যা খোলসের ফাটল থেকে বেরিয়ে আসছে। আমরা আসলে পচা ডিম ছিলাম।
মা ঘন ঘন আসতেন। বিশেষ করে শেষের দিকে। মনে হয় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আমি বিদায়ের জন্য প্রস্ততি নিচ্ছি। একবার তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লে তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আমার প্রিয় গানগুলোর একটি গুনগুন করে গাইতে শুরু করেছিলেন। আমার স্বামী তখন বাহিরে ছিল।
“মা, আমি তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি।”
মায়ের হাত জমে গেল।
“চলে যাচ্ছ?”
“হ্যাঁ”
“আরে কোথায় যাবে তুমি?”
“তোমাদের কাছে। তোমরা আমাকে নেবে না?”
“তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।” তিনি কাঁপতে লাগলেন। “তুমি আবার পঁচে যাবে।”
“আমি মেনে নেব না।” আমার খুব রাগ লাগছিল। কান্না শুরু হয়ে গেল শীঘ্রই।
“ওহ মানুষ কী বলবে?” মা চিৎকার করে উঠলেন। “তোমার বয়সী একটা মেয়ে? তুমি আলাদা হবে যাবে না?” তার স্বর কঠোর হয়ে উঠল। যেমন কঠোর হয়ে উঠতো আমার শৈশবে। যখন তার কথামতো পড়তাম না, খেতাম না।
“বিয়ে তো এমনই।” তিনি বলতে লাগলেন “তোমার কাছে নতুন বলে তুমি জানো না।”
“এটা কেমন তা জানার দরকার নেই।”
‘তুমি তোমার দুঃসাহসিক জীবনযাত্রায় মুক্ত পাখির মতো অভ্যস্ত হয়ে গেছো। সব সময় ঘুরে বেড়াতে। আল্লাহ জানে কার সাথে সময় কাটাতে। আমরা তোমাকে অনুমতি দিয়েছিলাম কনসার্টে যেতে, রেডিও-টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করতে।”
“এগুলো আমাকে সুখী করেছিল মা।” আমি তখনও কাঁদছিলাম। আর বলছিলাম, “আমি তখন খুব সুখী ছিলাম মা।”
“যখন তোমার বাবার সাথে আমার বিয়ে হয় তখন আমি এক মাস ধরে প্রতি রাতে কেঁদেছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি আমার পরিস্থিতি মেনে নিতে শুরু করি। তোমাকেও একই কাজ করতে হবে।”
আমি সবসময় ভাবতাম আমার বাবা-মা একজন সুখী দম্পতি। এখন মনে হচ্ছে আরো অনেক কিছু আছে তাদের মধ্যে যা আমাকে কখনও বলা হয়নি। আমি চিৎকার করে বললাম, “আমিও একই কাজ করতে চাই না। তার সাথে সংসার করার আগে আমার জীবনটা অনেক সুন্দর ছিল। আমি বুঝতে পারছি না কেন কিছু পরিবর্তন করতে হবে।”
‘তুমি ম্লান হয়ে যাচ্ছিলে। তুমি অর্ধেক নারী হয়ে যাচ্ছিলে। তুমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলে।" আমার চোখের জল গড়িয়ে পড়ল মায়ের শাড়ী উপর।
“এ ধরনের জীবনের চেয়ে মৃতুও ভালো।”
মা চুপ করে রইলেন। তিনি আর বিড়বিড় করলেন না। তিনি আবার আমার চুলে হাত বুলাতে লাগলেন। খুব আরাম পাচ্ছিলাম যতক্ষণ না আঙুল চুলে জট পাকিয়ে যাচ্ছিল।
মা আসার কয়েকমাস পর আমি এক সন্ধ্যায় রাতের খাবার তৈরি করছিলাম। আমার স্বামী একজন তরুণীকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। আমার অনুমান অনুযায়ী তার বয়স বিশের বেশি হবে না।
“কে ইনি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। তার উদ্দেশ্যে বললাম, “হ্যালো”
“আমি আবার বিয়ে করেছি। আজ বিয়ের বাজার থেকে তাকে নিয়ে এলাম।”
“কি!” এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো আমার। আমি তাদের দুজনের দিকে বারবার তাকাতে তাকাতে একসময় আমার শরীর ত্যাগ করে ওই তরুণীর ভেতরে প্রবেশ করলাম। তারপর তার চোখ দিয়ে এই হাস্যকর দৃশ্যটি দেখতে লাগলাম। আমার মনে প্রশ্ন খেলে গেল অচিরেই। ছেঁড়া নাইটগাউন পড়ে কাঠের চামচ দিয়ে ডালের পাত্র নাড়তে দেখে মেয়েটি আমার সম্পর্কে কী ভাবছিল? আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এই মেয়েটি তার স্বামীর মতো একজন হতাশাজনক ব্যক্তির মধ্যে কী খুঁজে পেয়েছিল। যদিও সে জানত না শীঘ্রই ওই লোকটা তার সাথেও একই ধরনের আচরণ শুরু করবে। মনে হলো তাদের মধুময় বৈবাহিক জীবনের মধ্যে আমিই একমাত্র বাধা। আমি তো রাগী মহিলা। আর তুচ্ছ ও হাস্যকর।
“তোমার চলে যাওয়ার সময় এসেছে। আমি বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজপত্র নিয়ে এসেছি।”
আমি বললাম, “ঠিক আছে।”
“ঠিক আছে?” তিনি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বুঝতে পারলাম আমার স্বামী এখানে কিছু প্রতিরোধের আশা করেছিলেন। হয়ত ভেবেছিল আমি মরিয়া হয়ে উঠব। আমিও জানতাম না এমন পারিস্থিতিতে আমার ভূমিকা কী হওয়া উচিৎ। সত্যি কথাটা হলো, আমি এই বাড়িতে এমন একজন ব্যক্তির সাথে থাকতে চাইনি যে তার জীবনের একাকিত্ব দূর করার জন্য আমাকে ব্যবহার করেছে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারানোর মাধ্যমে মৃত্যু, কিংবা স্থূলকায় হয়ে মৃত্যু, মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে মৃত্যু কিংবা যন্ত্রণাদায়ক অথবা যন্ত্রণাহীন মৃত্যু—যা-ই হোক না কেন আমি এর মুখোমুখি হয়ে এর শেষটা দেখে ছাড়ব বলে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করলাম। ডাইনিং টেবিলে রাখা কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেছিলাম। দুটি হাত এখনও আমার সক্রিয় থাকার জন্য কৃতজ্ঞ। এই স্বস্তির স্বস্তি ছাড়া অন্যকিছু বোধ করছি না। বহুদিন পর ভারমুক্ত মনে হচ্ছিল নিজেকে। যখন আমি আমার স্বামীকে (এখন প্রাক্তন) তার নতুন সুন্দরী স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরতে দেখলাম আমার মনে কোনো রাগ বা বিরক্তির অনুভব হলো না। আমি কেবল ভাবছিলাম আামার ভবিষ্যত নিয়ে।
চলে যাবার সময় আমার প্রাক্তন স্বামী বললেন, “তুমি মারা যাবে। তুমি আমাকে ছাড়া মারা যাবে।”
বাবার বাড়িতে ফিরে আসার রাতে এক অপ্রতিরোধ্য আনন্দ বয়ে গেল। আমি জানতাম না যে কতটা সময় অপচয় করেছি। অথবা পরবর্তীতে কী হারাব। জীবনের বিবর্ণতা বিয়ের মাধ্যমে নিরাময় হওয়ার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী? অথচ বেশিরভাগ নারীই বিয়ে করে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে। আমরাও সেটাই করেছিলাম। আমি ইচ্ছেমতো গভীর রাত পর্যন্ত হারমোনিয়াম বাজালাম। সা রে গা মা শব্দে আমাদের ফ্ল্যাট ভরে উঠল।
মা আমার পাশে ঘুমিয়েছিলেন। ঠিক যেমনটি আমার চোখ হারানোর রাতে ছিলেন। আর যা প্রায়শই করতেন যখন আমি ছোট ছিলাম।
“আমি দুঃখিত”। গভীর ঘুম আর স্বপ্নের জগতে প্রবেশ করার ঠিক আগে তিনি আমাকে ফিসফিসিয়ে বললেন।
“তোমাকে বাঁচানোর জন্য আমাদের অন্য উপায় খোঁজা উচিত ছিল।”
আমি বিড়বিড় করে বললাম, “ঠিক আছে মা। তুমি যা জানতে তাই করেছিলে।”
সকাল হলো। তখন থেকে বাকি জীবন আমি দুই পায়ে দাঁড়িয়ে নতুন চোখে পৃথিবীকে দেখছি।
ফারিয়া বাশার
গত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে যখন কমনওয়েলথ শর্ট স্টোরি প্রতিযোগিতা-২০২৫ এর অঞ্চল ভিত্তিক বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়, তার কিছুদিন আগে থেকে ফারিয়া বাশারের নামটি বাংলা গল্পপাঠক ও সাহিত্যমোদীদের মধ্যে উচ্চারিত হচ্ছিল। বাংলাদেশি লেখক হিসেবে দুজনের নাম ছিল সেখানে। একজন হলেন ফারিয়া বাশার, অন্যজন আরমান চৌধুরী। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ফারিয়া বাশার এশিয়া অঞ্চলের হয়ে এই পুরস্কার পেয়েছেন।
কমনওয়েলথ ফাউন্ডেশনের তথ্যানুসারে, ফারিয়া বাশার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেখক। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি ফিলিপাইন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেছেন। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি ও নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন ২৫ বছর বয়সী এই লেখক।