আমার সুনীল

এত ছোট হাতে কী করে ধরেছ বিশ্ব?
নিজেকে কী করে সাজালে আকাশি নীলে?
অথচ আমি যে এত দীন এত নিঃস্ব
শুধু লুকোচুরি খেলেছি কথার মিলে...

২০১০ সালের এক শীতের সকালে কুয়াশা ভেঙে ভেঙে আমার প্রাণের বন্ধু অময় দেব রায়ের সঙ্গে পৌঁছেছিলাম সুনীলদার বাড়িতে। আড্ডাও হয়েছিল। ওই একবারই তাঁর বাড়িতে যাওয়া। পরে তাঁকে আরও বেশি করে পেয়েছি রওডন স্ট্রিটে, কৃত্তিবাসের আড্ডায়। তিনি মধ্যমণি হয়ে বসে থাকতেন। আমি প্রতিমাসের শেষ শনিবার কলেজ স্ট্রিট থেকে ট্রাম ধরে পৌঁছে যেতাম কৃত্তিবাস আড্ডায়। কত কবির কবিতাপাঠ শোনার সুযোগ হয়েছিল ওই সময়! আজ সেকথা ভাবলে শিহরন হয়।

২০১১ সালে আইসিসিআরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কৃত্তিবাস পত্রিকার ৬০ বছর পূর্তি উৎসব। সেখানেও গিয়েছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে। সুধীর চক্রবর্তীর বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম। রবিঠাকুরের কবিতা পাঠ করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ২৫ মিনিট ধরে নিজের কবিতা পাঠ করেছিলেন স্বয়ং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দেখা পেতাম নানা অনুষ্ঠানে। বাংলা আকাদেমি সভাঘরে একবার তিনি 'আমার রবীন্দ্রনাথ' প্রসঙ্গে বলেছিলেন। আশ্চর্য সেই বক্তৃতা এখনও কানে লেগে আছে। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নবনীতা দেবসেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রথম দেখি অনেক ছোটবেলায়। ২০০৪ সালে কৃত্তিবাস পত্রিকা জমজমাট আড্ডার আয়োজন করেছিল শিলিগুড়িতে। অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন হরেন ঘোষ। আলিপুরদুয়ার থেকে বাবার সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম সেখানে। কৃত্তিবাসের সম্পাদক, নবীন কিশোর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মধ্যমণি। তাঁকে প্রথম দেখার রোমাঞ্চ এখনও মনে আছে।

সেই সময় থেকেই নানা লেখা পড়েছি। বাবার সংগ্রহে ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'বরণীয় মানুষ, স্মরণীয় বিচার'। বইটি আমার অত্যন্ত প্রিয়। এক সময় লাইব্রেরিতে পাঠ্যক্রমের পড়াশোনা করতে গিয়ে সুনীলের লেখাই পড়তাম বেশি। 'ছবি দেশে, কবিতার দেশে' একটানা পড়ে শেষ করেছিলাম লাইব্রেরিতে বসেই। এমনটা আরও অনেকবার হয়েছে। তাঁর লেখা এতটাই টেনে রাখত যে সবটা শেষ না করলেই নয়!

বাবা বললেন, 
অন্ধকারে একটুখানি দাঁড়িয়ে থাক আমার জন্য
মাটির তলার একটা সুড়ঙ্গে নেমে গেলেন
খুব আস্তে আস্তে
আকাশে প্রান্ত নির্ণয় ভুল করে ছুটে গেল একটা উল্কা
বন্দরে একটাও জাহাজ নেই, রাস্তাগুলো দুলে ওঠে
কী যে হল
বুঝতে বুঝতেই কেটে গেল আরও উনিশটা বছর
এর মধ্যে কত হুড়োহুড়ি, কত মধুলোভীদের সঙ্গে ঘুরপাক!
(বাবা/ ভোরবেলার উপহার)

কবিতাটি ভালো লাগে। কবিতা লেখা সম্পর্কে তিনি বলতেন, ‘কবিতা কেন লেখা হয় বা কীভাবে লেখা হয়, তার উত্তর আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। আমি অনেক জায়গায় লিখেছি যে, কবিতার প্রথম লাইনটি বিদ্যুত্-ঝলকের মতো মাথায় আসে; এর কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় লাইন আপনা হতে আসে। কিন্তু তৃতীয় লাইনটি শক্ত, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপচাপ বসে পরবর্তী দুটি লাইনের জন্য চেয়ে থাকি। আমি তখন সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুর মতো অসহায় বোধ করি।’

ভালো লাগে তাঁর অনুবাদ কবিতাগুলোও। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজের অনুবাদ কবিতার বই 'অন্য দেশের কবিতা'র ভূমিকায় বলেছেন, ‘কবিতার অনুবাদের জন্য প্রতিভা বা মেধার প্রয়োজন নেই। শব্দের সৌকুমার্য যেহেতু ভাষান্তরিত করা অসম্ভব, তখন মূল ভাষা জানার প্রশ্ন জরুরি নয়।’ যখন আমিও কবিতা অনুবাদ করতে শুরু করি সেই সময় কথাগুলো বেশ কাজে লেগেছিল। কবিতার অনুবাদ খুব কঠিন ব্যাপার। সেই কারণে অনুবাদে হাত দেওয়ার কথা কখনও ভুলেও ভাবিনি। কিন্তু সুনীলদার কথাগুলো পড়ে মনে হয়েছিল যে অনুবাদ করাটা খুব কঠিন ব্যাপার নয়। মনে হয়েছিল চেষ্টা করা যেতেই পারে। তারপর নানা দেশের কবিতা অনুবাদ করেছি। এখন অবশ্য আরও মনে হয়, তিনি যতটা সহজভাবে নিয়েছিলেন, ঠিক ততটা সহজও নয়!

আজ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিনে তাঁর উদ্দেশ্যে একটি কবিতা দিয়ে এ লেখা শেষ করলাম।


পারিজাত

রডওন স্ট্রিটের শনিবারের আড্ডা মনে পড়ে আজ।
মনে পড়ে কথা
কথার ভিড়ে লুকিয়ে থাকে স্মৃতি?
কথা স্মৃতি দুই তবে পড়ে থাকে মাঠে

মনে পড়ে গান...
ম্যান্ডেভিলা গার্ডেনের অমোঘ সেইসব গান

আজ গান নেই
শুধু তার তান ধরে উড়ে যায় পাখি

পড়ে থাকে কবিতাপাঠক আর সুনীল আকাশ...