দেবেশ রায়

ঘুমন্ত শিশুর মতো নিশ্চিন্ত

মধ্যরাত। আমার দায়িত্ব পড়লো দেবেশ রায়ের রুমে থাকার; তবে তাকে বলা যাবে না যে, আমি পাহারা দিতে এসেছি, সেটা বললে রাগ করতে পারেন।
তার বয়স আশির দিকে গেলেও তিনি তরুণ, তারুণ্য বলতে যা বোঝায় তা তার মধ্যে সবসময়ই ছিল। ক্লান্তিহীন কথাবলা, মনোযোগ দিয়ে শোনা, পড়া এবং লেখার ব্যাপারে তার তো দানবীয় শক্তি।
তার একটা চিঠিতে পড়েছি, তিনি আক্ষেপ করে বলছেন, এখন আর বেশি পড়তে পারেন না– এই এই না-পারাটা কিন্তু ৭-৮ ঘণ্টার কম নয়; তাহলে সতেজ শরীরে কত ঘণ্টা পড়তেন!
সেই রাতে প্রেশারের অষুধের সঙ্গে রিল্যাক্সিন ট্যাবলেট গিলে খরগোশের মতো যখন ঝিমুচ্ছি, বয়সের বলে আমাকে যেতে হলো দেবেশ রায়কে পাহারা দিতে।
দুটো ধবধবে সাদা বিছানা, আমি একটাতে শুলাম, দেবেশ রায় বললেন, ‘বাতি জ্বললে আপনার অসুবিধা হবে?’ আমি ঘুমের আয়োজনের সঙ্গে বাতি সহ্য করতে পারি না, তবু হেসে বললাম, ‘আমি বাতি জ্বেলেই ঘুমাই।’ ‘সমস্যা হলে বলবেন কিন্তু’ আবার জানতে চাইলেন।
তার কাছে শুতে আসার আগে আমার ঘুমের কস্টিউম খুলে টিশার্ট-প্যান্ট পরে নিয়েছি যাতে ঘুমন্ত আমাকে অভব্য দেখা না যায়।
শুভ রাত্রি বলে ঘুমালাম।
কিন্তু আমার মনের ভেতর কু, কুপ পাখি ডাকে, চোখ বুজলেই মনে হয়, দেবেশ রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বুঝি; উপরন্তু ঝিমুনির মধ্যে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। মা যেমন তার ঘুমন্ত নবজাতককে বারবার স্পর্শ করে দেখেন, আমিও তেমনি তাকিয়ে দেখি দেবেশ রায় ঠিকঠাক আছেন কিনা। এভাবে বারবার দেখতে গিয়ে তার সঙ্গে চোখাচোখি। আমি এমন ভান করি যেন বেঘোর ঘুমের মধ্যে আছি।
সারারাত দেবেশ রায় ঘুমালেন না, কী করছেন তাও বুঝতে পারছি না, আমিও ঘুমাতে পারছি না। শেষ রাতে আমি হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছি, জলের মিনার ঠেলে জেগে দেখি তিনি ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসে কিছু একটা পড়ছেন। আঁচড়ানো চুলের সৌম্য মুখখানা দেখে মনে হলো, যাক কালোরাত্রি শেষ হলো।
কিন্তু জীবনে কালোরাত্রি শেষ হয় না।
আজ থেকে ঠিক দুবছর আগে, গৌতম গুহ রায় মেসেঞ্জারে একটি ছবি পাঠালেন, মধ্যরাতে, দেবেশ রায় ফুলশয্যার বিছানায় শুয়ে আছেন, চোখে চশমা, ঘুমন্ত শিশুর মতো নিশ্চিন্ত; যাচ্ছেন শ্মশান উদ্বোধনে।