সাহিত্য ও সংগীতের সম্পর্ক

সংগীত ও সাহিত্যের সম্পর্ক আবহমানকাল থেকেই ঘনিষ্ঠ। সংগীত ও সাহিত্য দুটি মাধ্যমই মানুষের মনের ভাবকে প্রকাশ করে। প্রাচীন কালের যত সাহিত্য আমরা দেখি তার সবগুলো আসলে লেখা হত গাওয়ার জন্য, যার ফলে সাহিত্যের প্রাচীনতম রূপ হচ্ছে কবিতা। কবিতা ও সংগীতের মধ্যে তাই খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কাল পরিবর্তনের সাথে সাথে এই সম্পর্ক আরো দূরবর্তী হয়েছে এবং সংগীত আসলে বিভিন্ন কিছুকে নিজের মধ্যে প্রবেশ করিয়েছে, তেমনি সাহিত্যের নানা শাখা, উপশাখা সৃষ্টি হয়েছে। সংগীতের সাথে বাদ্যযন্ত্রের সম্পর্ক রয়েছে, সংগীতে শুধু কথাই মুখ্য নয়, বরং সুরের মাধ্যমেই সংগীত রচনা করা যায়। সংস্কৃত ভাষার বিভিন্ন বই থেকে যে সংজ্ঞাটি পাওয়া যায় তাহলে, “গীতং বাদ্যং তথা নৃত্যং ত্রয়ং সঙ্গীতমুচ্যতে” অর্থাৎ গীত, বাদ্য ও নৃত্য— এই তিনটিকে একত্রে সংগীত বলে। অপরদিকে, লেখক ভাষার মায়াজাল বিস্তারের মাধ্যমে সহৃদয়, হৃদয় সংবেদী পাঠকের সঙ্গে লেখক বা সাহিত্যে বর্ণিত নর-নারীর সুখ-দুঃখময় জীবনের সঙ্গে মিলন ঘটিয়ে থাকেন বলে ‘সাহিত্য’-এর অনুরূপ নামকরণ হয়েছে। সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন— “অন্তরের জিনিসকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষার, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের ও ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলাই সাহিত্যের কাজ।”

সংগীত মনোভাব প্রকাশের শ্রেষ্ঠতম উপায়। আমরা যখন কবিতা পাঠ করি তখন সেখানে অঙ্গহীনতা থেকে যায়; সংগীত আর কিছু নয়—সর্বোৎকৃষ্ট উপায়ে কবিতা পাঠ করা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, “গায়েকরা সংগীতকে যে আসন দেন, আমি সংগীতকে তারচেয়ে উপরে আসন দিই; তারা সংগীতকে কতগুলো চেতনাহীন জড় সুরের উপর স্থাপন করেন, আমি তাদেরকে জীবন্ত অমর ভাবের উপর স্থাপন করি। তারা গানের কথার উপরে সুরকে দাঁড় করাতে চান, আমি গানের কথাগুলিকে সুরের উপরে দাঁড় করাতে চাই। তারা কথা বসিয়ে যান সুর বাহির করার জন্য, আমি সুর বসিয়ে যাই কথা বাহির করার জন্য।”

বর্তমান সময়ে এসে সাহিত্য, সংগীতসহ আরো বিভিন্ন শিল্পের যে ভিন্ন ভিন্ন শাখাপ্রশাখা বের হচ্ছে তাতে করে কোনো শিল্প সম্পর্কেই একক কোনো মন্তব্যে আসা যাচ্ছে না, কারণ যে শিল্প আমাদের কাছে আজকে এক ধরনের আবেদন নিয়ে আসছে পরক্ষণে তা পাল্টে যাচ্ছে। যার ফলে একই শিল্পে বহুস্বরতা আমাদের কাছে ধরা দিচ্ছে।

মনের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষা আসলেই খুব দুর্বল, ভাষার পক্ষে মনের সব ভাবগুলো প্রকাশ করা সম্ভব নয়; আর সংগীত আসলে এ জায়গাতেই কাজ করে। ভাষা বা সাহিত্যের মতো সংগীত আরেকটা ভাষা যা সুর ও কথার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে। আবার শুধু সুরের সাহায্যেই ভাবকে প্রকাশ করা যায়।

সংগীত হচ্ছে হৃদয়ের সাহিত্য, ভাষা যেখানে শেষ হয়, সংগীত সেখান থেকে শুরু হয়। গান ও কবিতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন— “গানের কবিতা, সাধারণ কবিতাকে কেউ যেন একইভাবে বিশ্লেষণ না করেন। সাধারণ কবিতা পড়ার জন্য ও সংগীতের কবিতা শোনার জন্য। অতএব গানের কবিতা পড়ে বিচার না করাই উচিত খুব ভালো কবিতাও গানের পক্ষে হয়ত খারাপ হতে পারে এবং খুব ভালো গানও হয়ত পড়ার পক্ষে ভালো না হইতে পারে।”

সংগীত এবং সাহিত্যের মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হলেও এই সম্পর্ক অনেক বেশি ঘোলাটে। কবিতা ও গানের সংযোগ সূত্রটি চিরন্তন। কবিতা যেখানে শেষ, সেখানে গানের শুরু— এমনটাই বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অর্থাৎ কবিতার সম্প্রসারিত ছন্দেবদ্ধে অনেকাংশে নিহিত থাকে গানের তাল-ছন্দ-লয়-এর ত্রিকৌণিক মাধুর্য।

সংগীতের মতো সাহিত্যেরও বিভিন্ন ধরণ রয়েছে। কাল পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের চাহিদা যেমন পরিবর্তন হয়, তেমনি সংগীত, সাহিত্য বা শিল্পেরও নতুন নতুন ধরণ তৈরি হয়।

জে জি ব্রেইনর্ড বলেছেন— সংগীত হচ্ছে শাশ্বত ভাষা, যার আবেদন দেশ, কাল, পাত্রভেদে অভিন্ন। সাহিত্যকে যেমন বুঝতে হলে আমাদেরকে অনুবাদের সহায়তা নিতে হয়, সংগীতের ক্ষেত্রে আসলে এরকম হয় না, সংগীত আসলে নিজেই একটি ভাষা, যা সার্বজনীন। সব কালের মানুষের কাছে বা সকল ভাষার মানুষের কাছে তা একই রূপে ধরা দেয়।

সাহিত্য ও সংগীতের সম্পর্ক এক বিশাল ধাঁধা । সাহিত্য যেহেতু ভাষায় লেখা থাকে তাই এর অর্থ উদ্ধার সম্ভব হলেও সংগীতের ক্ষেত্রে তা সম্ভব না। সংগীতকে আসলে শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব না। আসলে সংগীতই জীবন আর সাহিত্য হলো জীবনের কিছু মুহূর্তকে তুলে ধরার কৌশল।