X
সোমবার, ০৯ জুন ২০২৫
২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

অনুভবের কথাই লিখতে চেষ্টা করেছি : সাম্য রাইয়ান

সাহিত্য ডেস্ক
০৯ জুন ২০২৫, ০০:০০আপডেট : ০৯ জুন ২০২৫, ০০:০০

সাহিত্য বিভাগের নির্ধারিত প্রশ্নে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কবি ও সম্পাদক সাম্য রাইয়ান। তার জন্ম ৩০ ডিসেম্বর, কুড়িগ্রাম জেলায়। ২০০৬ সাল থেকে সম্পাদনা করছেন শিল্প-সাহিত্যের লিটল ম্যাগাজিন ‘বিন্দু’। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ: লিখিত রাত্রি (২০২২), হালকা রোদের দুপুর (২০২৩) এবং জলের অপেরা (২০২৪)৷ সম্পাদিত গ্রন্থ: উৎপলকুমার বসু (নির্বাচিত রচনা ও পর্যালোচনা, ২০২২), জন্মশতবর্ষে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (পর্যালোচনামূলক প্রবন্ধ সংকলন, ২০২৩)।

বাংলা ট্রিবিউন: কোন বিষয় বা অনুভূতি আপনাকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করে?

সাম্য রাইয়ান: যা কিছু আমাকে চিন্তিত করে, যা আমি ভাবি—অনুভব করি, তারই নির্যাস কবিতা৷ আমার জীবন—সামগ্রিক অর্থে যাপন (দর্শন) ও তার সাথে সম্পর্কিত সবকিছু নিয়ে আমার কবিতাযাত্রা৷

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি কী ধরনের থিম বা বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

সাম্য রাইয়ান: সাধারণত আমি মানব মনের বৈচিত্র্যময় অনুরণন লিখতে পছন্দ করি৷ সেই অর্থে বলা যায় প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশই আমার লেখার বিষয়৷ এখন অব্দি এর বাইরে কিছু লিখতে পারিনি৷

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি তাৎক্ষণিক অনুপ্রেরণায় লেখেন, নাকি ধীরে ধীরে শব্দ সাজান?

সাম্য রাইয়ান:
যখন আমি আইডিয়া পাই তাৎক্ষণিক চিন্তায় অনুপ্রাণিত হই, কিন্তু কবিতার অবয়বে তা ধীরে ধীরে রূপ পায়৷ আমি হয়ত একটা শব্দকে কেন্দ্র করে ভাবতে শুরু করলাম, ঐটা সেন্টার পয়েন্ট; যাকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ পরিসর গড়ে ওঠে৷ আর তারপর আমি তাকে বারংবার সংস্কার করি, যাতে করে তা আমার কল্পনা ও অনুভূতির আরো কাছাকাছি পৌঁছতে পারে৷ এমন কবিতা আছে যা আমি এক বসায় লিখে ফেলেছি, পরে টুকটাক এডিটিং করেছি—খুবই সামান্য; যেমন: 'তীব্র কুড়িগ্রাম', 'হাসতে হাসতে মরে যাব', 'স্বাধীনতা লাগবে'—এরকম আরো আছে৷ অপরদিকে অনেক কবিতা আছে যা আমি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সময় নিয়ে লিখেছি৷ যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ‘জীবনপুরাণ’-এর কথা, যা এক বছর সময় লেগেছিল লিখতে৷ আবার ধরুন, ‘গভীর স্বপ্নের ভেতর’, ‘বেধিদ্রুম’ বা ‘উড়ন্ত কফিন’ এই কবিতাগুলো লিখতেও এক বছরের কাছাকাছি সময় লেগেছিল৷ ফলে আইডিয়া তাৎক্ষণিক হলেও লিখতে আমার অনেক সময় লাগে৷ সে ধীরে ধীরে তৈরি হয়৷

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার কবিতার ভাষা ও শৈলী কীভাবে বেছে নেন?

সাম্য রাইয়ান:
সেটা নির্ভর করে আমি কী নিয়ে লিখছি তার উপর৷ আমি যা চিন্তা করি, যেভাবে অনুভব করি তা প্রকাশের জন্য যেকোনো পদ্ধতি গ্রহণ করতে আমি প্রস্তুত৷ তথাপি আমি চেষ্টা করি এক আনকোরা ভঙ্গিমার, যা সহজ কিন্তু গভীর৷

কবিতার ফর্ম, তার শরীরে ছন্দ, অলংকার—এই সকলই চলে আসে কবিতার প্রয়োজনে। ফর্মটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি এমন কোনো ফর্মে লিখতে চাই না যা চর্বিতচর্বণ। নতুন চিন্তা, যা আমি প্রকাশ করি, প্রচার করি; তা নতুন ফর্মেই প্রকাশ করতে পছন্দ করি।

তাছাড়া প্রতিটি পাণ্ডুলিপিতে আমি একই ফর্মে প্রকাশিত হতে পছন্দ করি না৷ ভিন্ন ভিন্ন বইয়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশিত হওয়া আমাকে নতুন ধরনের আনন্দ দেয়৷ ফলে ‘চোখের ভেতরে হামিং বার্ড’ কিংবা ‘লিখিত রাত্রি’ কিংবা ‘হালকা রোদের দুপুর’ কিংবা ‘জলের অপেরা’ কোনোটিরই ভাষা ও শৈলী এক নয়৷ কোনো এক ফর্মে ফিক্সড না হয়ে আমি বরং খুঁজে চলেছি এক অন্যতর ভাষা ও শৈলীকে…৷ বলতে পারেন, এ এক আনকোরা প্রেমের দিকে অন্তহীন যাত্রা৷

বাংলা ট্রিবিউন: কোন কোন কবির প্রভাব আপনার লেখায় আছে?

সাম্য রাইয়ান:
নির্দিষ্ট করে ওভাবে বলতে পারবো না৷ তবে সাধারণভাবে, যে সকল কবির কবিতা আমি পড়েছি, ভালো বা মন্দ লেগেছে তার সবই কোনো না কোনোভাবে আমাকে প্রভাবিত করেছে৷

বাংলা ট্রিবিউন: কথাসাহিত্যের চর্চা করেন? এ চর্চা আপনার কবিতায় কতটুকু প্রভাব রাখে?

সাম্য রাইয়ান:
আমার একমাত্র প্রকাশিত উপন্যাস— ‘সকল প্রশংসা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের’৷ আরো কয়েকটি ফিকশন লিখবার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের; যেমন— ‘2.0 : সকল প্রশংসা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের’, ‘মিথ্যার মিউজিয়াম’, ‘মৌন’, ‘ঢাকার ওভারব্রিজে একটি গরু’, ‘এফ মাইনর’, ‘কেয়ারলেস ওম্যান’ আরো বেশ কয়েকটি৷ কবিতা আর কথাসাহিত্যের ভাষা-শৈলীতে অনেক মিল থাকলেও দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ক্ষেত্র ভাবতেই আমি স্বচ্ছন্দ বোধ করি৷ কখনো কোথাও গিয়ে সব মিলিত হয়ে যাচ্ছে বটে, তবুও অমিলের জায়গাটি খুবই দৃশ্যমান৷ আমি যখন প্রথমবার ফিকশন লিখতে শুরু করলাম, তখন আমি এক নতুন জগৎ আবিষ্কার করেছিলাম৷ সেই উপলব্ধি সম্পূর্ণ অন্যরকম৷ আমার মনে হলো— উপন্যাস আমাকে অনেক বেশি স্বাধীনতা দিচ্ছে, অনেক বেশি উন্মুক্ত করে দিচ্ছে৷ সম্পূর্ণ আবরণমুক্তভাবে পাঠকের সামনে দাঁড় করাচ্ছে৷ ব্যাপারটা আতঙ্কেরও! এতে আমি ভীত সন্ত্রস্ত হলাম৷ কিন্তু তার প্রেমে পড়ে গেলাম৷ মনে হলো আরো লেখা উচিৎ।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার প্রথম কবিতার বই সম্পর্কে কিছু বলুন। প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি কেমন ছিল?

সাম্য রাইয়ান:
প্রথম বইটা (চোখের ভেতরে হামিং বার্ড, ২০২০) প্রকাশের আগে আমি প্রায় এক যুগ সিরিয়াসলি লেখালেখি করেছি৷ আমি যেহেতু কনসেপচুয়ালি পাণ্ডুলিপি গোছাই, ফলে একই সাথে আমার কয়েকটি কবিতার পাণ্ডুলিপি তৈরি হচ্ছিল সেসময়, ‘চোখের ভেতরে হামিংবার্ড’ (২০২০), ‘লিখিত রাত্রি’ (২০২২), ‘জলের অপেরা’ (২০২৪)৷ প্রথম কবিতার বইটা প্রকাশের আগে প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে এক/দুই ফর্মার চারটা পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলাম, তিনটা কবিতা ও একটা গদ্যের৷ তবে প্রথম কবিতাপুস্তিকা প্রকাশের ঘটনাটা একটু বিব্রতকর৷ এক ছোট প্রকাশকের বারংবার অনুরোধে ২০১৪-তে প্রথম পুস্তিকা প্রকাশের পরিকল্পনা করি৷ কিন্তু পাণ্ডুলিপি জমা দেবার পর জানুয়ারির শুরুর দিকে তিনি আমাকে জানালেন— এটি প্রকাশ করা সম্ভব না, কারণ লিটলম্যাগ অঙ্গনের অনেকে আমাকে পছন্দ করছে না, তীব্র বিরোধিতা করছে৷ এরপর, যেহেতু পাণ্ডুলিপিটা গোছানো ছিল আর ঘোষণা দিয়ে ফেলেছিলাম ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশের, ফলে পিছিয়ে আসতেও ইচ্ছে করছিল না৷ আর কোনো প্রকাশকের কাছে গিয়ে আলাপ করারও আমার কখনো আগ্রহ ছিল না, ফলে শেষমেশ নিজেই ছেপে ফেললাম৷ এভাবে চারটা পুস্তিকা আমি নিজেই ছেপেছি৷ তারপর তো বাংলাবাজারের ঘাসফুল প্রকাশনী ২০২০ থেকে ছাপাছাপির দায়িত্ব নিয়ে আমাকে নির্ভার করল৷ সেই থেকে এখন অবধি আমার সব বইপুস্তক ওরাই ছাপছে৷

বাংলা ট্রিবিউন: সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ঘটনা কি আপনার কবিতায় প্রভাব ফেলে? যদি ফেলে, তবে কীভাবে তা প্রকাশিত হয়?

সাম্য রাইয়ান:
সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ঘটনা—তা আমার মননে যে আলোড়ন তৈরি করে তার অন্তিম নির্যাস কবিতায় প্রকাশ করতে চেষ্টা করি৷ খোলা চোখে যা দেখি তা নিয়ে কম লিখলেও, বন্ধ চোখে যা দেখি মূলত তা নিয়েই আমার কবিতার সংসার৷ ক্ষণস্থায়ী কোনো বিষয়ে কবিতা বোধহয় আমি লিখিনি৷ সেই অনুভবের কথাই লিখতে চেষ্টা করেছি, যার মূল সুর আসলে কোনো এক বিন্দুতে গিয়ে মিলিত হয়েছে কালের পরিক্রমায়—পরিবর্তিত নৃতাত্ত্বিক বাস্তবতায়ও৷

বাংলা ট্রিবিউন: পাঠকদের মন্তব্য আপনার লেখায় কোনো পরিবর্তন আনে?

সাম্য রাইয়ান:
পাঠকদের মন্তব্য আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি৷ তাদের সমালোচনা থেকে আমি নিজের ত্রুটি চিহ্নিত করতে চাই৷ কিন্তু সেইরকম মন্তব্য পাই না বললেই চলে৷ ফলে পরিবর্তনেরও সুযোগ নাই৷ এদেশে লেখালেখি নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা হওয়া দরকার, তার গণতান্ত্রিক পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি৷ বাকস্বাধীনতা নাই তো৷ ফলে সমালোচনা সাহিত্য গড়ে ওঠেনি৷ রবীন্দ্র আমলে বা তিরিশের কথাও যদি বলি, যে-রকম সমালোচনা করা হতো লেখা ও লেখকের, তা যদি এখন কেউ করে তাহলে নিশ্চিত গোলাগুলি লেগে যাবে৷ এদেশের তথাকথিত লেখকদের যে অবস্থা এখন, তা দেখে সামান্য সমালোচনার সাহসও কোনো পাঠক রাখেন না৷ ফলে পাঠকের মন্তব্য শোনার সুযোগ দিন দিন কমে আসছে৷

বাংলা ট্রিবিউন: ভবিষ্যতে কী ধরনের কবিতা লিখতে চান? নতুন কোনো ধারা বা শৈলীতে কাজ করার ইচ্ছা আছে কি?

সাম্য রাইয়ান:
কবিতায় আমার একটা অন্যরূপ-রূপান্তর প্রয়োজন৷ সেই সময়টা দিচ্ছি নিজেকে৷ ফলে আগামী চার-পাঁচ বছর কবিতার বই প্রকাশের পরিকল্পনা নেই৷ বিশেষ প্রয়োজনে পুস্তিকা হতে পারে, আবার! সাম্প্রতিক সময়ে কথাসাহিত্য আমার ভাবনার বিষয়৷ তাছাড়া গত পনেরো বছরে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রসঙ্গে আমার প্রবন্ধ-নিবন্ধ-চিৎকারের এক সংকলন প্রস্তুত করছি— ‘নীরবতা ভেঙে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসুক সশস্ত্র পিঁপড়ে’৷

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইতিহাস গড়ে লাল দুর্গের রাজত্ব ধরে রাখলেন আলকারেজ
ইতিহাস গড়ে লাল দুর্গের রাজত্ব ধরে রাখলেন আলকারেজ
ঈদের তৃতীয় দিন টিভি পর্দায় যত নাটক
ঈদের তৃতীয় দিন টিভি পর্দায় যত নাটক
সাবেক সংবাদ উপস্থাপক তরীর অস্বাভাবিক মৃত্যু
সাবেক সংবাদ উপস্থাপক তরীর অস্বাভাবিক মৃত্যু
অনুভবের কথাই লিখতে চেষ্টা করেছি : সাম্য রাইয়ান
অনুভবের কথাই লিখতে চেষ্টা করেছি : সাম্য রাইয়ান
সর্বাধিক পঠিত
এবার ৪৪ জন আমলাকে অপসারণের দাবিতে পোস্টার
এবার ৪৪ জন আমলাকে অপসারণের দাবিতে পোস্টার
লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করতে চান টিউলিপ সিদ্দিক
লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করতে চান টিউলিপ সিদ্দিক
মহিলা লীগ নেত্রীর কোরবানির মাংস ‘ভিক্ষা করার’ ভিডিও ভাইরাল
মহিলা লীগ নেত্রীর কোরবানির মাংস ‘ভিক্ষা করার’ ভিডিও ভাইরাল
সাবেক সংবাদ উপস্থাপক তরীর অস্বাভাবিক মৃত্যু
সাবেক সংবাদ উপস্থাপক তরীর অস্বাভাবিক মৃত্যু
রোগীর সেলাই-ড্রেসিং করা সেই ওয়ার্ডবয় গ্রেফতার
রোগীর সেলাই-ড্রেসিং করা সেই ওয়ার্ডবয় গ্রেফতার