'রূপসী বাংলা' কাব্যগ্রন্থে 'ইকোপোয়েট্রি'

ইকোপোয়েট্রি হচ্ছে পরিবেশ-সচেতন বিষয়ক কবিতা। সাম্প্রতিক ধারণা এটি। কবিতা ও বহিঃপ্রকৃতির মধ্যে যোগসূত্র বা সম্পর্কস্থাপন করে সজাগ করা। শিল্পায়ন ও বিভিন্ন দূষণের চরম এ সময়ে ইকোপোয়েট্রি কার্যকরী একটি দিক। প্রকৃতি, প্রেম, নারী, নস্টালজিয়া, জল, আকাশ ইত্যাদি নিয়ে এ কবিতা নির্মিত হয়। আমেরিকায় ১৯৮০ সালে এবং ইংল্যান্ডে ১৯৯০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এ কবিতার যাত্রা শুরু হয়। তবে, ওয়ার্ডসওয়ার্থ-জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ অনেক আগেই এমন কবিতা লিখেছেন। এ যুগের ‘পরিবেশ বাঁচাও’ আন্দোলন যেন জীবনানন্দের কবিতার প্রতিচ্ছবি। বিশেষ করে ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের সনেটগুলো (৬১টি) প্রধান সাক্ষী হিসাবে বিবেচিত হবে। জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা হচ্ছে জলরাশি, পাখপাখালি আর সবুজ বৃক্ষরাজিতে ভরপুর। এসব গন্ধ, দৃশ্য ও শ্রবণে বাংলার হৃৎস্পন্দনের সুর মিশে গেছে। জীবনানন্দ দাশ আমাদের কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করে, শানিত করে। সবুজের প্রতি প্রলুব্ধ করার রসদ পাই তার কবিতায়।

কবি জীবনানন্দ দাশ সবুজ পৃথিবীর জয়গান গেয়েছেন। ‘মরা নদী’ দেখে তিনি শঙ্কিত হয়েছেন। হরিণ শিকারে বসন্তের দখিনা বাতাসেও ঘুম আসে না তার। ফলে, বলতে পারেন তিনি, ‘তোমার যেখানে সাধ চ'লে যাও—আমি এই বাংলার পারে র'য়ে যাব' তার অস্তিত্বকে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে প্রোথিত করেছেন। তার এ সংকল্প, আকাঙ্ক্ষা প্রকৃতি ও প্রতিবেশের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছেন। কোমল ধান, কলমি, হেলেঞ্চা, শরপুটি মাছ, ধানগাছ, পচা পাট, ঘাস, পেঁচা, কদম বন, আকন্দ ও বাসক পাতা, সোনালি মাঠ, শিশির, খালবিল, কামরাঙা ফল, শালিক, কীর্তনখোলা-ধানিসিড়ি-জলসিঁড়ি নদী, প্রকৃতি ও বাস্তুসংস্থানগত উপদান দেখি। ইকো-লজিক্যালের প্রখর গন্ধ ও স্বাদ পাই তার কবিতায়। বলা যায়, রূপসী বাংলার কবিতায় ইকো-সেন্সকে গভীর ও শক্তিশালী হয়েছে। বিভিন্ন প্রাণী, গাছাপালা ও জল-আকাশ চিরন্তন বাংলার প্রতিনিধিত্ব করে সৌন্দর্যকে জোরালো করেছে। বলা যায়, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রাণীবিদ্যার সক্রিয় অংশ হতে পারে তার কবিতা।

স্থানীয় ফলমূল-পাখি-বৃক্ষরাজির সঙ্গে জলরাশি, আকাশ-বাতাস নিয়েই চমৎকার সব বাস্তুসংস্থান-চিত্র এঁকেছেন। তার কল্পনার বাড়ি ঠিক এক-একটি বাস্তুসংস্থান। বাস্তুসংস্থানের সর্বস্তরে তিনি থাকতে চেয়েছেন। 'কোনো শৃঙ্খল যাতে ভেঙে না যায়' তার চাওয়া সেটাই। বারবার সৃষ্টি হোক সবস্তরের খাদক। চক্রভেদ করার দরকার নেই। প্রকৃতিই নিয়ন্ত্রণ করুক এ চক্র। এসব তিনি মনেপ্রাণে খুব চেয়েছেন। রূপসী বাংলার কবিতা জুড়ে তার আকুতি আমরা জোরালোভাবে দেখতে পাই। তিনি বাস্তুসংস্থানের সবক্ষেত্রে বিচরণ করতে চান। সাম্প্রতিক ইকোভিলেজ-এর ধারণা তার কবিতায় লক্ষ করেছি। রবার্ট গিলমাল ১৯৯১ সালের দিকে ইকো-ভিলেজ ধারণা সৃষ্টি করেন। যেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ছোট-ছোট সম্প্রদায়ে বিভাজিত হয়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক স্থায়িত্ব লাভ করবে। ইকোভিলেজ সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ করবে। জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির মধ্যে স্বাধীন সত্তার অস্তিত্ব পরোক্ষ করেছেন। ‘বিকালে বাতাসে ধানের গন্ধ’, ‘বটফলগন্ধ-মাখা ঘাস’ ও ‘সোনালি রোদ’ প্রেমের মতো লাগে বলে প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে রেখে দিয়েছেন। বাদুড়, অপরাজিতা, ঝিঁঝি, অশ্বত্থ, বট, দাঁড়কাক, শালিধান, শালিক, বিভিন্ন নদী-বিল-জল, কুকুর, বিড়াল, ঘাস, বোলতা, চালতা, হিজল, পুকুরের জল, শঙখচিল, কুয়াশা, শঙখ, অঘ্রান, হেমন্ত, শীত, গাংচিল, বাঙালি নারী-প্রেমিকা, জোনাকি, ফেনসা ভাত, আমমুকুলের গন্ধ, জামরুল, শুপরী, হাঁস, ফড়িং, কাশ, বাসমতী, শাদা মেঘ, নীল আকাশ, মরা নদী, চর, নদীর স্রোত, পাহাড়, কাক, খেত, ধান, গুবরে পোকা, ধূসর সন্ধ্যা, পেঁচা, স্থানীয় বিভিন্ন ফুল-ফল,  ফিঙে, মউমাছি, খোঁপা, বউকথাকউ পাখি, পানের বাটা, থোড়, কাঁচপোকা, কল্কাপাড় আঁচল, বিনুনি, মউরীর গন্ধ, ক্ষীর, বেজি, নাটাফল, লিচুর পাতা, আনারসী শাড়ি, কড়ির মালা, ঝাউগাছ, লক্ষ্ম‌ীপেঁচা, ইঁদুর, কাঁঠাল পাতা, করমচাপল্লব, বাঁকা চাঁদ, খড়ের চাল, বাদুড়, শ্যামাপোকার দল, সাপমাসী, চাল-ধোয়া গন্ধ, জ্যোৎস্না, চালতা, গাভী, গাজন খেলা/গান, কার্তিকের বিভিন্ন রূপ, চড়ুই, দেউল, খিলান, নোনাফল, আতাবন, চিল, ঘুঘু ইত্যাদি প্রাত্যহিক রূপসী বাংলার উপাদানের পুনরাবৃত্তি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় লক্ষ করা যায়। এসব উপাদান তো প্রকৃতির, এসব তো রূপসী বাংলার নিজস্ব বিষয়াদি। প্রকৃতির এসব বিষয়াদি নিয়েই গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র বাস্তুসংস্থান, ইকো-ভিলেজ (আর্থ-সাংস্কৃতিক বন্ধন), এবং ‘পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন’—সহ প্রাকৃতিক বিভিন্ন ইতিবাচক ধারণা।

জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির বিভিন্ন অংশ পর্যবেক্ষণ করেছেন। পর্যবেক্ষণ-পরবর্তী কবিতায় প্রয়োগ করেছেন। প্রয়োগের যথার্থতা প্রায় নিখুঁত। উপমা-চিত্রকল্প বাস্তবতার খুবই কাছাকাছি। কবিতার উপমা-অলংকার পাঠ করলে এ সত্যতা আমরা দেখতে পারব। তার ষষ্ঠইন্দ্রীয় যথার্থ কাজ করেছে। ভুল করেছে খুব কম। তার কল্পনার মস্তিষ্ক সেকোনো সফটওয়্যার থেকেও শক্তিশালী ও নিখুঁত। চাকুরি ছেড়ে ও মানসিক যন্ত্রণার সময় প্রকৃতির কাছেই তিনি হাত পেতেছেন। প্রকৃতি তাকে সবকিছু দিতে চেয়েছে। কৃত্রিমতা তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। কিছু কবিতাংশ উল্লেখ করলে প্রকৃতি রূপসী বাংলার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও টান তার সপক্ষে বক্তব্য স্পষ্ট করা যাবে।

১.
‘আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে
ব'সে থাকি; কামরাঙা—লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো
...পৃথিবীর কোন পথে: নরম ধানের গন্ধ--কলমীর ঘ্রাণ,
হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা সরপুঁটিদের
মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর চাল-ধোয়া ভিজে হাত—শীত হাতখান,
ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা—এরি মাঝে বাংলার প্রাণ:
আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের।‘

আকাশে সাতটি তাঁরা/রূপসী বাংলা

২.
‘যতদিন বেঁচে আছি আকাশ চলিয়া গেছে কোথায় আকাশে
অপরাজিতার মতো নীল হয়ে...
...ধানসিড়িটির সাথে বাংলার শ্মশানের দিকে যাব ব'য়ে
সেইখানে এলোচুলে রামপ্রসাদের সেই শ্যামা আজো আসে,
সেইখানে কল্কাপেড়ে শাড়ি প'রে কোন এক সুন্দরীর শব
চন্দন চিতায় চড়ে’

যতদিন বেঁচে আছি/রূপসী বাংলা

৩.
‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে—এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়—হয়তো বা শঙখচিল শালিকের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’

আবার আসিব ফিরে/রূপসী বাংলা

৪.
‘এখানে ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্ণে শান্তি আসে মানুষের মনে
এখানে সবুজ শাখা আঁকাবাঁকা হলুদ পাখিরে রাখে ঢেকে’

এখানে ঘুঘুর ডাকে/রূপসী বাংলা

৫.
‘ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে
শিয়রে বৈশাখ মেঘ—শাদা যেন কড়ি-শঙ্খের পাহাড়
নদীর ওপার থেকে চেয়ে রবে—কোনো এক শঙ্খবালিকার
ধূসর রূপের কথা মনে হবে’

ঘুমায়ে পড়িব আমি/রূপসী বাংলা

৬.
‘পাড়াগাঁর দু'প্রহর ভালোবাসি—রৌদ্রে যেন গন্ধ লেগে আছে
স্বপনের; —কোন গল্প, কি কাহিনী, কি স্বপ্ন বাঁধিয়াছে ঘর
আমার হৃদয়ে, আহা, কেউ তাহা জানে নাকো—কেবল প্রান্তর
জানে তাহা,’

পাড়াগাঁর দু'প্রহর/রূপসী বাংলা

৭.
‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর:‘

বাংলার মুখ আমি/রূপসী বাংলা

প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত কবিকে কষ্টের কারণ হয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে তার সংযুক্তির বন্ধন ও ঘনিষ্ঠতা খুবই শক্তিশালী ও উষ্ণ। তিনি প্রকৃতি ও তার উপাদানগুলো৷ ভালোবাসা-স্নেহ-সচেতনতার মাধ্যমে সযত্নে লালন করতে পছন্দ করতেন। মানুষও তার এ সংকল্প বাস্তবায়ন করুন, তিনি তাও আশা করতেন। পরিবেশ ধ্বংসকারী মানুষকে তিনি অসুস্থ ভাবতেন। তাদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি তাদের দলে নিজেকে সোপর্দ করতে চাননি। তার জগৎ শতভাগ প্রকৃতিনির্ভর। হরিণ হত্যার জন্য 'দোনলার শব্দ' বসন্তের দখিনা বাতাসেও কবি জীবনানন্দ দাশকে ঘুমাতে দেয় না।

'এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি;
সারারাত দখিনা বাতাসে
আকাশের চাঁদের আলোয়
এক ঘাইহরিণীর ডাক শুনি—
কাহারে সে ডাকে!
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;
...ঘুম আর আসে নাকো
বসন্তের রাতে।
...শুয়ে শুয়ে থেকে
বন্দুকের শব্দ শুনি
...দোনলার শব্দ শুনি’

ক্যাম্পে

ব্যাবিলন ও এশিরিয়া সভ্যতা যেমন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, কিন্তু তাদের গল্প এখনো আমরা করি। জীবনানন্দ দাশও কবিতার মাধ্যমে বংশপরম্পরায় সবুজ বাংলার সাক্ষ্য রেখে যেতে চান। প্রকৃতির মধ্যে সৌহার্দ্য ও সৌন্দর্যে তিনি মুগ্ধ। এ আকাঙ্ক্ষা ও সংকল্প তিনি রেখে যেতে চান।

‘চারিদিকে শান্ত বাতি—ভিজে গন্ধ—মৃদু কলরব;
খেয়ানৌকাগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;
পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে র'বে চিরকাল;—
এশিরিয়া ধুলো আজ—বেবিলন ছাই হয়ে আছে।‘

সেই দিন এই মাঠে/রূপসী বাংলা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের অনেক ক্ষতি তিনি লক্ষ করেছেন এবং মর্মাহত হয়েছে। শিল্পায়নের যাত্রা তিনি দেখেছেন। প্রকৃতিকে গ্রাস করার কষ্ট তাকে ব্যথিত করেছে। 'সবুজ বাঁচাও' আন্দোলন জীবনানন্দ দাশ কবিতার মাধ্যমেই শুরু করেছেন। প্রকৃতিকে তিনি নারীরূপে কিংবা অস্তিত্বরূপে বিচার করেছেন। পরিবেশের উপাদানগুলোকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করতে চেয়েছেন। প্রকৃতি ও স্বাভাবিক পরিবেশ কবিতায় বিরাজমান। ফলে, তার কবিতা ক্রমশ পাঠকপ্রিয় হচ্ছে। তাইতো তিনি অনায়াসেই বলতে পারেন,

‘তোমার যেখানে সাধ চ'লে যাও—আমি এই বাংলার পারে
র'য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;
...হারাব না তারে আমি—সে যে আছে আমার এ বাংলার তীরে।‘

তোমার যেখানে সাধ/রূপসী বাংলা