সহিংসতার বিরুদ্ধে একমাত্র অস্ত্র হচ্ছে প্রেম

[কবি জফির সেতুর সুবর্ণজয়ন্তী আজ । তাঁর জন্ম ২১ ডিসেম্বর, ১৯৭১; সিলেট। বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর [চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]। পিএইচডি, সমাজভাষাবিজ্ঞান [জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]। পেশা : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। প্রকাশিত বই : কবিতা— বহুবর্ণ রক্তবীজ (২০০৪); শুদ্ধস্বর, ঢাকা সহস্র ভোল্টের বাঘ (২০০৬); শুদ্ধস্বর, ঢাকা স্যানাটোরিয়াম (২০০৮); শুদ্ধস্বর, ঢাকা তাঁবুর নিচে দূতাবাস (২০১১); শুদ্ধস্বর, ঢাকা সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী (২০১২); শুদ্ধস্বর, ঢাকা জাতক ও দণ্ডকারণ্য (২০১৩); শুদ্ধস্বর, ঢাকা সুতো দিয়ে বানানো সূর্যেরা (২০১৪); শুদ্ধস্বর, ঢাকা Turtle has no wings (২০১৪); শুদ্ধস্বর, ঢাকা ময়ূর উজানে ভাসো (২০১৪); চৈতন্য, সিলেট ডুমুরের গোপন ইশারা (২০১৪); চৈতন্য, সিলেট প্রস্তরলিখিত (২০১৫); নাগরী, সিলেট ইয়েস, ইউ ব্লাডি বাস্টার্ডস (২০১৫); ঘাস, সিলেট আবারও শবর (২০১৬); নাগরী, সিলেট এখন মৃগয়া (২০১৬); চৈতন্য, সিলেট নির্বাচিত কবিতা (২০১৮); বেহুলা বাংলা, ঢাকা উপন্যাস— হিজলের রং লাল (২০১৬); বেহুলাবাংলা, ঢাকা গল্প— বাবেলের চূড়া (২০১৩); শুদ্ধস্বর, ঢাকা প্রবন্ধ— লোকপুরাণের বিনির্মাণ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (২০০৯); শুদ্ধস্বর, ঢাকা কবিতার ইন্দ্রজাল (২০১৭); বেহুলাবাংলা, ঢাকা গবেষণাগ্রন্থ— সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের ইতিহাস! (২০১৮); নাগরী, সিলেট তাম্রশাসনে শ্রীহট্ট (২০১৯); নাগরী, সিলেট সম্পাদনা— শ্রেষ্ঠ কবিতা দিলওয়ার (২০১১); শুদ্ধস্বর, ঢাকা নন্দলাল শর্মা : ব্যক্তি ও মানস (২০১২); ঘাস, সিলেট সিলেটি বিয়ের গীত (২০১৩); শুদ্ধস্বর, ঢাকা সম্পাদিত পত্রিকা : ছোটোকাগজ : সুরমস (২০১০-) গোষ্ঠীপত্রিকা : কথাপরম্পরা (২০১১-)। এই কবির সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে কবি ও অনুবাদক লায়লা ফেরদৌসের নেওয়া সাক্ষাৎকার ও সম্প্রতি প্রকাশিত ‘আমি করচগাছ’ বই থেকে একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করা হলো। ]

 

লায়লা ফেরদৌস : পাঠক হিসেবে সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকীকে আপনার মাস্টারপিস বলে মনে করি। এ-কাব্যরচনার সময় আপনার মানসিক অবয়ব বা ভাবনার স্রোতধারা সম্পর্কে জানতে চাই।

জফির সেতু : মাস্টারপিস বলতে সেই সাহিত্যকর্মকে বোঝায় যেখানে শিল্পী তাঁর সমুদয় প্রতিভা উজাড় করে দিয়েছেন। শিল্প ও জীবননির্মাণে সর্বোচ্চ পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। সর্বোত্তম সৃজনীশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। সে-হিসেবে সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী (২০১২) এমন শিল্পসৃষ্টি কি না আমি বলতে পারি না। তবে বইটি রচনা করে আমি খুব আনন্দ পেয়েছিলাম; আবার শেষ করে ভীষণ অতৃপ্তিও রয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল কিছুই বুঝি হলো না। তবে বুঝেছিলাম এটা অন্যরকম একটি সৃষ্টি। তাই আমার প্রকাশক আহমেদেুর রশীদ টুটুলকে বললাম বইটি প্রকাশে কিছু শর্ত রয়েছে। এটি পেপার ব্যাক করতে হবে, পেঙ্গুইন প্রকাশনীর সিরিজের মতো। সেই একই মাপ, একই অবয়ব। হতে হবে বিশ্বমানের, দৃষ্টিনন্দন। টুটুল সেরকম করেওছিলেন। ধরতে গেলে এর আগের কাব্য ‘তাঁবুর নিচে দূতাবাস’ (২০১১) গ্রন্থে এসে আমি কবিতার ভাব ও ভাষায় একধরনের পরিবর্তন লক্ষ করেছিলাম। একটা জার্নি শুরু হয়েছিল পুরাপৃথিবী থেকে। সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী-তে তার একটা সূত্রও ছিল। বইটি লেখার একটা প্রেক্ষাপট আছে। আমি তখন কাশ্মির সফর করেছিলাম। জম্মু পেরিয়ে টানেলের ভেতর দিয়ে কাশ্মিরে প্রবেশ করে যে-পাইনবীথি, আকাশ, গ্লেসিয়ার, পাহাড়, উপত্যকা, ঘোটক, নারী, জাফরান বাগান, গেন্ডলা, মোগল গার্ডেন, মিনার, তাঁবু, টিউলিপ গার্ডেন, চেরি বাগান, বরফ ও রক্তপাত দেখলাম তা আমাকে ভীষণ প্রভাবিত করল। আমি সিন্ধুর জল ছুঁয়েছিলাম এক সন্ধ্যায়, আর্যরা এই নদী পেরিয়েছিল। আমি দেখেছিলাম যাযাবর অনেক নারী-পুরুষ-শিশু। আমি অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। ফিরে এসে কেন জানি আমাকে বিষণ্ন লাগছিল কদিন। হঠাৎ একদিন একটি পঙক্তি আমি মনে মনে উচ্চারণ করি। তারপর অন্য ইতিহাস। আমি একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যাই, সপ্তাহখানেকের মধ্যে লিখে ফেলি প্রায় ৮৪টি কবিতা। আমি তখন দিব্যোন্মাদ ছিলাম, এত আনন্দময় ছিল প্রত্যেকটি মুহূর্ত তখন। বানের জলের মতো কবিতারা ছুটে ছুটে আসছে, আর আমি ভ্রমণ করছি পাহাড়-উপত্যকা-মরু-পর্বত ও সমতলে। অতীত থেকে বর্তমানে, বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে। এ-এক অসাধারণ জার্নি। পুরাণ থেকে ইতিহাসে, ইতিহাস থেকে ঐতিহ্যে, স্বপ্ন থেকে রূঢ় বাস্তবতায়। আমি পেরিয়ে আসি আলতামিরা গুহা, আমি দর্শন করি বুদ্ধের মুখ, আমি দেখি সুজাতার কোমল হাত, আমি অনুভব করি যিশুর কষ্ট, আমি পান করি সক্রেটিসের হেমলক। কত শত সভ্যতায় আমার বিচরণ বিস্তৃত হয়, আমি পা রাখি সমুদ্রের ঢেউ থেকে পাহড়ের চূড়ায়। আমি জানি মানুষের জীবনটা একটা জেনেটিক জার্নি বই নয়। চেতনার দিক থেকেও। আমি তখন ঘুরে বেড়াই পাথরখণ্ড থেকে সভ্যতায় সভ্যতায়। আর আমার এই জার্নি ছিল ঘোটকী-সদৃশ এক নারীর সঙ্গে, এক ঘোটকীর সঙ্গে কিংবা এক নারীর সঙ্গে। অথবা গোটা জার্নিটাই ছিল একটা স্বপ্ন। আমার হাতে কখনো ছিল পাথরখণ্ড, কখনো বর্শা, কখনো-বা ফুলের শর। সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী-তে যে-ঘৃণা, সহিংসতা, যুদ্ধ, রক্ত ও মৃত্যু প্রবাহিত―এসবের বিরুদ্ধে আমার একমাত্র অস্ত্র হচ্ছে প্রেম বা প্রণয়। বইটি কেউ আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল ওইসময়। আমি উন্মাদ ছিলাম তখন।

 

লায়লা ফেরদৌস : কবি জফির সেতু ও মানুষ জফির সেতুর মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য কোথায়?

জফির সেতু : এই তুলনা করিনি কখনো। রবীন্দ্রনাথ একদা বলেছিলেন, ‘কবিরে পাবে না জীবনচরিতে’। এটা তো সত্যি। অনেকে আমার কবিতার সঙ্গে আমাকে মিলিয়ে দেখতে অভ্যস্ত। হয়তো সকল কবির অভিজ্ঞতাই এমন। প্রেমিক না-হয়েও একজন কবি প্রেমের কবিতা লিখতে পারেন। আবার একজন প্রেমিক কবির কবিতার প্রধান বিষয় বিদ্রোহও হতে পারে। তবে এটা ঠিক, আমার ভেতরে যে-অনেক মানুষ বসত করে তার মধ্যে এ-দুটি মানুষও ভিন্ন ভিন্ন। মানুষ জফির সেতুর আনন্দ-বেদনা, দুঃখ-কাতরতা, বিরহ-প্রেম কবি জফির সেতুকে প্রভাবিত করে প্রায়ই। অন্যদিকে কবি জফির সেতুর আবেগ-ভাব-উপলব্ধি মানুষ জফির সেতুকে মানবিক করে তোলে। মানুষ জফির সেতু সঙ্গপ্রিয় ও মুখর হলেও কবি জফির সেতু বড়োই নিঃসঙ্গ ও একা। কবি জফির সেতুর কাছে মানুষ জফির সেতু মাঝে মাঝে খুব বিরক্তিকর। তাকে ত্যাগ করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু পারি না। হা হা হা।

 

লায়লা ফেরদৌস : লেখনী দিয়ে কি মানবিক ক্ষয়িষ্ণুতা প্রতিরোধ করা সম্ভব?

জফির সেতু : মানুষ তো মানুষ হয়েই উঠেছে জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে। তুমি নিশ্চয়ই এখানে শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গে প্রশ্নটা করেছ? এ-ব্যাপারে আমার জবাব হচ্ছে ইতিবাচক। সাহিত্য-শিল্পই তো মানুষকে মানবিক করে তুলেছে। মানুষী সভ্যতার মূলে এই শিল্পসাহিত্য। এর মানে আমি এটা স্বীকার করছি না যে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে শিল্পীসাহিত্যিকরা কিছু রচনা করতে বসেন। উৎকৃষ্ট শিল্প সবসময়ই উদ্দেশ্যহীন। জগতের আনন্দযজ্ঞে তার নির্মাণ ও সৃষ্টি। কবিতা, সংগীত ও চিত্রকলা প্রভৃতি শিল্প মানুষের অনুভূতি-উপলব্ধিকে শানিত করে, মানুষকে প্রাণিত করে―মানুষকে মানুষের কাছে পৌঁছায়। সুতরাং, শিল্পসাহিত্য মানুষকে অনুভূতিশীল ও মানবিক আবেগ জাগিয়ে তুলতে পারঙ্গম বলে এর মাধ্যমে মানবিক ক্ষয়িষ্ণুতা প্রতিরোধ সম্ভব। নেরুদার কবিতা আমাদের যেমন প্রেমিক করে তোলে, তেমনি ব্রেখটের কবিতা গণমানুষের প্রতি আমাদের ধাবিত করে। একইভাবে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি পড়লে আমরা মানবিকতার চূড়ায় অবস্থান করি। বলা যায়, সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কহীন মানুষ পশু। সে বেঁচে থাকে, জীবনকে উপভোগ বা উদযাপন করে না। পশু বেঁচে থাকে, মানুষ জীবনকে উপভোগ বা উদযাপন করে। পশুর সাহিত্য নাই বলে পশুর বিকাশ নাই।

 

লায়লা ফেরদৌস : কবি হিসেবে সফল হওয়া সত্ত্বেও গল্প/উপন্যাস রচনায় হাত দিলেন কেন? সেটা কি কবি হিসেবে অতৃপ্তিবোধ থেকে মুক্তি পেতে?

জফির সেতু : না, আমার কবিতা ও আখ্যান―দুটো মাধ্যমেই লেখার একটা প্রবণতা শুরু থেকেই ছিল। কবিতা দিয়ে শুরু করলেও গল্পে ছিলাম আমি বিশেষ মনোযোগী। সাহিত্যে বিচিত্রতা আমার ভালো লাগে। আমি নাটকও লিখেছি একাধিক। আমার একাধিক উপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছে ঈদ সংখ্যায়। গল্প তো লিখেছিই প্রথম সমান তালে। এরপর কবিতার প্রতি বেশ মনোযোগী হয়ে যাই। আসলে আমি একসঙ্গে দুটো লিখেই অভ্যস্ত। এতে আমার অসুবিধা হয় না। কিন্তু অলসপ্রকৃতির বলে গদ্য লেখা হয় কম। গদ্যে খাটুনি থাকে বেশি। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। কবিতা তুলনামূলকভাবে কম আয়াসসাধ্য। এর মানে এই নয়, কবিতা সহজ শিল্পমাধ্যম। কবিতা ভাবপ্রধান ও ছোটো আঙ্গিক হওয়ায় দ্রুতই সম্পন্ন করা যায়। আবার এটাও হতে পারে, ভাটির দেশ বলে নৈসর্গিক কারণেই হয়তো সিলেটের মানুষের কবিতার প্রতি অতিরিক্ত টান রয়েছে। যাই হোক উপন্যাস-মাধ্যমে আমার কাজ করার তীব্রতা দীর্ঘদিনের। আশা করি আমি শীঘ্রই বসতে পারব। অকালবোধন (২০০৭) লেখার প্রায় ৮ বছর পর হিজলের রং লাল (২০১৫) উপন্যাসটি লেখা হলো। এটি লিখে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। কিন্তু উপন্যাস খুব শক্ত শিল্পমাধ্যম। যে-ভাষায় রবীন্দ্রনাথ-মানিক-আখতারুজ্জামান ইলিয়াস উপন্যাস লিখেছেন সে-ভাষা চর্চা করা সাহসের ব্যাপার। কবিতার সাহস বাঙালির আপনা থেকেই আসে। কবির অতৃপ্তি তো আরেকটা কারণ নিশ্চয়ই। এই অতৃপ্তির সীমা-পরিসীমা নেই।

 

লায়লা ফেরদৌস : দেশ ও দেশের বাইরে সুশীল সমাজের সঙ্গে আপনার সখ্য রয়েছে। অন্যান্য দেশের চাইতে বুদ্ধিচর্চা বা মানবিক বিকাশে আমরা পিছিয়ে কেন?

জফির সেতু : সৃষ্টিশীল সাহিত্যরচনা, পত্রপত্রিকা সম্পাদনা ও গবেষণার মাধ্যমে নানাভাবে এ-সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। আমার সবসময়ই ইচ্ছে ছিল বিশ্ব-মানবতার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে ওঠা। জ্ঞান ও বুদ্ধিচর্চায় বৈশ্বিক মননের অধিকারী হওয়া। কুয়োর ব্যাঙ হয়ে বেঁচে থাকার অর্থ হয় না। শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান-গবেষণা বা শিল্প-সাহিত্য ও দর্শনে নয়, জীবনবোধ ও মানবিক বিকাশে আমি সর্বদা অবিচল থাকতে চাই। কোনোরকম হীনম্মন্যতা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, জড়তা ও স্থবিরতা আমার ভেতরে নাই বলে আমি যেকোনো দেশের বুদ্ধিজীবী বা ব্যক্তির সঙ্গে মিশতে পারি। একাত্মবোধ করি পৃথিবীর যেকোনো মানুষের মানবিক বিপর্যয়ের সঙ্গে। অন্ধ জাতীয়তা বা জাত্যাভিমানও আমার নেই। মানুষের পরিচয়েই মানুষকে দেখতে অভ্যস্ত আমি। তাই সবকিছু সহজ হয়ে যায়। কিন্তু নিজের দেশ ও সমাজের দিকে যখন তাকাই তখন খুব পীড়িত বোধ করি। বুদ্ধিচর্চা ও মানবিক বিকাশে আমরা আসলেই অনেক পিছিয়ে। আমাদের এখানে পুঁজিবাজার বাড়ছে, দালান উঠছে, পোশাক-পরিচ্ছদ সুশোভন হচ্ছে, সুপার মল উঠছে―সবই হচ্ছে, কিন্তু বুদ্ধিচর্চায় বড়ো পিছিয়ে পড়ছি আমরা। ক্রমাগত সমাজে বাড়ছে সাম্প্রদায়িকতা, ব্যক্তি থেকে সমাজ কলুষিত হচ্ছে, রাষ্ট্রও প্রভাবিত হচ্ছে ভোটের রাজনীতিতে। নারী নারী হয়ে উঠছে, পুরুষ হয়ে উঠছে অতিকায় দানব। বাড়ছে লিঙ্গবৈষম্য, দূরত্ব বাড়ছে ধনী-গরিবে। বুদ্ধির বিকাশে যে-মানুষ মানবিক হয়ে ওঠে, এখানে তা ঘটছে না। সবই যেন স্থবির। মানুষ আরও স্বার্থপর হচ্ছে, হচ্ছে ধর্মান্ধ। ‘হিজাব’ নামক অদ্ভুত বিষয় জাতীয় পোশাকে রূপান্তরিক হচ্ছে। কেউ কোনো আওয়াজ তুলছে না। হরিবোল অবস্থা চারদিকে। আমরা এখন আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগছি। আগে ছিলাম বাঙালি, তারপর হলাম বাঙালি মুসলমান, এখন শুধু মুসলমান। কিন্তু এটা কেন? বুদ্ধিচর্চার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকতার একটা সম্পর্ক রয়েছে। আধুনিককালে আমাদের বুদ্ধিচর্চাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে ঔপনিবেশিকতার পৃষ্ঠপোষকতায় কিংবা ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার আলোকে। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এগুলোর যাত্রা। সামন্ত-সমাজ থেকে বেরিয়ে যে-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ঢুকেছিল নবীন-ভারত তথা বাংলাদেশ তার ভেতরটা ছিল দানবিক লুটপাট ও ক্ষয়িষ্ণুতায় ভরা। জ্ঞানতাত্ত্বিক সমাজের উদ্ভব ও বিকাশের সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দিয়েছিল ব্রিটিশ-ভারত ও পাকিস্তান ঔপনিবেশিক-সাম্প্রদায়িক শাসন-শোষণ। এতে জ্ঞাননির্ভর বা বুদ্ধিবাদী সমাজের পরিবর্তে লোভী, হঠকারী ও আত্মপরায়ণ সমাজের অভ্যুদয় হলো দিনে দিনে। স্বার্থমগ্নতা, ধর্মান্ধতা ও রাষ্ট্রিক অরাজকতার কারণে ভারত-মননের বিপর্যয় ঘটেছে এখানে। ইউরোপ-আমেরিকা বা চীন-জাপানের রাষ্ট্র ও সমাজবিকাশের ধারা আমাদের দেশের বিকাশের ধারার চাইতে পৃথক। ওইসব সমাজ ও রাষ্ট্র জ্ঞান ও বুদ্ধিবাদী বলে মানবিক। সুতরাং, জ্ঞানভিত্তিক বুদ্ধিবাদী সমাজগঠন না করতে পারলে এই মানবিক পশ্চাৎপদতা ঠেকানো যাবে না।


জফির সেতুর একগুচ্ছ কবিতা

হাওড়ের ভাইবোন 

নয়টি করচগাছ গোল হয়ে আছে
এরা হাওড়ের ভাইবোন!

মা নেই বাপ নেই এরা পরিজনহীন
আফালের সঙ্গেই সুখ-দুঃখের কথা বলে!

একটি বিলে নয়টি করচগাছ
চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মাটি জল কাদায়

তুমিও বলেছিলে, দাঁড়াও, আমরাও দাঁড়াই!


ঘর

পশ্চিমের ভিটায় ঘর তুলিয়াছি পুবদুয়ারি
আমার ঘরের ভিতরে আছে আটটি কুঠুরি!

এই যে ঘর করিয়াছি আমি নয়টি দরজা
বাঁশের খুঁটি ঘরের আর ইকড়ের বেড়া
পাশেই গহিন নদী ওপারে সরষেখেত
জলঘুঘু গান গায় শ্যাওড়ার ডালে!

কখনও আসো যদি চৌকাঠ মাড়িয়ে
আমার ঘরে যদি আসো দেখবে তুমিও
কেমন ঘর আমি তুলিয়াছি চৈত্রের আগে

দুইটি কবুতর দানা খুঁটে খায় দাওয়া ও উঠানে
আমার পুবদুয়ারি ঘরে আছে আটটি কুঠুরি!


এই ঝুরা মাটিতে

এই ঝুরা মাটিতে আমি কাল ফেলে এসেছি পদ্মবীজ
তুমি ভরসা রাখো-আজ ভোরেই এরা শিস দিয়ে উঠবে

এই দেশে মাটির ভিতরে লুকিয়ে থাকে এত সুগন্ধী জল
তুমি টের পাবে আজ যখন সূর্য উঁকি দেবে পুবআকাশে

এখন গভীর রাত; আকাশে বাগিচারসব সাদা ফুল ছেয়ে
তুমিও আর্দ্র চাটাইয়ে ঘুমিয়ে আছ আমার ঘাড়ের পাশে

এও এক ঝুরামাটির দেহ; ভিতরে লুকিয়ে মধুকূপী নদী
আমার বালিশে তোমার নিশ্বাস রাতেই শিস দিয়ে ওঠে।


সহবাস

উবু হয়ে আছি বর্ষণসিক্ত মাঠে
আমার নিচে ঘাস মাটি শামুক

আমার নাভিতে ঢুকে গেছে সোনামুখী জোঁক
আমি নেব সবই নেব-শুষে নিচ্ছে রক্ত নাড়ি-ভুড়ি

আমার দুপাশে ধানখেত আর মাথার উপরে রক্তনীলা মেঘ

আমার নাভিতে ঢুকে গেছে প্রেয়সী
লাল চাঁদ, একটি তুমুল জোঁক।


এইসব দৃশ্যের সাক্ষী 

মরাগাঙের পাড়ে গাইটি চেটে দিচ্ছে বাছুরের পিঠ
পানিতে শিশুপুত্রের গা ধুইয়ে দিচ্ছে হতদরিদ্র মা।

এইসব দৃশ্যের সাক্ষী কেবল একটা নাগেশ্বর গাছ।

গাঙের পাড়ে মেয়েদের রোদে দেওয়া শাড়ি
বোরোধানের ছিটানো খড় আর খেলছে ন্যাংটা শিশুরা

ভরদুপুরে হাঁটতে হাঁটতে এসবই দেখলে তুমি
একটা নাগেশ্বর গাছ অনেক বছর ধরে সব দেখছে!


সোঁতার পাড়ে 

বনবাদাড়েই নমঃশূদ্রের বেটিকে দেখি
ফুটে আছে জঙ্গলে করমচা ফুল

শীতের বাতাসে ফেটে গেছে ঠোঁট
অবিন্যস্ত চুলেও থোকা থোকা জট

কাঁখে কসলি আর মাথায় পানির ঘট নিয়ে
আমার ছায়া মাড়িয়েই বনপথে হেঁটে গেল

বনবাদাড়ে সোঁতার পাড়ে সেই যে দেখা
করমচা দেখলে আজও তাকে মনে পড়ে!


বনবিবি

মা বনবিবি আমি বাড়ি যাব  দোহাই পাড়ি তোকে
আমি বাড়ি যাব   বাড়ি মানে মায়ের মুখ  উঠানে শাড়ি

মা বনবিবি তোমার বাল্লক এলো বনে  দোহাই তোকে
শত্রু দুশমন চাপা দিয়ে রাখ গোড়ের কোণে  আমি বাড়ি যাব

বাড়িতে সানকিতে মা বেড়ে রেখেছে পায়েস  মা এখন অন্ধ
আমি আজ বাড়ি যাব  দুখে নামক বালক কাঠুরিয়ার!


শিংমাছ 

কাদামাটির গভীরে থাকে যে শিংমাছ
তার কাঁটা একবার ফুটেছিল পায়ে!

সে এক রাইকিশোরীও ছিল নওলি যৌবনা
বুক চিরে দিয়েছিল ভাঙা কবরের ভিতর!

সেই শিংমাছ আর নওল কিশোরী
আজও আছে ডুবি ও তীর্থে সমান দাপটে।


সঙ্গী

দাদার কবর বলতে শুধু একটা শ্যাওড়াগাছ
লতাপাতাসমেত ঝোপ আর জলডুপির বাসা।

দাদা ছিল প্রতাপশালী লোক 
একটা দাঁত ছিল সোনা দিয়ে বাঁধানো
হাঁটত মাটিতে হিন্তাল কাঠের লাঠি ঠুকে ঠুকে

ঝোপের নিচে দাদা শুয়ে আছে পাশেই দাদিজি
তাদের কবর থেকে মাঝেমাঝে একজোড়া
সাপ বেরিয়ে আসে-কালো, মাথায় ডোরাকাটা দাগ।

[‘আমি করচগাছ’ কবিতাগ্রন্থ থেকে]