পহেলা বৈশাখের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশকে দেখি : কুদরত-ই-হুদা 

কুদরত-ই-হুদা প্রাবন্ধিক ও গবেষক। জন্ম ১৯৭৮ সালের ২৫ জানুয়ারি; বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙায়। স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। তার এমফিল ডিগ্রির বিষয় ‘শওকত ওসমান ও সত্যেন সেনের উপন্যাস’। পিএইচডি করেছেন ‘ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিকাশ ও বাংলাদেশের কবিতা’ শিরোনামে। ‘শওকত ওসমান ও সত্যেন সেনের উপন্যাস : আঙ্গিক বিচার’ [২০১৩] এবং ‘জসীমউদ্দীন’ [২০১৮] তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। সাংস্কৃতিক রাজনীতি, ইতিহাস অনুসন্ধান, উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যসহ নানাকিছু কুদরত-ই-হুদার চিন্তার জগৎ। পেশা অধ্যাপনা।


প্রশ্ন :
পহেলা বৈশাখে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দবন্ধ―গ্রহণ ও বর্জনের দুই দিক থেকেই―ব্যাপারটা কীভাবে দেখেন?
উত্তর : বাঙালি জনগোষ্ঠীর সবার অংশগ্রহণে উদযাপিত সবচেয়ে বড় উৎসব অনুষ্ঠিত হয় পহেলা বৈশাখে। ফলে, পহেলা বৈশাখে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। সারা পৃথিবীতেই সব জাতিরই নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বকারী বিশেষ দিন থাকে। পহেলা বৈশাখ কালের বিবর্তনে বাঙালি জনগোষ্ঠীর কাছে সেইরকম একটা দিনে পরিণত হয়েছে। ফলে এই দিন ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ শব্দবন্ধটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হবে এটাই স্বাভাবিক।
অনেকে―বিশেষত নাগরিক সমাজে―উদযাপনের এইসব বিশেষ দিনটিকে আদিখ্যেতা হিসেবে দেখেন। আমি তা মনে করি না। পহেলা বৈশাখকে তো না-ই। কারণ এর সাথে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের লড়াই-সংগ্রামের একটা প্রত্যক্ষ ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এর উদযাপনের মধ্যে একটু বাড়াবাড়ি তো থাকতেই পারে।
কিন্তু আপনার প্রশ্নের মধ্যেকার উপবাক্যটি―গ্রহণ ও বর্জন উভয় দিক থেকেই―বেশ গোলমেলে ঠেকছে। কারণ পহেলা বৈশাখ যদি ‘বাঙালি সংস্কৃতির’ অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকে তবে ‘বর্জনের’ দিক থেকে এটি আলোচিত হবে কেন! পহেলা বৈশাখ তো একসময় পহেলা জানুয়ারিকে অস্বীকার করে নাগরিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উৎসবের মধ্যে ঘটা করে স্থান করে নিয়েছিল। আমি উনিশ শতকের কথা বলছি। আপনি রাজনারায়ণ বসুর আত্মচরিত পড়লেই দেখবেন, এই পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতীয়তাবাদের অংশ হিসেবেই কলকাতার শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে আদরণীয় হয়ে উঠেছিল। শুধু উনিশ শতকেই বা বলি কেন, বাংলাদেশের বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামেও পহেলা বৈশাখ প্রেরণা জুগিয়েছিল ষাটের দশকের ঢাকার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে। ইতিহাসে ঢুকলে দেখা যায়, ব্যাপকভাবে পূর্ব বাংলায় নববর্ষ পালনের প্রচলন হয় ১৯৬৪ সাল থেকে। ‘১৯৬৬ সালে নববর্ষ নতুন উদ্দীপনা ও জঙ্গিপনা নিয়ে পালিত হয়। ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)-এর পক্ষ থেকে প্রকাশ্য জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল প্রভাতফেরি। রাজপথে এতে ছাত্র-জনতার ঢল নামে। অভাবিত লোক-সমাবেশে ও প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টির কারণে সরকারও বিচলিত হয়ে ওঠে।’ কথাগুলো বললাম ইতিহাস থেকে। পহেলা বৈশাখে নববর্ষ পালনের মধ্যদিয়ে পূর্ব বাংলার নাগরিক সমাজ পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইসলামি সংস্কৃতির বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতার সংস্কৃতির জানান দিয়েছিল। কীর্তন-পদাবলি পরিবেশন, নারীদের বিশেষ সাজসজ্জা, নৃত্য-গীতাদির মধ্যদিয়ে নববর্ষ পালন করে পূর্ব বাংলার সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য জানান দিয়েছিল পূর্ব বাংলার সচেতন মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজ। অর্থাৎ সেদিন নববর্ষ পালন পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার অন্যতম উপাদান হয়ে উঠেছিল। একারণেই বোধ করি ষাটের দশকের এই নববর্ষ উদযাপন পাকিস্তানপন্থিদের পাকিস্তানি তাহজিব-তমদ্দুনবিরোধী বিষয় হিসেবে সেদিন যথেষ্ঠ সমালোচনার শিকার হয়েছিল।
এহেন পহেলা বৈশাখ ‘বর্জনের দিক থেকে’ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর সময়ে আলোচিত হচ্ছে―এ বড় অদ্ভুত ব্যাপার! কেন এমনটি হচ্ছে এখানে স্বল্প পরিসরে সেই আলোচনার সূত্রপাত করছি না। শুধু বলে রাখছি, বিষয়টা গভীরভাবে ভাবা দরকার।
সংস্কৃতি তো আসমান থেকে টুস করে পড়ে না। মানুষের গ্রহণ-বর্জনের বিষয়ও না। ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়ও না। একটা জাতির মানুষেরা যা করে তাই-ই তাদের সংস্কৃতি। সংস্কৃতি একটি জাতির জনগোষ্ঠীর মানুষের শারীরিক, মানসিক, ভৌগোলিক অস্তিত্বের সাথে গভীরভাবে যুক্ত। এটা বোঝার জন্য রবীন্দ্রনাথের বই খুলে কৃষ্টি-কালচারের সংজ্ঞা খোঁজার দরকার হয় না। তবে তো বোঝা যাচ্ছে আমাদের সাংস্কৃতিক নির্মাণে, উদযাপনে, সংজ্ঞায়নে একটা কোথাও ঘাপলা বেঁধেছে। সংস্কৃতির প্রশ্নে গ্রহণ-বর্জনের ব্যাপার উঠে আসে উপনিবেশিত সমাজে। কিন্তু বাংলাদেশ তো কোনো কোলোনাইজড দেশ নয়! না কি!

প্রশ্ন : ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ কি রাজনৈতিক ইস্যু?
উত্তর : আগের প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্ট হবার কথা যে, বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম অংশ পহেলা বৈশাখ সাধারণ কোনো বিষয় ছিল না। অন্তত ষাটের দশকে। আমাদের সংস্কৃতিকে আমরা রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করে তাকে ব্যবহার করেছি। এবং বেশ ফল পেয়েছি।
বর্তমান বাংলাদেশে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ আর নিরীহ ব্যাপার নেই। শুধু বাংলাদেশে বলি কেন, সারা পৃথিবীতে সংস্কৃতি ব্যাপারটাই আর নিরীহ অরাজনৈতিক ব্যাপার নেই। কিন্তু বাংলাদেশে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ জটিল অর্থে রাজনৈতিক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে দ্বৈত আদর্শব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তার সাথে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে বলেই মনে হয়। বর্তমানে উভয়পক্ষ থেকে আমরা বোধ করি ‘বাঙালি সংস্কৃতির’ দখল আর আরোপিত সংজ্ঞায়ন ও উদযাপনের কাল পার করছি। ব্যাপারটা রাজনৈতিক কারণেই ঘটছে বলে মনে করি। এ হলো রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের মতোই রাজনীতিতে ‘বাঙালি সংস্কৃতির’ (অপ!) প্রয়োগ।
  
প্রশ্ন : জাতিগত সংস্কৃতি ও ধর্মীয় সংস্কৃতি এই দুটো বিষয় কি বিরোধাত্মক জায়গায় অবস্থান করছে? 
উত্তর : একটা জাতির মানুষেরা যা-করে তাই-ই যেহেতু ওই জাতির সংস্কৃতি সেহেতু শুধু জাতিগত সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। আবার শুধু ধর্মীয় সংস্কৃতি বলেও কিছু নেই। এই দুই মিলেই একটা জাতির সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের এখানে এই দুই সংস্কৃতিকে আলাদা করে ভাবার রেওয়াজ আছে। কারণ এখানকার মুসলমান জনগোষ্ঠী যেহেতু মূলত ধর্মান্তরিত জনগোষ্ঠী সেহেতু অবশ্যই এই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে আগের সাংস্কৃতিক উপাদান (জাতিগত উপাদান) যেমন আছে তেমনি নতুন ধর্মীয় সংস্কৃতির উপাদানও এসে মিশেছে। এই দুই মিলেই বাংলাদেশের বিশেষত বাঙালি মুসলমানের (যেহেতু এরা সংখ্যাগুরু তাই বলছি) সংস্কৃতি। কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালিরা যেহেতু ভাষাগত আর জাতিগতভাবে পশ্চিমবাংলার বাঙালি জনগোষ্ঠীর সাথে যুক্ত তাই এখানে সংস্কৃতির বাছবিচার করার সময় হিন্দু আর মুসলমানের সংস্কৃতির উপাদান খোঁজাখুঁজির বিষয়টা চলে আসে। কিন্তু এটা একটা অদ্ভুত প্রশ্ন যে, বাংলাদেশের বাঙালির সংস্কৃতির মধ্যে কত আনা বাঙালি উপাদান আর কত আনা মুসলমানি উপাদান। এই দুই মিলিয়েই এখানকার বাঙালি সংস্কৃতি। এখানকার মুসলমানের সংস্কৃতির মধ্যে জাতিগত কারণে হিন্দুর সংস্কৃতির একটা বড় পরিমাণের মিশেল আছে। আর যেহেতু এখানকার সাংস্কৃতিক রাজনীতি আর ‘প্রগতিশীলতা’ সাংস্কৃতিক রাজনীতির অবস্থানের দিক থেকে কলকাতার সাংস্কৃতিক পাঠ আর লিগ্যাসি বহন করে সেহেতু সে বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে ওই পাঠ আর লিগ্যাসিকে খোঁজে। আয়োজনেও ওইসবকে বেশি গুরুত্ব দেয়। ফলে তার জীবনের সাথে ধর্মীয় সংস্কৃতির যেসব উপাদান মিশে আছে তাকে সে তার ধর্মের মতোই অস্বীকার করে। বা সামনে আনে না। এই সংকট ঢাকার সংস্কৃতিবিষয়ক ভাবনার বড় সংকট বলে মনে হয়―বিশেষত শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তশ্রেণির কাছে। কিন্তু গ্রামীণ জনসমাজ এসবের খুব একটা ধার ধারে না বলেই মনে করি। তারা বহুকাল আগে থেকেই বলে আসছে পহেলা বৈশাখের মেলা হিন্দুর সংস্কৃতি। সেই বিশের দশকে লেখা জসীমউদ্দীনের কবিতায়ও এর উল্লেখ আছে। কিন্তু তাই বলে তারা তা উদযাপন করা থেকে বিরত থাকতও না, বর্তমানেও বিরত থাকে না। উভয়ের কলস্বরে বিচিত্র আয়োজনের ভেতর দিয়ে তা আগেও উদযাপিত হতো, এখনো হয়। কোনটা ‘ধর্মীয় সংস্কৃতি’ আর কোনটা ‘জাতিগত সংস্কৃতি’ এসব দেখার তাদের টাইম নাই। সংস্কৃতি ব্যাপারটা তো তাই-ই।

প্রশ্ন : শামসুজ্জামান খানের মতে, বাংলার মুঘল সুবাদার মুর্শিদ কুলি খান প্রথম ‘পুন্যাহ’-এর রীতি শুরু করেন, যার অর্থ হচ্ছে ‘ভূমি রাজস্ব আদায়ের উৎসবের দিন’। মানে, ব্যাপারটা কৃষক-মজুর নয়, শাসকগোষ্ঠীর রাজস্ব উৎসবের দিন। পরবর্তীকালে ব্যবসায়ীরাও ‘হালখাতা’ করেন। কিন্তু এখন পহেলা বৈশাখ নিপাট একটি অনুষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। গ্রামেরও সীমিত পরিসরে সবসময়ই ছিল। ব্যাপারটা কীভাবে দেখেন? 
উত্তর : আপনি ঠিকই বলেছেন। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে ‘পুন্যাহ’ এবং ‘হালখাতা’ দুটো ব্যাপারই অর্থনীতির সাথে যুক্ত। ‘পুন্যাহের’ দিনে জমির পুরোনো খাজনা কৃষকরা মিটিয়ে দিত। অথবা জমিদারের পক্ষ থেকে পাওনা খাজনা মওকুফ করিয়ে নিত। এইদিনে কৃষক-রায়তরা নতুন বছরের জন্য জমি ইজারা নিত অথবা জমিচাষের অধিকার হারাত। এইসব অর্থনৈতিক ঘটনা একটা উৎসবের মধ্যদিয়ে হতো। এই উৎসবে সবাইকে বিনোদিত করার জন্য ঐতিহ্যবাহী নানা খেলাধুলার আয়োজন করা হতো। খাজনাটা জমিদারের ছিল। কিন্তু উদযাপানের বিষয়টা ছিল সবার। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় ‘পুন্যাহ’ অনুষ্ঠানেরও মৃত্যু ঘটে। কিন্তু ‘পুন্যাহ’ না থাকলেও ওই যে উৎসব করা, সেই উৎসবের রেওয়াজ গ্রামীণ সমাজে এখনো চালু আছে।
সম্ভবত ওই ‘পুন্যাহ’-এর অনুষ্ঠানের আদলেই একইভাবে পহেলা বৈশাখে দোকানদার বা ব্যবসায়ীরা (জমিদারদের মতোই) তাদের ক্রেতার কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায় করত। কখনো কখনো পাওনা রেয়াতও দেওয়া হতো। রেয়াত আর পরিশোধের পর দোকানির পক্ষ থেকে ক্রেতাদের জন্য আবার নতুন বাকির খাতা খোলা হতো। এ উপলক্ষ্যে খাওয়া দাওয়ার আয়োজনও করা হতো; এখনো হয়।
কিন্তু আজকাল নগরজীবনে পহেলা বৈশাখ একটা নিপাট অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এটা শহুরে মানুষের একটা ছুটির দিন কাটানোর ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এটাকে দেখে মনে হয়, অনুষ্ঠানের জন্য অনুষ্ঠান। কিন্তু এটাকে টিভিতে পত্রিকায় গ্লোরিফাই করা হয়, জাতীয়তাবাদী ব্যাখ্যার মোড়কে মুড়ে।

প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের প্রসঙ্গ কীভাবে এসেছে?
উত্তর : বাংলা সাহিত্যে পহেলা বৈশাখ একটা বড় স্থান দখল করে আছে। বাংলা ভাষায় কবিতা লেখেন অথচ পহেলা বৈশাখ নিয়ে একটা বা একাধিক কবিতা লেখেননি, এমন কবি বোধ করি খুঁজে পাওয়া ভার হবে। সাহিত্যে―বিশেষত নাগরিক সাহিত্যে―পহেলা বৈশাখ মূলত অতীতের জরাজীর্ণতা ভুলে নতুনদিনের মঙ্গল কামনার মধ্যেই মূলত সীমাবদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিশেষ বোধের সবচেয়ে ভালো রূপকার বলেই মনে হয়।

প্রশ্ন : পয়লা বৈশাখের শোভাযাত্রায় মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার মোটিফ ব্যবহৃত হয়ে আসছে―অর্থাৎ এর একটি রাজনৈতিক গোল আছে?
উত্তর : পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রায় মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার মোটিফ ব্যবহৃত হয়ে আসছে কথাটা সত্য। এর একটা রাজনৈতিক গোল আছে একথাও সত্য। কারণ, মঙ্গল শোভাযাত্রা চারুকলা থেকে যখন প্রথম ১৯৮৯ সালে শুরু হয় তখন এর একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। এই উদ্দেশ্য স্বৈরাচার বিরোধিতার সাথে যুক্ত ছিল। পরে সময়ে সময়ে রাজনৈতিক সরকারগুলোর মেজাজের সাথে সঙ্গতি রেখে, কখনো কখনো বিদ্যমান সরকারের বিরোধিতার হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। বলে রাখা দরকার, এই মঙ্গল শোভাযাত্রা যখন থেকে মৌলবাদ বিরোধিতার কাজে ব্যবহৃত হওয়া শুরু করেছে তখন থেকেই এর মধ্যে মুসলমানি উপাদান খোঁজার নামে নতুন সাংস্কৃতিক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এই আয়োজন খুব খোলামেলাভাবে তার সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করেছে। আপনি পহেলা বৈশাখের মধ্যে যে ‘জাতিগত সংস্কৃতি’ ও ‘ধর্মীয় সংস্কৃতি’-এর বিরোধাত্মকতা সম্পর্কে বলছিলেন তার ঘোষিত শুরু সম্ভবত এখান থেকেই। ফলে মঙ্গল শোভাযাত্রা খালি মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার রাজনীতির সাথে যুক্ত নেই। এটা এখন সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও দলীয় রাজনীতির বিষয়ও হয়ে উঠেছে। আমি আরো একটু বাড়িয়ে বলতে চাই, সম্ভবত এর সাথে শ্রেণি রাজনীতিও বেশ জড়িয়ে আছে।

প্রশ্ন : আগুনঝরা এই দিনটি আপনি কীভাবে কাটান?
উত্তর : ব্যক্তিগতভাবে আমার এই দিনটি কাটানোর ইতিহাসের একটা বিবর্তন আছে। গ্রামে থাকতে দিনটি একরকম ছিল। ঢাকায় এসে দিনটি―বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে―একভাবে কেটেছে। এসব সময় মূলত উদযাপনই মুখ্য ছিল। এখন অন্যভাবে কাটে। এই দিনে এখন বের হই খুবই কম। কোনো কোনো বছর বের হলে সাংস্কৃতিক পাঠের জন্যই মূলত বের হই। এখন আমার কাছে পহেলা বৈশাখ সাংস্কৃতিক রাজনীতি পাঠের একটা অধিক্ষেত্র। পহেলা বৈশাখের মধ্যদিয়ে আমি বাংলাদেশকে দেখি। আর বিচিত্র রঙের উৎসবপাগল মানুষ দেখার অপার আনন্দের ব্যাপার তো আছেই!