X
শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪
২৬ বৈশাখ ১৪৩১
উপন্যাস

বিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার

সাজেদুল ইসলাম
২৭ এপ্রিল ২০২৪, ২২:২৪আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ২২:২৪

রিহিল খুব আগ্রহভরে নেয়ামদ্দি মোড়লের কথা শুনছে। শুনতে শুনতে রিহিলের হঠাৎ মনে হলো, নেয়ামদ্দি মোড়ল কথা বলতে গিয়ে একেকবার একেক স্থানে সরছে। ক্রমাগত নিজের যৌক্তিক অবস্থান বদল করছে। এই এক্ষণে তার কথা শুনে রিহিলের মনে হচ্ছে, হায়দার মোড়ল ছিলেন একজন প্রজাহিতৈষী মানুষ। পরক্ষণে মনে হচ্ছে, তিনি আসলে রহস্য মানব—এই ভালো, এই খারাপ প্রকৃতির। অথবা এমনও হতে পারে যে, নেয়ামদ্দি মোড়ল রিহিলকে তার পূর্বপুরুষ সম্পর্কে কোনো গন্তব্য পৌঁছাতে দিতে চায় না। নেয়ামদ্দি মোড়ল রিহিলের কাছে হায়দার মোড়লকে এক চরিত্র হিসেবে বর্ণনা করছে—যাকে মীমাংসা করা যায় না।

সকালবেলা গাছের পাতা ফুঁড়ে রোদ হাসতে শুরু করেছে। টানা কয়েকদিন বৃষ্টির পর এই রোদ আনন্দের বন্যা বইয়ে দিয়েছে প্রকৃতিতে। গেরস্তরা নিজ নিজ ঘরে জমে থাকা স্যাঁতসেঁতে কাপড়চোপড় উঠোনে বাঁধা তারে ছড়াতে শুরু করেছে। এমন সময় নেয়ামদ্দি মোড়লের বৌ ফিরোজা একটি মাঝারি ট্রেতে দুই গ্লাস জল, চিনামাটির দুটি কাপে আদা, লবঙ্গ ও দারুচিনির মিশেলে লাল চা নিয়ে শানে এলো। ট্রেতে চায়ের সঙ্গে আরো রয়েছে হাতে ভাজা আমন চালের মোটা মুড়ি, মুড়ির উপরে শুইয়ে রাখা কয়েকটি সরু টোস্ট এবং অন্য বাটিতে লাল চাল ভাজা। শানের উপর ট্রে রেখে ফিরোজা বলল, আফনেরা খালি মুখে বইয়া কতা কইতাছেন, একটু চা-পানি খাইয়া নেন। নেয়ামদ্দি মোড়ল চায়ের কাপ ও জলের গ্লাস রিহিলের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, নেও বাবা, চা-পানি নেও। চা হাতে নিয়ে রিহিল নেয়ামদ্দি মোড়লের বৌ ফিরোজাকে বলল, ধন্যবাদ চাচি।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে নেয়ামদ্দি মোড়ল একমুঠ চালভাজা মুখে পুরে নেয়। আয়েশের সঙ্গে শব্দ করে চিবোতে চিবোতে সে বলে, আমাগো পূর্বপুরুষ ধান-চাউলের কারবারি আছিল বইলা আমরা এহনো মুড়ি আর চাইল ভাজা ছাড়তে পারি নাই। এই বলে নেয়ামদ্দি মোড়ল হেসে উঠল। রিহিলও না হেসে পারল না। রিহিল লাল চায়ের কাপে কিছু মুড়ি মিশিয়ে নিয়ে চুমুক দিল। চায়ে মুড়ি মেশানো দেখে নেয়ামদ্দি মোড়ল রিহিলকে বলল, চায়ে মুড়ি ডুবাইয়া খাওনের অভ্যাস তুমি কই পাইলা। আমি তো ভাবছি তুমি বিদেশের পোলা—এসব কিছু তোমার জানার কতা না। নেয়ামদ্দি মোড়লের কথা প্রসঙ্গে রিহিল বলে, বাবাকে মাঝেমধ্যে এভাবে খেতে দেখেছি। তখনই ভেবেছি, আমাদের বাড়ির লোকেরা হয়ত এভাবেই চা পান করে। রিহিলের কথা শুনে নেয়ামদ্দি মোড়ল বলে, আমি শুরুতেই বুঝছি—তোমার বুদ্ধি আছে। বুদ্ধি থাকবে না কেন, কার নাতি দেখতে অইবো না—বলেই সে ফের হো হো করে হাসলো।

ডাকাতদল তো ডাকাতির প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল, তবে মাঝখানে চাল কীভাবে মধ্যস্থতার বিষয় হয়ে এলো সেই প্রশ্ন সামনে রেখে চা-মুড়ি খেতে খেতে রিহিল এবার নেয়ামদ্দি মোড়লকে জিজ্ঞেস করলো, দাদা কারবারি ছিল বলেই কি তারা চাল সংগ্রহের পরিকল্পনা করে বাড়িতে এসেছিল? রিহিলের প্রশ্ন শুনে নেয়ামদ্দি মোড়ল বলল, দস্যুদলের কথা কইতাছ? এই প্রশ্নে রিহিল চুপ করে রইলো। হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। নেয়ামদ্দি মোড়ল এবার নিজেই বলে ওঠে, তারা তো কেবল পরিকল্পনা কইরা আহে নাই, তারা তোমার দাদারে আগে চিঠিপত্র দিয়া তারপর বাড়িতে আইছে। চিঠির কথা শুনে রিহিল অবাক হলো না। সে কেবল জিজ্ঞেস করলো, চিঠিতে তারা কী বলেছিল? নেয়ামদ্দি মোড়ল বলল, তেমন কিছু না। তারা যে ডাকাতি করবার চায়—এই ইচ্ছার কতা তারা আগে তোমার দাদারে জানাইছিল। রিহিল বলল, ডাকাতির ইচ্ছার কথা গেরস্তকে আগে জানাতে হয়? নেয়ামদ্দি মোড়ল এবারও হাসল। হেসে বলল, হেইকালে এইডাই ছিল নিয়ম। ভদ্রতাও কইবার পারো। রিহিল, শ্লেষের হাসি হেসে বলে, এ আবার কেমন ভদ্রতা? নেয়ামদ্দি মোড়ল বলে, এই চিঠির অর্থ অইলো গেরস্তরে আগাম বার্তা দেওয়া, হে যেন ধন-সম্পত্তি প্রস্তুত কইরা রাখে, আর থানা-পুলিশের কোনো ঝামেলা না করে। গেরস্ত যদি হেগো কতামত কাম করে তাইলে গেরস্তর কোনো ভয় নাই। রিহিল বলল, বাহ, আপস-মীমাংসার এক ভালো নিয়ম এটি। রিহিলের কথার প্রতিধ্বনি করে নেয়ামদ্দি মোড়ল বলল, আপস করলে কঠিন বিষয়ও মীমাংসা করা সহজ অইয়া যায়।

রিহিল এবার আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, বাড়ির লোকেরা ডাকাতির পত্র পেয়ে ভয় পেলনা? রিহিল সহজ বিষয়টিও কেন বুঝতে পারছে না দেখে নেয়ামদ্দি মোড়ল যেন কিছুটা বিরক্ত হল। সে বলল, ভয় পাইব ক্যান, হেগো নির্দেশ মতো কাম করলে ভয়-ডর কীসের। নেয়ামদ্দি মোড়লের কথায় সবকিছু কেমন গুমোট হয়ে আছে। পরিষ্কার হয়েও হচ্ছে না। রিহিল ফের তার কাছে জানতে চায়, বলে, চাচা, ডাকাতদলের এতো চাল কেন প্রয়োজন হল? রিহিলের এই প্রশ্নে নেয়ামদ্দি মোড়ল খুব আনন্দ পেল। সে বলল, ধুর বোকা। চাউল-ই সব। হেইকালে যার যত ধান-চাউল আছিল হে তত বিত্তবান হিসাবে পরিচিত আছিল। মানুষের পকেটে তহন কাঁচা টেকা বেশি থাকত না। ধান-চাউল-পাট, জমিজমা আর পোলা-মাইয়া আছিল মানুষের আসল সম্পদ। দেহ না, হেইকালে একেক জনের বারো-তেরডা কইরা পোলামাইয়া। নেয়ামদ্দি মোড়লের কথায় এবার কিছুটা পরিষ্কার হলো। রিহিল বলল, এত চাল তারা কোথায় নিয়ে উঠাল, তাদের নিজস্ব কোনো গুদাম বা কোল্ডস্টোরেজ ছিল? নেয়ামদ্দি মোড়ল এবার এক নতুন তথ্য হাজির করল। সে বলল, তারা তো চাউল বাড়িত নিয়া তোলে নাই। তাই এত চাউল রাখা নিয়ে হেগো টেনশন আছিল না। রিহিল ভাবলো তারা হয়ত হাটে সেসব চাল বিক্রি করে অর্থ তুলে নিয়েছে। এক্ষণে নেয়ামদ্দি মোড়ল বলল, তারা পঞ্চাশ মণ চাউল নিছে ঠিকই, কিন্তু হেই চাউল তারা হাটে বিক্রিও করে নাই, বাড়িতও নেয় নাই। এইসব চাউল তারা গরিব-দুঃখী মানুষের মাঝে রিলিফ দিয়া দিছে। রিহিল এবার নড়েচড়ে বসে। বলে, চাচা, এদেরকে তাহলে ডাকাত বলছেন কেন? এরা তো রবিনহুড। নেয়ামদ্দি মোড়ল জিজ্ঞেস করে, রবিনহুড কেডা? রিহিল ভেবেছিল নেয়ামদ্দি মোড়ল রবিনহুডকে চিনবে। সে বলল, চাচা, রবিনহুড একজন ইংরেজ। তিনি বীর যোদ্ধা ছিলেন। দক্ষতার সঙ্গে তীর ছুড়তে পারতেন। আসলে তিনি গরিবের বন্ধু এবং বিত্তশালী লোকের দুশমন ছিলেন। পয়সাওয়ালা লোকেরা তাকে ডাকাত বললেও তিনি বড়লোকের টাকা-পয়সা নিয়ে ও মালামাল ছিনিয়ে নিয়ে অসহায় মানুষের মাঝে বিলি করতেন। গরীবমানুষ তাকে ভীষণ পছন্দ করতো। তার জন্য অপেক্ষায় থাকতো—কখন আসবে রবিনহুড।

নেয়ামদ্দি মোড়ল বলল, আমি বাবা ফিরিঙ্গি রবিনহুডরে চিনি না। তয় তুমি যা কইলা তার লগে আমাগো দেশের এই ডাকাইত দলের মনে অয় কিছু মিল আছে। তারা প্রথমে বাড়ির মালিকের কাছে চিঠি লিখত। চিঠিতে পরিষ্কার কইরা লেখা থাকত যে, আমাগো ভালো কামের লেইগা টাকা-পয়সা-ধান-চাউল দরকার। তারা কেবল সামর্থ্যবানগো কাছে এই চিঠি লেখত। তাই গরীব মানুষরা সবসময় হেগো সমর্থন করতো। তয় এইডাও ঠিক যে—হেরা মেলা খুনখারাবি করছে। রিহিল এবার বলল, তারা মানুষ খুন করেছে কেন? নেয়ামদ্দি মোড়ল বলল, ওই যে যারা হেগো কতা না শুইনা পাকনামি করছে, ফাঁড়িতে খবর দিছে—তাগো মাইরা দিত। খুনখারাবি করত বইলা হেরা ডাকাইত নাম পাইল। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক ধইরা গেল। তারপরও হেরা মেলা দিন রাজত্ব করছে। বুদ্ধিমান মানুষের কোনো ক্ষতি অয় নাই। তারা সমঝোতা কইরা নিছে। বোকা আর মাথামোটা লোকেরা মারা পড়ছে এই ডাকাইত দলের হাতে। নেয়ামদ্দি মোড়লের কথার পিঠে রিহিল শুধু বলল, তাহলে যাদের অর্থ ও বুদ্ধি আছে কেবল তারা বেঁচে রইল। আর বুদ্ধিহীন বিত্তবানদের গর্দান পড়ল ছুরির নিচে। রিহিলের কথা শুনে নেয়ামদ্দি মোড়ল এবার অট্টহাসি দিয়ে বাড়ি মাথায় তুলল। বলল, তোমার দাদার হায়দার মোড়লের অর্থ ও বুদ্ধি—দুইডাই আছিল।

চলবে 

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চীন বিষয়ে বিশেষজ্ঞকে ঢাকায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
চীন বিষয়ে বিশেষজ্ঞকে ঢাকায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
আগুন নেভাতে গিয়ে ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ৭
আগুন নেভাতে গিয়ে ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ৭
১৮ শর্তে আ.লীগকে সমাবেশের অনুমতি দিলো ডিএমপি
১৮ শর্তে আ.লীগকে সমাবেশের অনুমতি দিলো ডিএমপি
নিহত পাইলটের লাশ হস্তান্তর, থানায় মামলা
নিহত পাইলটের লাশ হস্তান্তর, থানায় মামলা
সর্বাধিক পঠিত
আর্জেন্টাইন ক্লাবকে জামাল ভূঁইয়ার ২ কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ ফিফার
আর্জেন্টাইন ক্লাবকে জামাল ভূঁইয়ার ২ কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ ফিফার
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা: আজিজ মোহাম্মদসহ ৩ জনের যাবজ্জীবন
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা: আজিজ মোহাম্মদসহ ৩ জনের যাবজ্জীবন
চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় আহত পাইলটের মৃত্যু
চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় আহত পাইলটের মৃত্যু
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের বানান ভুল লিখলো সওজ, চলছে সমালোচনা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের বানান ভুল লিখলো সওজ, চলছে সমালোচনা
অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়লে পারমাণবিকনীতি পরিবর্তন করবে ইরান
অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়লে পারমাণবিকনীতি পরিবর্তন করবে ইরান