ইরাকের কবিতা

noname[আরবি সাহিত্য জগতে ইরাকি সাহিত্যের, বিশেষত কবিতার স্থান সুসংহত হলেও, আরবি ভাষাভাষী অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় কিছুটা নিষ্প্রভ। দেশটিতে উপর্যুপরি অবিন্যস্ত শাসন ব্যবস্থাই এর প্রধান কারণ। বাথ পার্টির তুঘলকি শাসন, ইরাক-ইরান যুদ্ধ, সাদ্দামশাহীর স্বৈরশাসন, এতসব বেড়াজাল মাড়িয়েই সগর্বে-স্বমহিমায় পথ চলেছে ইরাকের কাব্যচর্চা। তবুও গত শতকের পঞ্চাশেরর দশক থেকেই ইরাকি কবিরা আধুনিক কবিতার জমিনে ফসল ফলাতে আগুয়ান। কবিতার ফর্মে, ভাষার বহুমাত্রিক ব্যবহারে, রূপকের আশ্রয়ে পাশ্চাত্য ধারাকে স্বাগত জানিয়েছেন তাঁরা। যদিও এইসময়ের কবিদের কাছে বক্তব্যধর্মী কবিতা প্রাধান্য পেয়ে এসেছে, সেটি নেহায়েতই তাঁদের দুর্বলতা বা অক্ষমতা নয়। কেননা দেশান্তরি হবার খাঁড়া বা শাস্তির হুলিয়া মাথায় জোটেনি এমন কবির সংখ্যাও ইরাকে কম নয়! এতসবের মধ্যেও দেশে-বিদেশে ইরাকি কবিতার বলিষ্ঠ উচ্চারণ হয়ে গেছে ঠিকই। আর সেই কণ্ঠস্বরদের মধ্যে থেকে বাছাই পাঁচ কবির কবিতা অনুবাদ করা হয়েছে।]

nonameবদর শাকির আল-শায়াব

ইরাকের বসরায় জন্ম ১৯২৬ সালে। নমস্য কবি ও লেখক। ইরাকের কাব্যধারা তথা প্রাচ্যের সাথে পশ্চিমা কাব্যধারার মেলবন্ধন ঘটনোর প্রথম প্রয়াস যেকজন ইরাকি কবি ঘটিয়েছিলেন আল-শায়াব তাঁদের অন্যতম। প্রাচ্যের স্বনামধন্য গীতিকবিতার প্রাচীন ও ঐতিহাসিক ফর্মের বাইরে এসে আধুনিক কবিতার রূপটির বুনিয়াদ আল-শায়াব এবং তাঁর সমসাময়িকদের হাতেই গড়া। দীর্ঘ কবিতা দ্য গ্রেভ ডিগার (১৯৫২ সালে প্রকাশিত) বা গোর-খোদক এবং ব্লাই-প্রস্টিটিউট (১৯৫৪ সালে প্রকাশিত) তথা ‘অন্ধগণিকা’র জন্য বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। ১৯৬৪ সালে এই কবি মৃত্যুবরণ করেন।

বৃষ্টির গান
তুমি কি জানো কোন সে দুঃখ বৃষ্টিকে প্রাণীত করে?
জানো কি খানাখন্দ বুঁজে এলে সে কি করে কাঁদে?
পথভোলা একলা এক মানুষ বৃষ্টির ছাঁটে কী খুঁজে পায়?
অবিরাম, যেনো রক্তের ছিটে, যেমন ক্ষুধার্ত মানুষ, ভালোবাসার মতো,
যেমন শিশু, মৃত্যুর মতো, অনিঃশেষ বৃষ্টি।
তোমার চোখদুটো আমাকে নিয়ে চলে বৃষ্টি-বিহারে
উপসাগর উজিয়ে বিদ্যুৎরেখা কুড়িয়ে বেড়ায় ইরাকের ঢেউ যতো
সাথী হয় নক্ষত্ররাজি আর ঝিনুকের খোলেরা
যদি একটি ভোর তাদের থেকে বিশ্রাম ছিনিয়ে নেয়ওবা, ভারি রাত টেনে দেয় রক্তজমাট আঙরাখা। আমি কেঁদে ফেলি
উপসাগরের তীরে: ‘হে উপসাগর
হে মুক্তা, খোল আর মৃত্যুর দেবতা!’
আর তখন প্রতিধ্বনি আসে,
ঠিক যেমনটা ভাবা হয়েছিল তেমনই
‘হে উপসাগর
হে মুক্তা, খোল আর মৃত্যুর দেবতা!’
প্রায় নির্ভূল...শুনতে পাই শাঁসানো কণ্ঠের ইরাকি বজ্রধ্বনি
পাহাড়ে আর সমতলে জড়ো হয়ে উঠছে আলোর বান
কেননা আগুয়ানেরা আগল ভাঙল বলে! আর টুটলেই
ছড়িয়ে পড়বে হাওয়া উপত্যকা জুড়ে।
নিশ্চিত শুনতে পাই...খেজুর পাতারা আকণ্ঠ পান করছে বৃষ্টি-জল
শুনি তল্লাটে তল্লাটে দেশান্তরী মানুষের অস্ফূট গোঙানী
উপসাগরে যুঝে চলেছে বৈঠা আর পাল
ঝড় আর বজ্র হুঙ্কার, গাইছে
বৃষ্টি...বৃষ্টি....
ঝরঝর বৃষ্টি!


 

nonameনাযিক আল-মালাইকা
কবি, সমালোচক এবং গবেষক। জন্ম ১৯২৩, ইরাকের বাগদাদে। মালাইকা বিখ্যাত হয়ে আছেন আরবি ভাষার প্রথম সার্থক মুক্তছন্দের কারিগর হিসেবে। ১৯৪৫ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য নাইটস্ লাভার’ প্রকাশিত হয়। বলা হয়ে থাকে ১৯৪৭ সালে তাঁর রচিত ‘কলেরা’ কবিতাটি আরবি কবিতার জন্য বিপ্লব-স্বরূপ। ইরাকি সোশালিস্ট বাথ পার্টির আগ্রাসনে নাযিক দেশান্তরি হন, কুয়েতে বসবাস করতে থাকেন। পরে ১৯৯০ সালে ইরাকি স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের আমলে তিনি আবার দেশে ফিরে আসেন। দীর্ঘদিন পারকিনসন্স অসুখে ভোগার পর ২০০৭-এ এই কবির দেহাবসান ঘটে।

কে আমি


রাত জিজ্ঞাসে—কে তুমি!
আমি তার নিগূঢ়-উদ্বেগ, কালো, গভীর খাদ
তার স্পর্ধিত নীরবতা
হৃদয় ঢেকে নিয়েছি এই নীরবতায়
মুড়ে নিয়েছি সন্দেহে-নিরানন্দে, কটাক্ষে তাকাতে তাকাতে
মহাকাল জিজ্ঞাসে—কে তুমি?
আমি কে তা জানতে চায় দুদ্দার হাওয়া
আমি তার উদভ্রান্ত আত্মা, সময় বিবর্জিত
আমি চাই, এক অফুরান পথচলা
এক অনিঃশেষ যাত্রা, বিরতিহীন।
কোনও এক মোড়ে পৌঁছানো যাবে কি?
যেখানে এলে মনে হবে এই তো ঘনিয়ে এসেছে দহনরাত্রি।
তারপর বাতিল সময় জিজ্ঞাসে—কে হে?
আমি এক মহাকায়, শতশত বছরকে আলিঙ্গনে বেঁধে আমি ফিরে এসেছি
আর মঞ্জুর করেছি পুনরুত্থান।
আমিই সুদূর অতীতের স্রষ্টা
মনোহর আশার চনমনে আঁচ নিয়ে ফিরেছি
তাকে গোর দেব বলে।
শেষতক স্বজিজ্ঞাসে—তুমি কে?
বিমূঢ় এক, ছায়ায় তাকিয়ে চলি
শান্তি মেলেনা কিছুতেই
জারি তবু প্রশ্ন যতো আর উত্তর ঢাকা পড়ে রয়
মরীচিকাবৎ পর্দায়
তবুও ভাবি সে আসবেই, কাছ ঘেঁষে
কিন্তু যেই সে এসে দাঁড়াল নিকটে, দেখি সে লীন,
মৃত, উধাও!



nonameসাদি ইফসুফ
একাধারে কবি, লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক এবং সক্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। জন্ম ইরাকের বসরায় ১৯৩৪ সালে। উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন আরবি সাহিত্য বিষয়ে। অগ্রজ কবি শাতেল ত্বাকা এবং আবদ্ আল-ওয়াহাব আল-বায়াতির রচনা দ্বারা তিনি দারুণ অনুপ্রাণিত। আরবি ভাষায় তিনিই প্রথম গার্সিয়া লোরকা, ওয়াল্ট হুইটম্যান, কন্সটান্টিন পেত্রো কাফি’র রচনা অনুবাদ করেন। ২০১৪ সালে ‘কুর্দিস্তান’ কে ‘মাঙ্কিস্তান’ নামে ব্যঙ্গ করায়, ইরাকের কুর্দিস্তানের কুর্দি সরকার সেখানে তাকে আজীবন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সাদি বর্তমানে যুক্তরাজ্য অভিবাসী।
আজকের রাতটা কি দুর্বোধ্য?


আজ রাতে মনে করবার মতো কিছু নেই
আমার কোনও সত্য নেই
বলতে চাইছি, মনে করতে পারছি না কোথায় জন্মেছিলাম
বেঁচে থাকার জন্য একটুকরো রুটি জরুরী কি না,
মাও সে-তুঙ-এর সমাজতন্ত্র সবচেয়ে উত্তম কি না,
মাঝেমধ্যে সুড়ঙ্গের ভেতরের সুড়ঙ্গে সেঁধোই আমরা
আমরা কি প্রতিবিম্বিত হই?


প্রথম সুড়ঙ্গে প্রবেশ না করাটাই হয়তো আমাদের জন্য সবচেয়ে ভাল
মাও সে-তুঙ-এর সমাজতন্ত্রই সবচেয়ে উত্তম
কিংবা বিক্ষোভে ফেটে পড়া শ্লোগান
‘আমরা রুটি চাই’।


কোথায় জন্মেছিলাম-এই তথ্যটা হয়তো আমার মনে রাখা উচিৎ
বলছি—জন্মেছিলাম বসরার শহরতলীতে
সে এক দেশ, সবাই যাবে ইরাক নামেই চেনে
পুরনো দলিলেও তা-ই লেখা।
আমাকে বলতে হবে—আমার রক্ত
ইরাকের জন্য প্রবাহিত
আর ইরাক কখনওই মার্কিনিদের নয়।


 


আবদুলযাহরা জেকি


কবি, লেখক ও সাংবাদিক। ১৯৫৫ সালে ইরাকের বাগদাদে জন্ম। লেখালেখিতে সরব আছেন তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে। এ পর্যন্ত পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষটি ‘এ মনোগ্রাম অব লাইট এন্ড ওয়াটার’ ২০০৯ সালে প্রকাশিত।

নির্জন দুপুর

পেঁচাটা সেদিন
পাহাড়ের খাঁজে বসে কস্তুরী গোলাপ বিষয়ে বলছিল—
কস্তুরী গোলাপ
যেনো খুশিতে ডগমগ এমন নির্জন দুপুরে
পেঁচার সৌজন্যে।
সেদিন
আদপে কোনও গোলাপ ছিলই না
আর উৎসবমুখর পেঁচাটির সাথে
তাল মেলালো পাহাড়টি, কণ্ঠে তাঁর পেঁচার গান
যেনো গানে গানে শুনিয়ে দিচ্ছে একা গোলাপের সকল যাতনা।



nonameমানাল আল-শেখ
ইরাকি কবি, লেখক ও সাংবাদিক। উত্তর ইরাকের নিনেভাহ-তে জন্ম, ১৯৭১ সালে। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন দীর্ঘ একযুগ ধরে। তাঁর কবিতা ও অন্যান্য রচনাসমূহ ইংরেজি, নরওয়েজিয়, ফরাসি, কাতালান এবং ইতালিয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ইম্পসিবল লেটারস (২০১০) এবং উইথ এ রেড ডট আণ্ডার হিজ লেফট আই (২০১০)।
আমার শরীর


তোমার সাথে কাটানো প্রথম রাতে যে শরীরটা ধার দিয়েছিলাম...
আমি সে শরীর প্রতি রাতে পাহারা দিই, দেখি এক নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের দিকে ধাবমান
যেখানে বালিয়ারী বয়স শিরার ভেতর বিশ্রাম নেয় আর
অবসন্ন জাহাজ তার চোখে অবতরণ করলে
ঘুমের শমন জারি হয়।