মানুষ এত কই যায়

মাটির শিথানে

মানুষ এত কই যায় 
পতনে দহনে স্খলনে 
সমরে সংগ্রামে— 
অবিরাম
অশ্বে-বিমানে-জলযানে...

মানুষ এত কই যায়
শোকে অসুখে অবসাদে 
বিষ ও বিষাদে—
অবিকার
অবিরোধ আত্মহননে...

মানুষ এত কই যায় প্রাণছুটে
কি আছে সেখানে
আছে কি ফাল্গুন, সূর্যমুখী—
বর্ণিল রঙের বেসাতি
আছে কি মেঠোপথ আনত নারীর মুখ
আছে কি পারাপার, ভাটিয়ালি
রাতের উজানে ভাসা চারণের বাঁশি
আছে কি নীলখাম— প্রথম প্রেমের দ্বিধা
আছে কি মায়ের ছোঁয়া, কোমল রসনা

মানুষ কই এত যায় 
একবারও চায় না ফিরে;
দেখে না কেমন আছে বিরাণ ভূমিটি 
মানুষ কিসে এত ভুলে থাকে— 
কীসের আশ্বাসে ডুবে!
আমিও সেখানে যাব— 
মাটির শিথানে দেবো ঘুম।

অগ্নিজা 

ঝলমলে আলোসকালে দুইবন্ধু যখন নিহারণকে দেখতে এলো তখন সে ছিল মরফিনের তীব্র আবেশে অচেতন; যে দশায় মস্তিষ্ক স্মৃতিচর্বণে সক্ষম হবার কথা নয় কিন্তু ওর ঠোঁটদুটো নড়ছিল। জীবনের এই অপচয়ে-অবহারে বন্ধুত্বের করুণায় অভ্যাগতদের একজন উৎকট ভাপের আবরণ পেরিয়ে ওর ঠোঁটের কাছে কান ঠেকালো এবং কম্পমান ওষ্ঠ থেকে জড়ানো স্বরে বারবার একই ধ্বনি নিঃসরণে তার চোখে জল ভরে উঠল।

অগ্নিজা এক কামনা-ফুলের নাম। লক্ষ লক্ষ কোরকের নীল-নেশা সে ছড়িয়েছে চারদিক। সেই আঘ্রাণে অবসাদে ডুবেছিল নিহারণ, যার ছিল দেখার বয়স; তাকে আজ দেখেছে বন্ধুরা—তীব্র তমসার কোলে সে গান করে অস্ফূট : অগ্নিজা, অগ্নিজা... 


জুয়ার টেবিলে

জুয়ার টেবিলে থাকে নগ্নচোখ
রাগী পুরুষের সুস্থির ভঙ্গিমা
কড়া পানীয় ঢেলে দাঁড়িয়ে থাকা নায়িকাদের প্রখর প্রণোদনা 
স্তন ও তরলের উত্তাল ওঠানামা—
পাশে কিছু শ্রান্ত সিথান
জুয়ার টেবিলে মন একপেশে—
চক্রসুখী আঙুলের বশে বাজি রাখে জীবন-মরণ

জুয়ার টেবিলে আসে আত্মখুনি
নেই যার সুখের ঠিকানা—
নিজের পৃথিবী বেচে কোনও এক শান্ত-সকালে সে— 
ফিরে চলে নতমুখ;
আমরণ অভিলাষী—
মারণের অস্ত্র হাতে ঘুরে...

স্ত্রী-বিষয়ক টীকা 

বিবাহের দ্বিতীয়বর্ষে এক অষ্টাদশী রমণীর পায়ের গোছা ও ঘনচুল বাংলারেলের টিকিট কালেক্টর কমরুদ্দিনের মনোযোগ আকর্ষণ করে, ফলে টিকিট চেকের উছিলার বারকতক ফিরে ফিরে সে ঠ-বগির যাত্রীদের বিরক্ত করে। যাত্রীরা সর্বদা নিরীহ তাই তৃতীয় দফাতেও কেউ উত্তেজনা প্রকাশ করলো না। যেহেতু নিশিথ-যাত্রীনির নম্বর বা ঠিকানা জিজ্ঞাসাটা সৌজন্যের সর্বসীমা লঙ্ঘন করে তাই ইচ্ছে-সত্ত্বেও সে নিজকে সংযত রাখে। তারপর দিনকতক ঘনচুল আর রম্ভার-বগলির মতো গোছাদুই স্বপ্নেও হানা দিয়েছিল এবং কিছুদিন সে ছিল অচিন উর্বসীর স্বপ্ন-ঘোরে আচ্ছন্ন। আর ঘোরের বশেই একদিন প্রাতঃরাশের মুহূর্তে স্ত্রীর কাছে সে ঘনচুল ও মোটাগোছার বর্ণনা করে বসে! সেই থেকে শুরু সন্দেহের লাল নীল বিচিত্র গ্রন্থনা, সেই থেকে মাছি-ভনভন সকাল-দুপুর-অষ্টপ্রহর! সেই থেকে স্বপ্ন ও সুন্দরের পিঠে অবিরাম কাকের কীর্তন! 

বিবাহের যুগপূর্তি শেষেও যখন একমাত্র বধূটির আক্ষেপ ও হাহাকার ঘোছলো না তখন কমরুদ্দিন ভাবল এসব হা-হুতাশ, স্বপ্ন ও সংকট থেকে বহুদূরে নির্বাসনে কেমন হয় একাকী সংসার, দিনগুনে—গুনে গুনে তসবির মালা তীর্থবিজনে জীবন কেমন?

সুতরাং সে এমন এক তীর্থের উদ্দেশে বাড়ে যার অবস্থান সম্পর্কে কেউ জানে না! এবং পরদিন ভোরসকালে জেগে বধূ যখন পাশের সজ্জাটি খালি এলোমেলো পড়ে থাকতে দেখলো তারপর থেকেই সূচনা ঘটল এক বিরতিহীন কান্নার, যেহেতু লোকটি দূরদেশে ছিল তাই সহধর্মিণীর ভালোবাসাবিষয়ক এমতো অশ্রু ও বিষাদ সম্পর্কে একটুও জানার অবকাশ পেল না!