প্রসঙ্গ 'সামান্য একটু ডিটেইল'

'সামান্য একটু ডিটেইল' গল্পটি এক নামহীন আরব মেয়ের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। বইটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশে ১৯৪৯ সালের একদল ইসরায়েলি সৈন্যের কাহিনি বলা হয়েছে, যারা মরুভূমিতে টহল দেওয়ার সময় এক আরব মেয়েকে বন্দি করে ধর্ষণ ও হত্যা করে। দ্বিতীয় অংশে এক আরব নারীর গল্প বলা হয়েছে, যিনি পঁচিশ বছর পর এই ঘটনার একটি সংবাদ প্রতিবেদন দেখেন। তিনি নিজেও জানেন না কেন, কোন এক অদ্ভুত শক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে—এই ঘটনার আরও বিস্তারিত অনুসন্ধান করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছেন।

গল্পটি খুব জটিল নয়। কিন্তু শিবলি যেভাবে লিখেছেন, তা আমার কাছে বেশ বৈপ্লবিক মনে হয়েছে। তিনি যেন ইচ্ছাকৃতভাবে প্রচলিত লেখার মৌলিক নিয়ম—যেখানে কাহিনির দ্বন্দ্ব ও নাটকীয়তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—তা উল্টে দিয়েছেন। পুরো বইটি মূল ঘটনাকে খুব বেশি জায়গা দেয় না; বরং, বইয়ের শিরোনামের (সামান্য একটু ডিটেইল) মতোই, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে থাকে তুচ্ছ, আপাতদৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয় বিবরণ।

উদাহরণ হিসেবে প্রথম অংশের কথা বলা যায়, যেখানে মূল অপরাধী ইসরায়েলি সৈন্যের শেভ করার পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে—প্রায় যেন একটি হাই-রেজুলেশন ক্যামেরায় ধারণ করা দৃশ্যের মতো। সে কীভাবে পানির জেরিক্যান থেকে বাটিতে পানি ঢালে, কীভাবে সে শেভিং ক্রিম মাখে, কীভাবে সে ধীরে ধীরে শেভ করে—প্রথমে থুতনিতে, তারপর গালে, কীভাবে কাটা দাড়ির অংশগুলো পানিতে ভেসে ওঠে—এমন সমস্ত অপ্রাসঙ্গিক মনে হওয়া বিবরণ বেশ জায়গাজুড়ে লিখেছেন।

আগেই বলেছি শিবলি যেভাবে লিখেছেন, তা আমার কাছে বেশ বৈপ্লবিক মনে হয়েছে। 'সামান্য একটু ডিটেইল' এমন একটি উপন্যাস, যেখানে কাহিনির বিন্যাস খণ্ডিত, তা যদি আমাকে পুরোটা পড়তে বাধ্য করে এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে, তবে এটি প্রমাণ করে যে তিনি আরও উচ্চতর স্তরের লেখনীতে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন এবং সফল‌ও হয়েছেন। এমনকি যখন সহিংসতা হঠাৎ বইয়ের শেষের দিকে উদ্ভাসিত হয়, তখনও তার লেখনী এত সংযত যে তা প্রায় শীতল ঠেকে। কিন্তু কাহিনির বর্ণনাকারী কখনোই ঘটনার ওপর হস্তক্ষেপ করেন না; কোনো মন্তব্য বা আবেগ প্রকাশ না করে তিনি কেবল এক নিখুঁত পর্যবেক্ষক ও লেখক।

সব আপাতদৃষ্টিতে বিরক্তিকর ও অর্থহীন বিবরণ একত্রে মিলিত হয়ে শেষ পর্যন্ত যখন আরব মেয়েটির হত্যার মতো একটি বিবরণ প্রকাশ করে, তখনই তাদের প্রকৃত অর্থ বোঝা যায়। তখনই উপলব্ধি হয় যে নামহীন মেয়েটির ধর্ষণ ও হত্যা—যা এতটা আকস্মিক এবং এতটাই অনিয়ন্ত্রিত ছিল। যেখানে অপরাধী ইসরায়েলি সৈন্য তার অধস্তনদের ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে বলে যে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে নাকি হত্যা করা হবে—এটি অপরাধীর দৃষ্টিতে তার দৈনন্দিন জীবনের একটি তুচ্ছ ঘটনা মাত্র।

ইসরায়েলি সৈন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে, যিনি এই সহিংসতা চালিয়েছেন কিন্তু কোনো আবেগগত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেননি, মেয়েটির মৃত্যু তার কাছে পায়ে মাকড়সার কামড়ের চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

বইয়ের দ্বিতীয় অংশটি যেন এক ভৌতিক গল্পের মতো। পঁচিশ বছর পর, নামহীন আরব মেয়েটি যখন ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলিতে মরুভূমিতে নিহত হয়, তখন আরেকজন আরব নারী বেরিয়ে পড়েন ঘটনার আরও বিশদ অনুসন্ধানে। তবে তাকে তাড়িত করে দায়বদ্ধতা বা ন্যায়বিচারের কোনো অনুভূতি নয়, বরং একটি ক্ষুদ্র বিবরণ। তার জন্মদিন এবং নিহত মেয়েটির জন্মদিন একই দিন। একদিক দিয়ে দেখলে প্রথম অংশের অনেক বিবরণ দ্বিতীয় অংশে প্রতিধ্বনিত হয়। কুকুরের বাধা দেওয়া এবং ইসরায়েলি সৈন্যদের সামরিক কুকুর, হোটেলের বাথরুমে সাবানের ফেনা এবং প্রথম অংশে আরব মেয়েটিকে বাধ্য করা গোসলের দৃশ্য, পাহাড়ে দেখা উট এবং ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলিতে নিহত উট, অন্তহীন কুয়াশা, এবং অবশ্যই বন্দুকের শব্দ।

দ্বিতীয় অংশের আরব নারী যেন প্রথম অংশের আরব মেয়েটির পুনর্জন্ম। তারা একই দিনে জন্মেছে, যা একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত। নাহলে, তার মধ্যে এই ব্যাখ্যাতীত ভয় ও উদ্বেগ কীভাবে আসে? সে তার পূর্বজন্মের যন্ত্রণা ভুলতে পারে না। তাই সে সেই দিনের ঘটনা পুনরায় দেখতে বেরিয়ে পড়ে, হয়ত তার স্মৃতি নিশ্চিত করতে। কিন্তু তাকে অপেক্ষা করতে হয় আরেকটি গুলির বৃষ্টি।

শিবলি অনেক সময় ব্যয় করেন সীমান্ত পার হওয়ার বর্ণনা দিয়ে—একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর ইতিহাস জাদুঘর-এ প্রবেশ করার অভিজ্ঞতা এবং আরেকটি বর্ণনার মুখোমুখি হওয়ার প্রক্রিয়ায়। শিবলি দুটো অংশকে একটি ক্ষুদ্র দৃষ্টিকোণ থেকে, একটি সামান্য বিবরণ তুলে ধরেন—কিন্তু সেটি এক প্রচণ্ড শক্তিশালী সত্য। কোনো গুরুগম্ভীর শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। বরং, সীমান্ত পার হওয়ার মানসিক চাপ, শারীরিক লঙ্ঘন, প্রতিরক্ষা চৌকি অতিক্রম করার সময়কার মানসিক অবস্থা—এইসব অত্যন্ত স্পষ্ট বিবরণ দিয়েই তিনি পরিস্থিতির গভীরতা প্রকাশ করেন।

ব‌ইটি এজন্য সবার পড়া জরুরি কারণ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো বিষয়গুলির গুরুত্ব এবং তাদের গভীর অর্থ জানা প্রয়োজন। জীবনের ছোট ঘটনাগুলোর মধ্যে বড় শিক্ষা খুঁজে বের করা যায়। যারা সাধারণ বিষয় এবং মানুষের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে চান, তাদের জন্য এটি একটি উপকারী বই। জীবনের সাধারণ জিনিসগুলোতে লুকানো রহস্য এবং তা মানবিক সম্পর্কের মধ্যে কীভাবে প্রভাব ফেলে, তা জানতে।

'সামান্য একটু ডিটেইল' আদানিয়া শিবলি রচিত ও ওয়াহিদ কায়সার ও ফায়েকুজ্জামান ফাহাদ অনুদিত ছোট্ট পরিসরের একটি উপন্যাস, তবে এর বিস্তৃতি ব্যাপক। ব‌ইটা শেষ করার পর আপনার বারবার মধ্যপ্রাচ্যের জ্বলন্ত মরুভূমি, সশস্ত্র সৈন্য, ছোট জলপাই গাছ এবং কালো পোশাক পরা আরব মহিলা, দূর থেকে ভেসে আসা কুকুরের ঘেউ ঘেউ, মহিলাদের কান্না এবং  গুলির শব্দ মনে আসবে। যা অনেকের জন্য এক দিক থেকে মানসিক পীড়ার কারণও হতে পারে।

প্রকাশনা: ঐতিহ্য।
মূল্য: ২৩০ টাকা।