মোঃ রেজাউল করিমের “সীমান্তের দুই পারে” উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আবুল ফয়েজ নামের এক সংবেদনশীল, মেধাবী ও আত্মমগ্ন তরুণ। যার জীবনের সামনে এসে পড়ে সময়ের উত্তাল রাজনৈতিক বাস্তবতা ও তার ব্যক্তিগত অভিঘাত। বহরমপুরের মুর্শিদাবাদে জন্ম নেওয়া ফয়েজ কলেজ পড়তে পাড়ি দেয় কলকাতা শহরে। সে সেখানে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে গড়ে ওঠা এক তরুণের জীবন হঠাৎ করেই ১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসের রক্তমাখা কলকাতা। রাজপথে মানুষের চলাচল বন্ধ, হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় পুরো শহরে রুদ্ধশ্বাস। তরুণ ফয়েজ তখনো পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেনি যে, ইতিহাসের পাতায় লেখা রাজনৈতিক উত্তাপ কীভাবে বাস্তব জীবনে মৃত্যু ও বিভাজনের রূপ নেয়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করে সে আশ্রয় নেয় এক মুসলিম ছাত্রাবাসে—বেকার হোস্টেলে। তবে আশ্রয় পেলেও তার বুকজুড়ে তখন শুধুই বহরমপুরের ডাক, সেই জলঙ্গির পাড়, সেই ভিটে, সেই বাড়ির উঠোন যেখানে সে একদিন তার শৈশব জীবনে আনন্দে কাটিয়েছিল। সেই হোস্টেলে না থাকতে পেরে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসা যোদ্ধার মতো সে বাড়ি ফিরে আসে ফয়েজ। তবে সেখানেও তার জন্য অপেক্ষা করে বিশাল এক ধ্বংসস্তূপ। পুড়ে যাওয়া গাছ, ছাই হয়ে যাওয়া জমি, আগুনে পোড়া এক তেঁতুলগাছ, যার ডালে একদিন তার দোলনা ঝুলত—এসবের মধ্যে সে খুঁজে ফেরে হারিয়ে যাওয়া শেকড়। তার বাবার জমি দখল হয়ে গেছে, অন্যেরা সেইসব সম্পত্তি নিজেদের বলে ভোগ বিলাস করছে। ফয়েজদের বাড়িটা এখন শুধুই ধোঁয়ার স্মৃতি। বহরমপুর, যা একদিন তার আত্মপরিচয়ের কেন্দ্র ছিল, এখন শুধুই এক বিপন্ন ও নিরাপত্তাহীন জায়গা। তাই সে জীবন রক্ষার প্রয়োজনে পদ্মা নদীতে ওপার বাংলায় চলে যাওয়ার একটা নৌকায় ওঠার সিদ্ধান্ত নেয়। পাড়ে দাঁড়িয়ে বিক্ষুব্ধ পদ্মার দিকে তাকিয়ে ফয়েজের হৃদয় যেনো ধীরে ধীরে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোঁটা নিঃশব্দ অশ্রু, হৃদয় থেকে বের হয় এক অজানা আগুন। দূরের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গের গর্জনে বাজে এক নীরব বিদ্রোহের গান। ফয়েজ বুঝতে পারে, আজকের এই যাত্রা শুধুই নদীর এপার থেকে ওপারে যাত্রা নয়—এ এক আত্মার গভীর অন্তঃসারশূন্য রূপান্তর, যেনো নিজেকে আগুনের জঠরে সঁপে দিয়ে নতুন জন্মের আলোয় পুনরাবিষ্কারের এক অমোঘ আহ্বান।
নৌকায় ওঠার পর ফয়েজ অনুভব করে, এই দাঙ্গার বাতাসে মিশে আছে তার মায়ের হাতের শেষ স্পর্শ, বাবার গোপন ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টি আর তার শৈশব জীবনের ম্লান স্মৃতির আভাস। পদ্মার জল যেনো তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, “আজ তুমি বিদায় নিচ্ছ সত্যি তবে তোমার শেকড় চিরকাল এই মাটির তলায় গেঁথে থাকবে।”
এবার আসা যাক এই উপন্যাসের চরিত্র নিয়ে খানিক আলাপে। এখানে আবুল ফয়েজের চরিত্র যেন ইতিহাসের মগ্ন কোনো কুয়ার নিচে পড়ে থাকা একলা পাথর। যা দেখতে কারও চোখে পড়ে না অথচ যার চারপাশে বয়ে চলে সময়ের স্রোত, ইতিহাসের জোয়ারভাটা। মোঃ রেজাউল করিম এই চরিত্রের ভেতর দিয়ে যে সাহিত্যিক স্থাপত্য নির্মাণ করেছেন, তার প্রধান সৌন্দর্য ফয়েজের আত্মচেতনার গভীর স্তরে। যেখানে দেশভাগ, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা ও আত্মপরিচয়ের টানাপোড়েন এক অনন্ত যুদ্ধের মতো সহাবস্থান করে। উপন্যাসের কেন্দ্র নয় বরং মেরুতে দাঁড়িয়ে থাকা চরিত্র আবুল ফয়েজ। চরিত্রটা নাটকীয় নয় তবে গভীর আবেগে ভরা। সে কাঁদে না অথচ তার বুকভরা দীর্ঘশ্বাসে ভার। সে উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করে না কিন্তু তার নীরবতা ছুঁয়ে যায় কোলাহলের উৎস। মার্কেস যেমন বাস্তবতার গায়ে ফেলে দেন অলৌকিকতার স্বপ্নজাল, তেমনি এই উপন্যাসে বাস্তবতাই হয়ে ওঠে অলৌকিক। যেখানে ভিটেমাটির ধুলো হয়ে ওঠে আত্মপরিচয়ের প্রতীক আর বাবার একগুঁয়ে জমি না ছাড়ার সিদ্ধান্ত হয়ে ওঠে ইতিহাসকে টেনে ধরে রাখা এক প্রতীকী প্রতিরোধ।
এই উপন্যাসের সাহিত্যিক স্বরূপ নির্ধারণে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো লেখকের ভাষার সংযম ও আবেগের অন্তরশীলতা। এখানে কোনো বক্তৃতা নেই, ঘোষণা নেই, বরং প্রতিটি বর্ণনায় থাকে সময়ের কষ্ট-সঞ্চিত স্তর। ইতিহাস এখানে শুধু প্রেক্ষাপট নয় বরং চরিত্রের চেতনায়, চিন্তায়, প্রতিদিনের ক্ষুদ্র অনুরণন। যেমন ফয়েজের স্মৃতিতে বারবার ফিরে আসে দোলনায় ঝোলানো তেঁতুলগাছ কিংবা মায়ের হাসিমাখা মুখ, যা একেকটি পৃষ্ঠা হয়ে দাঁড়ায় বিস্মৃত ইতিহাসের পুনর্পাঠ।
এ উপন্যাসে লেখক ইতিহাসের রূঢ় বাস্তবতার ভেতর দিয়ে একজন সংবেদনশীল মানুষের অস্তিত্ববাদী দ্বন্দ্ব ও মানসিক অভিযাত্রাকে নিপুণভাবে চিত্রিত করেছেন। অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের মতে, মানুষ তার অস্তিত্ব নিয়ে জন্মায় কিন্তু তার জীবনের অর্থ বা ‘সারবত্তা’ তাকে নিজেকে নির্মাণ করতে হয়। ফয়েজের চরিত্র সেই অর্থে একদম নিরেট অস্তিত্ববাদী। তিনি একসময় মেডিকেল কলেজে পড়ছেন, উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিন্তু দাঙ্গা, দেশভাগ, জমি হারানো আর পরিবার বিচ্ছিন্নতা—সবকিছু মিলিয়ে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো ভেঙে পড়ে। তবুও এই ভেঙে পড়ার ভেতর দিয়েই সে নিজেকে পুনর্গঠনের চেষ্টা করে। দেশভাগ ফয়েজকে শারীরিকভাবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে দেয় কিন্তু মানসিকভাবে সে পরিপূর্ণভাবে কোথাও ঠাঁই পায় না। বহরমপুরের বাড়ি পোড়ানো, বাবার জমি দখল হয়ে যাওয়া, কলকাতা থেকে বিতাড়িত হওয়া—এসব কেবল ঘটনাই নয়, এগুলো তার পরিচয়চ্যুতি এবং শেকড়চ্যুতির প্রতীক। এই ভাসমান অবস্থানই তাকে এক গভীর অস্তিত্ব সংকটে ফেলেছে। তার মনে প্রশ্ন জাগে: “আমি কার, আমি কোথায়, আমার ঘর কোথায়?” এই প্রশ্নগুলো একেবারে সার্বজনীন অস্তিত্ববাদী প্রশ্ন। ফয়েজের পরিবার দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়া মানে শুধু ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা নয়—বরং তা তার মানসিক বিচ্ছিন্নতাকেও নির্দেশ করে। মা এদেশে আসতে চায় কিন্তু তার বাবা নয়। চাচার বাসায় শরনার্থীর জীবন, পুনরায় পড়ালেখার চেষ্টা, চাকরি সবকিছুই তার জীবনের মধ্যে এক অদৃশ্য অন্তর্ঘাত সৃষ্টি করে। এই অন্তর্ঘাত থেকেই জন্ম নেয় তার আত্ম-অনুসন্ধান। যা মূলত অস্তিত্বের বোধের গভীরে গিয়ে পৌঁছে। উপন্যাসে ফয়েজের মানসিক অবস্থান প্রায়শই সময়ের ফ্রেম থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। সে কখনো বর্তমানের দাঙ্গাপীড়িত বাস্তবতায় আবার কখনোইবা জলঙ্গির ঘাটের শৈশবে ফিরে যায়। এই স্মৃতিপ্রবাহ এবং বাস্তবতার সংঘাতে তৈরি হয় এক ধরনের “চেতনার প্রবাহ” (stream of consciousness)। ফয়েজের মননে অতীত-বর্তমান ভবিষ্যতের অবিরাম সংলাপ চলে—যা তার চেতনাকে করে তুলে বহুমাত্রিক। উদাহরণস্বরূপ, কলকাতা থেকে বহরমপুর ফেরার পথে সে যখন দেখে, তার ঘর পোড়ানো হয়েছে। তখন তার মনে পড়ে বাবার সাথে শেষ দেখা হওয়া সময়ের কথা, ছোটবোনের হাত ধরে জলঙ্গির পথ ধরে হেঁটে যাওয়া অথবা মেডিকেল কলেজের জীবনের প্রথম দিন। এই টুকরো টুকরো চেতনার অনুরণন এমন এক চিত্ররূপ দেয়, যা তার ভেতরকার মানুষটির চেতনার দ্বন্দ্ব। অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের প্রতি সর্বোচ্চ প্রত্যাশা হচ্ছে, সে যেন নিজের দায় স্বীকার করে এবং নিজের জীবনকে নিজেই রচনা করে। ফয়েজ যখন বাস্তবতা মেনে নেয় এবং নিজের জীবনকে এগিয়ে নিতে শুরু করে। বোনেদের নিয়ে আসে পূর্ব বাংলায়, তখনই সে হয়ে ওঠে সক্রিয় অস্তিত্ববাদী সত্তা। সে পালিয়ে যায় না বরং নির্মাণ করে। একটি অসম্পূর্ণ জীবনের ভেতরেই সে তার জীবনের অর্থ খুঁজে নেয়।
“সীমান্তের দুই পারে” উপন্যাসটি ইতিহাসভিত্তিক হলেও একে নিছক ঐতিহাসিক উপাখ্যান বলা চলে না বরং এটি এক বিস্তৃত ও সংবেদনশীল শিল্পরূপের পরিচয় বহন করে। এই উপন্যাসে ইতিহাস, মানবমন, স্মৃতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতা মিলেমিশে তৈরি হয়েছে এক গভীর সাহিত্যিক কাঠামো। যেখানে ভাষা, চিত্রকল্প, প্রতীক এবং সময়ের বিন্যাস একান্তভাবে শিল্পের সেবায় নিয়োজিত। লেখকের গদ্যশৈলী অনাড়ম্বর অথচ গভীর। যেখানে অতিনাটকীয়তা নেই, নেই কোনোরকম আবেগনির্ভর চিৎকার। আছে কেবল নীরবতার একটি প্রবল আবহ। ভাষার ভেতর গড়িয়ে পড়ে সংযম, সংবেদনশীলতা এবং সেইসব স্তব্ধতা, যা পাঠকের মনে তীব্র প্রতিধ্বনি তুলে। উপন্যাসজুড়ে লেখক কিছু দৃশ্য ও প্রতীক ব্যবহার করেছেন, যেগুলো বাস্তবতা ছাপিয়ে বিমূর্ত বেদনার রূপ নেয়। যেমন, পদ্মা নদী এখানে কেবল একটি জলস্রোত নয় বরং বিভাজনরেখার প্রতীক—যা ভৌগোলিক সীমান্তকে ছাড়িয়ে মানুষের চৈতন্যের ভেতর বিভক্তির অনুরণন তুলে। তেমনি পুড়ে যাওয়া তেঁতুলগাছ, ধোঁয়ার দেয়াল, ছাই হয়ে যাওয়া গবাদিপশু—সবই হয়ে ওঠে একেকটি রূপক। যা ফয়েজের মানসিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ। স্মৃতি ও বর্তমানের বিন্যাসে উপন্যাসটি গড়ে ওঠে একটি মনস্তাত্ত্বিক গতিরেখায়। যেখানে সময় একরৈখিক নয় বরং সচল ও স্তরিত। কখনো স্মৃতির ভেতর তলিয়ে যায় কাহিনি আবার কখনো বর্তমানের সংকটে ফিরে আসে অতীতের প্রতিধ্বনি। এই সময়বিন্যাস, স্মৃতির প্রবাহ ও ভাঙা আত্মপরিচয়ের চিহ্ন মিলেমিশে একটি প্রায় কবিতার মতো গদ্যধারা সৃষ্টি করেছে। যেখানে পাঠক কেবল ঘটনা জানেন না বরং দৃশ্য দেখতে পান। লেখকের বর্ণনায় এমন এক চিত্রকল্পময়তা রয়েছে, যা কখনো অলংকরণশূন্য হলেও দৃষ্টিপ্রবাহে সমৃদ্ধ করে তুলে।
উপন্যাসের সবচেয়ে বড় শিল্পসাফল্য এখানেই যে, লেখক সরাসরি রাজনীতি কিংবা ইতিহাস ব্যাখ্যা না করে মানুষের মনের গভীর স্তরে একটি সংবেদনশীল ভাষাশৈলীর মধ্য দিয়ে সেই ইতিহাস ও রাজনীতির অভিঘাত দেখিয়েছেন। ফলে “সীমান্তের দুই পারে” কেবল দেশভাগ নিয়ে লেখা আরেকটি উপন্যাস নয়, এটি হয়ে উঠেছে সময়, চেতনা এবং শিল্পের এক অনুপম সংমিশ্রণ।
শিল্পরূপের দিক থেকেও এই উপন্যাস স্বতন্ত্র। যেখানে অনেক দেশভাগ-ভিত্তিক উপন্যাসে ডকুমেন্টারি ঢঙের দৃশ্যপট ও প্রচলিত ভাষা ব্যবহৃত হয়, সেখানে“সীমান্তের দুই পারে” তুলনামূলকভাবে কাব্যিক, সংবেদনশীল ও নিঃশব্দতার শিল্পরীতিকে ব্যবহার করে। এতে পাঠকের সামনে ইতিহাস উঠে আসে ব্যক্তির স্মৃতিতে মিশে—ধোঁয়া, নদী, গাছ, বাড়ি আর শূন্যতার অনুপুঙ্খ বিবরণে।
“সীমান্তের দুই পারে” উপন্যাসটি একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক মুহূর্ত—১৯৪৭ সালের দেশভাগ এবং তার পূর্বাপর রাজনৈতিক অভিঘাত নিয়ে নির্মিত। কিন্তু এটিকে কেবল ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ বলে সীমিত করা যায় না। কারণ লেখক ইতিহাসের ঘটনাক্রম পুনর্গঠনের পরিবর্তে একজন সংবেদনশীল মানুষের ভেতর দিয়ে সেই ইতিহাসকে উপলব্ধি করিয়েছেন। আবুল ফয়েজ নামের প্রধান চরিত্রের পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা, ব্যক্তিগত অনিশ্চয়তা এবং আত্মপরিচয়ের সংকট আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে, ইতিহাস কেবল রাষ্ট্রের নয়, মানুষেরও।
এখানে উপন্যাসটি ইতিহাসকে অনুসরণ করেনি বরং ইতিহাসের বুকে ঢুকে পড়েছে। এই ভেতরে ঢোকার ক্ষমতা, ব্যক্তিগত ক্ষত দিয়ে সময়ের বৃহৎ রক্তক্ষরণকে উপলব্ধি করানো, এই শক্তিই উপন্যাসটির প্রধান সাহিত্যিক স্বার্থকতা।