এ পোর্ট্রেট অব দি আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়াং ম্যান

তরুণ লেখকদের আত্মবিশ্বাসের দলিল

nonameজেমস জয়েসের লেখার পরিমাণ খুব বেশি নয়। কিন্তু যা লিখেছেন তাই ইতোমধ্যে ক্ল্যাসিকের পর্যায়ে উন্নীত। বলা হয়ে থাকে এই আইরিশ লেখকের সব লেখাই আত্মজীবনীমূলক। প্রশ্ন হচ্ছে আসলে কোনো শিল্পীই কি ‘আত্ম’কে জড়িত না করে শিল্প সৃষ্টি করতে পারেন? কারণ এক ‘আত্ম’র বিভিন্ন রূপ। তবে জয়েসের জীবনী যারা পড়েছেন তারা জয়েসের ইউলিসিস, গল্পের বই ডাবলিনার্স আর এই উপন্যাসটার মধ্যে জয়েসের নিজের জীবনের চিত্র দেখতে পান। বিশ্বসাহিত্যে এই বইটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। জয়েসের গদ্য এমনিতে অসামান্য কিন্তু তার বিষয়ের দর্শন জটিল। তাই হয়ত সাধারণ পাঠকের কাছে ভীতিপ্রদ। এই বইটির সবচেয়ে গুরুত্বের দিকটা হচ্ছে প্রথা-ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের অন্ধত্ব ছেড়ে শিল্পকে সাথে নিয়ে এক তরুণ শিল্পীর একাকি চলার লড়াই। ষোল থেকে বিশের মধ্যে এক যুবকের চিন্তা বদলে যাওয়া। বলতে গেলে একজন শিল্পী বা লেখক বা ভাবুককে তো আগে নিজের দাঁড়ানোর জায়গাটা তৈরি করতে হবে। তিনি কোন জমিনে দাঁড়িয়ে দুনিয়াকে বিচার করবেন? এটা একটা বেসিক প্রশ্ন। আমাদের এ গল্পের নায়ক স্টিফেন ডিডালাস প্রথাগত এক আইরিশ খ্রিস্টান পরিবারে জন্ম নেন। কৈশোরে স্কুলের হোস্টেলে থাকা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার ভেতরে এই গল্প তৈরি হয়। তখনকার অভিজাত মাধ্যমিক স্কুলগুলো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হত এবং পাদ্রিরাই ছিল সেসব স্কুলের শিক্ষক। দেখা, শোনা, স্পর্শ, গন্ধ ইত্যাদির ভেতর দিয়ে মানব শিশুর যে বেড়ে ওঠা সে সব ব্যাপারে জয়েস সচেতন। এরপর স্কুলে সহপাঠীদের নিষ্ঠুরতা। শিক্ষকদের অবিচার ও ভয়ভীতি। ধর্মীয় শিক্ষকদের কড়াকড়ি। এটা করা যাবে না ওটা করা যাবে না। নারী সংসর্গ ও কনফেশন। কনফেশনের পর এক ভয়াবহ নরকভীতি। পাদ্রি হবার জন্য মনস্থির করা ও সেই ভীতি থেকে বেরিয়ে এক মুক্ত স্বাধীন মানুষ হওয়া দিকে যাত্রা এই তরুণ শিল্পীর ব্রত। কাহিনির জন্য যারা উপন্যাস পড়েন তাদের হয়ত জয়েস হতাশ করবেন। কিন্তু যারা কাহিনির পরের পাঠক, মানে যারা কাহিনির বিষয়ের দর্শন ও ভাষা নিয়ে পড়তে চান তাদের জন্য উত্তম লেখক জয়েস।

স্কুলে থাকাকালীনই স্টিফেনের বিভিন্ন জাতের অভিজ্ঞতা হতে থাকে। পরে স্টিফেন বলবেন যে নানা খানাখন্দে ধাক্কা খেয়ে পাওয়া অভিজ্ঞতাই তার জীবন। জয়েস বলেন, স্টিফেনের নস্যির কৌটার সঙ্গে সহপাঠী ওয়েলসের পুরনো বাদাম কাঠের বাঁটওয়ালা ছুরি বদল করেনি বলে তার কাঁধে ধাক্কা মেরে তাকে চতুর্ভূজ গর্তের ভেতর ফেলে দিয়েছিল।

অথবা স্টিফেনের উপলব্ধি, ন্যাস্টি রোশ আর সাউরিন কোকো খেয়েছে যা তাদের অভিভাবকরা তাদের জন্য টিনে করে পাঠিয়েছেন। তারা বলে, এখানকার এই চা-কফি তারা খেতে পারে না। এগুলা নাকি ঘোড়ায় খায়। জানা গেল ওদের দুজনের বাবাই ম্যাজিস্ট্রেট। এইভাবে স্টিফেন শ্রেণি সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করে। অনেক পরে আমরা দেখব এই টুকরো টুকরো ঘটনাগুলোকেই পরম শিক্ষক হিসাবে বরণ করবেন স্টিফেন।

ঈশ্বর আর ধর্ম বিষয়ে ছোটবেলায় তার পরিবারেই তর্ক বিতর্ক হতে দেখেছে স্টিফেন। ফলে নিরবে সেসব তার ভেতর কাজ করতো। অই সময়ে আয়ারল্যান্ডে গির্জাগুলোতে ধর্মের পাশাপাশি পাদ্রিরা রাজনীতিও নিয়ন্ত্রণ করতে চাইতো। সেসব নিয়েই স্টিফেনের বাবা-চাচাদের মধ্যে বাদানুবাদ হচ্ছিলো একদিন। স্টিফেনের বাবা বলছিল গির্জার পরামর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন করতে। কিন্তু চাচা মি ক্যাসি বলল- আমরা ঈশ্বরের উপাসনাগৃহে যাই কায়মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে কোনো নির্বাচনী বক্তৃতা শুনতে নয়।

মধ্যযুগে একসময় ধর্মই ছিল প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। পোপ যেমন নিয়ন্ত্রণ করতো সারা ইউরোপ। তেমনি এরপর ইসলামই নিয়ন্ত্রণ করতো এশিয়া আফ্রিকা আরব ও ইউরোপের কিয়দংশ। কে বলে ধর্ম অরাজনৈতিক? কিন্তু ধর্ম নিজেই ভান করে সে অরাজনৈতিক। এটা তার একটা কৌশলও হতে পারে।

যাইহোক এরপরেই মি ডিডেলাস তথা স্টিফেনের বাবা বলেছিল, যে বাড়িতে খ্রিস্টধর্মের পাদ্রিদের জন্য ভক্তি-শ্রদ্ধা কিছু নেই সেখানে সৌভাগ্য বা ঐশ্বরিক অনুগ্রহ আসবে কোত্থেকে? এর সবই কাজ করতো তরুণ স্টিফেনের মাথায়।

আরো অনেকগুলো বিষয় ধর্ম সম্পর্কে ধীরে ধীরে স্টিফেনের মনে প্রশ্ন তৈরি করতো। প্রোটেস্টেন্ট ছেলে মেয়েরা যিশু জন্ম নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতো ও মেরিকে কুমারি বলে মানত না। প্রোটেস্টেন্টরা এসব নিয়ে হাসাহাসি করতো। আর গির্জার নিচে রাখা মদ খেয়ে একবার কয়জন যাজক ধরা পড়ে। ইত্যাদি বিষয় তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতো।

এরপর তরুণ স্টিফেন স্কুলে তার কথা, লেখায়, তার নিজস্ব যুক্তি দিতে লাগল অচিরেই সহপাঠীদের কাছে পণ্ডিত হিসাবে চিহ্নিত হলো। তার লেখায় ধর্ম বিষয়ে অসহিষ্ণুতা আর সাহিত্যের প্রতি টান খুঁজে পেল যাজকরা। আর সহপাঠীরা আবিষ্কার করলো তরুণ স্টিফেনের ভেতর একজন তরুণ বায়রন বাস করে। বায়রণ তখন তারুণ্যের প্রতীক, যিনি কোনো প্রথা মানেন না, ধর্ম মানেন না। এরপর সহপাঠীদের সাথে তার তর্কবিতর্ক হয়। বোলান্ড জিজ্ঞেস করলো- শ্রেষ্ঠ কবি কে? আরেক সহপাঠী হেরন উত্তর দিল লর্ড টেনিসন। এবার স্টিফেন তার নীরবতা ভেঙে বলল- টেনিসন একটা কবি? সে তো ছড়াকার। বোলান্ড বলল- তোমার মতে তাহলে শ্রেষ্ঠ কবি কে? স্টিফেন উত্তর দিল- অবশ্যই বায়রন। বন্ধুরা অবজ্ঞা করল, বায়রনতো অশিক্ষিত মানুষের কবি। তখন স্টিফেন ক্ষেপে যায়- চুপ কর। কবিতা বলতে তো তোমরা বোঝো স্কুলের উঠানে শ্লেট পাথরের উপর যা লেখা তাই। এরপর সহপাঠীরা বায়রনকে কবি হিসাবে অস্বীকার ধর্মদ্রোহী নীতিভ্রষ্ট বলতে থাকলে স্টিফেনও ক্ষেপে গিয়ে তাদের মূর্খ বললে সহপাঠীরা তাকে বেত, ছড়ি আর গিঁটে ভরা ডাঁটা দিয়ে প্রহার করে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে ফেলে যায়।

প্রতিদিন তাকে স্কুলে এবং গির্জায় গিয়ে জীবনের অর্থহীনতা আর খ্রিস্টের গৌরবগাঁথা শুনতে হয়। সেগুলো নিয়ে সে বিশদে বিচার বিশ্লেষণ করে নিজের ভেতর। একজন যুক্তিবাদী হিসাবে সে এসবের কুলকিনারা করতে পারে না। তার ভেতর সংশয় বাড়তেই থাকে। যাজকরা বলে- দুনিয়ায় আমাদের আগমন মাত্র একটি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। ঈশ্বরের ইচ্ছাপুরণ করার মাধ্যমে আমাদের আত্মার সদ্গতি করা। এছাড়া আর সব কিছু মূল্যহীন। বা এই ঐহিক জীবন ত্যাগের বিনিময়ে পরবর্তী জীবনে তাদের প্রাপ্তি ঘটবে শতগুণ সহস্রগুণ।

আসলে সেমেটিক সবধর্মই এই একই কথা বলে। ইহুদি খ্রিস্টান আর ইসলাম। এজীবন অসার, অর্থহীন। ধার্মিকদের জন্য পরকালই আসল জীবন। এরপর রয়েছে নরকের ভয়ংকর বিবরণ। অনন্তকাল ধরে আগুনে জ্বলতে থাকা।

এরমধ্যে স্টিফেন একদিন গরীব ইহুদি বেশ্যাপাড়ায় এক নারী সঙ্গম করে। তার অন্যরকম অনুভূতি হয়। এবং পরদিনই সে কনফেশন করতে যায় গির্জায়। কনফেশনের এক পর্যায়ে সে স্বীকার করে সে পাপী। এরপরই তাকে পাদ্রি নরকের ভয়াবহ রকম বর্ণনায় সিক্ত করে। স্টিফেন ভয় পেয়ে যায় এবং সে দেখা-শোনা গন্ধ ও স্পর্শ থেকে দূরে সরে আসে। তার অতিরিক্ত সহ্য ক্ষমতা দেখে যাজকরা তাকে পাদ্রি হওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিতে বলে। এদিকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় হয়ে আসে। সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এক পর্যায়ে তার ফেলে আসা জীবন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা তাকে পথ দেখায়। সে ধর্মীয় ভয় থেকে নিস্কৃতি পায়। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং পাদ্রি হওয়ার সিদ্ধান্ত বাদ দেয়। এরপর সে প্লাটো এরিস্টটল ও অন্যান্য দার্শনিকদের লেখা পড়তে থাকে। নিচের বিচারবুদ্ধির ব্যবহার করতে থাকে। আয়ারল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের সাথে কথা হয় স্টিফেনের সে তাদের সোজা বলে দেয় সে জাতীয়তাবাদী নয়। এক বন্ধু তাকে তাকে প্রশ্ন করে প্রথা-ধর্ম ও জাতীয়তা ছাড়া সে কি করে বাঁচবে? স্টিফেনের সহজ উত্তর- শব্দ আর রঙের মাধ্যমে চেতনার রুদ্ধ কপাট খুলে দিয়ে বিনয়ের সাথে প্রকাশ করা। এটাই সুন্দরের রূপকল্প সৃষ্টি অর্থাৎ শিল্প।