দেবেশ রায়ের গল্পপাঠ

‘হাড়কাটা’ থেকে ‘উদ্বাস্তু’ ।। পর্ব-২

এবছর একুশে গ্রন্থমেলায় কাগজ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে দেবেশ রায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প। সম্পাদনা করেছেন সমরেশ রায়। বইয়ের শেষে একটি দীর্ঘ পাঠ-অভিজ্ঞতা লিখেছেন প্রশান্ত মৃধা। সেই লেখাটি পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।
প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: ‘হাড়কাটা’ থেকে ‘উদ্বাস্তু’

‘ঐ বছরই [১৯৫৫] জলপাইগুড়ির আনন্দচন্দ্র কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রের পাঠানো এই গল্পটি [হাড়কাটা] সাপ্তাহিক ‘দেশ’-এ ছাপা হয়ে গিয়ে যেন তাকে পাকাপাকি গল্পকারই বানিয়ে দিল।’ লিখেছেন দেবেশ রায়। এবং, সেই থেকেই তিনি লেখক, সেই থেকেই নিজের ও নিজেদের সাহিত্যযাত্রার পথ অগ্রজদের সঙ্গে তুলনামূলক বিচার করে দেখেছেন। ফলে পুরনো বাংলা গদ্য কিংবা উনিশ শতকে বাংলা সাংবাদিক গদ্যের ঠিকুজি খোঁজা, সেই যাত্রার ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথের আদি গদ্য খোঁজা, কিংবা একই পত্রিকায় আদি গদ্যের রবীন্দ্রনাথের, গদ্যভাষার ও ছোটোগল্প যাত্রার টানের সন্ধান, সবটাই আসলে নিজের সময়ের ওই আধুনিকতার উত্তরাধিকারের অভিযাত্রা। ফলে, তাকে জানাতেই হয়, ‘পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই বাংলা গল্পে আধুনিকতার একটি ভিন্ন সংজ্ঞা খোঁজা শুরু হয়। বাংলা-উপন্যাসে আধুনিকতা এখনো অনেকটাই বিলম্বিত, বিশেষত বাংলা কবিতার তুলনায়। সেদিন আধুনিকতার সেই আবেগ অনেকের মধ্যেই ছড়িয়ে গিয়েছিল। বাংলা গল্পের নামকরণ, সংলাপ এই সব তখন থেকেই বদলাতে শুরু করে।’ এই কথা দেবেশ রায় লিখছে ১৩৯৮ (১৯৯২)-এ, তাঁর ‘গল্পসমগ্র’র প্রথম খণ্ডের ভূমিকায়। তাই আর জানাতে হচ্ছে তাকে, ‘১৯৬১ পর্যন্তই যেন সে-চেষ্টা খানিকটা সংগঠিত চেহারা নিতে পেরেছিল। সাহিত্যচর্চার সেই পরিবেশ এই গল্পগুলির ওতপ্রোত। এ-ধরনের সমবেত সচেতনতা আলাদা-আলাদা লেখকের ভিতর খুব বেশি দিন একই রকম সক্রিয় থাকে না। এই গল্পগুলিতে সেই সমবেত সচেতনার স্মৃতি আছে।’ এই সাহিত্যিক কারণগুলোর পাশাপাশি দেবেশ রায় যে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যান, সেই সম্পর্কেও জানিয়েছেন। হয়তো, এই পর্বের এমনকি পরের পর্বের গল্পগুলোকে বুঝি নিতে, কিংবা, যে দেবেশ রায় রাজনীতির পথহাঁটার ভিতর দিয়ে সাহিত্যকে বুঝে নিতে চাইছেন, তারও অন্তর্গত বক্তব্য :

“দ্বিতীয় কারণটি আমার কাছেও দুর্বোধ্য। আবাল্য রাজনীতির ভিতর বড় হলেও নিজের অনুভব, অভিজ্ঞতা কল্পনার কথা বাইরে বলবার প্রয়োজন যখন প্রথম বোধ করেছিলাম—রাজনীতি তখন আমার গল্পের বিষয় হয়ে আসেনি। অথচ পঞ্চাশের দশকে আমাদের ছাত্রজীবনজুড়ে তো ছিল পশ্চিমবঙ্গে নিষেধাজ্ঞা-মুক্ত কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলনমুখর বিকাশের পর্ব। আন্দোলনের সেই স্রোতের টানে নিজে ভেসে গেলেও সে-স্রোতে কেন আমার প্রথম দিকের গল্পগুলোতে উছলে এল না? কোথাও কি নিহত ছিল ছাত্র রাজনীতির আন্দোলন মুখিতার সঙ্গে মহত্তর রাজনৈতিক বোধের অনন্বয়? অথবা ছাত্র রাজনীতির সেই উচ্ছ্বাসেরই ছিল এক আত্মসর্বস্বতা, যা সাহিত্য বা শিল্প-অভিজ্ঞতা হয়ে উঠতে চায়নি? অন্তত আমার ক্ষেত্রে। অথবা এই সময়ের শেষ দিকের কিছু গল্পে সে-কথা আসতে চাইছিল অনিশ্চিত। ৬১-র পর মাত্র তো একটি বছর। ৬২-র প্রথমে নির্বাচন, শেষে চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধ-রাজনীতি আমার ওপর সমুদ্রের ঢেউয়ের মত শ্বাসরোধী ঝাঁপিয়ে পড়ল। অথচ তখন তো কমিউনিস্ট আন্দোলনের পক্ষে সবচেয়ে দুর্বিপাকের কাল।”

তাহলে, এক অর্থে অথবা সব অর্থে, রাজনীতি দিয়ে সাহিত্যকে সাহিত্যের পথ হেঁটে রাজনীতির ভিতরে স্বদেশকে আবিষ্কারের চেষ্টা তাই দেবেশ রায়ের একেবারে শুরুর দিককার রচনায়ও ভীষণভাবে দগদগে। পরেও বলেছেন তিনি, বা নিজের কোনো লেখায় আর অগ্রজদের লেখায় এক আত্মআবিষ্কারের উপায় নিয়ে। যেমন গোপাল হালদার, ননী ভৌমিক, সমরেশ বসু এঁদের লেখায় সেই স্বদেশিতা যে একদা রাজনৈতিক কর্মীর দিনযাপনের ব্রতের ভিতর দিয়ে তাঁরা পেয়েছেন, সে উল্লেখ আছে। আর, ওই স্বদেশিকতা-বোধের ভিতর দিয়েই দেবেশ রায় বাংলা উপন্যাসের নান্দনিকতা খোঁজারও প্রয়াস নিয়েছেন, যদিও তা একটু পরে। তাই হয়তো প্রায় প্রথম পর্বে লেখা উপন্যাস বা যা উপন্যাস হিসেবে পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, সেই লেখাটিকেও তিনি গল্পসংগ্রহের প্রথম খণ্ডের শেষ দিতে চান। কারণ, ‘একটি ছোটোগল্প অনেক দিন ধরে লেখা যায় না, একটি উপন্যাস অনেক দিন ধরে গড়ে ওঠে। এই লেখাগুলো যখন (১৯৫৫-৬১) লিখছি তখন উপন্যাসের কোনো ধারণা আমার ভিতরে তৈরি হয়নি।’ এই সময়েরই কাছাকাছি ‘কালীয়দমন’ নামে একটি উপন্যাস বেরিয়েছে, কিন্তু তার উপন্যাস বোধ তৈরি না হওয়ায় আকৃতিতে বড়োগল্প এই লেখাটিকে তিনি গল্পসংগ্রহের প্রথম খণ্ডে স্থান দিতেন। ফলে, দেবেশ রায়, যখন এরপরে জানাচ্ছেন, ‘গল্পের ওপর এই বিকল্পহীন নির্ভরতার ফলেই এই খণ্ডের [প্রথম] অনেক গল্পই গল্পের সীমার মধ্যে আটকে থাকতে পারেনি বা গল্পের সংজ্ঞাটিকে সুবিধেমত বদলে নিয়েছে। ১৯৬১-র পর শুধু গল্পরই ওপর আমার অনন্যনির্ভরতা কমে আসে। তখন উপন্যাসও ভাবতে শুরু করেছি।’
সেই শুরুর দিনগুলোতে, সাহিত্য বা গল্পচর্চা, শিক্ষকতা, রাজনীতি আর জলপাইগুড়িতে থেকেও ‘সাহিত্যচর্চার সমবেত প্রয়াস’, কবিতার তুলনায় ‘বিলম্বিত আধুনিকতা’, খোঁজার প্রয়াস আর গল্পের সংজ্ঞার্থের বাইরে যাত্রা, যা ঘটছে নিজের অজানিতে। ফলে, দেবেশ রায় তখন থেকে উপন্যাসও ভাবতে শুরু করছেন। এই শেষোক্ত বিষয়টি তার গল্প ধারাবাহিকভাবে লক্ষ করলেই বোঝা যায়। দেখা যাবে, গল্প যেন তার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আকৃতিতে বড়ো হয়ে যাচ্ছে। কখনো সংলাপহীন, অনুচ্ছেদহীন। এমনকি শেষহীন। কিন্তু গল্প সব সময়েই শেষ হয়, উপন্যাস হয় না। ‘গল্পর তাই শেষটাই শুরু’। আর জীবনের শেষ বছর কুড়ি দেবেশ রায় গল্প একেবারেই কম লিখেছেন। ছোটোগল্পের সংজ্ঞা তার কাছে ততদিনে একেবারেই বদলে গেছে।

‘দেশ’ পত্রিকায় ১৯৫৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত ‘হাড়কাটা’ পড়তে গিয়ে মনে হয় না, একটি উনিশ বছর বয়সি কোনো তরুণের প্রথম প্রকাশিত গল্প, অথবা প্রথম দিককার গল্প। প্রথম দিককার কিংবা প্রথম প্রকাশিত, এসব অন্য হিসাব। সাড়ে আঠারো বছর, একজন এর আগে আর কটি গল্প বা লিখে থাকতে পারেন? একটির খোঁজ পাওয়া গেছে। হয়তো স্কুল-কলেজ ম্যাগাজিনে আরও দু-একটি পাওয়া যেতে পারে। তবে কসাই নানকু কাহারকে নিয়ে লেখা এই গল্পটা দেবেশ রায়কে একেবারে সরাসরি লেখক বানিয়ে দিয়েছে। দেবেশ রায়ও তাই বলেছেন। মধ্য পঞ্চাশের দশকে ‘দেশ’ পত্রিকায় একটি গল্প প্রকাশিত হলে পাঠকসমাজে সাড়া পড়ত। গল্পের সম্পাদক তখন বিমল কর। পঞ্চাশের দশকের প্রধান গল্পকার প্রায় সবারই ‘দেশ’ পত্রিকায় ও একই সঙ্গে ‘ছোটোগল্প : নতুন রীতি’ গল্পপত্রে গল্প ছাপানোর অভিভাবক বিমল কর। তিনি নিজেকে ছোটোগল্পের এক অসাধারণ রচয়িতা। ফলে, ওই একটি গল্প ছাপা হওয়াতে দেবেশ রায়কে লেখক বানিয়ে দেওয়া বিষয়টি, দেবেশ হয়তো একটি কৌতুক করেই বলেছেন, কিন্তু অত্যুক্তি তেমন নেই। আর হয়তো সেই অজ্ঞাত স্বীকৃতির জন্যেই, এরপরের গল্পটা যখন দেবেশ রায় দিতে যান তখন তার অতি তারুণ্য দেখে, বিমল কর হয়তো তাকে আর ‘হাড়কাটা’ গল্পের লেখক ভাবতে পারেননি, দেবেশ রায়ের গল্পের বাহক মনে করেছিলেন।
আজ, ‘হাড়কাটা’ প্রকাশিত হওয়ার পঁয়ষট্টি বছর বাদে, ওই গল্পটি প্রথম প্রকাশের সন তারিখ কিছুই না দেখে, পড়তে গেলে মনে হতেই পারে, বিমল করের সেই মনে হওয়াটা কোনোভাবেই অযৌক্তিক ছিল না। এর একটি পারিপার্শ্ব জমিও কারণও অবশ্য একইসঙ্গে ভেবে নেওয়া যায়। রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা গল্পের প্রধান লেখকরা প্রায় সবাই জীবিত ও সক্রিয়। শুধু গল্পলেখক হিসেবে যারা স্মরণীয় আজ, সেই নরেন্দ্রনাথ মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ থেকে শুরু করে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী পর্যন্ত তাদের মধ্যপর্বের শ্রেষ্ঠ গল্পগুলো লিখছেন। পাশাপাশি বিমল কর, সমরেশ বসু আর রমাপদ চৌধুরী তখন খ্যাতিমান তরুণ লেখকের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছেন। সেখানে দেবেশ রায় তাঁর সহযাত্রী যথা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায় প্রমুখের সঙ্গে এমন একটি গল্প ছাড়া হাজির হনই-বা কী করে। একথা এই সঙ্গে বলা হচ্ছে না যে, ‘হাড়কাটা’ দেবেশ রায়ের সেরা গল্প। বলা হচ্ছে এটি প্রথম প্রকাশিত গল্প আর যে গল্পটি লিখছেন একটি আঠারো-উনিশ বছরের ছেলে এবং গল্পটি তার চেনা পটভূমির জলপাইগুড়ি শহরের। যদিও, তার সেই দেখার দিগন্ত বিস্তৃত চোখ, যাতে নানকু কসাই বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে শুরু করে, ওপাশে বিহারের কাছাকাছি যে ভূগোল—সেখানেও তার যাতায়াত। দেশভাগ হয়েছে কয়েক বছর, কিন্তু সময় ও পটভূমির পিছনে ফিরলে, ওই উনিশশ পঞ্চান্ন সালেরও দশ বছর আগের সময়টায়ও তিনি খেয়াল রাখতে ভোলেন না। ‘হাড়কাটা’র শুরু :

“‘লেরে শালা-আর কত চিল্লাবি—’ পাঁঠাটার ঘাড়ের ওপর ছুরিখানা একবার বুলিয়ে নেয় নানকু—‘যা, মামাবাড়ি গিয়ে চিল্লাস’—পাঁঠাটার কবন্ধ দেহ ঐ জায়গাটাজুড়ে দাপাদাপি করতে লাগল।
‘আয়-রে—’ বলে আরেকটার ঘাড় ধরে একটি হ্যাঁচকা টান দিল মিউনিসিপ্যাল মার্কেটের লাইসেন্সিয়েট কশাই নামকু কাহার।
দুটো পাঁঠার ছাল ছড়িয়ে ফেলে দোকানে টাঙাল বাঁশের সঙ্গে।”

কসাই নানকু কাহার সম্পর্কে আমাদের জানা হলো। একইসঙ্গে একেবারে শুরুতেই আমরা গল্পে ঢুকে পড়লাম। এই মাংসের দোকানের সামনে একটি কুকুর। পরে সেখানে এসে হাজির হয় পাগল। আর নানকু রায় পাকিস্তান সীমান্তে, পাঁঠা সংগ্রহ করতে। পিছনে আছে কীভাবে তার বউ গাধুলির সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তাকে বিয়ে করে এখানে এনেছে, যুদ্ধের কন্টাকটারকে পাঁঠা সাপ্লাই দেওয়া নানকু তখন এই শহরের এক পাঁঠা বিক্রেতা। থাকে তিন ফুট উঁচু ঝুপড়িতে, তার এক পাশ বানিয়ে নিয়েছে একটি মাচা। যেখানে পাঁচটি বাচ্চা নিয়ে বউ ঘুমায়। এইসব। কিন্তু দেবেশ রায়ের অনুপুঙ্খ বর্ণনা দেওয়ার ক্ষমতা তখনই বিস্ময়কর। চোখের দেখায় তাঁর প্রায় কিছুই বাদ পড়ে না। ঋতুর স্বাভাবিক আবর্তন, যান্ত্রব প্রতিবেশ, কাহারের মনের গড়ন, মাংস বিক্রেতা হিসেবে অসততা আর লোভ, রাগ ও বউয়ের প্রতি নির্দয়তা সবই আছে। লোকে যে তাকে হাড়কাটা ডাকে। চোখের কোনায় যেন লেগে থাকে ওই কাটা পাঁঠার রক্তের দাগ। তাতে ছফুট লম্বা নানকুকে প্রায় খুনির মতনই দেখায়। 
এ সময়ে রাত্রে তার বউ গাধুলি একটা রুপোর হাঁসুলি চেয়ে মার খায় নানকুর হাতে। কিন্তু পরদিন সকালে, প্রথম অবশিষ্ট রাগ ঝাড়ে কুকুরটাও পাগলটার ওপর। পরে, দোকানে থাকতেই গাধুলির সঙ্গে তার দেখা ও বিয়ের স্মৃতি মনে ভাসে, যখন কুকুর আর পাগলটা খেলা করছে। নানকু তাদের মাংস দেয়, বাকি মাংস বিক্রি না করে বাড়িতে ফেরে, আজ আর মাংস বেচবে না, বউকে বলে মাংস ভালো করে রাঁধতে।

“বাড়িতে ঢুকে দেখে গাধুলি উনুনের সামনে বসে আছে। ছেলেমেয়েরা কোথায় বেরিয়েছে। কেউ বাড়িতে নেই।
‘লে রে বৌ, খুব ভালো করে রাঁধবি, বুঝলি’—পুঁটলিটা রেখে নানকু বলল। চমকে উঠে পেছন ফিরে একগাল হেসে ফেলল গাধুলি।
ওর সামনে মাটিতে বসে পড়ে নামুক বলল, ‘খুব লেগেছিল কাল রাত্তিরে না? ইস, গালে একেবারে দাগ পড়ি গেছে—’
‘ধ্যেৎ’—আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকল গাধুলি। ছলাৎ করে উঠল দশ বছর আগের কাল পুকুরের ঢেউ।

তারপর? দুটো বিদ্রোহী চোয়ালের গর্তে যার একজোড়া লাল চোখ সব সময় ঘুরপাক খাচ্ছে, মিউনিসিপ্যাল মার্কেটের শ্লটাররুমের রক্তাক্ত অন্ধকার কেটেছে যার দশটা বসন্তের সবগুলো সকাল—সেই হাড়কাটা কশাই নানকু কাহার আর তারাপুর গাঁয়ের মোড়লের শ্যামলা মেয়ে গাধুলির প্রেমসম্মিলন কেমন করে হল ইতিহাস তা বলে না। সেই ঝিরঝির সজনে পাতা ওড়া ফাল্গুনের সকালে আড়াই হাতি ঘরে মুখোমুখি বসে থাকা ঐ দুটি লৌহযুগের নরনারী তার নায়ক-নায়িকা, তার সাক্ষী। পৃথিবীর কেউ কোনোদিন সে কথা জানেনি—জানবেও না।”

গল্পের শেষ দিকে প্রায় সবকথা একটানে বলা হয়ে গেছে। আর, একইসঙ্গে কোথায় যেন রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ আর মানিক বন্দোপ্যাধায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’-এর একেবারে শেষ অনুচ্ছেদের আবহ ধ্বনিত হয়। কিন্তু, তা কোনোভাবেই সচেতন বা অচেতনে তার অনুসরণ নয়, অনুকরণ তো নয়ই, এই মিল হয়তো পাঠকের মনে হতে পারে, নাও পারে, কিন্তু দেবেশ রায় এই গল্পটার এক চিরকালীন সমাপ্তির খোঁজে ওই কথাগুলো শেষ লিখেছেন। কারণ, নানকু কাহারের ওই তিনটি দিন তো তার চিরকালের তিনটি দিন, যা অতীতে ছিল, ভবিষ্যতেও তার সেই তিনটি দিনই থাকবে। সেখানে এরপরে ঝুপ করে ঢুকে পড়বে তারাপুর গাঁ, আর দেশভাগের এক মোচনীর পটভূমি। সেখান থেকে কোনোদিন তাকে অথবা তাদের কেউ ফেরাতে পারবে না, যেমন আর যেভাবে পৃথিবীর কেউ কোনোদিন সেকথা জানেনি, জানবেও না।

দেশভাগ গল্পের পিছনের পট হিসেবে আছে এর পরের গল্প ‘নাগিনীর উপমেয়’তে [দেশ, ১৯৫৭]। একটু দগদগে আর বাস্তব সেই পিছন। অনেকটাই যেন শক্তিপদ রাজগুরুর ‘চেনামুখ’ ওরফে ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’র মতো, যদিও, কাহিনি একেবারেই ভিন্ন, এখানে শুধু পিছনের পটটার কথাই বলা হচ্ছে। আর, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ এই গল্পের অন্তত বছর তিনেক পরের ঘটনা। ইচ্ছে করলে এই গল্পে একটু রোমাঞ্চের আবরণও দেওয়া যায়, যা যায় একেবারে শুরু আর শেষের খানিকটা মাথায় রেখে, সেখানে নাম-ধাম উহ্য রেখে দুজন রাজনৈতিক কর্মী, নর-নারী, এর ভিতরে পুরুষটি যেন অনেকটা চিঠি লেখার অথবা প্রেমিকা পাশে বসিয়ে বলছেন এই গল্প। কিন্তু বলাটাই, গল্পের বাইরের দিক, ভিতরে উদ্বাস্তু কলোনির মেয়ে তথা এখানে মেট্রিক পাস প্রতিমার আত্মরক্ষার তাগিদে নাগিনী হয়ে ওঠার গল্প। ওই কলোনির দায়িত্বপ্রাপ্ত তরুণ নেতা অরুণ বসুকে নিয়ে না করে প্রতিমা কেন এক বখাটের কাছেই নিজস্ব নিরাপত্তা বা ব্যক্তিত্বের জোরে আশ্রয় খোঁজে।
অরুণ-প্রতিমার বিয়েটা ভেঙে যায় বিয়ের আগের দিন। কিন্তু কেন সেকথা অরুণ কাউকে বলেনি, অথবা এখানে যা বলা হচ্ছে এর বাইরেও অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। তখন গল্পকথক :

“প্রথম যখন অরুণের সঙ্গে আমার চোখাচোখি হল, অরুণ আমাকে দেখে একটু হেসেছিল। তখন মনে হয়েছিল হাসিটা কান্না-কান্না। পরে বুঝেছিলাম খুব জয়ের হাসি আর খুব পরাজয়ের হাসির চেহারাগত তফাৎ অতি সামান্য, তৃতীয় ব্যক্তির চোখে ধরাই পড়ে না।
যাক। আমি অরুণের কাহিনী শুনেছি এবং কাল সারারাত মনে রেখেছি। আজ তোমার কাছে এসে অক্ষত আকারে তার বিবরণ দিচ্ছি। কারণ, এ-খবর তোমারই শোনা দরকার সবচেয়ে আগে।
তবে, দুঃখ করো না। কেউ-ই এখনো এ সম্পর্কে অবহিত নন। এই সাতসকালে ঘুমের অর্ধেকটা না ঘুমিয়ে তোমার কাছে এসেছি। দার্জিলিঙের বুড়ো মাখনঅলা রমজান আলি থেকে শুরু করে, সেদিন হোম থেকে আসা সেন্ট জোসেফের প্রিন্সিপাল পর্যন্ত কারো বলার সাধ্য নেই যে আমাকে কে এত সকালে কোনোদিন পথে দেখেছে।...”

লক্ষ করার বিষয়, কাহিনিগদ্যে দেবেশ রায়ের কিছু মুদ্রা আছে, যা তার একেবারেই নিজস্ব, তার গল্প রচনার সেই ঊষাকালে তিনি তা একেবারেই স্বাভাবিক মুনশিয়ানায় হাতে তুলে নিয়েছেন, আর, গদ্যে আছে তার নিজস্বতা অর্জনেরও চেষ্টা। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তার আত্মজীবনী ‘জীবন-রহস্য’-তে সে-কথা লিখেওছেন যে, আমাদের ভিতরে শুরু থেকেই গদ্য নিয়ে নিজস্ব ভাবনা বা সযত্ন চেষ্টা ছিল দেবেশের। এখানেও দেখা যায়, পঞ্চাশের কৃতী প্রতিষ্ঠিত কথাসাহিত্যিকদের গদ্যের কোনো আবরণ বা আভরণ কোনোটাই যেন দেবেশ রায়ের গায়ে লাগে না। তিনি এই সময়ের কিংবা এইটুকু সময়ের ভিতরেই নিজের জন্যে এক স্থিরীকৃত পথের খোঁজে নামেন। যে উদাহরণ উপরের উদ্ধৃত অংশেই খেয়াল করলে বোঝা যায়। দেবেশ রায়ের ভাষায় ছোটগল্প : নতুন রীতির ঝোঁকে, যে সমবেত প্রয়াস, সেই প্রয়াসেরই এক জোর যেন গল্পকে আপাত-কাহিনিহীন করে তোলা। না, তাও তিনি পুরোপুরি করেননি। বরং, জীবনের এক নির্দিষ্ট সময়ের, খুবই কম সময়ের, প্রায় সময়ের ভগ্নাংশকে এখানে হাজির করেন, প্রয়োজনে ফিরে যান পিছনে।
আর, সেই পটভূমিতে কলকাতা দেবেশ রায়ের কলমে নেই। সেখানে জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, অর্থাৎ যাকে বলা যায় প্রকৃতই উত্তরবঙ্গ, রাজনীতির পথহাঁটা দিয়ে দেবেশ সাহিত্যের দিনযাপনকে জড়িয়ে নিচ্ছেন, যে যাত্রা, ‘মানুষ খুন করে কেন’ থেকে উত্তীর্ণ যৌবনে ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’র পটভূমিকে ছোঁবে, যদিও এর আগেই লেখা হবে ‘মফস্বলি বৃত্তান্ত’র প্রথম লেখন বা প্রথম সংস্করণ। সবই উত্তরবঙ্গ, পথহাঁটায় তিনি রাজবংশী ভাষাকেও সঙ্গী করে নেবেন। সেখানের বাঙালি জনজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে, অথবা উলটোটা ওই রাজবাংশী আধা-বিহারি আর উদ্বাস্তু জনজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে উত্তরবঙ্গের বাঙালি জনজীবন। ফলে, পাবনায় জন্মগ্রহণকারী দেবেশ রায়ের কথাসাহিত্যে কলকাতা সেই প্রথম ও মধ্যপর্বে প্রায় নেই-ই, অন্তত উপন্যাসের ক্ষেত্রে ‘লগন গান্ধার’-এর আগে তেমন প্রয়াসও ‘ইতিহাসের লোকজন’, ‘স্বামী-স্ত্রী’ ছাড়া সেভাবে নেই। এরপরে আছে। যদিও, একেবারে শেষ দিকে দেবেশ রায় উপন্যাসকে মেট্রোপলিটন প্রকল্প বলেছেন, এমনকি ‘মানুষ খুন করে কেন’ তার জলপাইগুড়িতে লেখা, তবু বলেছেন ১৯৭৬-এ তিনি কলকাতায় আসার পর থেকেই উপন্যাসকে করে নিতে পেরেছেন আয়ত্তাধীন। ফলে, এইখানে এই কথাগুলো আবারও তোলা, যদি অপ্রাসঙ্গিকও হয়ে থাকে, এ কথা বোঝানোর জন্য যে, ১৯৬১-এর কাছাকাছি সময়ে দেবেশ রায়ের উপন্যাস-ভাবনা শুরু হলেও, তার গল্প-উপন্যাসের পটভূমি কোনোভাবেই উত্তরবঙ্গের বাইরে আর কোথাও স্থাপনের সুযোগ হয়তো ছিল না। এমনকি ১৯৫৭-৫৮ এ কলকাতা বাস পর্বেও সেভাবে নয়। বরং, ব্যক্তিকে সময়ের পটভূমিতে দেখার স্বকীয় স্বাধীনতায় তিনি কলকাতাকে পটভূমি হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আর সেখানে উদ্বাস্তু কিংবা নিম্নবিত্তের জীবন, হয়তো কলকাতায় ছাত্রজীবনে শ্রমিকদের ভিতরে কাজের অভিজ্ঞতার কারণে, কলকাতায় ছাত্রত্বের কারণে তার সহগামী হয়েছে।
‘নাগিনীর উপমেয়’ কেন নাগিনীর প্রসঙ্গ, প্রতিমাকে কেন সেখানে স্থাপন করা হয়েছে, তার কার—সেই বখাটে ছেলেটির কাছ থেকে অরুণ বসু যখন প্রতিমাকে নিয়ে ফেরে, সে সময়ের বর্ণনা :

“একটু থেমে অরুণ প্রতিমাকেই আবার বলল, ‘কোথায় গিয়েছিলেন আপনারা?’
ততক্ষণে প্রতিমা সমস্ত অবস্থাটা বুঝে নিয়েছে, তার মুখচোখ থেকে অনুগৃহীত হবার পরিচয় মুহূর্তের মধ্যে নিঃশেষে মুছে গেছে। সমস্ত ব্যাপারটাই সে পরিষ্কার বুঝল আর বোঝামাত্র গা-ঝাড়া দিয়ে উঠল। নারীর সঙ্গে নাগিনীর একটা মিল প্রায়শই কল্পিত হয়ে থকে, অনুপ্রাসটাই তার প্রধান কারণ। কিন্তু নারীর সঙ্গে যদি কারো তুলনা করতেই হয় তবে সে বাস্তুসাপ। কলা দাও, দুধ দাও, তুমি তাকে মান দেখিয়ে চলো, সেও তোমাকে মার দেখাবে। কিন্তু যদি একবার সম্মানের লেজে পা পড়ল—ফুঁসে উঠবে অমনি। মেয়েদের ফুঁসে ওঠার মতো মহৎ দৃশ্য খুব কম আছে।
চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দাঁড়িয়েও তাই অরুণ বসুর ওপর ফুঁসে উঠতে পারল প্রতিমা—‘তা দিয়ে আপনার দরকার?’
প্রশ্ন করবার ভঙ্গি আর প্রশ্নটার তীক্ষèতায় উদ্বাস্তু প্রাণবল্লভ অরুণ বসু একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল।”

কিন্তু, এই উদ্বাস্তু প্রাণবল্লভ অরুণ বসুর সঙ্গে প্রতিমার প্রেম হয়েছিল। যদি তাকে প্রেম বলা যায়। এমনকি বিয়ের দিনও পাকা হয়েছিল। কিন্তু, ‘পরশুর আগের দিন সন্ধ্যায়’ ‘অরুণের মাথায় হঠাৎ খেয়াল চাপল’ ‘প্রতিমা ও সে একসঙ্গে প্রতিমার মাকে প্রণাম করবে’। আর তখনই—

“অরুণ বসু প্রতিমার ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সেই দুবছর আগের মাস্তান ছোকরাটির আর প্রতিমার অন্ধকারে পাশাপাশি বসে থাকার মতো রিয়্যালিটিকে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিল। তারপর মোটরে চড়ে দার্জিলিংয়ে পালিয়ে আসতে লেগেছিল তিন ঘণ্টা।”

দুজনার পারস্পরিক বিবৃতিতে এই গল্প, এরপর শেষের দিকে। একজন অন্যজনকে আরও কথা বলে, কিন্তু প্রতিমা কেন বিয়ে করল না সে রহস্য কোনোভাবে যেন সমাধান হয় না, যেমন গল্পের শুরুতে কেউ বুঝে উঠতে পারেনি কেন তাদের বিয়ে হয়নি। কিন্তু সেই ইঙ্গিতের দুই এক ছত্র নমুনাও সেখানে ছড়িয়ে আছে। একজন জানায় : ‘...সেই সমস্ত ভদ্রলোকেরা এ মন্তব্য জুড়ে দেখেন নিশ্চয়ই—“প্রতিমার মত চরিত্রহীন মেয়ের হাত থেকে যে শেষ পর্যন্ত অরুণ বসু উদ্ধার পেয়েছে এটাই আশ্চর্য!...” এই কথার পিঠেই কথা এগোয়; সেখানে, যে এই গল্পের মূল কথক সে বলে, ‘তোমার সমস্ত আহত ব্যক্তিত্ব কেন্দ্রিত করে আমার দিকে চাও—উদ্যত ফণা নাগিনীর মতো মহিমাময় ভঙ্গিতে। প্রতিমা আফিমঅলার কাছে আত্মসমপর্ণ করতে পারেনি—পাছে জীবিকার আর অর্থের অফিমের লোভ দেখিয়ে তার বিষদাঁতটি অরুণ তুলে নেয়।’ তাই সে বাস্তুর কোণ খুঁজেছিল। আর যাই হোক, মাস্তান ছোকরাটি বাস্তুনাগের মস্তানের লেজে পদদলিত করতে পারবে না। ফলে, পাঠক হিসেবে আমাদের মুক্তি ঘটে, অন্তত প্রতিমা তার ব্যক্তিত্বের জোরে ওই দাম্পত্য সে রচনা করতে চায়নি।
গল্পটা শেষ হওয়ার পরে বোঝা যায়, দেবেশ রায় কোথায় ইঙ্গিত রেখে গেলেন। চলবে