X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০
দেবেশ রায়ের গল্পপাঠ

‘হাড়কাটা’ থেকে ‘উদ্বাস্তু’

প্রশান্ত মৃধা
১৫ মার্চ ২০২২, ১৫:৪৮আপডেট : ১৫ মার্চ ২০২২, ১৫:৪৮

[এবছর একুশে গ্রন্থমেলায় কাগজ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে দেবেশ রায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প। সম্পাদনা করেছেন সমরেশ রায়। বইয়ের শেষে একটি দীর্ঘ পাঠ-অভিজ্ঞতা লিখেছেন প্রশান্ত মৃধা। সেই লেখাটি পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।]


সাপ্তাহিক ‘দেশ’-এর গল্প-সম্পাদক কথাসাহিত্যিক বিমল কর তাঁর সাহিত্যিক স্মৃতিকথা ‘আমি ও আমার তরুণ লেখক বন্ধুরা’য় দেবেশ রায় সম্পর্কে একটি মজার স্মৃতির উল্লেখ করেছেন। ‘দেশ’ পত্রিকার দপ্তরে গল্প দিতে এসেছেন দেবেশ রায়। এসে যেভাবে একজন বলেন যে তিনি লেখা নিয়ে এসেছেন, সেভাবেই বলেছেন, কিন্তু স্নাতকপড়ুয়া দেবেশ তখন এতটাই তরুণ যে তাকে দেখে বিমল করের মনে হয়েছিল এই ছেলেটি দেবেশ রায়ের গল্পের বাহক। যদি এটি দেবেশ রায়ের ওই কাগজে দ্বিতীয় গল্প ‘নাগিনীর উপমেয়’ (১৯৫৭)-র ক্ষেত্রে হয়ে থাকে, হতে পারে, কেননা, দেবেশ তখন সবে কুড়ি বছর ছাড়িয়েছেন। ইতিপূর্বে ডাকে পাঠানো ‘হাড়কাটা’ (১৯৫৫) বেরিয়েছে। তখন আঠারো ছাড়িয়ে উনিশের মুখে, জলপাইগুড়ি কলেজে স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র, ‘দেশ’ পত্রিকার ইতিহাসে দেবেশ রায় তরুণতম লেখকদের একজন।

ওই ‘হাড়কাটা’রও আগে দেবেশ রায়ের একটি গল্পের সন্ধান পাওয়া যায় তার রচনাপঞ্জিতে। ‘নিশিগন্ধা’। গল্পসমগ্রে নেই এই গল্প। দেবেশ রায়ের ছয় খণ্ডের ‘গল্পসমগ্র’ তাই শুরুই হয়েছে ‘হাড়কাটা’ দিয়ে। আপাতত ওইটিই তার সূচনা গল্প হিসেবে চিহ্নিত। পাঠক সেভাবেই তাকে পড়ে থাকেন।

কিন্তু ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’র লেখক হিসেবে, এবং, বাংলা উপন্যাস সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব বক্তব্যের কারণে দেবেশ রায় এখন যেভাবে চিহ্নিত হন, তাতে গল্পলেখক দেবেশ রায় আমাদের কাছে একটু যেন দূরবর্তী। অথবা, কথাটা অন্যভাবেও ভাবা যায়, বাংলা ভাষায় একইসঙ্গে কথাসাহিত্যের দুই মাধ্যমে চিহ্নিত বা নির্দিষ্ট লেখক যেন কম। না সেখানে তাঁদের শক্তি আর সামর্থ্যরে কোনো ঘাটতি নেই পাঠকসমাজে, এমনকি সাহিত্য-সমালোচকগোষ্ঠীকে মাথায় রেখেও এই কথা বলা। যিনি ঔপন্যাসিক কৃতিত্বে সর্বাধিকারী, তাঁর ছোটোগল্পলেখক সত্তা পিছনে পিছনে আসে ঠিকই, কিন্তু তা কোনোভাবেই সব সময়ে সহযাত্রী হয় না। আবার, পরাক্রমী ছোটোগল্প লেখককে ঔপন্যাসিক অভিযাত্রায় সব সময়ে সামিল রাখা তো হয়ই না। হয়তো পাঠক বা সমালোচক ঢাল হিসেবে এই খাঁচা তৈরি করে নেন, অথবা, হতে পারে, চিন্তার গঠন প্রক্রিয়াই এমনভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। যদি উদাহরণ দিতে হয়, ছোটোগল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলা ভাষার তো বটে। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ এক লেখক, তার ‘গোরা’, ‘ঘরে-বাইরে’, ‘যোগাযোগ’-এর মতন উপন্যাসের পরেও ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ যেন কখনো কখনো আমাদের হিসেবের চৌহদ্দির বাইরে থাকেন। অথবা বিভূতিভূষণ-তারাশঙ্কর-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ছোটোগল্প লেখক হিসেবে তিনজন তিন কারণেই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তারাশঙ্কর কিংবা বিভূতিভূষণ সেক্ষেত্রে একটু দূরে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্তত খেয়ালে থাকেন, যেমন থাকেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। আবার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কিংবা সতীনাথ ভাদুড়ী, কমলকুমার কিংবা সমরেশ বসু, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা সিরাজ, কিংবা অমিয়ভূষণ মজুমদার। বরং, উলটোও কিছু আছে। যেমন নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সুবোধ ঘোষ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, হাসান আজিজুল হক, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। তারা ঔপন্যাসিকও বটে, কিন্তু ছোটোগল্প লেখক হিসেবেই তাদেরকে সব সময়ে স্মরণে রাখা হয়।

দেবেশ রায়ের ছোটোগল্প লেখক হিসেবে পরিচয়কে অপরিচয় করে দেওয়ার এই বিষয়টা মনে উঠতে পারে। মধ্যপঞ্চাশে ছোটোগল্প লেখক হিসেবে আবির্ভাবের পরে পরবর্তী প্রায় অন্তত পঁচিশ বছর তিনি, উপন্যাস-লেখক হিসেবে নিয়মিত হওয়ার আগে পর্যন্ত, এতটাই নিয়মিত ছোটোগল্প লেখক তিনি, বাংলা ভাষায় তার পরাক্রমশালী সহযাত্রীদের সঙ্গে একই কদমে এত ছোটোগল্প— প্রায় সোয়াশ বা শ দেড়েক ছোটোগল্প লিখেছেন। কিন্তু সেই মধ্যআশির দশক থেকে ধীরে ধীরে দেবেশ রায়ের ছোটোগল্পকার পরিচয় খানিকটা লুপ্তই হয়ে গেল বুঝি! প্রশ্নটা সেখানেই। কেন এটা ঘটে। সে অর্থে তার সমকালীন ছোটোগল্প লেখক সৈয়দ মুজতবা সিরাজ, মতি নন্দী, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায়, দিব্যেন্দু পালিত আর বাংলাদেশে আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলীর মতোই দেবেশ রায় জোরকদমে এগিয়ে গেছেন। তখন পর্যন্ত কলকাতা থেকে অনেক দূরে জলপাইগুড়িতে থাকেন, কিন্তু কলকাতার প্রধান দুটি কাগজ ‘দেশ’ ও ‘পরিচয়’-এ নিয়মিত তার গল্প প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকি একইসঙ্গে যদি, উপরে যাদের নাম নেওয়া হলো, তাদের কয়েকটি শ্রেষ্ঠ গল্পের নাম উল্লেখ করা হয়, সেখানে দেবেশ রায়ের গল্পের নামও আসবে। বলে রাখা দরকার, এই ঘটনা যে শুধু গল্পলেখক দেবেশ রায়ের ক্ষেত্রে, তাও নয়। যাদের নাম এখানে করা হয়েছে, প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই একইভাবে সত্যি। হয়তো এখানে এই কথাটা তোলাটাই ঠিক হয়নি, কথা তেলার ঔচিত্যবোধের যে মাত্রা থাকে তা খানিকটা খুইয়ে বসে আছি। সাহিত্যে এমন ঘটে থাকে। হয়তো গল্প যৌবন আর তারুণ্যের শিল্প, ঔপন্যাসিক কৃতিত্ব অর্জিত হলে তা গল্পের কৃতিত্বকে ধীরে ধীরে গিলে ফেলে।

সঙ্গে, অনায়াসে যুক্ত করা যায়, প্রাবন্ধিক হিসেবে দেবেশ রায়ের নিরন্তর প্রশ্ন তোলা, আর কখনো কখনো একেবারে প্রবন্ধের বই লেখা, যেটি বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথের পরে অন্নদাশঙ্কর রায় বাদে লেখক জীবনের শুরু থেকে কথাসাহিত্যিকদের ভেতরে আর কেউ করেননি। দেবেশ রায় বরং, একেবারে নির্দিষ্ট বিষয় ধরেও প্রবন্ধগ্রন্থ লিখেছেন। কখনো মার্কসীয় নন্দন, উপন্যাস, বাংলা গদ্য, সাংবাদিক গদ্য, রবীন্দ্রনাথের আদিগদ্য, ছোটোগল্প এবং গান ও রবীন্দ্রসংগীত। বইয়ের বাইরে আছে অসংখ্য রাজনৈতিক প্রবন্ধ ও কলাম ও সংবাদপত্রের জন্যে রচিত ফিচারধর্মী লেখা, বইয়ের আলোচনা, যা কখনো কখনো একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধেরই অন্য রূপ! লিখেছেন তারাশঙ্কর ও মানিক সম্পর্কে স্বতন্ত্র বই। ‘পরিচয়’ সম্পাদনার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, ছিলেন ‘প্রতিক্ষণ’ সম্পাদনা পর্ষদেও।

সেই ‘হাড়কাটা’ এরপর ‘নাগিনীর উপমেয়’ পর্বের সময়ে তো তার ছাত্রজীবন, অন্তত এর বছরখানেক বাদেই তা শেষ হলে দেবেশ রায় আবার জলপাইগুড়িতে ফিরে যান। সেখানের আনন্দচন্দ্র কলেজে শিক্ষকতায় যুক্ত হন। আর সার্বক্ষণিক রাজনীতিও যুক্ত হন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে। কলকাতায়ও ছাত্রজীবনে রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন, শ্রমিকদের সঙ্গে পার্টির কাজ করেছেন, জলপাইগুড়িতে ধীরে ধীরে নেতৃস্থানীয়। জলপাইগুড়িতেই, ১৯৬৮ সালের বন্যায় সেনাবাহিনীর বন্দুকের সামনে জামার বোতাম খুলে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন দেবেশ, শঙ্খ ঘোষের কবিতায় সেকথার উল্লেখও আছে। দেবেশ রায় যেভাবে বলতেন, তখন রাজনীতি দিয়েই সাহিত্যকে বুঝতে চাইতেন; যদিও তার লেখাপত্র কখনো রাজনৈতিক সাহিত্য নয়। কিংবা যাকে খুব সাদা বাংলায় বলা যায়, রাজনৈতিক ইচ্ছাপূরণের সাহিত্য কখনো করেনি। সে বিষয়টা তিনি রাজনৈতিক-কর্মীর জীবন শুরু করার সময় থেকেই পৃথক করে নিয়েছিলেন। এর ভিতরেও কথা থাকে। হয়তো, পুরোটা উত্তরবঙ্গ পায়ে ঘুরে দেখার সেই যাত্রায় জনজীবন আর এর ভূগোলকে জড়িয়ে নিয়েছেন অস্তিত্বের সঙ্গে। তারই মাঝখানে, কোনো-একদিন ‘আপাতত শান্তি কল্যাণ হয়ে আছে’ নামের উপন্যাসটি যখন লিখবেন, পুজোর মুখে লিখবার জন্যে কোনো একটি জায়গা খুঁজে ফিরছেন, পার্টি কমরেডদের কাছে থেকে নিচ্ছেন কদিনের বিরতি, তখন তাঁদের সেই চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হয় তাঁরা মনে করছেন, দেবেশের মাথায় কোনো বাতিক ঢুকেছে। এ তো দেবেশ রায়ে অকৈশোর। অগ্রজ দিনেশচন্দ্র রায়ের সঙ্গে শঙ্খ ঘোষের কবিতা মুখস্থ বলা কিশোর দেবেশ থেকে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছেন সে সময়ে ‘জেলফেরতা’ তরুণ লেখক সমরেশ বসুর নৈহাটির কুঁড়েঘর সদৃশ্য বাড়িতে বারবার যাওয়া, সেই সময়ে ‘গঙ্গা’, ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধান’-এর এই লেখকের সম্ভাবনা, একজন অতি তরুণ সাহিত্যকর্মীর চোখ দিয়ে প্রত্যক্ষ করা। সমরেশেরই তখন জীবিকাই সাহিত্য। দেবেশ তাঁকে নিয়ে পরে লিখেছেন, সমরেশ বসু কখনো অফিস পালানো লেখক ছিলেন না। হয়তো, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াকালীন সমরেশ বসুকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে দেবেশ রায় নিজেকে সার্বক্ষণিক লেখকই ঠাওড়েছেন। যদিও চল্লিশ-ঊর্ধ্ব পর্যন্ত আনন্দচন্দ্র কলেজে শিক্ষকতা, এবং, এরপর দীর্ঘদিন কলকাতার বিখ্যাত সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোসাল সায়েন্সের সঙ্গে যুক্ততা, এটাই তো তাঁর চাকরি, কিন্তু এর ভিতরে লেখক দেবেশ রায় সব সময়েই সমান্তরালে বহমান।

“আমি নেহাতই বাংলা ভাষার এক গল্প লেখক, শুধু লিখে খাওয়ার জোর নেই বলে অন্য চাকরি করেছি আর সঙ্গে একটু-আধটু লিখেছি। ঐ পার্টটাইম লেখক হওয়ার সুবাদে কিছু মস্তানি হয়তো লেখায় এসে গেছে কিন্তু সেগুলো চব্বিশ ঘণ্টা লেখা নিয়ে থাকার ফলে যেমন রক্তে ঢুকে যেতে পারত, তেমন ঢোকেনি। রক্তে ঢুকে যেতে পারত কী না সেটাও তো আনুমানিক কথা। রক্ত থাকলেই কি সে-রক্ত সব উপাদান বইতে পারে? আমাকে খুব হিসেব করে লেখক হতে হয়েছে, লেখক থাকতে হয়েছে। সেই প্রক্রিয়ায় এই ছোটোখাটো হিসেব বড় বেশি জরুরি—দিনে ক-পাতা লিখলে, ক-দিনে বিশ হাজার মতো শব্দ লেখা যায় ও পুজোর সময় কার দেয়া কথা রাখা যায়। এত ছোট, এত ছোট, এত হিসেবি, এত আত্মরক্ষণশীল, ভিতু, বাৎসরিক কৃত্যের মতো লেখালেখি—এ-সব অবান্তর, সেই যতই ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে কোরান পর্যন্ত প্রায় হাজার দশেক বছরের স্বপ্ন বিনিময় ও জন্মবিনিময় ঘটুক। আমাদের পাড়ার বাচ্চারাও শচীনের একত্রে ১০-লেখা গেঞ্জি পরে খেলতে নামে।” [‘নিজের স্বপ্নপুরুষের সঙ্গে কয়েক জন্মের তফাতে জুলেখার মিলন’, বাংলা ট্রিবিউন, ১১ মে ২০২১]

সম্প্রতি প্রকাশিত সমরেশ রায়ের সম্পাদনায় ‘দেবেশ রায়ের কবে কোন লেখা’ হাতে নিলে দেখা যায়, প্রায় প্রতি সপ্তাহই, তার কোনো না কোনো লেখা প্রকাশিত হয়েছে। স্বনামে, ছদ্মনামেও। অর্থাৎ দেবেশ রায় সব সময়ে লেখায় ছিলেন, চাকরির পাশাপাশি তিনি আসলেই ছিলেন সার্বক্ষণিক লেখক। দেখা যায়, ‘মানুষ খুন করে কেন’, ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, ‘সময় অসময়ের বৃত্তান্ত’, ‘তিস্তাপুরাণ’ কিংবা ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’-এর মতন দীর্ঘ উপন্যাসের লেখক তিনি, ওই গ্রন্থপঞ্জি ভাষ্য দিচ্ছে এখনও অগ্রন্থিত উপন্যাসের কয়েকটি, আর ১৯৬৮-র তিস্তা উপচানো বন্যায় ভেসে গেছে ‘অস্বিস্তের গণিত’ নামের একটি চারশ পৃষ্ঠার উপন্যাস। শুধু এই কটি উপন্যাসেই তো হতে পারে একজন লেখকের সারা জীবনের কাজ। হতে পারে ওই কাজ তিনি করেছেন, সেখানে এত প্রবন্ধ এতগুলো গল্প আর সাংবাদিক গদ্য ইত্যাদি লিখলেন কখন? শঙ্খ ঘোষ যেমন বলেন, দেবেশ এত সময় পায় কোথায়? উনিশ শতকের সাংবাদিক গদ্য নিয়ে বইটিও আকৃতিতে ঢাউস। এখানে বলা যেতে পারে, ‘মফস্বলি বৃত্তান্ত’-এর পরই দেবেশ রায় যখন ‘উপন্যাস’কে হাতে তুলে নিতে শুরু করেছেন, সেই থেকে, ‘মানুষ খুন করে কেন’ থেকে ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ পর্যন্ত কিংবা এরপরে ‘ইউসুফ-জুলেখা’ পর্যন্ত তাঁর এই যাত্রার মাঝখানে বাকি কাজ, এ সবই দুটো দুটো বড়ো লেখার মাঝখানে ফাঁক পূরণ! সেখানেও দেবেশ রায় পরাক্রমী। যেমন ইমতিয়ার শামীম তার প্রয়াণের পরে লিখেছিলেন, কখনো তাড়া ছিল না তার। ফলে আঠারো-উনিশ বছর বয়েস থেকে যখন রাজনীতিতে নিবেদিতপ্রাণ দেবেশ রায় স্থির করে নেন, লেখাই তার কাজ হবে, রাজনীতি দিয়ে সাহিত্যকে বুঝে নেওয়ার সেই ঘোরে দেবেশ রায় বুঝতে পারেন, এবং লেখেন, মাকর্সবাদ ছাড়া কোনো আধুনিকতা নেই। এটি নিজস্ব দীক্ষা। তাঁর লেখাকে, নিজেকের কাছে বুঝে নেওয়ায় এটা ধরন অথবা কৌশল। সেই কৌশলে, বিদ্যাসগার-ঈশ্বর গুপ্ত-প্যারীচাঁদ-কালীপ্রসন্ন-মধুসূদন-বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে তার সময়ের গল্প লেখককে পর্যন্ত দেবেশ রায় বুঝে নিতে চেয়েছেন। ফলে, শেষ দিকে গল্প লেখা কমেছে কিন্তু একেবারে শুরু থেকে, সেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশক থেকে, যখন শাস্ত্রবিরোধী কিংবা ছোটোগল্প নতুন রীতির আন্দোলনে যুক্ত, সেই থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ছোটোগল্প নিয়ে, উপন্যাসের পাশাপাশি তার নিজস্ব ভাবনা বহমান ছিল, বহমান যে ছিল তার কিছু প্রত্যক্ষ প্রমাণ এখানে হাজির করা যায়। দেবেশ রায় সম্ভবত আশির দশকের মাঝামাঝি ‘রবীন্দ্রনাথের গল্প : বিপরীতের বাস্তব’ প্রবন্ধে প্রথম বিষয়টি তুলে ধরেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে ধ্বস্ত যে বাংলার সমাজ, যে কৃষি কাঠামো তার সবচেয়ে শিল্পসফল রূপটি ধরা পড়ে রবীন্দ্রনাথের গল্পে। এবং, সেই লেখায় তিনি কবিতার উদাহরণসহ তিনি প্রামাণিক করে তোলেন, এই শিলাইদহ-শাহজাদপুর-পতিসর পর্বের রবীন্দ্রগল্পে বাংলার কৃষিকাঠামোর যে ধ্বস্ত রূপটি পড়ে, তা বাংলা ভাষার আর কোনো লেখায় এভাবে প্রত্যক্ষ নয়, ওদিকে জীবনের একেবারে শেষ দিকে (২০১৯) সালে অতীন বন্দ্যোপ্যাধ্যায়কে নিয়ে একটি লেখায় তিনি দেখিয়েছে, সেই শিলাইদহ অথবা ‘সোনার তরী’-পর্বে রবীন্দ্রনাথ যে গল্পগুলো লিখেছেন তা-ই, একইসঙ্গে বাংলা ও পৃথিবীর যে কোনো ভাষার ছোটোগল্পের আদি রূপ, নিজের অজ্ঞাতে অথবা জ্ঞাতেই, সৃষ্টির আসুরিক ক্ষমতায় রবীন্দ্রনাথ এই মাধ্যমটি প্রথম ও আজ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ এক লেখক। সেখানে তিনি এলান পো, সমারসেট মন, পুশকিন, তুর্গিনেভ, দস্তয়েইভস্কি, তল্স্তোয় কি চেখভেরও নাম নেন, এবং অতি দৃঢ়তার সঙ্গে জানান, তাদের লেখাগুলো যদিও রবীন্দ্রনাথের আগেই কিন্তু সেগুলো অন্য লেখা। ছোটোগল্প হিসেবে পৃথিবীতে যে শিল্পমাধ্যমটি চলমান তা নয়, সেগুলো অন্য কিছু। ছোটোগল্প বলতে আজ আমরা যা বুঝি, তার শুরু রবীন্দ্রনাথের হাত দিয়ে। এমনকি সেখানে শুরুর দিককার সেই রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলো, যথা : ‘দেনা-পাওনা’, ‘পোস্টমাস্টার’ ইত্যাদির নামও উল্লেখ করেছেন। এখানে একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে হচ্ছে। দেবেশ রায়ের এই দুঃসাহসী উচ্চারণ, যা রবীন্দ্রনাথ-প্রীতিতে উৎসারিত নয় কোনোভাবেই, বরং বাংলাগল্পের এমন এক পাঠক যিনি পৃথিবীর ছোটোগল্পের সঙ্গে নিজ ভাষাকে সাহসের সঙ্গে স্থাপন করতে পারেন, তবু পশ্চিমি-ধারণায় শিক্ষিত আমাদের মনের কাঠামোর জায়গা থেকে তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, পুশকিন থেকে চেখভ পর্যন্ত নামগুলোর উল্লেখ করে যে এভাবে রবীন্দ্রনাথই ছোটোগল্প নামক শিল্পমাধ্যমের প্রথম লেখক, বাকিরা যা লিখেছেন তা আখ্যান-কথাসাহিত্য কিন্তু ছোটোগল্প নয়, সেটি রবীন্দ্রনাথের হাতের শুরু—এই কথাটা একটু বেশিই শোনাচ্ছে না? দেবেশ রায় তাঁর স্বভাবসুলভ যুক্তির দৃঢ়তায় বলেছিলেন, এই প্রস্তাবটা আমি তুলেছি, নিজের যুক্তি যেখানে যতটুকু পারি দিয়েছি, আমার যা বলার বলেছি, তোমাদের যদি বিপরীতে কিছু বলার থাকে যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করো। আমি মনে করি আজ যা ছোটোগল্প, এই পৃথিবীতে তার স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!

আর, প্রেমচাঁদ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে, তিরিশ ও চল্লিশের দশকের প্রধান ছোটোগল্প লেখকদের অনেকেই বাস্তবকে নির্মিত দিতে পারতেন না বলেই, সংলাপে চাতুরির আশ্রয় নিতেন, কিংবা ছোটোগল্পের শেষ যে চমক তা আসলে লেখাতেই তার ইচ্ছেপূরণ, এমন কথাও জানিয়েছেন। সেখানে দেবেশ রায় নিজের যুক্তিকে যথার্থতার মাপে ধরাতে নেন নিয়ে প্রবোধচন্দ্র সান্যাল, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুবোধ ঘোষ কিংবা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের নাম। আর, তাদের পঞ্চাশের লেখকের উত্থানের কালে ছোটোগল্প নতুন রীতির সময়ে, তারা প্রভাব বিস্তার করেছেন ওই তিরিশও চল্লিশের লেখকদের ওপর। এমনকি সেখানে তাদের সেই আধুনিকতা-প্রভাবক যাত্রায় সামিল অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত কিংবা বুদ্ধদেব বসুর মতন লেখক। ওদিকে, এই দেবেশ রায়ই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটোগল্পেই পর্বান্তর খোঁজেন; কারণ, মানিকের ছোটোগল্পে প্রাথমিক থেকে দুর্ভিক্ষকাল থেকে তার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান ও দেশভাগ—এইসব সময়ের টানে লেখার ভিতরে যেভাবে বদলে গিয়েছিল, তাতে মানিকের পক্ষে ভাষার ওই বদল ছাড়া গল্প রচনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তারাশঙ্কর সম্পর্কে, তারাশঙ্করে রচনার ভূগোল সম্পর্কে, সেই ভূগোলের চাপ তার ‘রচনা’য় কীভাবে প্রভাবক, আর তাই হয়ে ওঠে তারাশঙ্করের রচনার আধুনিকতা। আর সেই খোঁজায় তারাশঙ্করের সমকালীন বুদ্ধদেব বসুর সেই উক্তি : তারাশঙ্কর লেখায় শিল্পকুশলতার বড়ো অভাব—সেকথা তারাশঙ্করের লেখার জ্বলন্ত ভূগোল খোঁজার ভিতর দিয়েই ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। এইসঙ্গে ওই তথাকথিত ‘শিল্পকুশলতা’ যে ‘আধুনিকতার’ নামে বাস্তবকে অস্বীকার। যেমন, ওই সময়ের কারও কারও লেখায়, সংলাপে আর বর্ণনা আর গল্পের শেষের চমকের সঙ্গে মিলিয়ে এক কৌশলগত চাতুরি—সেই কথাটা প্রকারান্তরে দেবেশ রায় জানিয়ে দেন। যেমন, বিভূতিভূষণ, দেবেশ রায় বলতেন, তিনি তাকে একটু পরে আবিষ্কার করেছেন। সেই আবিষ্কারে তিনি লক্ষ করেছেন, গল্পে বিভূতিভূষণ যে অসামান্য স্রষ্টা কারণ, ঘরের দীনহীন মানুষের একেবারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দুঃখ, এমনভাবে তিনি নাড়াচাড়া করতেন, গদ্যে কোনোমাত্র দেখানোর বিষয় সেখানে নেই, আর একেবারে ‘গল্পহীনতা’ও অসাধারণ গল্প হয়ে ওঠে তার ক্ষমতার গুণে। ‘বাটি চচ্চড়ি’ নামে বিভূতিভূষণের খুবই ছোটো একটি ছোটোগল্পে এক বিধবা চিরকালীন ভারতবর্ষের অমোচনীয় বৈধব্যকে সামনে হাজির করেন। এটা ঠিক ‘বাটি চচ্চড়ি’ নিশ্চয়ই বিভূতিভূষণের প্রধান গল্পের একটি নয়, কিন্তু দেবেশ রায় সেখানে খুঁজে ফিরেছেন একেবারেই ভিন্ন বাস্তবতা, ফলে প্রকরণহীনতার এই প্রকরণ, যা আমাদের প্রধানতম কথাসাহিত্যিকেরা করে দেখিয়েছেন আর একইসঙ্গে তা বাংলা গল্পের ভাণ্ডারের শ্রেষ্ঠ স্মারক। পাশাপাশি ‘আধুনিকতা’র (এখানে ইউরোপবাহী আধুনিকতাও বলা যেতে পারে) প্রদর্শনের নামে দেশকাল মানুষকে ঠিকঠাক চিনে উঠতে না-পারা, দুটো বিষয়ই দেবেশ রায় বহুবার হাজির করেছেন, দেখিয়েছেন, লিখে জানিয়েছেন; এবং, অতি অবশ্যই বলেছেনও।

বলাটা দেবেশ রায়ের স্বভাবেই ছিল। স্বভাববক্তা গোছের মানুষ, বলতেও পারতেন অক্লান্ত, যৌবনে, উত্তরবঙ্গে নিরবিচ্ছিন্ন রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা তাকে দড় করে তুলেছিল। যা পরে বিভিন্ন সাহিত্যিক বক্তৃতায়ও ভীষণভাবে কার্যকর হয়েছে। ফলে, যদি ১৯৫৫-এ তার গল্প রচনার সূচনাবিন্দু ধরে নেই, যেহেতু এর আগের ‘কলেজের কাগজে, স্থানীয় সাহিত্যপত্রে, বা এমনকি স্কুলে পড়ার সময়ে স্থানীয় পত্রিকাতেও লেখালিখি ছাপা হয়েছে—প্রায় নিয়মিতই’, এসব লেখাপত্তর তার কাছে অনুমোদনহীন, তাহলে পাশাপাশি একটি বিষয়ও খেয়াল রাখতে হয় যে, সেই মধ্যপঞ্চাশের দশক থেকেই বাংলা গল্পের ওই পর্যন্ত চলমান ভাষ্যকে তারা বদলে দিতে চান। চলবে

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’