পথে নেমে পথ খোঁজা

প্রথম মানস-সন্তানের জন্মবৃত্তান্ত ।। পর্ব—৬

নিজের লেখা বইকে সন্তানের সঙ্গে তুলনা করতে ভালোবাসেন অনেক লেখক। প্রজনন প্রক্রিয়ায় পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব অর্জনের মতো আনন্দ-যন্ত্রণা, স্বপ্ন-উদ্বেগ এবং দায়িত্ববোধ এমনভাবে মিশে থাকে যে, এক হিসেবে লেখা তো লেখকের মানস-সন্তান বটেই। লেখকের এই সন্তানবাৎসল্য মানবশিশুর বাবা-মায়ের চেয়ে কম যায় না। পিতামাতা এক পর্যায়ে তবু বুঝতে পারেন কোন সন্তানটি তার মানুষ হলো, আর কোনটি অমানুষ বা কুলাঙ্গার চিহ্নিত হলো। কিন্তু লেখকরা বোধহয় তাও পারেন না। অনেক সন্তানের ভিড় থেকে সেরা কিংবা প্রিয়টিকে নির্ধারণ করতে বললে বাৎসল্যবোধের চাপে বিহ্বল বোধ করেছেন অনেক বড় লেখক। সঠিক জবাব দিতে পারেন না। কিন্তু পরিকল্পিত ভবিষ্যৎ গড়ার এই যুগে যে-লেখকগণ অপরিকল্পিত এবং দায়-দায়িত্বহীনভাবে প্রজননক্ষমতায় সেঞ্চুরি করার পরও বৃদ্ধ বয়সেও যৌবনের তেজ দেখাতে পারেন, তাদের বাৎসল্যবোধ তেমন গভীর হয় কিনা জানি না। তবে প্রথমটির ক্ষেত্রে সম্ভবত, অবিস্মরণীয় দুর্বলতা থাকে ছোট কি বড়- সব লেখকেরই।

আমার প্রথম বই `অবিনাশী আয়োজন’। ১৯৮২ সালে বেরিয়েছে। প্রথম বই বলে কথা। প্রথম সন্তান পেটে আসতে না আসতেই মা ও বাবা যেমন সন্তানের নাম নিয়ে ভাবতে থাকেন, তেমনি আমার প্রথম বইয়ের নামটাও বই প্রকাশের অনেক আগে থেকেই বেশ ভেবেচিন্তে রাখা। নাম থেকেই যেন পাঠক গল্পগুলোর বিষয়, বিশেষত্ব, লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি ও সাহিত্যিক-উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনেকখানি ধরতে পারেন। প্রথম বই লেখকরা সাধারণত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রিয়জনকে উৎসর্গ করেন। কিন্তু বইয়ের গল্পগুলি লেখারও আগে, আমি প্রথম বইয়ের উৎসর্গপত্র ঠিক করে রেখেছিলাম। লেখক হওয়ার জন্য ঢাকায় এসে প্রথম উৎসাহ ও আশ্রয় পেয়েছিলাম ইত্তেফাকের দুই সাংবাদিক সহকর্মী রাহাত খান ও আখতার উল আলমের কাছে। বেশ কিছুদিনের ফুটপাতের ভাসমান জীবন শেষে আখতার-উল-আলমের বাসায় যেদিন গিয়ে উঠি, সেই রাতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমার প্রথম বই দুঃসময়ের এ দুই শুভার্থীকে উৎসর্গ করব। বই বেরোয় এ ঘটনার প্রায় দশ বছর পর। ততদিনে দুজনের সঙ্গেই বেশ দূরত্ব তৈরি হয়েছে। দেখা-সাক্ষাৎ হয় না বললেই চলে। কিন্তু আমি ভুলিনি নিজের সিদ্ধান্তটি। বই হাতে নিয়ে গিয়েছিলাম ইত্তেফাকে। রাহাত ভাই তো প্রায় ভুলে গিয়েছিলেন সামান্য উপকারের স্মৃতি। বলা বাহুল্য বই পেয়ে খুশি হয়েছিলেন দুজনই। তাদের পাঠ-প্রতিক্রিয়া আর জানাতে পারিনি।

নিজের লেখা পাঠক-সমালোচকগণের অন্তরে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা জানবার আগ্রহ, বিশেষ করে প্রথম বইয়ের ক্ষেত্রে সব লেখকরেই কিছুটা বেশি থাকে বোধহয়। নিজের মানস-সন্তানের জন্য পাঠকচিত্তে আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়ার বাসনা সুপ্ত কিংবা সচেতনভাবে থাকে বলেই প্রথম বই প্রকাশের আয়োজন ঘিরে আনন্দ-উদ্বেগ স্বপ্ন-কল্পনার অনুভূতিগুলো নবীন লেখকের মনে তীব্র হয়ে ওঠে। আমারও হয়েছিল। কিন্তু গল্পগুলি লেখার সময়ে পাঠক-সমালোচকের প্রশংসা বা প্রত্যাখ্যান নিয়ে মোটেও মাথাব্যথা ছিল না। এ কারণে বইটির প্রকাশের ঘটনা স্মরণ করার আগে, গল্পগুলির জন্মবৃত্তান্ত প্রকারান্তরে লেখক হয়ে ওঠার সময়টাকে খানিকটা স্মরণ করা যাক।

নিজের সৃষ্টিকে সন্তান কিংবা চিরকালীন সাহিত্য পাঠকের জন্য অমর সম্পদ ভেবে লেখকগণ যতই তৃপ্তবোধ করুন, তিনি ও তার সন্তানগণ উঠে আসে আসলে একটি বিশেষ সময় ও সমাজ থেকে। স্থান-কালের পরিচয়ে চিহ্নিত হয়ে ওঠেন তারা। এদিক থেকে আমরা যারা বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকের লেখক, বাংলাদেশ নামক নবীন রাষ্ট্রের জন্ম-যন্ত্রণা ও স্বপ্ন-সংগ্রাম তরুণ চেতনায় কমবেশি ধারণ করেই লেখালিখিতে তাদের আবির্ভাব ঘটেছে। স্বাধীনতার সুফল ও কুফল খুঁজতে খুঁজতে আমিও গল্প লিখতে শুরু করেছিলাম সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। আর সত্তর দশক মানে সবচেয়ে বড় সামাজিক গল্প, সত্তর দশক মানে বাঙালি জাতির সেরা ঐতিহাসিক ঘটনা, সত্তর দশক মানে শোক ও গর্বের বীরত্ব-গাথায় পূর্ণ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। লেখক হিসেবে তাই, অনেক সময় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফসল মনে হয় নিজেকে।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বয়সের দিক থেকে কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণে ছিল অবস্থান। সেই সময়ে বাঙালির জাতিমুক্তির স্বপ্ন-জাগরণ ও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা চৈতন্যে যে আলোড়ন তুলেছিল, তাতে আত্মোৎসর্গকারী একজন মুক্তিযোদ্ধা না হয়ে উপায় ছিল না কোনো সংবেদনশীল মানুষের। একাত্তরে রাইফেল হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুযোগ ঘটেনি। তবে কলম হাতে নির্যাতিত মানুষের মুক্তিসংগ্রামে সামিল হওয়ার অঙ্গীকার ও মানসিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছিল একত্তরেই। দেশ স্বাধীন হবার পরও মানুষের সামাজিক মুক্তির প্রশ্ন অবান্তর হয়ে যায়নি, বরং তীব্রতর হয়ে উঠেছিল আরো। লড়াই করার নানা মত ও পথ তৈরি হয়েছিল সমাজে। নানা পথ ও মতের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণই ছিল প্রধান লক্ষ্য। ক্ষমতায় যারা ছিলেন কিংবা লুটপাটের প্রক্রিয়ায় ছিলেন সক্রিয়, জনগণের দুরবস্থা দেখে তারাও শোষণহীন সমাজ বা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলতেন বেশ জোরেসোরে। আর সমাজবিপ্লব ঘটাবার জন্য প্রকাশ্যে বা আন্ডারগ্রাউন্ডে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদভিত্তিক কতো যে বাম রাজনৈতিক দল ও গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল, তার সঠিক পরিসংখ্যান বলাও এখন বেশ শক্ত। মুক্তিযুদ্ধের সময়েই শুধু দেশপ্রেমিক যুবকেরা শহিদ হয়নি, স্বাধীনতা-পরবর্তী সমাজেও আদর্শের লড়াইয়ে অত্মোৎসর্গ করেছিল অগণিত মেধাবী দেশপ্রেমিক যুবক। লেখকজীবনের শুরুতে সমাজবদলের রাজনীতি তথা মার্কসীয় দর্শনের প্রভাব আমার ওপর পড়েছিল তীব্রভাবে।

স্বাধীনতার পর, সামজিক প্রতিষ্ঠার সহজ পথ কিংবা মানুষ হওয়ার ধরাবাঁধা পথগুলি পরিহার করে লেখক হিসেবে সামাজিক দায়িত্ব পালন ও আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ খুঁজতে শুরু করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিরিখেই বুঝতে চেয়েছিলাম স্বাধীনতা পরবর্তী সমাজের অস্থিরতা। মানুষের আশা ও আশাভঙ্গের কারণ। ফলে সামাজ-সচেতনতা ও সামাজিক অঙ্গীকারই প্রধানভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে সেই সময়ের লেখক সত্তাকে। গল্পে বিষয় হিসেবে ঘুরেফিরে এসেছে আজন্মের পরিচিত গ্রামজীবন, গ্রামের ক্ষুধা-দারিদ্র্য তথা স্বাধীনতার সুফল থেকে বঞ্চিত মানুষজন। লিখতে গিয়ে রাগ, ক্ষোভ, প্রতিবাদের অনুভূতি প্রচ্ছন্ন তো ছিলই, শিল্পের সংযম ভেঙেও তা সোচ্চার হয়ে উঠতে চাইত অনেক সময়।

এরকম পটভূমি ও মেজাজ থেকেই রচিত হয়েছিল ‘অবিনাশী আয়োজন’-এর গল্পগুলি। বইটির প্রথম গল্প ‘প্রিয় দেশবাসী’। ১৯৭৯ সালের দিকে লেখা। সেই সময়ের রাষ্ট্রপতি উৎপাদনের রাজনীতিতে গতি সঞ্চারের জন্যে একবার হেলিকপ্টারসুদ্ধ উত্তরবঙ্গের তিস্তা তীরবর্তী গ্রামেও অবতরণ করেছিলেন। গাঁয়ের দরিদ্র কৃষক আমানুল্লার হেলিকপ্টার ও রাষ্ট্রপতি দর্শনের অভিজ্ঞতা, সহসা ভিড়ের সামনে পড়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তার অপ্রত্যাশিত কোলাকুলি দৃশ্যের প্রতিক্রিয়া, অন্যদিকে দেশবাসীর উদ্দেশে চিৎকার করে রাষ্ট্রপতির প্রেম নিবেদন। সংক্ষেপে এই হলো গল্পটির বিষয়বস্তু। লেখার পর গল্পটি ছাপা কঠিন হয়ে পড়েছিল দেশে। রাষ্ট্রপতিকে চিনতে পারার কারণেই কিনা জানি না, গণসাহিত্য এবং সাংবাদ সাহিত্য সাময়িকী ছাপেনি। ফলে গল্পটি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গের ‘পরিচয়’ পত্রিকায়। দেবেশ রায় ছিলেন তখন ‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদক। ‘পরিচয়’ পত্রিকার বিশেষ গল্পসংখ্যার জন্য নির্বাচন করেছিলেন গল্পটিকে। অমিয়ভূষণ মজুমদার, অসীম রায়, মহাশ্বেতা দেবী, সমবের বসু, দেবেশ রায় প্রমুখ বিখ্যাত সব লেখকের তালিকায় অখ্যাত এই নবীন লেখকের গল্প গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছিল গল্পসংখ্যায়। ছাপা হয়ে পত্রিকাটি যখন বাংলাদেশে আসে, বিদগ্ধ পাঠক-লেখক অনেকেই কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন। কে রে এই মঞ্জু সরকার, হিন্দু না মুসলমান, মেয়ে না পুরুষ ইত্যাদি। সরাসরিও অনেকে জিজ্ঞেস করত এসব, খারাপ লাগত। কারণ লেখককে যে জাত-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের সংকীর্ণ গণ্ডী পেরিয়ে মানুষ হতে হয়, বিশ্বমানবের অংশী হতে হয়, এই বোধ নিয়েই তো যাত্রা শুরু করেছিলাম।

এর আগে দেশে দৈনিক বাংলা, সংবাদ সাময়িকী, সন্ধানী ও গণসাহিত্য পত্রিকায় গল্প বেরিয়েছে আমার। এ ছাড়া দেশে লেখক হিসেবে আমাকে পরিচিত করানোর ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন ‘রূপম’ পত্রিকার সম্পাদক আনওয়ার আহমেদ। ‘রূপম’ সেসময়ে গল্পের পত্রিকা হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছিল। তিনি প্রিয় দেশবাসীকে মহামানব নাম দিয়ে এবং প্রেসিডেন্টকে মাহামানবের পরিচয়ে আড়াল করে গল্পটি ‘রূপম’-এ ছেপে দিয়েছিলেন। সেই গল্প পড়ে কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন ‘রূপম’ পত্রিকায়। অফিসে এসে পরিচিত হয়েছিলেন লেখকের সঙ্গে। নবীন লেখকের জন্য প্রতিষ্ঠিত বা অগ্রজ লেখকরা আজকাল এ ধরনের ভূমিকা পালন করেন কি না জানি না। রিজিয়া আপার সেই লেখা খুব একটা বড় পুরষ্কার পাওয়ার মতো উৎসাহ দিয়েছিল লেখককে। এরপর ‘রূপম’-সম্পাদক উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ ‘কার্তিকমাসী মঙ্গা’ নিয়ে লেখা কার্তিকের অতিথি গল্পটি ছেপেছিলেন তার পত্রিকায়। এ গল্পটিও সুধীজনের প্রশংসা পেলে আনওয়ার ভাই প্রথম প্রস্তাব দিলেন- আমার গল্পের বই প্রকাশ করবেন তিনি।

সম্পাদক হিসেবে আনওয়ার ভাই প্রিয় বা ঘনিষ্ঠ ছিলেন না আদৌ। প্রকাশক হিসেবেও আকাঙ্ক্ষিত নন। কিন্তু সেই সময়ে গাঁটের টাকা গচ্চা দিয়ে একজন নবীন লেখকের বই প্রকাশ ও তার লেখক স্বীকৃতি আদায়ের উদ্যম অন্য প্রকাশক ও সাহিত্যোদোক্তার মধ্যে থাকা দূরের কথা, স্বয়ং লেখকের মধ্যেও তার অভাব ছিল। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সঙ্গে যেহেতু দেশের বড় ছোট সব শ্রেণির প্রকাশকেরই সুযোগসুবিধা লাভের নিবিড় সম্পর্ক, প্রতিষ্ঠানের কর্মী হিসেবে আমাকেও চেনে অনেকেই। গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক, নিদেন পক্ষে কবি কায়সুল হকের সুপারিশ নিয়ে কোনো প্রকাশককে অনুরোধ জানালে হয়তো বইটা করে দিত। কিন্তু কারো সুপারিশ নিয়ে পত্রিকায় লেখা ছাপানোর রুচি যেমন হয়নি, তেমনি কারো সুপারিশে বড় প্রকাশকের অনুকম্পা পাওয়াও বড্ড অরুচিকর মনে হতো সেই তরুণ বয়সেও। অগত্যা আনওয়ার ভাইয়ের উদ্যমের কাছে পরাস্ত মেনে অবিনাশী আয়োজনের পাণ্ডুলিপি তৈরি করলাম। বইয়ের মান ও চরিত্র বজায় রাখতে গিয়ে প্রথম দিকের লেখা অনেক গল্পই বাদ রাখতে হলো।

প্রথম বই ‘অবিনাশী আয়োজন’-এর প্রচ্ছদফকিরাপুলের এক লেটার প্রেসের সাথে সম্পর্কিত ছিল আমার বেকারজীবনের বন্ধু আহমাদ কফিল। ভালো পাঠক ও দক্ষ প্রুফরিডার ছিল সে। দুজনেই সাহিত্যপাগল ও বেকার ছিলাম বলে সম্পর্কটা অর্থ উপার্জনের ধান্ধাসহ সুইপার কলোনির মদ্যপানের আসর পর্যন্ত গড়িয়েছিল। আনওয়ার ভাই সেই কফিলকে কাগজ কেনার টাকাসহ সব দায়িত্ব চাপিয়ে কাস্টমসের চাকরিতে ব্যস্ত থাকেন। কফিল বইয়ের কম্পোজ, মুদ্রণ, বাঁধাই ইত্যাদি কাজের সঙ্গে লেগে ছিল এবং আমিও তার সঙ্গে লেগে থেকে বই যন্ত্রস্থ হওয়ার যন্ত্রণা অনেকটা উপলব্ধি করেছিলাম। বইটির প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন গ্রন্থকেন্দ্রে আমার অগ্রজপ্রতিম সহকর্মী ও সেই সময়ের আলোচিত প্রচ্ছদশিল্পী আব্দুর রোউফ সরকার।

অবশেষে বাঁধাইকার আবুল ভাইয়ের কাছ থেকে কাঁচা গন্ধযুক্ত বই নিয়ে ব্যাংকার বন্ধু নুরুল করিম খসরুসহ প্রকাশককে দেখানোর জন্যে গিয়েছিলাম এয়ারপোর্টে। কাস্টম ইনস্পেকটর হিসেবে আনওয়ার ভাই তখন এয়ারপোর্টে ডিউটি করেন। সত্যি সত্যি সন্তানকে নিয়ে এয়ারপোর্টে যাওয়ার অনুভূতি জেগেছিল। সেদিনের আনন্দস্মৃতি অম্লান এখনও।

ওই সময়ের প্রচলিত নিয়মে প্রথম সংস্করণে ১২৫০ কাপি ছাপা হয়েছিল বইটি। কত কপি বিক্রি হয়েছিল জানি না। পেশাদার লেখক হওয়ার লক্ষ্য থাকলেও প্রথম বই থেকে এক টাকাও রয়্যালিটি পাইনি। প্রকাশকও পেশাদার ছিলেন না। ফলে বিক্রয়ের চেয়ে বইটি প্রকাশক তাঁর একটি ভালো কাজের নমুনা হিসেবে সাহিত্যবোদ্ধা লেখক-বুদ্ধিজীবীদের কাছে সৌজন্য বিতরণ করেছিলেন বেশকিছু কপি। বইটি পড়ে পরলোকগত বিজ্ঞানের লেখক-অধ্যাপক জহুরল হক, গল্পকার মিরজা আব্দুল হাইম ড. মফিজ চৌধুরী এবং অচেনা বেশ কয়েকজন পাঠক চিঠি লিখে আন্তরিক প্রশংসা ও অভিনন্দন জানিয়েছেলেন লেখককে। লেখকের সঙ্গে পরিচয় বা সম্পর্কের বিষয় বিবেচনা না করে আলোচনা লিখেছিলেন সন্তোষ গুপ্ত, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, অধ্যাপক সুনীল মুখোপাধ্যায়, শফি আহমেদসহ পশ্চিমবঙ্গের ‘দেশ’ পত্রিকাতেও একজন। সন্তোষ গুপ্ত সংবাদে ‘প্রিয় দেশবাসী’ গল্পটিকে বিশ্বসাহিত্যে স্থান পাওয়ার যোগ্য বলে মন্তব্য করায় বন্ধুরা অনেকেই আমাকে বিশ্বসাহিত্যিক বলে বিদ্রুপ করতে শুরু করেছিল। ঐ সময় ব্যাংকার লুৎফর রহমান সরকার ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মনজুরে মওলার উদ্যোগে দেশের সবকটা সরকারি ব্যাংক মিলে বাংলা একাডেমির মাধ্যমে ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার চালু হয়েছিল। সাহিত্যের প্রতি শাখায় সেরা বইয়ের জন্য দশ হাজার টাকা দেওয়া হবে। আমাকে না জানিয়েই আনওয়ার ভাই আমার বইটি জমা দিয়েছিলেন। ওই বছরের কথাসাহিত্য শাখায় সেরা গ্রন্থ হিসেবে প্রথম মানসসন্তান ‘অবিনাশী আয়োজন’ ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কারটি লাভ করায়, বড় লেখক হওয়ার আত্মবিশ্বাস ও প্রেরণা অনেকটাই শক্ত ভিত পেয়ে যায়। ১৯৮৩-তেই প্রথম ও শেষবার দিয়ে ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কারটি মরে গেছে। এরপর অবিনাশী আয়োজনের তৃতীয় সংস্করণ ছাড়াও কয়েক ডজন নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে আমার। কিন্তু সব বইয়ের প্রকাশের স্মৃতি ম্লান করে দিয়ে প্রথম মানসসন্তানের জন্মবৃত্তান্ত স্মৃতিতে বড় জীবন্ত হয়ে আছে। প্রথম বইয়ের বেলায় সব লেখকই এরকম বোধ করি। চলবে

কায়েস আহমেদের হাত ধরে প্রিয় লেখকদের আস্তানায় ।। পর্ব—৫