পথে নেমে পথ খোঁজা

ডিজিটাল বিশ্বে মানুষ কেন একা ও আতঙ্কিত।। পর্ব—১২

আইটি বিপ্লবের সূচনায় ১৯৯০-এর দশকেই গোটা বিশ্বে ইন্টারনেট সংযুক্ত কম্পিউটারের বহুমুখী ব্যবহার বাড়তে থাকে। অবশ্য বাংলাদেশে কম্পিউটারের ব্যবহার, বিশেষ করে মুদ্রণশিল্পে প্রসার ঘটেছিল প্রথম। ইন্টারনেট আসার পর, সমুদ্র তলদেশের আন্তর্জাতিক ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার পর থেকে দেশে দেশে কম্পিউটারের বহুমুখী ব্যবহার প্রতি বছরেই গুণিতক হারে বেড়ে চলেছে। তার ছাড়াই ইন্টারনেট আসে এখন কম্পিউটারের ক্ষুদ্রতম সংস্করণ নানারকম স্মার্টফোন ও বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইসে। উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশও আজ নিজেকে দাবি করতে পারে ডিজিটাল দেশ। কারণ সতেরো কোটি মানুষের এ দেশে মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহৃত হচ্ছে সতেরো কোটি, আর সক্রিয় ইন্টরনেট ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা ১১ কোটি। ইন্টারনেট নির্ভর বাণিজ্য ও ই-সেবা দেয়া-নেয়ার কাজ হচ্ছে নানা ক্ষেত্রে।

মাত্র তিন-চার দশক আগেও দারিদ্র্যপীড়িত দেশে ঘরে বসে গোটা বিশ্বেকে হাতের মুঠোয় দেখতে বা ধরতে পারাটা ছিল অনেকটা রূপকথার মতো অবিশ্বাস এবং রোমাঞ্চকর কল্পনা মাত্র। এখন সেই অবিশ্বাস্য ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা শহরের বালক, বৃদ্ধ থেকে শুরু করে নিভৃত পল্লীর স্বল্প শিক্ষিত মানুষটিও। হাতে ধরা মোবাইল ফোনের স্ক্রীনে তন্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ফেসবুকে আড্ডা দেয়। ইউটিউবে বিশ্ব দেখে কিংবা বিশ্ব ছড়িয়ে থাকা স্বজনদের সঙ্গে মুখোমুখি কি কানেকানে কথা বলে ফ্রি ইন্টারনেট-ফোনে। এসব সুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা ঘরেবাইরে সর্বত্রই বাড়ছে। ডিজিটাল জগতের বাসিন্দারা এখন হাতের ক্ষুদ্র যন্ত্রটি ছাড়া একদিনও বাঁচার কথা ভাবতে পারে না আর।

২০২০ ও ২১ সালে করোনা ভাইরাসের বিশ্বায়নে সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে দেশে লক ডাউনে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত হওয়ায় বেড়েছে মানুষের ইন্টারনেট নির্ভরতা। মহামারি আতঙ্কে মানুষকে অন্যান্য মানুষ এবং প্রকৃতি-পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে গৃহবন্দি থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। এমন অস্বাভাবিক বিচ্ছিন্নতায় স্বভাবতই বাইরের প্রকৃতি-পরিবেশ ও সমাজের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার আকুতি প্রবল হয়ে ওঠে ব্যক্তি মানুষের। কারণ প্রকৃতি ও সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে বাঁচাটাই তার জৈবিক ধর্ম। মানুষের এই ধর্ম কিংবা মৌলিক চাহিদা পূরণে আইটি বিপ্লবে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো জায়ান্ট টেক কোম্পানি। গুগল, ফেসবুক, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, অ্যাপেল, ইন্টেল ইত্যাদি নাম এখন কম্পিউটার ও স্মার্টফোন ব্যবহারকারী বিশ্বের প্রতিটি মানুষ জানে। গত তিন-চার দশকে গড়ে ওঠা এসব টেক-কোম্পানির কারো কারো একক আয়ের পরিমাণ এখন বিশ্বের ২০০ কোটি মানুষের চেয়েও বেশি। বহু গরিব রাষ্ট্রের বার্ষিক বাজেট দেয়ার মতো আর্থিক সক্ষমতা রয়েছে এক একটি কোম্পানির। অল্প সময়ে কী ভাবে বিলয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিক হলো তারা?
 
আমরা জানি পুঁজিবাদী সমাজে ধন-বৈষম্য ও শোষক-শোষিতের অবস্থান স্বাভাবিক রীতি। শিল্প বিপ্লবের পর শিল্পপতি-পুঁজিপতিরা কলে-কারখানায় উদ্বৃত্ত মূল্য তথা শ্রমিকদের শোষণ করে বলে মালিক ও মজুরের মধ্যে ধনবৈষম্য আকাশ-পাতাল হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে যে যত বেশি সংখ্যাক ভোক্তার কাছে পণ্য বা সেবা পৌঁছে দিয়ে বেশি বেশি মুনাফা অর্জন করে, তার ধন-সম্পদ ততই বাড়ে। এ ছাড়া নড়বড়ে রীতিনীতির দেশে স্বল্প সময়ে সম্পদের পাহাড় গড়ার আর একটি সহজ উপায় হলো লুটপাট ও দুর্নীতি। এই সত্যটি বোঝার জন্য অবশ্য এ দেশের মানুষকে অর্থনৈতিক তত্ত্ব জানা প্রয়োজন হয় না, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দৃষ্টান্ত অফুরান। 
আইটি জগতের প্রভাবশালী কোম্পানিগুলির প্রায় সকলেরই উৎপত্তি ও হেড অফিস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে পুঁজিবাদ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পোক্ত বলে লুটপাট ও দুর্নীতির মাধ্যমে হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া সহজসাধ্য নয়। তাছাড়া এসব জায়ান্ট টেক কোম্পানির অনেকেই (যেমন গুগল ও ফেসবুক) বিশ্ববাসীকে ফ্রি-সার্ভিস দিয়ে থাকে। মানুষ দিনেরাত যত খুশি গুগল সার্চ দিক কি ইউটিউব দেখুক, সে জন্য গুগল কোনো ফি নেয় না। সামাজিক নেটওয়ার্কে তাদের প্লাটফর্মে মানুষ দিনেরাতে বন্ধুদের সঙ্গে যত খুশি সামাজিকতা করুক, সে জন্য ফেসবুকের মতো কোম্পানিগুলো কোনো ফি নেয় না। বরং আইটি বিপ্লবের সুফল ও বহু টেক কোম্পানির সাহায্য নিয়ে বহু দেশ এবং বাণিজ্যিক সংস্থা তাদের উন্নয়নের গতি ও সেবাদান কার্যক্রম সহজ, স্বচ্ছ এবং গতিশীল করেছে। তা হলে কীভাবে এসব জায়ান্ট কোম্পানি অল্প সময়ে বিশ্বসেরা ধনকুবের হয়ে উঠছে? অন্যদিকে দেশে দেশে মানুষের আয় বৈষম্যই-বা হু হু করে বাড়ছে কেন?

এক ডলার যে আয় করতে পারে না, তার মাথায় বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন প্রকৃত অর্থেই আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর জানতে চাওয়া মনে হয় নিজের কাছেও। লুটপাট কিংবা উদ্বৃত্ত মূল্য বা শ্রমিকদের শোষণ না করেও বড় টেক কোম্পানির অগাধ অর্থসম্পদের মূলে মেধাসত্ত্ব কিংবা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কী গুমোড় কাজ করছে, অর্থনীতিবিদরা তার ভালো ব্যাখা দিতে পারবেন। আমার প্রশ্ন এবং আতঙ্ক আসলে মানব-জীবনে আইটি বিপ্লবের অপব্যবহার ও নেতিবাচক দিক নিয়ে।

সমাজ বিপ্লব করার লক্ষ্যে একদা দুনিয়ার মজুর শ্রেণিকে এক করতে ব্যর্থ হয়েছে সাম্যবাদীরা। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির হোতা কোম্পানিগুলো তাদের ডিজিটাল প্লাটফর্মে একত্রিত করেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্ববাসীকে। তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বায়নে ও তাদের ডিজিটাল প্লাটফর্মে মানুষের এমন বিশ্ব সম্মিলন ঘটানোর মূলে তাদের মানব কল্যাণের কোনো দর্শন বা লক্ষ্য কাজ করছে তা স্পষ্ট নয়। তবে মুনাফার দিকটি স্পষ্ট। মানুষ তাদের কাছে পণ্য, ভোক্তা বা সংখ্যার অধিক কিছু নয়। কাজেই ভৌগলিক সীমা ও জাত-বর্ণ-ধর্ম-সংস্কৃতির ঘেরাটোপ ভেঙে বিশ্ববাসী মুহূর্তেই এসব সাইবার বা ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে একত্রিত হচ্ছে বটে, একইরকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে, কিন্তু তাতে কি মানুষে মানুষে ঐক্য ও বিশ্ব মানবতাবোধ সমৃদ্ধ হচ্ছে? নাকি পরকে আপন করে তুলতে গিয়ে ঘরকেও পর করছি আমরা?
 
সম্প্রতি করোনা ভাইরাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি ধ্বংস ও মৃত্যুর আতঙ্ক বড় করে তুলছে বিশ্ববাসীর মনে। প্রাকৃতিক ভাইরাসের মতো আইটি জগতেও নানা ভাইরাস-সংক্রমণ ও সাইবার এ্যাটাকের কথা শোনা যায় প্রায়ই। বাস্তব সমাজে লুটেরা-ডাকাতের অস্তিত্ব যেমন, তেমনি এই জগতেও হ্যাকার-ক্রিমিনালদের ষড়যন্ত্র ও সক্রিয়তা প্রমাণিত সত্য। কাজেই ডিজটাল প্লাটফর্মগুলি মানুষে মানুষে ঐক্য সংহতি বাড়ায়, নাকি সমাজে ধনবৈষম্য, মানুষের মনে একাকিত্ব ও আতঙ্কবোধ বাড়াতেই কাজ করছে আসলে? দেখেশুনে আমার মনে আরো প্রশ্ন জাগে, প্রাকৃতিক ভাইরাসের মতো আইটি জগতেরও অদৃশ্য ভাইরাস একদিন মানব প্রজাতি ও মানব-সমাজের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে না তো?

শিল্প বিপ্লবের পর তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব অতি অল্প সময়ে বিশ্বে যে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে, মানুষের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিতে যে প্রভাব রাখছে, তার কারণ ও ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখার বিশেষজ্ঞ জ্ঞানীরা বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করছেন। এসব প্রযুক্তি ব্যবহারকারী সাধারণ মানুষের দুই-তিন দশকের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার জগৎ পরিক্রমাতেও এই বিপ্লবের কারণে সৃষ্ট পরিবর্তনের চিত্রগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এ কারণে এ লেখাটায় একজন সামান্য লেখক হিসেবে আইটি জগতের সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্কের স্মৃতি-ভাবনার সরল বয়ান দিতে চাই। তাতে হয়তো আইটি বিপ্লবে উদ্ভুত যে আতঙ্ক ও নেতিবচাক দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি, তা আরো স্পষ্ট হবে এবং সঠিক জবাব খুঁজে পাওয়াও সহজ হবে।

বিদ্যুতায়িত হওয়ার আগে আমরা যারা গ্রামে জন্মেছি, হাজার বছরের ধারাবাহিক অন্ধকারে শৈশব-কৈশোর কেটেছে যাদের, মুক্ত প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বেঁচে থাকার টানটা তাদের মধ্যে বোধহয় বেশি কাজ করে। এ কারণে যৌবনে ঢাকা শহরবাসী হওয়ার পরও, সেই পুরোনো টানে আমি শহরতীর একটি গ্রামে সস্তায় জমি কিনে ধানক্ষেতে বাড়ি করেছিলাম। মূল কারণ ছিল অবশ্য নগরসীমায় উপযুক্ত বাড়ি করার অক্ষমতা। গত শতকের আশির দশক ছিল সেটা। নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত সেই আবাসভূমিতে বসবাসের ভোগ-দুর্ভোগ সহার শক্তি যুগিয়েছিল একদিকে পূর্বপুরুষের হাজার বছরের অন্ধকার যুগে বসবাসের ঐতিহ্য ও সংগ্রাম, অন্যদিকে উন্নত ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন। গাঁয়ের ধানেক্ষেতের প্রান্তর থেকে আলো ঝলমল রাজধানীর হাতছানি চোখে পড়ত। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কিংবা অর্থবিত্তের দিক থেকে যারা দুর্বল, মাত্র দুই যুগ আগেও নাগরিক সুবিধা তথা বিদ্যুৎ, গ্যাস বিশেষ করে সরকারি একটি ল্যান্ডফোন সংযোগ পাওয়া মোটেও সহজসাধ্য ছিল না তাদের জন্য। অপেক্ষা ও চেষ্টা-তদ্বিরের পর পাগলা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বাড়িতে একটি ল্যান্ডফোন সংযোগ পেয়ে খুশি হয়েছিলাম সবচেয়ে বেশি। কারণ ল্যান্ডফোন ছাড়া ইন্টারনেটের অসীম জগতে ভ্রমণের কোনো উপায় ছিল না তখন।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষ স্বভাবতই স্থিতাবস্থার পক্ষে এবং পরিবর্তনকে ভয় পায়। সমাজ বিকাশের প্রতিটি স্তরে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবনকে বরণ করতে ভয় পেয়েছে মানুষ। কিন্তু গত শতকের নব্বইয়ের দশকে আইটি বিপ্লবে শরিক হওয়ার জন্য আমার ভয়ের চেয়ে ব্যাকুলতাই ছিল বেশি। তার কারণ সম্ভবত শহরতলির সেই বাড়ির বিচ্ছিন্নতা ও নানারকম দুর্ভোগ। এ কারণে ১৯৯৮ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার পেয়েই পুরস্কারের টাকায় আমি বহু স্বপ্নসাধের ডেস্কটপ কম্পিউটার কিনেছিলাম। উদ্দেশ্য কম্পিউটারে বেশি লিখে বেশি বেশি রোজগার করা এবং ইন্টানেটের অসীম জগতে ইচ্ছেমতো ভ্রমণ করা। ততদিনে সমস্যাবহুল এ দেশেও ইন্টারনেট যুক্ত কম্পিউটারের প্রসার ঘটতে শুরু করেছে। কম্পিউটার ব্যবসায় ও কম্পিউটার শিক্ষা প্রসারে এগিয়ে এসেছে অনেক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে মোস্তাফা জব্বারের অবদান (বর্তমানে টেকনোক্র্যাট কোটায় ডাক ও তার মন্ত্রী) বিশেষ ভাবে মনে পড়ে। কারণ কম্পিউটারে বাংলায় লেখায় জন্য তিনি বিজয় কীবোর্ড ও বাংলা ফন্ট-এর সফটওয়্যার চালু করেছেন। এ ছাড়া আইটি বিপ্লবের অগ্রগতি নিয়ে পত্রপত্রিকায় কলামও লিখতেন নিয়মিত। জব্বার ভাই তার আগে প্রেস, ট্রাভেল ব্যবসায় জড়িত এবং একটি বিনোদন পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক ছিলেন। তাঁর পত্রিকার ঈদসংখ্যায় উপন্যাস লেখার সুবাদে আলাপ-পরিচয় ছিল। কম্পিউটার কিনেই ফোন করে তাঁকে উদ্দেশ্য জানালাম। তিনি আমাকে মাগনা বিজয় লোড করে দেয়ার জন্য সিপিইউ নিয়ে অফিসে ডাকলেন। আনন্দ কম্পিউটার ছাড়াও তরুণ প্রজন্মকে কম্পিউটার শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য কী একটা প্রতিষ্ঠানও খুলেছেন। সেই সময়ে আমার বড় ছেলে কলেজে পড়ছিল। তাকেও কম্পিউটার জগতের যোগ্য করে গড়ে তোলার প্রেরণা দিতে, তার কাঁধে সিপিইউটি দিয়ে চললাম জব্বার ভাইয়ের অফিসে। আমার কম্পিউটারে বিজয় লোড করে দিয়ে চালানোর সহজ কায়দাও শিখিয়ে দিলেন। ছেলেকেও কম্পিউটার শিক্ষায় আগ্রহী করতে সময়োপযোগী উপদেশ দিলেন বিস্তর।

অতঃপর কাগজ-কলমে ঘষাঘষির বদলে কম্পিউটারে মহাউৎসাহে শুরু হলো সাহিত্য চর্চা। মুনীর অপটিমায় বাংলা টাইপের দক্ষতা আগে থেকেই ছিল। বিজয় কীবোর্ড রপ্ত করতে সময় লাগল না বেশি। আপন সৃজনশীলতায় সাদা স্ক্রীনের অন্তহীন পৃষ্ঠা ভরানোর প্রয়াস চালতে থাকে। ক্লান্তি কাটাতে কম্পিউটারে সিডি কিংবা ফ্লুপি ডিস্ক ভরে মালটি মিডিয়ায় গান শুনি কিংবা ছবি দেখি। কম্পিউটারে আসল মজাটা শুরু হলো প্রশিকা সার্ভারের মাধ্যমে ইন্টারনেট যুক্ত হওয়ার পর। ফোন ও একটি মডেমের মাধ্যমে এক ধরনের ক্যারক্যার আওয়াজ দিয়ে আমার কম্পিউটারটিও ইন্টারনেটের অনন্ত বিশ্ব সংযুক্ত হতো। ভাবতেও পুলক জাগত। পাসওয়ার্ড দিয়ে গুগল, মজিলা ও এমএসএন ইত্যাদি সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে তথা বিশ্বব্যাপী লাখো-কোটি ওয়েব-পেজের মাধ্যমে গোটা বিশ্বকেই ধরতে চাইতাম যেন। ইংরেজি ভাষার বহু বিশ্বখ্যাত সংবাদপত্র ও সাহিত্য পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ এবং অনেক প্রতিষ্ঠানের আর্কাইভ ডকুমেন্টস ফ্রি পড়তে পারতাম। শুরুর দিকে ই-কমার্স এতটা চালু হয়নি বলে গ্রাহক হওয়ার শর্ত আরোপ ও গ্রাহক চাঁদা হিসেবে ডলার দাবি করত না তারা। অনলাইনে পড়া-শোনা ও ছবি দেখার চেয়েও আমার জন্য লাভবান হওয়ার মতো বড় সুবিধা ছিল ই-মেইল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও প্রকাশকের কাছে হাতেলেখা পান্ডুলিপি হাতে হাতে কিংবা ডাকযোগে পৌঁছাতে হতো আগে। কম্পিউটার হওয়ার পর ফ্লুপি ডিস্কে লেখা কপি করে অনেক পত্রিকা কি প্রকাশকের কম্পিউটারে দিয়ে এসেছি। কিন্তু ইন্টারনেটের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যেই বিশ্বের যে কোনো গন্তব্যে নিজের ডকুমেন্টস পাঠানো কিংবা প্রাপ্তির সুযোগটিকে মনে হয় আইটি জগতের সবচেয়ে বড় সুবিধা।
 
নব্বইয়ের দশকে কিংবা বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে ফেসবুক টুইটার ইত্যাদি সোশ্যাল নেটওয়ার্ক আজকের মতো ফুলেফেঁপে ওঠেনি। তবে ইন্টারনেটে আড্ডা দেয়া বা চ্যাট করার মতো কিছু প্লাটফর্ম ছিল। আর পর্ণো সাইটের সংখ্যাও ছিল লক্ষ লক্ষ। গোপনে নিজের কম্পিউটারে বিশ্বের নানা জাত ও বর্ণের উলঙ্গ নারী-পুরুষ ও তাদের জান্তব কামের প্রকাশ দেখে দেহমনে প্রতিক্রিয়া হতো অবশ্যই। আবার যুবক ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে ভয় জাগত আরো বেশি। অল্প বয়সীরা এসব দেখার সুযোগে নেশাগ্রস্ত হলে কী উপকারটা হবে তাদের? আইটির আন্তজালে গোটা বিশ্ব যেভাবে বাঁধা পড়ছে, তাতে নতুন প্রজন্মকে বিচ্ছিন্ন রাখার উপায় নেই। অন্যদিকে সাইবার জগতে যারা নিজেদের লাভের জন্য মানব-সমাজের জন্য ক্ষতিকারক অনৈতিক অশ্লীল কর্মকান্ড করছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে কে?
 
আইটি বিপ্লবের নেতিবাচক দিকটি নিয়ে ভাবতে গিয়ে, অবশেষে একদিন ভাইরাস আক্রান্ত হলো আমার কম্পিউটারটি। বিপর্যয় দেখা দিল সিস্টেমে। ততদিনে আমার কয়েক বছরের লেখা বেশ কিছু গল্প-উপন্যসের ফাইল বই হবার অপেক্ষায় কম্পিউটারে বিভিন্ন ড্রাইভে অদৃশ্যভাবে অবস্থান করছিল। ঢেঁকি ও খড়ম যুগের ইতিকথা নামে দু’বছর ধরে একটা দীর্ঘ উপন্যাস শেষ করে এনেছিলাম প্রায়। এগুলোকে উদ্ধার করার জন্য আমার পুত্র কম্পিউটারটিকে ঘাড়ে নিয়ে তার পরিচিত কম্পিউটার মেকানিক্সের কাছে গেল। ভাইরাস ক্লিন করতে গিয়ে আমার ড্রাইভের সব লেখাও মুছে দিয়েছে সেই হাতুড়ে ইঞ্জিনিয়ার। দীর্ঘদিনের স্বপ্নসাধনায় লালিত নিজের মানস-সন্তানের অকাল মৃত্যুতে এত কষ্ট পেয়েছিলাম যে চোখের জল লুকাতে পারিনি। তখনো কপি সংরক্ষণের জন্য পেনড্রাইভ ও গুগল ড্রাইভ ইত্যাদি সুবিধা উদ্ভাবিত কিংবা সহজলভ্য হয়নি। তারপরও পুত্র কম্পিউটারে এন্টিভাইরাস লোড করা ছাড়াও কপি সংরক্ষণের জন্য আলাদা একটি হার্ডড্রাইভ কিনে দিয়েছিল।
 
ব্যক্তিগত ক্ষতির এ ঘটনাকে তুচ্ছ করে গত দুই দশকে আইটি জগতের বিকাশ ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন নানা ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ডেস্কটপের বদলে নিজেও এখন ল্যাপটপে পুরনো কীবোর্ড লাগিয়ে লেখালিখি করি। করোনাকালে গৃহবন্দি হয়ে আপন বিচ্ছিন্নতা ঘোচাতে হাতের মোবাইল ফোনে গোটা বিশ্বকে নেড়েচেড়ে দেখি দিনমান।
 
গুগলে ভর করে ইন্টারনেটের অনন্ত জগতে পরিভ্রমণ এবং কাক্সিক্ষত কোনো কিছু নিমেষেই চোখের সামনে হাজির করাতে পারলে যে দারুণ মজা হয়, সেটা কদিন আগে আমাকে দশ বছরের নাতিটিও বুঝিয়ে দিয়েছে। কম্পিউটার গেমের নেশায় নাতি দাদুকে আর সময় দিতে পারে না আগের মতো। করোনার কারণে বৎসারাধিক কাল ধরে স্কুল এবং বাইরের উন্মুক্ত খেলাধূলা কিংবা বিনোদন-ভ্রমণ বন্ধ তাদের। ঘরে বসে গৃহবন্দী জীবন সহনীয় করে তুলতে, বড়দের স্মার্টফোন নিয়ে টানাটানি বন্ধ করার কৌশল হিসেবেও বটে, তাকে ডেস্কটপ কম্পিউটার ব্যবহার করতে দেয়া হয়েছে। ওয়াইফাই ইন্টারনেট যুক্ত সেই কম্পিউটারে সে ইউটিউবে কার্টুন আর কীসব গেম দেখে। কানে হেডফোন লাগিয়ে গানবাজনাও শোনে। গেম খেলার নেশায় নাওয়া-খাওয়ার কথাও ভুলে যায়। আর জ্ঞানী হওয়ার জন্য এ যুগে বই পড়াটা মোটেও বড় কাজ নয়। বরং গুগল সার্চই মোক্ষম অস্ত্র। গুগল সার্চ দিয়ে একদিন ইন্টারনেটের অসীম দুনিয়ায় চেনা দাদুর ছবি ও লেখক পরিচয় আবিষ্কার করে একই সঙ্গে খুশি ও খেদের সঙ্গে জানায় সে, গুগলে তুমিও আছো দাদু! আমি নেই কেন? আমার নাম সার্চ দিলে আমি আসছি না কেন?

নাতিকে আশ্বস্ত করি, বড় হলে ইন্টারনেটের দুনিয়ায় আমার চেয়েও তুমি আরো ভালো ভাবে থাকবে। কয়েক বছর পর গুগল ফেসবুকে নিজের ফ্রি একাউন্ট হবে তোমার। তোমার ছবি, জীবনের খুঁটিনাটি তথ্য, এমনকি তোমার শরীরে ভিতরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ, রক্ত চলাচল ও ব্রেনের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম খবরও ওরা জেনে যাবে। স্ক্রীনে তাকানো ও কীবোর্ডে আঙুল ছোঁয়ামাত্র তোমার পরিচয় এবং অবস্থান ওরা টের পাবে। বলার আগেই ওরা বুঝে যাবে তুমি কী খুঁজছো, কী তোমার মনের চাহিদা। চাহিদা পূরণে তৎক্ষণাৎ তোমার পছন্দের জিনিসের সন্ধান দেবে তারা। বড় হলে বন্ধুত্ব করার জন্য তোমার কাছে একটা রোবট রাজকন্যাও পাঠিয়ে দিতে পারে।

নাতি অবিশ্বাস করে না। বরং খুশি হয়ে মন্তব্য করে, গুগল তো এখনই আমার পছন্দ মতো অনেক গেম ইউটিউবে পাঠিয়ে দেয়। বড় হয়ে আমিও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হবো দাদু। ঘরে বসে বিলিয়ন ডলার আর বিটকয়েন হ্যাক করব। আর এমন একটা সুপারম্যান বানাব, তাাকে হুকুম দিলেই করোনা ভাইরাস-ফাইরাস আর দুনিয়ার সব খারাপ লোককে ফিনিশ করে দেবে।
ক্লাস থ্রিতে পড়া নাতির অস্বাভাবিক অ্যাম্বিশন কিংবা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ বিস্ময় সৃষ্টি করে না। বছর কয়েক আগে কে ভাবতে পেরেছিল এক করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বের এমন ওলট-পালট অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে? দুই যুগ আগে নিজে আইটি জগতে শরিক হয়েও বুঝতে পারিনি, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতারা অল্প সময়ে এমন বিশ্বসেরা ধনকুবের হবে। আইটি বিপ্লব এখন আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স যুগে উত্তীর্ণ হয়েছে। কৃষি থেকে শুরু করে কলকারখানায় উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে, রাস্তায় গাড়ি চালানো থেকে শুরু করে ঘরে-বাইরে মানুষকে নানারকম সেবা দানের ক্ষেত্রে মানুষের চেয়েও এআই বা রোবটই অধিক দক্ষতার সঙ্গে ক্লান্তিহীন কাজ করতে পারবে। তার মানে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বময় কোটি কোটি মানুষের কাজ থাকবে না। কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তখন? সামনের সোনালী সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের চেহারা কল্পনাও করতে পারি না।

আমাদের দেশে সরকার যেমন এখন বেকার গরীবদের নানারকম ভাতা দিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের টেক কোম্পানিগুলিও তেমনি ভাতা দিয়ে বেকার মানুষকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করবে? নাকি তাদের দায়মুক্তি দেয়ার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ কোটি কোটি মানুষকে সহসাই সংহারের দায়িত্ব নেবে? আবার এমনটা ঘটাও বিচিত্র নয় যে, প্রাকৃতিক করোনা ভাইরাসের মতো এমন আইটি ভাইরাস ওরা ছাড়বে যাতে মানবপ্রজাতি লুপ্ত না হোক, মানুষের অর্থ ও সংজ্ঞাই আমূল বদলে যাবে। নাতির প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে না পারার অক্ষমতাও মনে এরকম প্রশ্ন ও আতঙ্ক জাগায়। করোনা সংক্রমণের ভয়ে ঘরে বসে থাকি একা। ফেসবুকে বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা বন্ধুদের স্ট্যাটাস দেখি। কিন্তু তাতে নিজের নিঃসঙ্গতাবোধ কাটে না। বিশ বছর আগে ভাইরাস সংক্রমণে আমার লেখা ঢেঁকি-খড়ম যুগের ইতিকথা মুহূর্তেই হারিয়ে ফেলে যে কষ্ট পেয়েছিলাম, সেই কষ্টের স্মৃতি নতুন করে আরো অনেক অনেক মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলার আশঙ্কাটাই বড় করে তোলে কেন, ঠিক জানি না।