অমৃতকথা—৩

অমৃত চিন্তার ইতিহাসে পারস্য তথা ইরানের দর্শন সবচেয়ে প্রাচীন, এমন মনে করা হয়। যদিও তা তর্কসাপেক্ষ। খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ থেকে ১৮০০ সময়কালে পারস্যে জরথুস্ট্র বা জোরোস্টারের চিন্তা বিকাশ লাভ করে। তাঁর দর্শন বা প্রজ্ঞা জরথুস্ট্রবাদ নামক ধর্মের ভিত্তি হয়ে ওঠে। ইন্দো-ইরানীয় দর্শনের প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনিই। জরথুস্ট্র প্রথম চিন্তাবিদ যিনি দার্শনিক অবস্থান থেকে ‘অশুভ’ নামক সমস্যার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ধর্মের ইতিহাসে তিনি প্রাচীনতম একেশ্বরবাদীদের অন্যতম। তিনি শুভ চিন্তা (আন্দিসে-নিক), শুভ বাক (গোফতার-ই-নিক) এবং শুভ কর্ম (কেরদার-ই-নিক)-এর উপর ভিত্তি করে একটি নৈতিক দর্শনের জন্ম দেন, যা চিন্তার ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন।

জরথুস্ট্রের অমৃতচিন্তা গ্রীক দর্শন এবং রোমান দর্শনের উপর ভীষণ প্রভাব প্রস্তাব করেছিল। বেশ কিছু প্রাচীন গ্রীক লেখক জরথুস্ট্রীয় দর্শনকে দুনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজ বলে উল্লেখ করেছেন, যেমন সিনিডাসের ইউডক্সাস এবং ল্যাটিন লেখক যেমন প্লিনি দ্য এল্ডার। মহামতি প্লেটো ইউডক্সাসের মাধ্যমে জরথুস্ট্রীয় দর্শনের শিক্ষালাভ করেছিলেন এবং প্লেটোনিক বাস্তববাদের মধ্যে এটির বেশিরভাগ অংশকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। প্লেটো এতটাই জরাথ্রুস্ট্রের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন যে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে কোলোটেস নামক এক চিন্তাবিদ প্লেটোকে চুরির দায়ে অভিযুক্ত করেন। প্লেটোর বিখ্যাত ডায়ালগ ‘দ্য রিপাবলিক’ নাকি জোরোস্টারের ‘অন নেচার’-এর কিছু অংশ থেকে টুকলি করা, বিশেষত রিপাবলিকের ‘দ্য মিথ অফ এর’ নামক অংশটি।

এ হেন জরথুস্ট্র ছিলেন একজন ঋষি, বিশেষ করে পোস্ট-ক্লাসিক্যাল পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে তিনি ঐন্দ্রজালিক ও অলৌকিক মানুষ বলে পরিচিত ছিলেন। এমন একজন চিন্তাবিদকে ইউরোপ অবশ্য জেনেছে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে, তার আগে পর্যন্ত জরথুস্ট্র সম্পর্কে তাঁরা প্রায় কিছুই জানতে পারেনি। ভলতেয়ারের মতো আলোকিত চিন্তাবিদেরা জরথুস্ট্রবাদের উপর গবেষণা করেন, এই চিন্তাকে প্রচার করেছিলেন এই বিশ্বাসে যে এটি একটি যুক্তিবাদী ধর্মবাদ, খ্রিস্টধর্মের চেয়েও পছন্দের। মজার কথা, এই সে দিন মানে ২০০৫ সালে অক্সফোর্ড ডিকশনারি অব ফিলোসফি জরাথুস্ট্রকে দার্শনিকদের কালপঞ্জিতে প্রথম স্থান দেয়। মাজদা-ইয়াসনা নামে তিনি যে যুক্তিবাদী নীতিশাস্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মূলত তার কারণে জরথুস্ট্রের প্রভাব আজও চিন্তার ইতিহাসে স্থায়ী আসন লাভ করে আছে। মাজদা-ইয়াসনা শব্দটি আবেস্তান এবং ইংরেজিতে "Worship of Wisdom" হিসাবে অনুবাদ করা হয়েছে। এনসাইক্লোপিডিয়া ন্যাচারাল হিস্ট্রি (প্লিনি) দাবি করে যে জরথুস্ট্রবাদীরা গ্রীকদের শিক্ষিত করে তোলেন, যাঁরা পিথাগোরাস থেকে শুরু করে, চূড়ান্ত সত্যের অনুসন্ধান বর্ণনা করার জন্য একই ধরনের শব্দ, দর্শন বা ‘প্রজ্ঞার প্রতি প্রেম’ এই সব শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে শিখেছিল।

প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের সময়কালে চিন্তার ইতিহাস সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। এ কথা সর্বজনবিদিত যে স্টোইক চিন্তাধারার সৃষ্টিতে ফার্সি সংস্কৃতির প্রভাব ছিল। স্টোইকবাদ হল হেলেনীয় দর্শনের একটি সম্প্রদায় যা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর প্রথম দিকে এথেন্সে সিটিয়ামের জেনো দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি হল ব্যক্তিগত সদগুণের নীতিশাস্ত্র।

মানি নামক এক চিন্তাবিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ম্যানিকেইজম নামক চিন্তাধারা অতি প্রাচীনকালে পশ্চিমে উত্তর আফ্রিকা থেকে পূর্বে চীন পর্যন্ত প্রভাবশালী ছিল। হিপ্পোর সেন্ট অগাস্টিনের মাধ্যমে পাশ্চাত্য খ্রিস্টান চিন্তাধারায় এর প্রভাব এখনও সূক্ষ্মভাবে অব্যাহত রয়েছে। সেন্ট অগাস্টিন ম্যানিকেইজমকে খ্রিস্টচিন্তায় রূপান্তরিত করেছিলেন, তাঁর লেখাগুলি ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট এবং অর্থোডক্স ধর্মতত্ত্ববিদদের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাবশালী। ম্যানিকেইজমের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হল এর দ্বৈতবাদী বিশ্বতত্ত্ব/ধর্মতত্ত্ব, যাকে মাজদাক-বাদের সঙ্গে এক করে দেখা হয়। মাজদাক-বাদ হল মাজদাক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি দর্শন। মাজদাক ছিলেন একজন জরথুস্ট্রবাদী মোবাদ বা পুরোহিত, তিনি নিজেকে আহুরা মাজদার একজন নবী বলে দাবি করেছিলেন এবং সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচি চালু করেছিলেন। মাজদাক-বাদ তথা ম্যানিকেইজিমের দ্বৈতবাদের অধীনে মহাবিশ্বের দুটি মূল নীতি ছিল: আলো অর্থাৎ ভাল দিক এবং অন্ধকার অর্থাৎ মন্দ দিক। এই দুটি দিক একটি মহাজাগতিক দুর্ঘটনার দ্বারা মিশ্রিত হয়েছিল। এই জীবনে মানুষের ভূমিকা হল আলোর অন্তর্গত নিজের অংশগুলিকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ভাল আচরণ করা। মানি ভাল এবং খারাপের মিশ্রণকে মহাজাগতিক ট্র্যাজেডি হিসাবে দেখেছিলেন, কিন্তু মাজদাক এটিকে আরও নিরপেক্ষভাবে ব্যাখ্যা করেন যার মধ্যে আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী ছিল। 

অমৃতকথা—২