রাতে ঘুম হয়নি বলে ছেলে-মেয়ে দুটিকে স্বামীর সাথে স্কুলে পাঠিয়ে রুবি বেডরুমের দরজা বন্ধ করে একেবারে প্রতিজ্ঞা করে বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিয়েছে। রুবি ভেবেছিল, ছেলে-মেয়ে দুটিকে যখন সে আনতে যাবে, একেবারে তখনি বিছানা ছেড়ে উঠবে। রুমে ঢোকার আগে সে বাড়ির অন্যদের বলে দিয়েছে, তাকে যেন কেউ না ডাকে।
কিন্তু অভ্যাসবশত কিছুক্ষণের ভেতর সে হাতড়িয়ে টেনে এনে ফোনটা খুলে আধখোলা চোখের সামনে ধরতেই এমন একটা কাহিনি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, তাতে ক্রমে তার চোখ বড় হয়ে উঠতে লাগল। ইউটিউবার অদৃশ্যে থেকে চল্লিশের মতো বয়সি এক ব্যক্তিকে প্রশ্ন করে যাচ্ছিল, আর লোকটি সেসব প্রশ্নের উত্তর খুব ধীরেসুস্থে দিয়ে যাচ্ছিল। উদগ্র হয়ে পুরোটা শোনার পর দম ধরে থাকতে থাকতে রুবির দু-চোখের পাতা কখন লেগে গিয়েছিল।
এর ভেতর ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা হাতের ভেতরেই ছিল, তাই বেজে ওঠার সাথে সাথে তার ধড়ফড়ানি শুরু হয়। দ্রুত ফোন ওপেন করে শব্দ ঠেকাতে নাম না দেখেই রুবি কলটা ধরল। ওপাশে তার খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু অহনা খন্দকার তার ‘হ্যালো’ শব্দ শুনেই বলল, কি রে, তুমি এখনো ঘুমাচ্ছ? শরীর খারাপ করেনি তো?
—না, শরীর খারাপ করেনি, তবে রাতে ঘুম হয়নি, ভাবলাম সব কাজ ফেলে একটু ঘুমিয়ে শরীরটা ঠিক করে নিই। ঘুম না হলে আমার মাথা ঘোরে। কিন্তু হেঁয়ালি করে ফোনটা খুলতেই এমন একটা বিষয় চোখের সামনে এসে পড়ল...।
—কী?
—ইউটিউবে ইউটিউবারের সাথে একজনের কথোপকথন শুনে আমার চোখে অশ্রু নয়, বিশ্বাস করো, যেন কেউ জিকার আঠা ঢেলে দিয়েছিল। আর তাতেই চোখ বন্ধ রাখতে রাখতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম!
—সর্বনাশ, তাহলে কথা বলবে কী করে? আমি বরং পরে ফোন করি!
—আরে তুমি শুনবে না, ঘটনা কী?
—কিন্তু তোমার চোখের আঠাটা কাজে লাগুক, তুমি ঘুমোও। একটা সময় থেকে আমার তো রাতের পর রাত ঘুম হয় না, তাই কারো একরাতও ঘুম না হওয়ার জ্বালাটা আমি বুঝি!
—আজ অফিসে যাওনি কেন?
—দুপুরের পর যাব। তিন দিনের জন্য ট্যুরে গিয়েছিলাম। রাতে ফিরেছি। ঘরের কাজ করতে করতে পাগল হওয়া। চাকরি না করলে জানতামই না অফিসের কাজের থেকে ঘরের কাজ কষ্টে র। দিন চলে যায়, কাজ শেষ হয় না। তাই ভাবলাম, তুমি তো সুখের পায়রা, এর ভেতরেই তোমার সাথে একটু বাকুম বাকুম করি!
—তাহলে আমার দেখা ঘটনাটাই শোন তুমি। বিষয়টা এরকম, লোকটি মালয়েশিয়া নাকি ইন্দোনেশিয়া গিয়েছিল চাকরি করতে। সেখানে চাকরির সুবিধার জন্য এক মেয়েকে বিয়ে করেছিল।
—তুমি এইমাত্র দেখেছ, তাতেই দেশের নামই বলতে পারছ না, লোকটি কোথায় ছিল, তো গল্প বলবে কী করে?
—আরে, শুরুতে আমি কি আর জেনেছি গল্পটি এত বিদঘুটে! এখন তো তুমি লিংক চাইলেও দিতে পারব না!
—যা হোক, বল!
—একসময় লোকটি সে দেশ থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে দেশে চলে আসে। কিন্তু বিদেশি বউটিকে আর রেখে আসতে পারে না। সেও চলে আসে লোকটির সাথে।
—তারপর?
—বউটি এসে দেখে এদেশে লোকটির আরেকটি বউ আছে!
—সে বউ বেঁকে বসল, নাকি?
—সোজা-ব্যাঁকার প্রসঙ্গ ছিল না এ আলাপচারিতায়। লোকটি স্বীকারোক্তি দিচ্ছিল ইউটিউবারের কাছে।
—কীসের স্বীকারোক্তি?
—মানে বিদেশি বউটি আত্মহত্যা করেছে। বউটির আত্মহত্যায় তার মদত ছিল, সন্দহবশত লোকটিকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে একজনের সুনজর পড়ে, বিষয়টি আবার ইনভেস্টিগেশন হয়। আর তখনি প্রমাণিত হয়, সে বিষ জোগান দেয়নি। আত্মহত্যা করতে প্ররোচিতও করেনি। এতে সে জেল থেকে বাইরে আসার সুযোগ পায়। কিন্তু তার মামলা খারিজ হয়ে যায় না, সে সন্দেহের ভেতরেই থাকে। কারণ, বিদেশি বউ বিষ হাতের কাছে পেল কি করে! তাকে কেউ না কেউ তো তা জোগান দিয়ে রেখেছে। আর সেই ব্যক্তি ওই লোকটি নিজে কি না! এরপরও এই যে সে একজনের কৃপায় জেল থেকে বের হয়ে আসতে পারল, আর এই সময়ের ভেতরে সে আরো একটি বিয়ে করতে পারল কী করে, তুমি ভাবো! ও, তারওপর কথা আছে, লোকটির দেশে বউ ছিল, তা তো তোমাকে বলছি।
—হ্যাঁ!
—একটা ছেলেও আছে! ইউটিউবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার একটি বউ আছে, আরেকটি বউ আত্মহত্যা করল, যার কারণে আপনি এখনো আসামি হিসেবে গণ্য। এতসব কিছুর পরও আপনি আরেকটি বিয়ে করতে পারলেন কী করে?
—কী বলল লোকটি?
—লোকটি আমতা আমতা করে বলল, তার ছেলে প্রতিবন্ধী। যদি আরেকটা ভালো ছেলে হয়, সেই আশায়!
—হ্যাঁ, সে আশা সে করতেই পারে!
—আমি ভাবছি, আরেকটা ভাল ছেলে যে সে পয়দা করবে, পয়দার যন্ত্রটি ওর কার্যকর হলো কী করে? আমি তো এই ভেবেই ঝিম মেরে গেছি! মূলত এটাই বোঝাতে চাচ্ছি তোমাকে!
—কেন?
—আমার হাজবেন্ড বাসায় কোনো মেহমান এলেও সে মনে করে ওটা আমরা করলে ওরা টের পাবে। তাই একেবারে গুটিয়ে থাকে, যেন নড়েচড়েও শোয় না। এই যে এতখানে গিয়ে হোটেল-মোটেলে থাকি, তার গায়ে হাত দেওয়া যায় না! এমনিতে সে কিন্তু পারফেক্ট! আমার ধারণা ছিল জগতের সব পুরুষ আমার হাজবেন্ডের মতো!
—একজনকে দেখে তো তুমি সবাইকে একই রকম ভাবতে পারো না!
—এই অহনা, আমার সন্দেহ হচ্ছে তুমিও ওই ইউটিউবের নায়ক লোকটির মতো! তুমি পুরোটুকু শোন, লোকটির নিজের মুখে বলা, লোকটি সেদিন বড় বউয়ের ঘরে ঘুমোতে গেছে। মাঝরাতে মুতে ধরায় বাইরে এসেছে। মানে ঘটনাটা গ্রামের। তো কাঁচাবাড়িতে তো আর অ্যাটাচ বাথরুম থাকে না। লোকটি বাইরে এসে দেখে বিদেশি বউ বারান্দায় বসে আছে। তখন লোকটি বলল, তুই ইয়ানো ক্যা?
বিদেশি বউটি নাকি উত্তর দিয়েছিল, আমার ঘুম আসে না, কী করব?’ লোকটি মুত মাইনাস করে বড় বউয়ের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দেখল, বিদেশি বউ সিগারেট ধরাচ্ছে। তখন সে নাকি বলে গেছে, ‘যাও, বিত্রে গিয়া শুইয়া পড়। আর সিগ্রেট খাইও না!’ এরপর সকালে উঠে সে বউয়ের ঘরে ঢুকে দেখে বউটি বিষ খেয়ে মরে আছে!
—তারপর লোকটিকে জেলে নেয়?
—সরাসরি তো আর জেলে নেয় না! প্রথমে তো থানায় নেওয়া হয়। কিন্তু সে ওইটুকু সময়ের মধ্যে নিশ্চয় প্রমাণ করতে পারেনি যে সে বিষ এনে দেয়নি, বা তার নাগালে এনেও রাখেনি বা বউ আত্মহননের দিকে যায়, এর কোনোটাই সে করেনি! প্রমাণ স্থির না করতে পারাতে থানা থেকে কোর্টে চালান হওয়ার কথা।
—আমাদের দেশের আইনেরও যে দুর্গতি, লোকটির পক্ষ হয়ে কেউ লোকটির টাকাই ঢেলে হয়ত জেল থেকে বের করে এনেছে, যে বিষয়টি প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত আসামি জামিনে বাইরে থাক।
—তাও হতে পারে! আমি তাই তো ভাবছি, এরপর তার আরেকটা বিয়ের খায়েশ হয় কী করে, অন্তত মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত! আর দেখ, বিদেশি বউটি, যে কিছু না জেনে তারওপর ভরসা করে চলে এসেছে। লোকটি সেই মেয়েটিকে রাতে বাইরে বসা অবস্থায় রেখে বড় বউয়ের ঘরে হাজিরা দিতে গেল! অথচ সে মেয়েটি তারই বিরহে তড়পাচ্ছিল। এরপরের ঘটনা সকালে উঠে সে লোক বিদেশি বউকে মৃত্যু অবস্থায় দেখল। বেটার তো অনুতাপে খাক হয়ে যাওয়ার কথা! তা না, সে আরেকটা বিয়ে করে নিল!
—এবার তুমি ভাবো, আমরা স্বামী-স্ত্রী হয়ে যারা একই ছাদের নিচে-চার দেয়ালের ভেতর বসবাস করি, কারো কারো ভেতরের রূপ-সম্পর্ক আদতে এমনি, স্থানকালের ভেদ না মেনে অনেকের ওই সিদ্ধিই আসল কথা। তোমার মতো সুন্দর ঘেরাটোপ সবার নয়, তুমি যা ভেবে রেখেছ। আমার একটা কৌতুক মনে পড়ে গেল তোমার কাহিনি শুনে!
—বলে ফেল!
—হ্যাঁ, বলে ফেলি, শেষে তুমি সারাজীবন ধরে ভাববে, আমি পুরুষ মানুষদের সম্পর্কে এই ধারণা নিয়ে ঘুরে বেড়াই!
—আরে কৌতুক তো কৌতুকই, তাও যদি তোমার কৌতুক বিবমিষার মতো ওই অমানুষ লোকটার ভাবনা থেকে আমাকে বের করে আনতে পারে!
—এটা আমি ফেসবুক থেকে পেয়েছি, মন দিয়ে শোনো, একাকী বসবাস করা এক নারী পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিল, সে এমন এক পাত্র চায়, যে কখনো পালাবে না তাকে ছেড়ে। কখনো মারবে না, কেবল তাকে ভালোবাসবে আর আদর করবে নিয়মিত। পরদিন খুব সকালে বিজ্ঞাপনদাত্রীর দরজায় তীব্র খটখট শব্দ! ভেতর থেকে বিজ্ঞাপনদাত্রী বলল, কে?
দরজার ওপাশ থেকে উত্তর এলো, আমি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে এসেছি!’
দরজা খুলে বিজ্ঞাপনদাত্রীর চোখ তো ছানাবড়া!
—কেন?
—দরজায় অপেক্ষমাণ পুরুষটির হাত নেই, পা নেই। তার অবস্থা দেখে বিজ্ঞাপনদাত্রী নারীটি জিজ্ঞেস করল, তোমার তো পা নেই বিয়ে করবে কীভাবে?
পুরুষটি বলল, আপনি তো এটাই চেয়েছেন, যেন আপনাকে ছেড়ে না পালাতে পারি! তাই পা নেই তো পালাব কী করে?
নারী বলল, তোমার তো হাতও নেই!
পুরুষটি বলল, আপনি তো এটাও চাইছেন, কখনো যেন আপনাকে না মারি। তাই হাত নেই তো মারব কী করে!
নারী তখন হেসে বলল, হাত নেই, পা নেই, কিন্তু ওটা কী আছে? আমার তো তৃতীয় আরেকটি চাওয়াও আছে!
এবার লোকটি হেসে বলল, ওটা না থাকলে দরজায় নক করলাম কীভাবে?
এই গল্প তোমার বানানো? অহনাকে রুবি বলল।
—আরে ধুর, অত মেধা, অত সাহস আমার আছে নাকি?
—তাহলে বলছ, খালি মেধা থাকলেই এমন গল্প বানানো যায় না, সাহসও লাগে?
—আলবত! এর থেকে বিদঘুটে অবস্থা আমার দেখা আছে, আমি লেখক হলেও তো তা কোনোদিন লিখতে পারতাম না! আচ্ছা তুমি ঘুমাও, স্কুলে গেলে দেখা হবে! টিউলিপকে স্কুল থেকে তুলে তাকে সহ অফিসে একবার ঢুঁ মারব। যদিও আমার আজ অফিসে যাওয়ার কথা ছিল না!
একটা সময় পর্যন্ত অহনা অনেক কথা অনেককে আপন ভেবে বলে ফেলত নিজের ভার কমাতে। কিন্তু ক্রমে সে টের পেতে শুরু করল যাদের কাছে সে ভার কমাতে বেদনার কথা বলত, একটা পর্যায়ে এসে তারাই তার বেদনা বাড়িয়ে দিত। হয় তা তীর্যক মন্তব্য করে, না হলে হেয় চোখে দেখে। আরো পরে অহনা খেয়াল করেছে, গলদ সবারই কমবেশি আছে। কিন্তু যে যত চেপে যায়, সে তত অন্যের চোখে গ্রহণীয় হয়ে থাকে! আর সে গ্রহণযোগ্যতাকে বাড়িয়ে তুলতে তাদের কেউ কেউ আবার ফাঁপা বুলিও ঝাড়ে।
এরপর থেকে অহনা পুরোনো বন্ধুদের সাথে মেশা বন্ধ করে শুধু নয়, তাদেরকে এড়িয়ে নতুন কিছু বন্ধু জুটিয়েছে। রুবি তাদের একজন। যতদিন মেয়ে টিউলিপকে স্কুলে ভর্তি করেছে, রুবির সাথে পরিচয়ও ততদিনের। সে হিসেবে একেবারে নতুনও নয়। বিসিএস দিয়ে রুবির কলেজে চাকরি হয়েছিল। কিন্তু বিরাট সংসারের সমন্বয় রক্ষা করতে সে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়েছে। ওর হাজবেন্ড সহকারী সচিব হিসেবে আছে এক মন্ত্রণালয়ের অধীনে। রুবি অহনার চেয়ে বয়সে কবছরের বড়। কিন্তু কথা বলে সমবয়সীদের মতো। আর তা একটুও আরোপিত মনে হয় না, এটাই রুবির বড় গুণ। আরো গুণ, বনেদি পরিবারের একান্নবর্তী সংসারের সমন্বয় যেমন রক্ষা করে রাখে, তেমনি ছেলেমেয়ে দুটিকেও নিজে লেখাপড়া করায়। শ্বশুরের আমলের রংচটা বাড়িতে পুরনো-নতুন প্রজন্মের সবাইকে নিয়ে থেকেও তার আধুনিকতা রক্ষায় এতটুকু ঘাটতি হয় না। আর এসব কিছুতেই নাকি তার চাকুরির চেয়ে বেশি তৃপ্তি! রুবি বলে সংসারও একটি প্রতিষ্ঠান, তা যে চালাবে, প্রতিষ্ঠানটিও তার মাপে হবে। তাই সাংসারিক কাজকর্ম, তার জের-জেয়াদার হিসাব-নিকাশ, এগুলো ছোট করে দেখার নয়। পরিবারের দুজনের একসাথে ক্যারিয়ার রক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেছে পরবর্তী প্রজন্মের সবকয়টির ক্যারিয়ারে ধস নেমে গেছে!
রুবির মেয়ে আর অহনার মেয়ে একই স্কুলের একই ক্লাসে পড়ে। সেভেনে। আর রুবির ছেলেটি পড়ে নাইনে। স্কুল একই।
রুবির ফোনটা রেখে অহনা আনমনা হয়ে বারান্দায় বসে থাকে। ভাবতে থাকে, মানুষের জীবনে যৌনতার দিকটি সবসময় সবার নান্দনিক থাকে না। বা কারো হয়েও ওঠে না। যে কোনো খাদ্য ভালোবেসে খাওয়া আর পেট ভরাতে খাওয়ার যে ব্যবধান, অহনার নিজের কাছেও যৌনতা বিষয়টি তেমন। পেট ভরাতে যেমন খেতে হয়, যৌনতাও জীবনে তেমনি। তা সে নিজের ইচ্ছেয় হোক বা সঙ্গীর ইচ্ছেয় হোক।
কারো সাথে পরিচয় হলে একসময় যখন অহনা অনেক কথার মতো এটাও বলে ফেলত, ‘এটা আমার দ্বিতীয় বিয়ে...।’ আসল কথা খালেদ জোবায়েরের সাথে তার যে বয়সের ব্যবধান, এদিকটা লক্ষ করে যে কোনো কারো মনে ‘কিন্তু’ এর মতো একটা প্রশ্ন জাগতেই পারে। তাই ভেবে নিজের থেকে যেন তাদেরকে অগ্রিম সংকট থেকে রক্ষা করতে চাইত অহনা। তখনকার একদিন একজন সিনিয়র প্রতিবেশী নারী অহনার এমন কথায় ধমকে বলেছিলেন, তুমি এটা আমার কাছে বলতে গেলে কেন?
অহনা বলেছিল, মানে আপনি তো কখনো না কখনো জানবেন একই জায়গায় বসবাস করি যখন..., তাই বললাম!
—আমি জানলে আমার মতো জানব, কিন্তু তুমি বলে বেড়াবে কেন? তুমি যে জন্য আগের স্বামীকে ছেড়েছ, বা হতে পারে তিনি তোমাকে ছেড়েছেন, এটা না বলতে বলতে বিষয়টা মাথা থেকে বিস্মৃত হয়ে আসে। মিথ্যে হয়ে আসে এবং যত সে বিষয়টি মিথ্যে হয়ে আসবে, তত তোমার পরিত্রাণ ঘটবে সে বন্ধন থেকে! তুমি সে বন্ধনকে বোঝার মতো বয়ে বেড়াতে তো মুক্তি নাওনি!
—আসলে কেউ এভাবে বলেনি তো!
—কেউ জানলে তবে তো বলবে! আমাদের সবার শেখা হচ্ছে আশপাশের গড়পড়তা মানুষের থেকে। অন্যেরা যেটা করছে, সেটাই যেন ঠিক! আমিও সেটা করলে অন্যরা আর সমালোচনা করবে না! এই দু-পেয়ে জন্তুদেরই এই জন্য আমাদের বড় ভয়!
—কোনো বইতেও তো এমন অমৃতবাণী পাইনি মা গো, আপনি যা শেখালেন!
—বইটা লিখেছে কে, সেটাও তো একটা বিষয়। আর বইতে সব পেতে হবে কেন, তুমি বোঝো না, তুমি নিজের কথা নিজে বলে বেড়ালে, কেউ আর তোমাকে পরোয়া করে কথা বলবে না!
—কিন্তু তারা অন্য কারো কাছ থেকে জানলে?
—তারা অন্য কারো কাছ থেকে জানলে তাতে একটা কিন্তু থাকে। তারা তা অন্যভাবে জানলেও তোমাকে জিজ্ঞেস করতে আসবে না! আর শোনো, আমরা ঘর ভাঙা মেয়ে দেখলে লানত দিই। কিন্তু উল্টোটা হওয়া উচিত। ঘর ভাঙার সাহস যার আছে, সে যদি যথার্থ কারণে সম্পর্ক ভেঙে আসে, আসতে পারে, তাকে আমাদের অভিনন্দিত করা উচিত। আর পড়ে পড়ে যে মার খায়, তাকে অভিনন্দন জানানোর কী কারণ থাকতে পারে? পরিবর্তনের জোয়ারটা অনুভবে রাখবে। তাতে গা ভাসাতে বলি না! তবে ভাসাতে হলে ভাসাবে না, তাও নয়।
অহনা মাস্টার্স করেছে সোশিওলজিতে। এরপরও বিস্তর লেখাপড়া করেছে সে এ বিষয়ে। কিন্তু সামনের ফ্ল্যাটে বসবাস করা এবং তাদের আত্মীয় পরিচয়ে থাকলেও মূলত সারাক্ষণ গভর্নেসের কাজ করে চলা এক প্রৌঢ়া তার এতটুকু আলাপে যেন অনেক আলো জ্বেলে দিলেন অহনার মনে। অহনা প্রৌঢ়ার কথার উত্তর না দিয়ে তার মুখের ওপর দৃষ্টি প্রসারিত করে রাখে। আর প্রৌঢ়া পুরোনো কথার জের ধরে বলে যান, তোমার কাছে যদি পর্যাপ্ত টাকা থাকে, তাহলে তুমি তার ভেতর যা ইচ্ছে তাই কিনতে পারো। তেমনি তোমার নিজস্ব মতামত প্রয়োগ করতে হলে, যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে, তা তুমি তোমার ক্ষমতায় তা বাস্তবায়িত করতে পারো যদি, তাহলে কেন তুমি অন্যের একতরফা মত-সিদ্ধান্ত বয়ে বেড়াবে? বিয়ে ভাঙার বিষয়টিও সে-রকমই।
প্রৌঢ়া কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার বলেন, কিন্তু আমার নিজের কোনো ক্ষমতা নেই, অভিজ্ঞতা নেই, তারপরেও শ্বশুরবাড়ির সবাই ভালো ব্যবহার করলে আমরা নারীরা বর্তে যাই, ভাবি আমার অধিকার রক্ষা হচ্ছে! তার মানে তারা দুর্ব্যবহার করলেও কিছু করার ছিল না! আসল কথা আমাকে একটা অর্থকরী কিছু জানতে হবে। সংসার করাটা অত্যন্ত অর্থকরী কাজ। কিন্তু তারও একটা ব্যাকরণ আছে। ব্যাকরণমাফিকভাবে তা জানতে হবে, আসল জোরটা তখনি মনের ভেতরে সৃষ্টি হবে। সংসারের ভেতর বসে থাকলেই সংসার করা হয় না! সব ঠিকঠাকভাবে বোঝার পর তখন কেউ তোমাকে যেনতেন ভাবে অর্ডার করতেও দ্বিধাগ্রস্ত হবে। তারওপর আরেকটা কথা কি জানো?
একটা প্রসঙ্গের এত দিক, বেগবান জলে ক্ষুদ্র ডিঙ্গির মতো দোল ওঠে অহনার হৃৎপিণ্ডে। সে অবুঝের মতো পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘কী?’
—দুজন মানুষ ভালোবেসে হোক আর সম্বন্ধ করে হোক, বিয়ের পর যখন তারা একসাথে থাকতে শুরু করে, তখন যদি তারা প্রতিযোগিতা করে তর্কাতর্কি না করে, একজন আরেকজনকে কথায়-কাজে টেক্কা দিতে না চেয়ে, একে অন্যের রুচি, পছন্দ-অপছন্দের দাম দেয়ার প্রতিযোগিতাটা অব্যাহত রাখে, সেই সংসার থেকে কখনো আনন্দ ফুরোয় না। সে সংসার-সম্পর্ক কখনো পুরোনো হয় না এবং ছেলে-মেয়ে একটা সুন্দর শৈশব পায়। বড় হয়ে মা-বাবার ঘনানো প্রশান্তিই তারা তাদের জীবনভর বয়ে চলে। বাড়িয়ে চলে!
সেই একযুগ আগে মাতৃসম এক নারীর বুকে মুখ লুকিয়ে অহনার হু হু করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু আগেই নারীটি তাকে যে মন্ত্র কানে তুলে দিয়েছেন, সে সেই ক্ষণেই নিজের ধস রক্ষার পণ করে ফেলেছে। সে আর কাউকে বলবে না তার কোনো গ্লানির কথা! যত ক্ষয় তার জীবনে ঘটেছে, একটু একটু করে সে পূর্ণ করে নেয়ার চেষ্টায় প্রতিদিন ব্রতী হয়ে ওঠে!
কলেজ জীবন পর্যন্ত খুলনা শহরে বেড়ে ওঠা অহনা দেখেছে গ্রাম থেকে আসা মানুষগুলোর সাথে তাদের পরিবারের মানুষেরা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলছে। শিক্ষকতা বাবার পেশা হলেও তার ভেতরও কোনো আদর্শ খুঁজে পায়নি অহনা। ওর বাবা গড়পড়তা শিক্ষকদের একজন। মা রবীন্দ্রসংগীতের শৌখিন গায়িকা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি পঙক্তিতে যে আলো ঝরে, তার কোনো ছায়া তার ভেতর পড়া দূরে থাক, তারই দুর্বুদ্ধি ও পরশ্রীকাতরতার জের অহনার জীবনে পুরোই ঢুকে পড়েছিল। না হলে যে স্বপ্ন তার প্রাণে ঝর্ণার মতো উদ্দাম ছিল, সব তার অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো একজনের আস্তিনে জমা রাখতে হলো! যে মানুষটি পরিখাবেষ্টিত এক পোড়োবাড়ির মতো এককিত্বে নির্জন, কিন্তু অন্যদেরকেও তার কখনো দরকার হয় শুধু সামাজিক হয়ে উঠতে!
অহনার প্রথম বিয়ে যার সাথে হয়েছিল সে মেধাবী ছাত্র ছিল। ভালো সরকারি চাকরি করত। বাড়ির অবস্থাও খারাপ ছিল না। কিন্তু তার পরিবার বাস করত গ্রামে। তাই গ্রাম থেকে সাদামাটা স্বভাবের শ্বশুর-শাশুড়ি এলে অহনা যেমন তাদেরকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে কথা বলতে পারেনি, তেমনি ওর স্বামী তার কলেজ-ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া দুটি ভাইবোনকে তাদের লেখাপড়ার সুবিধার জন্য বাসায় রাখাতে অহনা সবসময় বিবাদের ছুঁতো খুঁজত। আর পুরো বিষয়টিতে অহনার থেকে অহনার মা-ই দূর থেকে মদত যোগাত! মা তাকে সবসময় বলত, তৌহিদ তার ভাইবোনদের জন্য সব খরচ করে ফেললে তোদের ভবিষ্যৎ কী হবে। মায়ের এই কথাই যেন অহনার মাথা ছাড়তে চাইত না! অহনার স্বামী পারভেজ অহনাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে, বলেছে, দেখো, এখন এরা আমার ওপর নির্ভর করে আছে বলে সারাজীবন থাকবে তা তো নয়! দেখবে বছর দুই তিনেক পরে এদেরকে খবর দিয়েও হয়ত আনতে পারবে না! যে যার মতো কর্মজীবনে ঢুকে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আর এদের যদি আমি দায়িত্ব না নিয়ে এড়িয়ে চলি, এরা এদের লক্ষ্যে পৌঁছুবে ঠিকই, কিন্তু মাতাপিতার বড় সন্তান হিসেবে আমি কী করলাম? এরা ভালো করতে না পারলে শেষে সারাজীবন এরা আমাকে অশ্রদ্ধা করবে! একটা গাছের পাশে আরো কটা গাছ থাকলে সে গাছগুলো ঝড়ঝাপটা থেকে বড় গাছটিকে রক্ষা করতে চেষ্টা করে, মানুষের জীবনে ভাইবোনের ভূমিকাও তেমনি। তাই বড় ভাই হিসেবে আমার ভাইবোনগুলোকে টেনে তোলাও আমার দায়িত্ব। আমার সাথে থেকে এটাকে তুমিও তোমার অংশগ্রহণ ভাবতে পার!
কিন্তু কে শোনে কার কথা! বিবাদ চরমে উঠলে একদিন অহনা তার মা-বাবাকে বলে পারভেজ আমার গায়ে হাত তুলেছে!’ অহনার মা-বাবা ঢাকা এসে জামাইয়ের কাছে কোনো কথা জানতে না চেয়ে মেয়ে অহনাকে দিয়ে জামাইকে ডিভোর্স করিয়ে নিজেদের কাছে নিয়ে গেল। দু-বছরের সংসারের সমাপ্তি টেনে আশৈশবের বাড়ি পৌঁছে অহনা টের পেল তার স্বামীর দুটি ভাইবোন বাড়তি রাখা ছোট বাসাটির থেকে তাদের খোলামেলা বড় বাড়িটি তার জন্য এখন যাকে বলে দোজখ! কদিন না যেতে নিজের মা-ই তাকে উঠতে বসতে খোটা দিচ্ছে স্বামীর সাথে মানিয়ে চলতে না পারার জন্য এবং আবারো একটা বিয়ে দিলে অবস্থা যে এমনই হবে, এমন সব কথা শুনতে শুনতে অহনা বাড়িতে টিকতে পারত না।
অহনা বিয়ের আগে থেকেই চাকরি খুঁজছিল এবং বিভিন্ন স্থানে ছুটোছুটি করে ইন্টারভিউও দিয়ে আসছিল, কিন্তু যা হতো, তা তার পছন্দ হত না। কিন্তু পরে সে মরিয়া হয়ে ওঠে যে কোনো একটি চাকরির জন্য। চাকরি খোঁজায় যেমন নিজেকে ব্যস্ত রাখত, তেমনি বাড়িতে না থাকার জন্য প্রফেসর বাবার এক ছাত্র তার ও তার ইমিডিয়েট বড় একমাত্র ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল তাদের প্রতিবেশী। বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সহযোগী ব্যবসায়ী সেই প্রতিবেশী বন্ধুর সাথে লুকিয়ে প্রতিদিন অহনা এদিক-সেদিক বেড়াতে বের হত। তারপর দুচারদিনের ভেতর সে বন্ধুর সাথে তার দৈহিক সম্পর্কও হতে শুরু করল। সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার সেটাই হয়ে উঠল অহনার উত্তাল নেশা।
প্রেমান্ধ অবস্থায় খোলা বসনে বিছানায় শোয়া অহনা একদিন তৌহিদকে বলল, তোর সাথে এই প্রেমটা আগে হলে পারভেজের সাথে বিয়ের নামে দুর্ঘটনায় জড়াতে হত না! তোকেই বিয়ে করতাম, এখন তো তোরও বউ-বাচ্চা আছে!
দিগম্বর তৌহিদ অহনার দু-পা দুদিকে ধরে রাখা অবস্থায় সাফ সাফ বলে ফেলল, ‘দেখ, তোকে আমি বিয়ে করলেও তোর এই দশাই হতো। এখন আমার সাথে শুচ্ছিস্, তখন আমাকে ছেড়ে গিয়ে অন্য কারো সাথে এসব ঘটাতি...। হতে পারত, তখন সেটা পারভেজের সাথে ঘটত, মানে যাকে ডিভোর্স দিয়ে এলি!’
অহনার এমন একটা আবেগঘন কথার তৌহিদের এমন চাঁছাছোলা উত্তরে অহনা দুহাতে তৌহিদের বুক ঠেলে সরিয়ে রেখে বলল, কেন? তোর সাথে বিয়ে হলেও আমার এই দশা কেন হত? তোর থেকে আমি কম কিসে? তুই রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করেছিস, আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে...। তোর বাপ...।
–দেখ, যা-ই বলিস, বিয়ে খালি মানুষ এই এক কাজ করতে করে না! স্ট্যাটাস বাড়াতে তো নয়ই! সুখে-দুঃখে, একজন আরেকজনের আবেগের মূল্য দিয়ে জীবনের অংশ হয়ে উঠতে হয়। আমি আবারও বলছি, আমি যদি টের পাই, আমার বউ আমার মা-বাবাকে অশ্রদ্ধা করে, আমার ভাইবোনকে ভালোবাসে না, তখন মনে কর, নিজেকে ক্লান্ত না করলে আমার যখন ঘুম আসবে না, তখন হয়ত আমি আমার বীর্যপাত ঘটাতে তোর সাথে যা করছি, তার সাথেও তাই করব! অনন্যোপায় হয়ে যেমন মানুষ বালিশও ছিদ্র করে ফেলে। তাতে কিন্তু কোনো ভালোবাসা থাকবে না, আর অন্যের শ্রদ্ধাটা অবশ্যই যার যার নিজের অর্জনের বিষয়। ওটুকু ছাড়া সব ফাঁপা!
তৌহিদের মুখ থেকে এসব কথা শোনার পর অহনার মুখ থেকে কথা বেরোয় না। সে ভাবতে থাকে এই ছেলে ছাত্রাবস্থায় যখন তখন আমাদের বাসায় গিয়ে আব্বার থেকে পড়া বুঝে আসত, আর আমাদের সাথে ভাব জমাতে মুখিয়ে থাকত। সেই সূত্রে কখনো ভাইয়ার সাথে কখনো আমার সাথে লুডু-দাবা-কেরাম খেলতে পারলে বর্তে যেত। সম্পর্কের পাল্লাটা আজও সেভাবে নিজেদের দিকেই ঝুঁকে আছে বলে অহনার বিশ্বাস ছিল। কিন্তু আজ সেই ছেলে এ কি শোনাল! তৌহিদ আবারও বলল, এই দেশ আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া হয়ে যায়নি, যে একটি শিশু জন্মালেই তার মা-বাবার অ্যাকাউন্টে মোটা অঙ্কের টাকা সরকার জমা করে দেবে। বাচ্চা পালতে কষ্ট হলে সরকার সাহায্য করবে। তারপর সে লেখাপড়া শেষ করে চাকরি না পেলে সরকার বেকার ভাতা দেবে! মানুষ অসুস্থ হলে বিনামূল্যে চিকিৎসা পাবে! বৃদ্ধ হলে ভাতা পাবে! অতএব আমাদের দেশে, আমাদের কালচার সন্তান জন্ম দিয়ে তাকে পোষা মা-বাবার একধরনের বিনিয়োগ! তারা নিজেদের বঞ্চিত করে জীবনের সব রসদ সন্তানের জন্য খরচ করে। ঘর-আঙিনা ছাড়া তারা দুটো টাকা খরচ করে কোথাও বেড়াতে গিয়েও নিজেরা বিনোদিত হয় না। সন্তানের মুখের মায়াতেই তারা আবিষ্ট হয়ে থাকে। তাই তারা বিয়ে দিয়েও সন্তানকে পাখির মতো উড়িয়ে দিতে পারে না এবং সুসন্তান নিজেও তাদের ছেড়ে যেতে পারে না!
তৌহিদ তখনো অহনার ওপরে ভর দিয়ে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ছিল। সে অহনার ভেজা বারুদের মতো দৃষ্টি দেখে বলল, কী করতে দিবি নাকি নেমে যাব?
অহনার মনে হচ্ছিল সে তৌহিদকে লাথি মেরে ছিটকে ফেলে দেয়! তবু সে বলল, এই দরকারটা কি শুধু আমার একার ছিল?
—দেখ, প্রতিদিনই মোটর সাইকেলে করে তোকে নিয়ে শহরের ইতিউতি ঘুরতে ঘুরতে বোর হচ্ছিলাম। একদিন বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে এসে তাকে না পেলেও একটা চাবি আমার কাছে থাকায় বিশ্রামের জন্য ঢুকে পড়েছিলাম। তারপর আমি কিন্তু তোকে জোর করিনি! বরং তরই মদত ছিল এসব করতে। আমি কিন্তু তকে বন্ধুই ভাবতাম।
—এখন ভাবিস না!
—নয় কেন? যদি কিছু গিয়েই থাকে, দুজনের সমান গেছে আমি তাই মনে করি! এই ঘটনা বাইরে জানাজানি হলে তোর কলঙ্ক হবে, আর আমাকে মানুষ ফুল-চন্দন দেবে?’ বলতে বলতে তৌহিদ অহনার অনুমতি ছাড়াই উঠে শার্ট-প্যান্ট পরে ফেলল। অহনা তখনো নিচে পড়ে থাকা তার সালোয়ার-কামিজের দিকে হাত বাড়ায়নি। শোয়া অবস্থায় পাতলা চাদরে শরীর ঢেকে রেখেছে। তৌহিদ পাশের ঘরে গিয়ে অহনাকে সুযোগ করে দিয়েছিল আবৃত হওয়ার!
সেদিন অহনা তৌহিদের মোটরসাইকেলে না চড়ে নিজেই একটা ট্যাক্সি ডেকে বাসায় ফিরছিল। এরপর থেকে সে কোথাও যেত না বটে কিন্তু ঘুমের বড়ির পরিমাণ বাড়িয়ে দিনভর ঘুমিয়ে থাকার চেষ্টা করত। আর তার পুরনো পরিচিতদেরকে নিজেই ফোনে ফিসফিসিয়ে বলতো তার জন্য পাত্র দেখতে। এর ভেতর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ইমেইল আসে। তার চাকরি হয়েছে। যার ইন্টারভিউ অনেক আগে দেওয়া ছিল।
জয়েন করতে হবে ঢাকাতে। বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে অহনা ঢাকায় চলে আসে। পরে মা ফোন করলে সে ধরেনি। বাবা ফোন করলে মেসেজ করে জানিয়ে দিয়েছে তার চাকরি হয়েছে এবং সে ঢাকায় চলে আসছে। ঢাকাতেই থাকতে হবে।
অহনা ভেবেছিল এবার তার বিয়ে আটকাবে না, বরং অনেক ভালো পাত্র তার পাণিপ্রার্থী হবে। কিন্তু পারভেজের স্ট্যাটাসের দূরে থাক, তার থেকে নিচের লেভেলেরও কাউকে পায়নি সে। তার এবার ভালো একটা চাকরি হওয়া সত্ত্বেও ডিভোর্স তকমার আড়ালে তা ঢাকা পড়ে গেছে। আর তার জন্য তার মাঝে মাঝে তার মনে হয়েছে, আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে একাই তো থাকতে পারি!
একদিকে ঘুমের বড়ি আরেকদিকে বয়সের আঁচড় এবং মায়ের নিষ্ঠুরতা মনে পড়ে তার ওপর আবার তৌহিদের সেদিনের অমন তাচ্ছিল্য, সব একহয়ে যেন তার মেরদণ্ডের ভেতর ঘুণ হয়ে ঢুকেছিল। সে তাই প্রবলভাবে প্রার্থনা করছিল ঝড় হয়ে কেউ তার জীবনের আসুক, জীর্ণ পাতার মতো উড়িয়ে নিয়ে যাক তার সব সংকট-গ্লানি!
এক দুপুরে অহনার স্কুল জীবনের বান্ধবী ইসমত অহনাকে ফোন করে বলল, তুই তো পাত্র খোঁজার কথা বলেছিলি। একজনকে পাওয়া গেছে, আমাদের বাসায় আমার ভাশুরের সাথে এসেছে, তুই কি আসবি? তাহলে তাদেরকে কিছুক্ষণ থাকতে বলি!
—এই অসময়ে আসব? আরো তিন ঘণ্টা বাকি অফিস টাইম শেষ হতে!
—আচ্ছা, তুই আসবি বললে আমি ওনাকে বলি সে পর্যন্ত থাকতে!
—এই, তুই আমার জন্য কোনো পানিতে পড়া মানুষ ধরে আনিসনি তো?
—পানিতে না পড়লে উদ্ধার হতে আসবে কেন, বল?
—মানে চাকরি-টাকরি আছে তো?
—চাকরি-ফ্ল্যাট, ব্যাংক ব্যালান্স সব আছে। বউও ছিল, চলে গেছে!
—তা মরে চলে গেছে, না ছেড়ে চলে গেছে?
—তোর জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়ে গেছে! ফাজিল মেয়ে, সবকথা আমার থেকে শুনলে তার সাথে কী কথা বলবি? চলে আয়, আমি তাদের আটকাই!
পারিবারিকভাবেই হাত খুলে খরচের অভ্যাস নেই অহনার। তবু সে সেদিন ইসমতের বাসায় যেতে এক অভিজাত রেস্তোরাঁ থেকে অনেক রকমের খাবার কিনল। ইসমতের বাসা শ্যামলীতে। সন্ধ্যার ভারী নাস্তা থেকে রাতের টেবিল ভেসে থাকল অহনার আনা খাবারে! প্যাকেট খুলতে খুলতে ইসমত বলছিল, ‘তুই এত খাবার এনেছিস কেন? লোকটা যদি টের পায় এই খাবার তুই এনেছিস, তাহলে ভাববে তোর খুব গরজ! মেয়েদের গরজ দেখলে পুরুষ মানুষ মনে করে যা পাওয়ার পেয়ে গেছি, তখন আরো ভালোর দিকে নজর ছোটে তাদের, তাই ধীরে আগাও বন্ধু, ধীরে..!’
অহনা হতাশ কণ্ঠে বলল, তাই নাকি? তা তর মনে হল কেন আমি তর মেহমানের জন্যই এগুলো এনেছি?
—তাই না তো কী?
—এই বুদ্ধি নিয়ে তুই আগে কোথায় ছিলিরে?
—এই শোন, আমি ডাল বেটে পেঁয়াজু করেছি, সেগুলোই কিছু দিয়েছি, কিছু এখনো আছে, সেটাই এখন আবার চায়ের সাথে দেব আর এখান থেকে ছিটেফোঁটা কিছু দেব।
—দুপুরে কী খাইয়েছিস?
—বাব্বা, দরদ উথলাচ্ছে! দুপুরে উনি খেয়ে এসেছেন। আমার বড় ভাশুরের বন্ধু উনি। দুজন এক সাথেই এসেছেন।
—এম্মা, অনেক বয়স?
—তা একটু!
—তোর ভাশুর কই? তোর ভাশুর জানল কেমনে যে আমার জামাইয়ের দরকার?
—ভাশুরের একটা কাজ ছিল তার এই ছোট ভাইয়ের কাছে। এখান থেকে ওনাকে নিয়ে ভাশুরের পছন্দের এক পাত্রী দেখতে যাবেন, তা আবার কথাচ্ছলে বলে ফেলেছেন। আমি ভাশুরকে ভেতরে ডেকে নিয়ে আমার সাথে কলেজে তোলা তোর ছবি দেখিয়ে ভুলিয়েছি। পরে ভাশুর তোর ছবি ওনাকে দেখিয়ে, আমাকে দিয়ে তোর পারিবারিক অবস্থান বর্ণনা করিয়ে বুঝিয়েছেন, যেখানে যাচ্ছি, তার থেকে এটা ভালো হবে!
—বাবা, অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করেছিস। তবে আমার চাকরিটিও কিন্তু ভালো!
—তাও বলেছি বাবা, নাহলে এমনিই কি আর ঘাড় গুঁজে বসে আছে!
অফিস থেকে কিছুটা পরিপাটি হয়েই এসেছিল অহনা। আর পোশাক-আশাক সে বরাবরই দামি পরে। তাই ইসমতকে আর বলতে হল না মুখটা ঘষামাজা করে নেওয়ার। কারণ তাও অহনা করে এসেছে।
চাকরিজীবী স্বামী-স্ত্রী দুজনের রোজগার একত্র করেও ইসমত এবং মনোয়ারের সংসারকে মধ্যবিত্তের সংসার বলা যায় না। তাই নিম্নবিত্তের ড্রয়িং কাম ডাইনিংয়ের স্বল্প পরিসরে ওদের সবার সাথে সবার যে ঘন আলোচনা হলো, এর ভেতর যার যা জানার বিষয় ছিল সবই প্রকাশিত হয়ে পড়ল। খালেদ জোবায়েরের অমতের কোনো কারণ নেই, তবে একটা শর্ত তিনি বয়ে নিয়ে বেড়ান। যদিও এখনো তিনি তা এখানে প্রকাশ করেননি। এমনকি অহনাকে তার পছন্দ হয়েছে, তাও চেপে রেখেছেন!
আর অহনা হিসেব করছে, লোকটি তার থেকে বছর বারোর মতো বড়। চেহারা বলতে কিচ্ছু নেই। তবে লোকটি মুগ্ধতা সৃষ্টি করে রাখতে পারেন ওই কী আছে কী নেই হিসেবের ভেতর আটকে রেখে। তার অবস্থানও ভাল। অতিমাত্রায় সুন্দর করে কথাও বলেন। এটুকু সময়ের ভেতর যা জেনেছে, যা দেখেছে এটাই যদি মুখোশ না হয়ে স্বাভাবিক অবস্থা হয়, তাহলে রাজি হওয়া যেতে পারে! কারণ চাকরির তিনমাস গড়াতে চললেও একটা প্রস্তাবও আসেনি তার বিয়ের জন্য, যদিও তার নিজের জানাশোনার গণ্ডিও মোটেও ছোট নয়। আর সেই যে তৌহিদের সাথে মিলনের ব্যর্থ ক্ষণ, কাউকে পেলেই সে নিজেকে কানায় কানায় পূর্ণ করে নেবে, যে বাসনাতে সে তৌহিদের কাছে বলি হয়েছে বারবার!
ঘড়ির কাঁটা রাত দশটা পার করে ফেলেছে। ইসমতের ভাশুর বলে উঠলেন, তোমাদের ঘর ভেসে আছে খাবারের তীব্র ঘ্রাণে। না খেয়ে তো যাওয়া যাবে না। “আমাদেরকে খাইয়ে-দাইয়ে বিদায় করে দাও। আমরা প্রয়োজনে আরেক সিটিংয়ে কাছাকাছি সময়ে আরো একদিন এসে কথা বলব।” ভাশুরের কথায় ইসমত তার স্বামীকে টেবিলে প্লেট সাজাতে বলে নিজে চলে গেল কিচেনে। ইসমতের সাথে সাথে অহনা গিয়ে বলল, “শোন, আমি খাব না। আমি আজ যাই...। রাত হচ্ছে!” খালেদ জোবায়ের বলে উঠলেন, “অহনা ম্যাডাম, আমি একটা কথা বলি, আগামীকাল অফিস ছুটি। আপনি বরং থেকে যান। আর যেতে চাইলে আমার গাড়ি আছে, যেখানে যেতে চান ড্রপ করে যাব।”
ইসমত ধেই ধেই করে বলতে লাগল, “এই অহনা, ভাইয়া ঠিকই বলেছেন। তুই থেকে যা। আমরা সারারাত গল্প করব। মনোয়ার বাচ্চাদের কাছে থাকবে।”
ইসমতের ভাশুরের মনে হলো, বন্ধু খালেদ জোবায়েরের অহনাকে পছন্দ হয়েছে। তিনি মুখ ফসকে বলে ফেললেন, “হ্যাঁ, অহনা থেকে যাও। প্রয়োজনে আমরা কালই কাজী নিয়ে চলে আসব। নাহলে কোথায় আগারগাঁওয়ে তোমার বাসা খুঁজতে যাব!”
খালেদ জোবায়ের বন্ধুর হালকা কথার তেমনি হালকা চালে উত্তর দিলেন, “অহনার আপত্তি না থাকলে আগামীকাল কেন? আজই কাজী ডাকতে পারেন!”
ইসমতের ভাশুর বলে উঠলেন, “এই মনোয়ার, তুই প্লেট সাজানো রাখ। যা, কাজী আনতে যা! এটা সাকসেস হলে এটা হবে আমার দ্বারা সংঘটিত তেরতম বিয়ে। যাকে বলে আনলাকি থার্টিন! আর এজন্যই শঙ্কায় আছি!”
মনোয়ার বলল, “আমি এতরাতে কাজী কোথায় পাব? আর কোথায় খুঁজব, তাও তো জানি না!”
ইসমত সবাইকে তাদের উচ্ছ্বাস থেকে নিবৃত্ত করে ধীরে ধীরে বলল, অহনাকে জিজ্ঞেস করো, ও রাজি কিনা?
—অহনা লাজুক নাকি অপারগ হাসি হেসে বলেছিল, আমি কি বলব? তোরা যা ভালো বুঝিস!
অত রাতে কাজী পাওয়া যায়নি। পরে মনোয়ার বুদ্ধি করে মসজিদে যায় হুজুর খুঁজতে। কিন্তু এসে বলে, এখন কি আর সেইদিন আছে যে মসজিদের হুজুর মসজিদ ঘেঁষা কোনো একটু কোনায়-কানায় কারো তোলা ডেরায় পড়ে থাকবেন! এখন তারাও আধুনিক ফ্ল্যাটে থাকেন। মোবাইলের ইউটিউবে বা টেলিভিশনের পর্দায় মোক্ষম বিষয়গুলো রসিয়ে রসিয়ে দেখবেন, ওয়াজের কলেবর বাড়াতে সেভাবে অভিনয় করে দেখাবেন! তাই এই যে খাদেমকে ধরে নিয়ে এলাম!
ইসমতের ভাশুর আনোয়ার সাহেব বললেন, তা বিয়ে পড়াতে পারবে তো?
খাদেম বলল, পড়াই তো! বস্তি-টস্তিতে তো আর হুজুর যায় না...!
আনোয়ার সাহেব তার ছোটভাই মনোয়ারকে বললেন, “যা তো, তর ক-জন প্রতিবেশী ডেকে নিয়ে আয়। তাহলে হুজুর জোগাড় না করার ঘাটতি পুষিয়ে যাবে।”
মনোয়ার বের হতে হতে খালেদ জোবায়ের বললেন, “আমি একটু বাইরে থেকে আসছি!” বলেই কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে গেলেন। অহনা মনে মনে ভাবল, তার যা দুর্ভাগ্য লোকটি ভাগল কিনা! কিন্তু খালেদ জোবায়ের খুব বেশিক্ষণ ঘরের মানুষদের উদ্বেগে রাখেননি। তিনি হাতখোলা মানুষ। এই বাসায় ঢুকতে মোড়ে মিষ্টির দোকান দেখেছিলেন। সেখান থেকে কেজি দশেক মিষ্টি নিজেই বয়ে নিয়ে এলেন।
বিয়ে পড়ানোর পর খাওয়া-দাওয়া শেষে কে কার বাসায় যাবেন, অহনা খালেদ জোবায়েরের বসুন্ধরার বাসায় নাকি খালেদ জোবায়ের অহনার আগারগাঁওয়ের বাসায়? রাতের খাবার খেয়েদেয়ে দুজনেই দুজনের বাসায় যেতে রাজি। কিন্তু ইসমত তার ভাশুর আনোয়ার সাহেবকে ডেকে বলল, আপনারা সবাই চলে যান, অহনা আজ রাতে থাকবে আমার বাসায়! কাল আপনারা কাজী নিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করে তবে এখান থেকে ওকে নিয়ে যাবেন! তারপর আপনারা চাইলে আপনাদের ইচ্ছে মতো একটা অনুষ্ঠান করবেন।
এমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটা সহজ বিষয়টাকে ইসমত জটিল করে তোলায় আনোয়ার সাহেব ও খালেদ জোবায়ের আমতা আমতা করে বেরিয়ে গেলেন! ইসমত কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ভাশুরকে ডেকে ফিরিয়ে বলে দিল দশলাখ টাকার কাবিন দিতে হবে কিন্তু!
আনোয়ার সাহেব বললেন, ফোনে জানাব।
মেহমান বিদায় করে ইসমত ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করতেই অহনা তাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে শুরু করল। এতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল ইসমত ও তার স্বামী মনোয়ার। মনোয়ার বলল, আমরা ভুল কিছু করলাম কি অহনা...?
অহনার কান্নার বেগ এত তীব্র ছিল, সে কান্না থামিয়ে কোনো উত্তর তখনি সে দিতে পারল না। পরে যখন ইসমত তাতে টেনে নিজের রুমে নিয়ে গেল, তখন সে ধীরে ধীরে বলতে লাগল, আমার জীবনে সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি আমার মা। আমার আজকের এই অবস্থার জন্য আমার মা দায়ী। আমাকে মা ডিভোর্স করিয়ে সপ্তাহ না যেতে তার কথার ঘায়ে আমি ঘরে থাকতে পারতাম না! কিন্তু তুই আমার থেকে বয়সে ছোটই হবি, তারপরও আমার নিরাপত্তার কথা ভেবে তুই আমাকে আটকে রাখলি লোকটির সাথে যেতে না দিয়ে! দেখ ইসমত, আমার বোধহয় ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা নেই। নাহলে আমার নিজেরই তো আপত্তি করা উচিত ছিল, অন্তত আজকে এভাবে শেওলার মতো ভেসে যেতে! তর কণ্ঠের তেজ আমাকে অভিভূত করেছে। আমি আজকে তর যে মাতৃরূপ দেখলাম, এই বিয়ে যদি মিথ্যেও হয়ে যায়, আমার কোনো দুঃখ থাকবে না! আমি অনেক কিছু হারিয়ে মনে হচ্ছে, ইসমত আমি তকে পেলাম!
—শোন অহনা, তর বাবা কলেজের প্রফেসর ছিলেন, আমার বাবা স্কুলের মাস্টার। আমরা একই এলাকায় বেড়ে উঠেছি বটে, একসাথে খেলাধুলাও করেছি ঠিকই, কিন্তু স্ট্যাটাসের বৈষম্য নিয়েই কিন্তু আমরা বড় হয়েছি। তরা কখনো আমাদের সাথে মনের বৈষম্য দূর করে মিশিসনি। তবু দেখ, আমি পসার জমাতে না পারলেও, ল পাস তো করেছি! তাই আমাকে দিয়ে তোর কোনো ক্ষতি হোক পেশাগতভাবেই তা আমি চাইব না! আর নারীর সর্বজনীন কল্যাণীয় রূপটিই সবাই দেখতে ভালোবাসে, যা সবার জন্য সমানভাবে ফুটিয়ে তুলতে নারীই পারে! আমি তর জন্য আলাদা কিছু করিনি রে!
—যাক, এক উছিলায় একটা রাত তর সাথে আমার থাকা হলো। ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ছে রে!’ অহনা-ইসমত কথা বলতে বলতে ইসমতের ফোন বেজে ওঠে। আনোয়ার সাহেব ফোন করেছেন, বললেন, খালেদ জোবায়ের দশ লাখ টাকার কাবিন দেবেন না, একলাখ টাকার কাবিন দেবেন।
বিয়েটা রেজিস্ট্রি হওয়াই বড় কথা। সেটা অহনা বোঝে। কিন্তু কথাটা যখন উঠেই গেছে, আর লোকটির কার্পণ্য দেখে অহনা অবদমিত হয়ে গেল। সে হেসে বলল, প্রতিদিন জীবনের দাম বাড়ে না কমে রে?
—কেন, বল শুনি?
—পারভেজের সাথে যখন আমার বিয়ে হয়, মাত্র মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছি। রেজাল্টও বের হয়নি। তাই বিশ লাখ টাকা বরপক্ষই ধারণ করেছিল। আব্বা বলেছিলেন, ত্রিশ লাখ।
—এখন কি করবি? বয়স্ক লোক, তাকে তো পেশারও দেওয়া যাবে না! যা বলেছেন, ভেবেচিন্তেই বলেছেন!
—অথচ দেখ, লোকটার আচরণ ছিল কিন্তু ঔদার্যে পূর্ণ, ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা! বিয়ে পড়ানোর জন্য খাদেমকে পাঁচশো টাকা দিলেই হত, সেখানে পাঁচহাজার টাকা দিয়ে দিয়েছেন!
—লোকটির বউ যদি চলে গিয়ে থাকে তাহলে তো এমনিই যায়নি! তাতে নিশ্চয় গচ্ছাও গেছে। তাই বোধহয় লোকটি আর হুমকিতে পড়তে চাইছে না!
—তাহলে বিয়ে করে আবার খাল কেটে কুমির ঢোকানোর আয়োজন করছেন কেন?
—বউ না থাকলে মানুষ অসামাজিক হয়ে পড়ে তা জানিস তো! একে বউ না থাকা একটা ডিসক্রেডিট। আবার বউ না থাকলে কোনো অনুষ্ঠানে গিয়েও সর্বস্তরে মেশা যায় না, আসলে এই ছোট ছোট বাঁধাগুলো একসময় মানুষের কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে। আর তখনি নেমে পড়ে আবার পাত্রী খুঁজতে! আবার সেই মেয়েমানুষ! যার আত্মা আছে কিনা তা নিয়েও একসময় সন্দেহ পোষণ করা হতো!
—আর এখন বিজ্ঞান বলছে নারীর এক দেহে দুই আত্মা!
—তাই নাকি? সেটা কেমন করে হয় বল তো?
—নারীর দেহে দুটি আলাদা ইমিউন সিস্টেম। মানে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় আছে!
—তুই না এলে এগুলো জানতাম? আর কাউকে না পারি, মনোয়ারকে তো ঘায়েল করতে পারব এই তথ্য দিয়ে!
—নতুন নতুন কত তথ্য আবিষ্কার হয়ে বাতাসে ভাসে, আর আমাকে লাগে তোর এসব জানতে!
—শোন অহনা, এখন কী করবি? বিয়ে কিন্তু হয়ে গেছে! শুধু কাবিন না হওয়ার দরুন চাইলে যে কোনো পক্ষই অস্বীকার করতে পারে।
—তাহলে আমিই অস্বীকার করি, কি বলিস!
—খামখেয়ালিপনা করিস না, রাজি হয়ে যা!
—শোন, ওই ভয়টাই আমি পাচ্ছিলাম, ভাবছিলাম, লোকটার যে মুখ দেখছি এটা মুখোশ না হলেই হলো!
—তুই কি লোকটার সাথে কথা বলছিস? তা না হলে বুঝবি কী করে তিনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বলছেন!
—শোন ইসমত, আমি যা রোজগার করি, আমি একটি পরিবার প্রতিপালন করতে পারি! তাই আমি বিয়েটা তো ভাত-কাপড়-আশ্রয়-পরিচয়ের জন্য করছি না! যখন পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়, তখন দরদামের স্বেদটা অভিভাবকদের ওপর দিয়ে যায়। মানে কাবিনের টাকার পরিমাণ বাড়ানো কমানোর কদর্য ফায়সালাটা অভিভাবকদের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু আমার তো গা থিকথিকই করছে লোকটির কথা শুনে! অন্তত পাঁচলাখ বলতে পারত!
—আমাদের এসব কথা পুরুষবাদীরা শুনলে বলবে, নারীরা খালি প্রগতির কথা বলে, সমান অধিকারের কথা বলে। আবার পুরুষের কাছে কাবিনের টাকাও চায়!
—আমিও চাইতাম না। কিন্তু কথাটা তুই তুলে খটকাটা বাঁধালি! তবে এই কাঁটা আমি মন থেকে তুলতে পারব কি না, জানি না!
—এখন ঘুমো তো। দেখা যাক কী হয়!
লোকটার স্মার্টনেস দেখে আমার যে প্রেমভাব জেগেছিল তার কার্পণ্য দেখে তা কুয়াশার মতো উবে গেল, ধুর, পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই! তর কাছে কি স্লিপিংপিল আছে?
—তুই তো অলরেডি ঘুমিয়ে গেছিস। চোখ বন্ধ, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, আবার ঘুমের বড়ি কেন?
ইসমত অহনার থেকে এ কথার কোনো উত্তর পেল না, কারণ অহনা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে!
আরো একটি দিন আরো একটি রাত অহনা ইসমতের বাসায় সেঁধে থেকে গিয়েছিল। এতে ইসমতও খুব খুশি হয়েছিল। অহনা ইসমতের শাড়ি-ব্লাউজ পরার পর মনোয়ার বলেছিল, আমি কিন্তু গুলিয়ে ফেলছি, কে ইসমত কে অহনা! সারাদিনে এবং আরো একটি রাতে তারা নিজেদের কথা ছাড়া আর কারো কথা তোলেনি! যেন নতুন কথা বলার মতো কিছুই ঘটেনি কাল-পরশু! তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই ইসমতের সাথে অহনার কথা চলতে থাকে। দিন পনেরো পরে অহনা ইসমতকে বলল, খালেদ জোবায়েরের মোবাইল নম্বরটা দিতে পারবি?
—কী করবি?
—ফোন নাম্বার দিয়ে কী করে মানুষ?
—শোন, আমার কাছে তো থাকার কারণ নেই। আমার ভাশুরের কাছে চাইতে দ্বিধা লাগছে। উনি ভাবতে পারেন, যে কোনো কথা থাকলে তা আমার মাধ্যমে বল! বুঝিস না, কারণ ঘটকালির ক্রেডিটটা তো তিনি নিতে পারেননি! সেটুকুর জন্যই নিজের খেয়ে বনের মোষ টেনে অন্যের গোয়ালে বেঁধে দিতে চেষ্টা করেন, বুঝলি না? নিজেরা নিজেরা একটা সমঝোতায় এলে মধ্যস্থতাকারীর গুরুত্ব কমে যায় না? এটাও তো একধরনের লোভ!
—তোর থেকে কদিনে আমি কতকিছু যে শিখলাম!
—তুই ফেসবুকে ওনার নাম লিখে সার্চ দে! পেলে জানাস, কেমন?
—গুড আইডিয়া! তুই এত্ত বুদ্ধি নিয়ে ঘুমাস কী করে রে?’ বলে লাইন কেটে দিল অহনা!
অহনা সার্চ দিয়ে পেয়ে গেল খালেদ জোবায়েরকে। মেসেঞ্জারে লিখে রাখল, আপনার ফোন নম্বরটি পেলে ভালো হত।
দু-দিন পর উত্তর পেল এবং অহনা একটু সময় বের করে অফিস টাইমেই ফোন করে বলল, আপনার সাথে একটু সময় কাটাতে চাই!
ওপাশ থেকে যেন আঁতকে ওঠা প্রশ্ন, মানে?
—মানে, এই যেমন লালবাগের কেল্লা বা জাদুঘর বা চিড়িয়াখানা বা কোনো নদীতে বা লেকে নৌকায় ভাসা...!
—হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, আমি ভেবেছিলাম অন্যভাবে...। তবে এতদিনে যোগাযোগ করেননি, আজ কেন এমন অদ্ভুত আবদার করছেন?
—আবদারটি কি সত্যিই অদ্ভুত? একটি সামান্য পরিচয়ের মানুষকে আরো একটু জানার চেষ্টা করা যায় না?
—তাহলে ঠিকাছে! কোনখানে আমরা প্রথম মিট করব তাই বলেন!
—আপনি এক কাজ করেন, প্রথমে আমার অফিসে আসেন!
—আপনার অফিসে? সেদিন তো আমারও অফিস!
—শেষ বেলায় একটু সময় নিয়ে আসেন!
—আচ্ছা! সেটাই ভালো হবে!
আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিশাল কর্মকর্তা খালেদ জোবায়ের। বিশাল তার চেম্বার। অহনা যাওয়ার পর তিনি পিয়নকে চা দিতে বলে, এও বলে দিলেন, “চা দেওয়ার পর আমি না ডাকা পর্যন্ত কেউ আসবে না এখানে। এমন কি আমাকে কলও দেবে না।” বলে অহনার দিকে তাকিয়ে বললেন, তা ম্যাডাম কেমন আছেন? এতদিন পরে আসতে মনে হলো?
—আপনিও তো ডাকেননি? বা ফোনও করেননি!
—আমি ডাকলে আপনি আসবেন জানলে হাজারবার ডাকতাম!
খালেদ জোবায়েরের এত সহজভাবে কথা বলার ধরনে অহনার সেদিনের থেকে আজ আরো বেশি ভালো লাগতে থাকে। কিন্তু তা সে প্রকাশ করতে চাইছে না! যেন দুটি সুতার দুটি গুটির মতো নিজের নিজের বলয়ে দুজনেই প্যাঁচ খাচ্ছেন।
দুজনেরই প্রায় নীরবে কাপের চা শেষ হয়ে গেল। কেউ কোনো কথা বলছিল না। অহনা টের পাচ্ছিল খালেদ জোবায়ের তাকে গভীর অভিনিবেশে নতুন করে দেখছেন। সে অস্বস্তি বোধ করছিল। কী বলবে ভেবে না পেয়ে বলল, দরজা বন্ধ, বাইরে যারা বসে আছেন কী ভাববেন!
—আপনি সমাজকল্যাণ অফিস থেকে এসেছেন না? সরকারি অফিসের লোকেরা আধাসরকারি অফিসে হানা দিতে পারে না! ওদেরকে তাই বলে রেখেছি! তার ওপর হাজবেন্ডের সামনে তার ওয়াইফ বসে আছে, অকারণে এলেও পাপের কিছু নেই!
—এম্মা তাই নাকি?
—কাবিন না হয় না হলো, তাই বলে বিয়ে তো মিথ্যে হয়ে যায়নি! হুজুর না হোক, মসজিদের খাদেম বিয়ে পড়িয়েছে। কিন্তু অশুদ্ধ তো পড়াননি! আমি প্রথমে মাদ্রাসায় পড়েছি, সেই সূত্রে শুদ্ধ-অশুদ্ধ এর ভেদটা জানি!
—তাই নাকি? সেই শিক্ষা দিয়েই শিক্ষাজীবন শেষ হলে লেবাসটা কেমন হত আমি কল্পনা করছি!
হা হা হা, শব্দ করে হেসে খালেদ জোবায়ের তার চেম্বারের গুমোট ভাবটি উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ডজনখানেক মানুষ সাক্ষীও আছে, বিয়ের প্রধান বিষয় সেটাই। তাই এখন শুধু শাড়ির আঁচলটা মাথায় তুলে দিয়ে জাপটে ধরে বাসায় নিয়ে গেলেও পুলিশের কিছু করার নেই!
—কেমন যেন লাগছে আপনার কথাগুলো!
—একেবারে আধুনিক গল্পের মতো, তাই না! আমার রোমাান্টিক গল্প পড়তে খুব ভালোলাগে! সৃষ্টিকর্তা নিজেই কি রোমান্টিক তা ভেবে দেখেছ?
—কিন্তু আমার কাছে তো মনে হয় আল্লাহ একজন বুড়ো!
—স্বরূপ না চিনলে এমনি হয়! আচ্ছা মনে কর, তোমাকে যদি কেউ সরিষা পরিমাণ একটা দানা হাতে দিয়ে বলে এটা তোমার ভেতর স্থাপন করে রাখ, এর থেকে একটা মনুষ্য বাচ্চা হবে। সে তোমার মতো দেখতে পাবে, শুনবে পাবে, বুঝতে-ভালোবাসতে পারবে এবং সে ধীরে ধীরে বড় হবে! সে তোমাকে মা ডাকবে! তবু তুমি তা শরীরে স্থাপন দূরে থাক তুমি তা ছুঁয়েও দেখবে না! কিন্তু সৃষ্টিকর্তা এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে, সেই বীজটি তোমার শরীর চুম্বকের মতো টেনে আরেকজনের কাছ থেকে বের করে নেবে তার নিজস্ব তাড়নায়! কখনো ভেবেছ এভাবে?
এসব কথা শোনার পর অহনার মুখ রক্তিম হয়ে ওঠে। সে কিছুই বলে না, বরং ভেতরে ভেতরে অন্য এক ভাবনা তার শ্বাসনালি চেপে রাখে। মুখ শুকিয়ে আসে। তার বদন বিরস দেখে খালেদ জোবায়ের বললেন, তুমি এসেছ কেন তাই বল!
—ভুল করেছি কি এসে?
—সেও তো তুমি জানো! তুমি এসেছ, ওয়েলকাম! না এলে ডেকে আনতাম না!
—কেন ডাকতেন না?
—ডাকলে যদি না আসো, অবজ্ঞা সহ্য হবে না, তাই!
—কিন্তু আপনি তো একটা অধিকারের কথাও বললেন!
—অধিকার দেয়ার পরই তা প্রয়োগ করা যায়, বিয়ে-কাবিন ওসবে ভর করে যারা অধিকার প্রয়োগ করে তারা পেশির জোরে চলে। ভেতরের আর কোনো শক্তি-আলো-ঐশ্বর্য তারা টের পায় না!
খালেদ জোবায়েরের কথার পর অহনা আবার কোনো কথা খুঁজে পায় না! অহনার মনে হতে থাকে প্রথম জীবনেই আসলে এই মানুষটিকে তার দরকার ছিল! কিন্তু সে নির্বিকার হয়েই বসে থাকে! এমনিতে অনেক অনিয়ম করে নিজেকে আর নিয়মের ভেতর আনতে পারছে না। তার ভেতর টেস্ট করে দেখেছে সে তিন থেকে সাড়ে তিনমাসের প্রেগন্যান্ট! পেটে বাচ্চা এলে মেয়েরা খেতে পারে না, বমি আসে বলে জানে। কিন্তু তার ওসব কিছু হয়নি! আর মাসিকের অনিয়ম তার আগেও ছিল। পারভেজের কাছ থেকে চলে আসার পর বাড়ির অবস্থা তার জন্য ভয়ংকর হয়ে ওঠায়, সারাক্ষণ সে ত্রাহি ত্রাহি প্রমাদ গুনত। আর তার ঘোরেই কি অন্যসব অনুভূতি তার চাপা পড়ে ছিল!
তারও ওপর আবার তৌহিদের করা অপমান! বাস্তবতা তার কাছে সত্যিই অকল্পনীয় ভয়ের হয়ে উঠেছিল। ডাক্তার বলেছেন, এই সময় এই বাচ্চা নষ্ট করলে তাকে সারাজীবন সন্তানহীন অবস্থায়ও কাটাতে হতে পারে। তারচেয়ে বড়কথা তার নিজের জীবন নিয়েও টানাটানি পড়বে। পেশার হাই। এই বাচ্চা রাখতে গেলেও তাকে প্রেসার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে! অহনা অন্যদের জীবন থেকে শিখেছে স্বামী না হলেও একটা বাচ্চার অন্তত দরকার! তাই কদিন ধরে তার মনে হচ্ছে, হতে পারে এই সন্তানই তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন! কিন্তু এই লোকটির কাছে সে কেন এসেছে! বরং বিষয়টা জানার পর তো তার পরিচিত সবার থেকে লুকিয়ে থাকা উচিত। তৌহিদ প্রথমদিন না হলেও দ্বিতীয় দিন যখন তাদের শারীরিক সম্পর্ক ঘটে, সে কনডম ব্যবহার করতে চেয়েছিল। সে সেটা নিয়েই এসেছিল। কিন্তু অহনাই বলেছিল ওসব তার ভালোলাগে না! অথচ পারভেজকে সে কনডম ছাড়া কাছে আসতে দিত না। বলত, তোমার ভাইবোন বাসা থেকে না বেরোলে আমি বাচ্চা নেব না। কারণ বাচ্চা ওদের থেকে গাঁইয়া কথা-গাঁইয়া আচরণ শিখবে!’ তাই অহনা তার আজকের এই অবস্থার জন্য কাকে দায়ী করবে, বুঝতে পারে না!
অহনা দীর্ঘ ছুটি নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে, সে জো নেই। কারণ নতুন চাকরি! মাসছয়েক হলো পারভেজের কাছ থেকে চলে এসেছে। এরপর তৌহিদের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা। চাকরি হয়েছে মাস তিনেক। তাহলে সে কনসিভ করেছে তৌহিদের সাথে মেলামেশার শেষের কদিনে!
অহনা খালেদ জোবায়েরের রুমে বসা থেকে হঠাৎ সটান দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাই!
—এসেছিলে কেন, বলোনি কিন্তু?
—এমনি!
—এমনি’র ভেতরেই কিন্তু বড় মানে লুকিয়ে থাকে! তুমি আগারগাঁও থেকে মতিঝিল এসেছ। এখন আবার আগারগাঁও যাবে? বাসা অফিস একই জায়গায়?
—হ্যাঁ!
—বাসায় আর কে কে আছেন?
—আমি একা। এই মাসতিনেক চাকরির বয়স। দুই ভাইবোন আমরা। ভাই ব্যবসা করে খুলনাতে। আব্বা-আম্মাও খুলনা নিজেদের বাড়িতে থাকেন। তাই একা থাকাই আপাতত নিয়তি!
—একা থাকো ভয় করে না!
—এই রে, সৃষ্টিকর্তা মানুষের ভেতর অহেতুক একটা ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে তাকে অন্যের ওপর নির্ভর করতেই বোধহয়। দিনে তেমন ভয় পাই না, কিন্তু রাত হলে ভয় পাই! মানে বিষয়টা এমন, দিনে ভয় পাই মানুষকে। আর রাতে ভূতকে! সারাবাড়ি জুড়ে খসখস পায়ের আওয়াজ, উঠে দেখি কেউ নেই! কেমন লাগে বলেন তো!
—তুমি তো বেশ যুক্তিপূর্ণ কথা বল!
—আরে না, ঘটে বুদ্ধি থাকলে কপালে এই দশা হয়!
—কী দশা? আমি তো দেখছি তুমি খুব ভালো আছো! চল, আমরা বেরোই। আমি তোমাকে এখন ঘোরাব, যেভাবে তুমি ঘোরার বায়না ধরেছিলে! সন্ধ্যার পর ঘুরতে আমার ভালো লাগে। কোনো তাড়া থাকে না!
—আমি কিন্তু আপনার বাসায় যাব না!
—আমার বাসা যদি তোমার বাসা হয়, তবু যাবে না?
কদিন আগে একবার ইসমতকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেছে অহনা! আজও তার সেই দশা হওয়ার মতো। কিন্তু যে গহিন খাদে সে পড়েছে, কেউ কি অতটা মহানুভবতা তাকে দেখাবে? তবু সে এই লোকটির কাছে এসেছে এক চৌম্বক টানে! খালেদ জোবায়েরের এমন কথার পরে একটু ছেলেমানুষি ভাবে অহনা বলে ফেলল, আপনি তো একলাখ টাকা কাবিন দিতে চেয়েছেন, তাই আপনার ঘর আমার ঘর হবে কী করে? কিপটের হাঁড়ি!
—আমাকে যখন তুমি নিজের মনে করবে তখনি আমার ঘর তোমার হয়ে যাবে! আর আমাকে বাদ দিয়ে কাবিনের টাকার ওপর যদি নির্ভর কর, তাহলে মাত্র ওইটুকুই তোমার হবে!
—বাইরে ঘুরবেন বলেছেন, চলেন! কিন্তু রাস্তায় যে জ্যাম থাকে, ঘোরা তো হবে না, হবে একসাথে স্থির থাকা!
—সেভাবেই নাহয় জানব, ‘তুমি আছ আমি আছি!’
খালেদ জোবায়ের অহনাকে একেবারে পূর্বাচলের তিনশো ফুট রাস্তার পাশে নিয়ে গেলেন। যেতে যেতেই রাত নয়টা পার হয়ে গেছে। দশটা বাজতেই অহনা বলল, রাত বাড়ছে। আপনার বাসা তো বসুন্ধরায়। এখান থেকে কাছেই। আমাকে আপনার পৌঁছে দিতে হবে না। আমি একটা সিএনজি নিয়ে চলে যাই!
—তোমার সাহস ও অকপটতা আমাকে মুগ্ধ করল। কারণ আমি নিজে খুব সাহসী না হলেও ভীতু মানুষ পছন্দ করি না!
—কিন্তু সবসময় তো নিজের সাহসে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না! আমাকে এটাও মনে রাখতে হবে, কজন মিলে বা একা কেউ একটা ছোট ছুরি নিয়ে আক্রমণ করলেও আক্রান্ত ব্যক্তির কিছুই করার থাকে না। এ অবস্থায় নারী-পুরুষ দুজনেরই সমান বিপদ! আমি নারী বলে ভয় পাচ্ছি তা কিন্তু নয়! আমি আজ যাই, আরেকদিন যদি সময় দেন, আমি এখানে আবার আসব আপনার সাথে! এদিকটা এত সুন্দর, খালি শুনেছি, আপনার বদৌলতে দেখা হলো!
—তুমি বলছ শুধু আরেকদিন? আমি তো আমার জীবনের বাকি সমস্ত দিন তোমার নামেই উৎসর্গ করে রাখতে চাই!
খালেদ জোবায়েরের এই কথার পর অহনা আবেগে বিহ্বল হয়ে বলল, আমার পেটে সাড়ে তিন মাসের বাচ্চা! আমি এত টেনশানে ছিলাম, বিষয়টা বুঝতেই পারিনি। তারপর এই সপ্তাহখানেক হয়, টেস্ট করে জানলাম কেন পিরিয়ড হচ্ছে না!
—বাচ্চাটা তোমার প্রাক্তন হাজবেন্ডের তো!
—আর কার হবে!’ এটুকু বলে অহনা চুপসে থাকল। তার পায়ের নিচের মাটি দুলছে। কারণ এটা শুধু তার অস্তিত্বের সংকট নয়। তার নিজের জীবন নিয়েও সংকট আছে!
—বছরদশেক আগে বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের পর কোনো এক কারণে আমার জানা হয়, আমি বাবা হতে পারব না। কথাটা আমার স্ত্রীকে বলা হয়নি। সে বিয়ের বছর পাঁচেক পরে একদিন ঘটা করে আমাকে বলল, ‘আমি মা হতে চলেছি!’ আমি তার উচ্ছ্বাস দেখে আশ্চর্য হতে থাকলাম। দুদিন ধরে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলাম, কোথাও তার কোনো ফাঁকি ধরা পড়ে কিনা। কিন্তু তা পড়েনি! তার এই নিপুণ অভিনয়টা আমার সহ্য হয়নি! অভিনয়টা অত নিপুণ না হলে আমি হয়ত তাকে ক্ষমা করে দিতাম। পরে তার কাবিনের থেকে চারগুণ বেশি টাকা তাকে আমি হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলাম, এটা নিয়ে তুমি চলে যাও। আমাকে রেহাই দাও! তুমি মা হতে চলেছ, কিন্তু আমার বাবা হওয়ার ক্ষমতা নেই, বারবার পরীক্ষা করিয়েছি। কয়েকজন ডাক্তারই সে কথা বলেছেন। এটা তোমাকে আগে না জানিয়ে ভালো করেছি, কী মন্দ করেছি, আমি এখন সেটা বুঝতে পারছি না! তবে বিয়ের আগে জানতে পারলে তোমাকে অবশ্যই তা জানাতাম।
—আপনি তাকে অনুগ্রহও তো করতে পারতেন!
—নিজেকে অপমান করে তো অন্যকে অনুগ্রহ দেখানো যায় না! সে সারাজীবন আত্মতুষ্টি অনুভব করত আমাকে ঠকানোর। কিন্তু তোমাকে উদ্ধার করতে সহায়তা করলে দরজা ভাঙা ঘরে বসবাস করা মানুষের মতো তোমার থাকবে ভয়, বিনয়, কৃতজ্ঞতা! যদিও কোকিলের বাসায় কাকের ছা পোষার মহানুভবতা আমি দেখাতে চাই না! কিন্তু মানুষ হিসেবে নাহয় মনুষ্য জন্মের কিছুটা দায় এভাবে শোধ করলাম!
খালেদ জোবায়ের কথা শেষ করে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন। অহনাও কথা খুঁজে পাচ্ছে না। খালেদ জোবায়েরের কথাগুলো তার অপরাধ আরো ভারী করে তুলছে। নীরবতা ভাঙতেই বুঝি খালেদ জোবায়ের আবার শুরু করেন, ‘স্ত্রী চলে গেছে। তাই তার শূন্যতা পূরণ নয়, শুধু বিছানার সঙ্গীও নয়, আমি আমার জন্যই একজন পারফেক্ট সঙ্গী খুঁজছি, যার অনেকটাই আমি তোমার ভেতর পেয়েছি! আমি কথা বলতে ভালোবাসি। আমি বেড়াতে ভালোবাসি। আর একজন ভালো সঙ্গী পাশে থাকলে বাঁচার আনন্দটা বহুগুণ বেড়ে যায়। প্রতিটি উপলব্ধি ভিন্ন ভিন্ন ভাষা পায়। কাউকে মুগ্ধ করে রাখার ভেতরে একটা অব্যক্ত আনন্দ থাকে, যেমন ফুলের বুকে লুকানো সুবাস থাকে। আমার শুধু সেই তেমন একটি মানুষ দরকার, যে মুগ্ধ হতে জানে! সেদিন কাকতালীয়ভাবে বিয়েটা পড়ানো হয়ে গিয়েছিল, পরে আমার মনে হয়েছিল, তোমাকে এই ত্রুটির বিষয়টা জানানো উচিত ছিল। আর শুধু সেজন্যই আমি তোমার খোঁজ-খবর করিনি! তবে তুমি এই যে সব জানলে, তুমি এভাবে সন্তানসহ আমার জীবনে এলেও, ওয়েলকাম!
—আপনি বলেছেন, আমাদের যে বিয়ে পড়ানো হয়েছে, ওটাই আসল বিয়ে! কিন্তু পেটে আরেকজনের বাচ্চা থাকলে তো বিয়ে জায়েজ হবে না!
—নিজেকে তরিয়ে নেওয়ার জন্য তুমি তা বুঝেশুনে যে চেপে যাওনি, এতে তোমার প্রতি আমি সত্যিই মুগ্ধ হলাম। আর তাই আমি যদি মনে করি ও বাচ্চা আমারই, তাহলে তাকে নাজায়েজ করার ক্ষমতা কার আছে! স্বয়ং বিধাতার কাছেই তো সে ব্যতিক্রম কিছু। সন্তান জন্ম দিলেই পুরুষ বাবা হয় না। পুরুষ বাবা হয় সন্তানের প্রতি তার আচরণে! তোমার সন্তানের বাবা হয়ে উঠতে আমার চেষ্টার ত্রুটি থাকবে না। আমি নির্বিবাদী মানুষ, সব অবস্থায় আমি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান পছন্দ করি।
—আমার ভয় হচ্ছে, আমি কি কোনো মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, নাকি স্বপ্ন দেখছি কাউকে? এই কথোপকথন, এই যে বেড়াতে আসা, এসব স্বপ্নে ঘটছে না তো! আপনি প্রতিজ্ঞা করে বলেন, আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না!
—বিয়ের একটা অংশ তো প্রতিজ্ঞাই। একটা মুখে বলা, আর একটা লিখে প্রমাণ রাখা! সেভাবেই তো একজনের ঘরে ঢুকেছিলে, সে ঘর ভেঙে আসতে হয়নি? প্রতিদিন টিকে থাকার চেষ্টা, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টাই কেবল সম্পর্ক নতুন করে রাখে এবং সে চেষ্টাই তা টেকাতে পারলেও পারে! পানি যেমন কাউকে ভাসিয়ে রাখে না, ভাসার কৌশলটা আগে শিখে তারপর তাকে বাগে রেখে ভাসতে হয়। পৃথিবীতে আমাদের জীবনযাপনের ধরনও আসলে সেরকম। তবে আমার একটা শর্ত আছে, মানবিকতা রক্ষার সাথে আমি কিন্তু রক্ষণশীলতা পছন্দ করি! কথাবার্তা, চালচলন, পোশাক-আশাক, মানুষের সাথে বন্ধুত্ব, প্রতিটি বিষয়ে একটি সীমারেখা থাকতে হবে।
—তোমার সব চাওয়া আমি পূর্ণ করে দেব। সমস্ত জীবন আমি নিজেকে সবার উর্ধ্বে রাখতে চেয়েছি যে কোনোভাবে। এখন মনে হচ্ছে এমন কারো পায়ের নিচে ঠাঁই পাওয়া ওই আত্মশ্লাঘার চেয়ে অনেক বেশি প্রশান্তির! দীর্ঘ পথ হাঁটা ক্লান্ত পথিকের মতো আমার এখন খুব ঘুম পাচ্ছে!
—‘পান্থশালা এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়!’ বলে খালেদ জোবায়ের অহনাকে জাপটে ধরে আরেক হাতে গাড়ির দরজা খুললেন।
সেদিনের পর থেকে একযুগের বেশি সময় পার হয়ে গেছে অহনার জীবন থেকে। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে আছে অহনা! এই সুখকে সে পাখির মতো বস করে রেখেছে খালেদ জোবায়েরের প্রতি সমর্পণ ও আনুগত্যের দামে। আর সকল ধস রক্ষার যে মন্ত্র দুদিনে শিখিয়ে দিয়েছিল ইসমত আরা এবং আরো পরে এসে তার পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীর আশ্রিতা, যিনি মা পরিচয়ে থাকলেও তাকে দিয়ে করানো হত গভর্নেসের কাজ। কিন্তু কথার নৈপুণ্য ও পোশাকের পরিপাট্যতায় তার চারপাশের সবাই যেন তার ছায়াতে ছিল। অথবা আজও তার অবর্তমানেও তার স্মৃতিকে সবাই ছায়া দিয়ে রেখেছে।