ছোটগল্পের সংকলন ‘হার্ট ল্যাম্প’-এর জন্য এবছর আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার পেয়েছেন কন্নড় ভাষার লেখক বানু মুশতাক। 'Red Lungi' গল্পটি দীপা ভাস্তির ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশ করেছে প্যারিস রিভিউ।
গ্রীষ্মের ছুটিতে মায়েদের কষ্টের যেন শেষ নেই। সব বাচ্চাই তখন বাড়িতে। তারা যদি টিভির সামনে না থাকে, তবে সামনের উঠানে পেয়ারা গাছে উঠে বসে, কিংবা বাড়ির সীমানার দেওয়ালে চড়ে বসে। যদি হঠাৎ পড়ে গিয়ে কারও হাত বা পা ভেঙে যায়—এই উদ্বেগ কখনোই কাটানো যায় না।
এসময় তারা তাদের কান্নাকাটি, হাসাহাসি, একে অপরকে শাস্তি দেওয়ার রহস্যময় ন্যায়বিচারের নিয়মে চলতে থাকে! এ কারণে ছুটির শুরুতেই রাজিয়ার মাথাব্যথা বেড়ে যায়। কপালের শিরাগুলো টনটন করে, মাথা গরম হয়ে ফেটে যেতে চায়, আর মনে হয় ঘাড়ের রগগুলো যেকোনো মুহূর্তে ছিঁড়ে যাবে। একের পর এক বাচ্চারা চিৎকার করে, কাঁদতে কাঁদতে নালিশ নিয়ে আসে…আর তাদের সেইসব খেলা…আরিপ্ বাপ…তলোয়ার ও মেশিনগান নিয়ে যুদ্ধ, বোমা হামলা…!
“আর না”—ভাবলেন, তিনি মাথায় শক্ত করে কাপড় পেঁচিয়ে হলঘরের ডিভানে শুয়ে পড়লেন। তিনি এই শব্দ সহ্য করতে পারছিলেন না। টিভি চলছিল বটে, তবে অল্প সাউন্ডে। বাচ্চাদের কঠোরভাবে সাবধান করে দিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন একটু আরাম করে পা তুলে বিশ্রাম নিতে পারবেন—ঠিক তখনই কেউ একজন হাউমাউ করে উঠল, “দোদ্দাম্মা… দোদ্দাম্মা, ও আমায় চিমটি কেটেছে!” রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে রাজিয়া উঠে দাঁড়ালেন, মনে মনে গালমন্দ করতে লাগলেন সবাইকে।
ঠিক তখনই তার স্বামী লতিফ আহমদ ঘরে ঢুকলেন। রাজিয়া ভাবছিলেন—ছয়টা ছোট্ট ডায়নোসর তো আছেই, প্রতিটা দেওরের দুটো করে… তিনটা করেও আছে… সব এসেছে ছুটিতে। আর আমার দুই ছোট বোনের ছেলেরাও এখানে—আল্লাহ্, আমি একা কী করব! স্ত্রীর অবস্থা দেখে লতিফ আহমদ একটু সজাগ হলেন। রাজিয়া কখনই বাচ্চাদের সহ্য করতে পারতেন না। শুরু থেকেই তার তীব্র মাথাব্যথা, আর এই চিৎকার-চেঁচামেচি করা বাচ্চারা যেন সেই ব্যথার ওপর লাল মরিচের গুড়া ছিটাচ্ছে… চুপিচুপি আড়চোখে তিনি গুনলেন—এক, দুই, তিন, চার… সব মিলিয়ে আঠারোটি বাচ্চা, বয়স তিন থেকে বারোর মধ্যে।
রাজিয়া কিছু বলার আগেই লতিফ আহমদ তাদের ধমক দিলেন, “এই, চুপ করে বসো—যে বেশি শব্দ করবে, কিছুই পাবে না!” ঠিক তখনই হুসেন মাঠ থেকে আমের ঝুড়ি নিয়ে এলো। বাচ্চারা চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ল ঝুড়ির ওপর, তখন লতিফ আহমদের ভয়ের শুরু। তিনি স্ত্রীর দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বাথরুমের দিকে এগোলেন। রাজিয়া মাথাব্যথা আর সহ্য করতে না পেরে হাতের কাছে যাদের পেলেন, দু’একজনকে টপাটপ পেটালেন… পটাপটাপটাপটা… এই নিরন্তর যন্ত্রণার গ্রীষ্ম থেকে মুক্তি পেতে হলে কিছু ছেলেকে বিছানায় পাঠাতে হবে—এই সিদ্ধান্তে এলেন তিনি। খতনা করাতে হবে।
রাজিয়ার হিসাব অনুযায়ী, ১৮টি বাচ্চার মধ্যে ৮টি মেয়ে—তাদের রেহাই হবে। বাকি ১০টির মধ্যে যাদের বয়স জোড় সংখ্যা—চার, ছয়, আট—তাদেরও। ফলে বাকি ৬টি… লতিফ আহমদ কোনো প্রতিবাদ না করে খতনা করানোর ব্যাপারে রাজি হয়ে গেলেন।
তাদের পরিবার জেলা শহরের ধনী পরিবারগুলোর একটি। যদিও লতিফ আহমদের চারজন ছোট ভাই সরকারি চাকরি করার সুবাদে শহরে থাকে, পরিবারিক অনুষ্ঠানাদি বড় ভাইয়ের বাড়িতেই হয়। রাজিয়া খরচে কোনো কৃপণতা করতেন না—এটা তার কর্তব্যবোধ। উপরন্তু, যাদের খতনা হতে চলেছে, তাদের মধ্যে দুইজন ছিল তার ছোট বোনদের সন্তান—এই ব্যাপারটি তাকে খুশি করছিল।
তার তত্ত্বাবধানে প্রস্তুতি শুরু হলো। কয়েক গজ লাল আলওয়ান কাপড় কেনা হলো। বাচ্চারা তাদের দোদ্দাম্মার সঙ্গে মিলে কাজ করতে লাগল। রাজিয়া কাপড় কেটে লুঙ্গি তৈরি করতে লাগলেন। লুঙ্গিগুলো রং করা, তাতে চুমকি ও জরির কাজ করছিল মেয়েরা। ৬টি লুঙ্গি তৈরি হওয়ার পরও অনেক কাপড় থেকে গেল। রাজিয়া ভাবতে লাগলেন বাকি কাপড় দিয়ে কী করবেন। হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধি এলো—“আরে, রান্নার মেয়ে আমিনার ছেলে আরিফ আছে না? আর আমাদের খেতমজুরের ছেলে ফরিদও আছে…আসলে, কয়েকজন গরিব ছেলেরও খতনা করানো যায়?” সঙ্গে সঙ্গে তিনি কাজে লেগে গেলেন।
শহরে পাঁচটি মসজিদ ছিল—এগুলোর মধ্যে জামিয়া মসজিদ এবং মসজিদে-নূর অন্যতম। শুক্রবারের নামাজের পর পাঁচটি মসজিদের সেক্রেটারিই মাইক হাতে মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন: “আল্লাহর রাস্তায় নজরানা হিসেবে লতিফ আহমদ সাহেব আগামী শুক্রবার আসরের নামাজের পর সম্মিলিতভাবে সুন্নতে ইব্রাহিমের আয়োজন করেছেন। যারা নিজেদের ছেলেদেরও অংশগ্রহণ চান, তারা আগেভাগে নাম নিবন্ধন করিয়ে নেবেন।”
সরাসরি 'খতনা' শব্দটা ব্যবহার করলেও পারা যেত, কিন্তু মঞ্চে মাইক্রফোন হাতে তা বলা সম্ভব নয়। ব্যাপারটি ছিল আসলে ইব্রাহিম নবীর একধরনের আনন্দানুষ্ঠানের মতো—তবে বাস্তবে যা ঘটত, তা-ই: একসঙ্গে অনেক শিশুর খতনা ঘিরে উৎসবের আবহ তৈরি হতো—শেষে ছেলেরা চিৎকার করে কেঁদে উঠত।
সব কিছু পরিকল্পনামাফিকই চলছিল। অনেক দরিদ্র পরিবার তাদের ছেলেদের নাম লিখিয়েছিল। রাজিয়া একটার পর একটা লুঙ্গি তৈরি করে যাচ্ছিলেন। তার নিজের পরিবারের ছেলেরা পেতো সিকুইন আর জরির লুঙ্গি, অন্যরা সাধারণ লুঙ্গি। তার ছেলে সামাদের লুঙ্গিতে এত সিকুইন ছিল যে আসল কাপড়ের রং চেনাই যেত না। বস্তাবন্দি গম আর নারকেল জোগাড় করা হয়েছিল। বাদাম, কিশমিশ, খেজুর আর ঘি কেনা হয়েছিল।
শিশুরা কিছুটা অস্থির ও ব্যাকুল ছিল। তবুও চারপাশে উৎসবের মেজাজ ছড়িয়ে ছিল, সবাই খুশি। এরই মধ্যে শুক্রবার এসে গেল। আসরের নামাজ শেষ হওয়ার পর লতিফ আহমদ তাড়াতাড়ি দুপুরের খাবার শেষ করে মসজিদের পাশের মাঠে পৌঁছে গেলেন। সেখানে ইতোমধ্যে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে—যে-সব ছেলেদের খতনা হবে তারা পিতা-মাতাসহ লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে।
সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা টুপি কিংবা পাগড়ি পরে একদল তরুণ স্বেচ্ছাসেবক তৈরি—সবাই সদ্য গোসল করে নামাজ পড়েছে, কারো চোখে সুরমা, কারো গায়ে আতরের গন্ধ। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে মনোহর সুবাস।
খতনার কাজটি হতো পাশের মাদ্রাসায়। কুস্তিগিরের মতো বিশালদেহী ইব্রাহিম আজকের দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সে নাপিত হলেও, বংশপরম্পরায় খতনার কাজ করেন।
তিনি হলঘরের এক কোণে বসে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। উলটো করে রাখা একটি ব্রোঞ্জের বিন্দিগে ছিল সামনে—যেটাকে রাজিয়া বারবার ইমলির রস দিয়ে পরিষ্কার করে ঝকঝকে করে রেখেছেন। সামনে ছিল প্লেটভর্তি চালা ছাই।
সবকিছু খুঁটিয়ে দেখে তবেই সন্তুষ্ট হলেন ইব্রাহিম। এ বিষয়ে তার প্রচুর অভিজ্ঞতা। বলা হতো, তিনি নিখুঁতভাবে একটানে খতনা শেষ করতেন, কোনো সংক্রমণও হতো না। এমনই ছিল তার সুনাম। হলঘরের আরেক কোণে কিছু তরুণ বড় জমখানা এমনভাবে বিছিয়ে দিল যাতে কোনো ভাঁজ না থাকে।
সব কিছু যাচাই করে নিয়ে তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। পকেট থেকে শেভিং ক্ষুর বের করে বাঁ হাতে এক ঝটকায় ঘষলেন, নির্দেশ দিলেন, “একজন একজন করে ভেতরে আনো।”
একটু অস্বস্তিতে থাকা স্বেচ্ছাসেবক আব্বাস বললেন, “আপনি চাইলে ক্ষুরটা ফুটন্ত পানিতে ভিজিয়ে জীবাণুমুক্ত করে দিই। মনে হয়, ডেটলও মেশানো যায়।”
ইব্রাহিম তার দিকে তাচ্ছিল্যের চোখে তাকালেন—এই ছেলেটা বোধহয় কলেজের গন্ধ পেয়েছে। সে ব্যঙ্গ করে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন?”
“যাতে সেপটিক না হয়,” কেঁচে গেল আব্বাসের গলা।
কিন্তু ইব্রাহিম থামলেন না। খোঁচা দিয়ে বললেন, “তোমার কী এমন হয়েছিল?”—এতে আব্বাসের বন্ধুরা হেসে উঠল, “কী কী কী…”
বিরক্ত হয়ে আব্বাস বলে উঠল, “একেবারে অসভ্যের একটা দল”—বলেই হেঁটে চলে গেল।
ইব্রাহিম বিজয়ী হাসি হেসে আবার ডাক দিলেন, “একজন করে ভেতরে আনো।”
বাইরে স্বেচ্ছাসেবকরা ছেলেদের অন্তর্বাস খুলে ফেলতে বলল। সবার আগে ছিল আরিফ। ১৩ বছর বয়সি, প্রায় বড় হয়ে উঠছে। সাধারণত ৯ বছরের আগেই খতনা হয়ে যায়, কিন্তু ওর মা আমিনা এতদিন টাকাই জোগাড় করতে পারেননি।
আরিফ পরনের কাপড় খুলে কেমন কুঁকড়ে গেল। এক তরুণ হেসে গায়ে হালকা চাপড় মেরে ওকে ভেতরে ঠেলে দিল।
পাঁচ-ছয়জন মিলে আরিফকে বসালো সেই উলটো বিন্দিগের উপর। আরিফ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ একজন তার বগলের নিচে হাত ঢুকিয়ে তাকে চেপে ধরল। কেউ তার উরু শক্ত করে ধরা, কেউ পেছন থেকে হাত ধরে রেখেছে।
আরিফ গলা ছেড়ে চিৎকার করে উঠল—“ছাড়ো, ছেড়ে দাও, আইয়্যো…আম্মা…আল্লাহ!” যেন এইটাই প্রত্যাশিত ছিল, তিন-চারজন একসাথে বলে উঠল, “আরে, এমন করে চেঁচাস না, বল ‘দীন, দীন’ ”
হাঁপাতে হাঁপাতে আরিফ বলতে লাগল, “দীন… দীন…আল্লাহ…আম্মা…আইয়্যো…”
ইব্রাহিম এক টুকরো কাগজ ও পাতলা বাঁশের চিমটা আরিফের লিঙ্গের গায়ে এমনভাবে আটকে দিলেন যেন শুধু খোলসটা সামনে থাকে। কেউ একজন আরিফের মুখ ঘুরিয়ে বলল, “বল দীন, বল, বল তাড়াতাড়ি!”
‘দীন’ শব্দের অর্থ হতে পারে 'ধর্ম', 'বিশ্বাস' বা অন্য কিছু—তবু না জেনেই আরিফ গলা ছেড়ে চিৎকার করে উঠল, “দীন! দীন!”
তার জিভ শুকিয়ে গেল, পিঠ দিয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ল, বুক গরম হয়ে উঠল, কিন্তু হাত-পা ঠান্ডা। সে শেষ চেষ্টা করল পালিয়ে যাওয়ার।
“কী রে?” একজন বলল, “ছেড়ে দিতে বলছিস?”
আরিফ কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বাথরুমে যাব, ছেড়ে দাও।”
উত্তর এলো, “একটু পর।”
তাকে আরও শক্ত করে চেপে ধরা হলো।
ইব্রাহিম পিছনে লুকিয়ে রাখা ক্ষুর বের করে এক ঝটকায় লিঙ্গের আগা কেটে ফেললেন। খোলসটি পড়ে গেল ছাইয়ের প্লেটে। রক্ত ছুটে বেরিয়ে এলো। ইব্রাহিম সাবধানে ছাই ছিটিয়ে রক্ত বন্ধ করলেন।
আরিফের মুখ ফ্যাকাশে, সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। নিঃশব্দে কাঁদছে। দুজন তরুণ তাকে ধরে পাশের মেঝেতে শুইয়ে দিল। ঠান্ডা প্লাস্টার যেন একটু আরাম দিল। তবু জ্বালাপোড়া কমলো না।
এদিকে আরেকজন ছেলেকে ধরে টেনে আনল তারা।
আব্বাস আরিফকে একটু পানি দিল, পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগল।
চারদিক থেকে চিৎকার: “দীন… দীন…”
আরিফ পেট ধরে কেঁচে উঠছে, পাশেই আরেক ছেলেকে শুইয়ে দেওয়া হলো।
“দীন…দীন…”—চিৎকার চলছেই।
চারদিকে ছটফট করা দেহ।
যন্ত্রণার মাঝেও আরিফের চোখ বুজে এলো। ঘুমে ঢলে পড়ল—আবার জেগে উঠল। কয়েকবার এরকম ঘুম আর জাগরণ।
একসময় কেউ আস্তে করে তাকে নাড়িয়ে দিল। ব্যথা তখনো ছিল, তবে সহ্য করার মতো। চোখ মেলে দেখে আব্বাস দাঁড়িয়ে আছে।
“আরিফ, হাঁটতে পারবি?” বলল আব্বাস। “দেখ, তোর মা এসেছে।”
তার মা পুরোনো একটা বোরখা পরে দরজার ওপাশ থেকে উঁকি দিচ্ছিলেন। পুরুষদের সামনে আসতেও পারছিলেন না, আবার ছেলেকে একা ফেলে যেতেও পারছে না। মায়ের জীর্ণ বোরখা দেখে হঠাৎ যেন সাহস ফিরে পেল আরিফ।
আব্বাসের সহায়তায় ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল আরিফ।
দরজার পাশে বসে থাকা লতিফ আহমদ তাকে একটি থলে দিলেন।
আরিফ দেখল, তার ভেতরে গম, দুই টুকরো নারকেল, এক প্যাকেট চিনি, প্লাস্টিকে মোড়ানো মাখন… তার মুখে লালা এসে গেল।
একটি ছেলেকে ভিতরে নেওয়া হচ্ছিল, সে কাঁপতে কাঁপতে থমকে দাঁড়াল। সে কাঁদতে শুরু করলে আরিফ বুক টানটান করে একেবারে বীরের মতো বলল, “এই… সুবহান, ভয় পাস না… ‘দীন’ বল, শুধু ‘দীন’ বল, কিছুই হবে না।”
সে তখন একেবারে অভিজ্ঞ।
আমিনা থলেটা নিয়ে বলল, “ওই বারান্দায় গিয়ে বস।”
যাতে লুঙ্গি ঘায়ে না লাগে আরিফ পা ছড়িয়ে সাবধানে বসে পড়ল।
লাইন থেকে একজন জিজ্ঞেস করল, “এই আরিফ, ব্যথা করে নাকি?”
আরিফ মুখে একটুও না ফুটিয়ে বলল, “না রে, একটুও না, ক্যানো, একটুও না।”
একজন দাড়িওয়ালা মধ্যবয়স্ক লোক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি শুনে বললেন, “সাবাশ, বেটা। এই নাও, এটা রাখো, আর নিজের খেয়াল রাখো,” বলেই পঞ্চাশ টাকার একটা নোট তাকে দিলেন। অপেক্ষারত ছেলেরা হিংসায় আরিফের দিকে তাকিয়ে থাকল। ভেতর থেকে চিৎকার ভেসে এলো—“দীন…দীন…আয়্যো… আল্লাহ…” আরেকটি ছেলেকে ভেতরে ঠেলে দেওয়া হলো।
ছেলেরা একে একে ভেতরে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর লাল লুঙ্গি পরে বেরোচ্ছিল। এই ব্যস্ততার মধ্যেই সেই নারীটি এসে হাজির হলেন। কৃষ্ণকায়, চোখ একদম দেবে গেছে, শরীরে যেন কোমরই নেই—তবু একটি শিশু কোলে নিয়ে আছে। ছেঁড়া শাড়ির আড়ালে জোড়া লাগানো ব্লাউজ। ছয় বা সাত বছরের একটা ছেলেকে হাত ধরে টেনে আনছিলেন। ছেলেটি ছুটে পালাতে চাইছিল কিন্তু তিনি শক্ত করে ধরে আছেন। ছেঁড়া শাড়ির আঁচল দিয়ে তিনি মাথা ঢাকার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু আঁচল আরও খুলে যাচ্ছিল। তিনি খুব ধীরে নিজের শোনার মতো অনুচ্চ গলায় বললেন, “ভাইয়া…”
লতিফ আহমদ তখনো আলাপে মগ্ন ছিলেন। একটু পরে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “কী ব্যাপার, মা?”
ছেলেটি আরও জোরে কাঁদতে লাগল। “আমার ছেলেরও খতনা করে দিন, ভাইয়া,” অনুরোধ করলেন সেই নারী। “না, না, আমি চাই না!” ছেলেটি চিৎকার করে পালাতে চাইল। তার মা শক্ত করে হাত ধরে রাখলেন। টানাটানিতে শাড়ির আঁচল মাথা থেকে পড়ে গেল। তার কুঁচকে যাওয়া পেট, উঁচু হাড়, দেবে যাওয়া চোখ আর ছেঁড়া ব্লাউজে লতিফ আহমদের চোখে ভেসে ওঠে মর্মান্তিক এক ছবি।
তিনি নিচের দিকে তাকিয়ে ছেলেটিকে ধমক দিয়ে বললেন, “এই! ঠিক করে দাঁড়াও। তুমি কি দীনের অংশ হতে চাও না? খতনা ছাড়া ইসলাম ধর্মে থাকা যায় না। তাই চাও?” ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে সত্যি কথাটা বলে ফেলল, “আমার খতনা হয়ে গেছে।”
তার মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “কিন্তু ভালো করে হয়নি ভাইয়া… এইবার ঠিক করে করে দিন।”
লতিফ আহমদের সন্দেহ হলো, কিন্তু তিনি নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। তিনি পাশে দাঁড়ানো এক তরুণকে বললেন, “এই, সামি, এই ছেলেটাকে ধরে দেখ তো।”
কয়েকজন কিশোর যারা শুধু মজা দেখার আশায় ঘুরঘুর করছিল, তারা ছেলেটিকে তুলে নিল। একজন তার হাফপ্যান্ট নামিয়ে দিল। শরীরের সঙ্গে মানানসই না হওয়ায় প্যান্টটা সহজেই খুলে গেল।
লোকজন হাসতে যাচ্ছিল। একজন বলল, “খতনা তো ঠিকঠাক হয়েছে।” ছেলেরা তখন আর হাসি চাপতে পারল না, হেসে গড়িয়ে পড়ল। একজন কটাক্ষ করে বলল, “তোমার স্বামীকেও নিয়ে এসো, তাকেও খতনা করিয়ে দিই—তাহলে গম আর নারকেল পাবে।” আবারও হাসির রোল পড়ে গেল।
ছাড়া পেয়ে ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে প্যান্ট পরে দৌড়ে পালাল। তার মা ছেঁড়া শাড়ির আঁচল দিয়ে আবার মাথা ঢেকে পা টেনে টেনে হাঁটতে লাগলেন।
একজন লোক থুতু ফেলে বলল—“থু! কত নীচু মানুষ আছে দুনিয়ায়…এত নিচে নেমে যায়,”।
লতিফ আহমদের মনে কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। এত দারিদ্র্য ও দুর্দশার সামনে কি তিনি নিষ্ঠুর হয়ে পড়লেন? সেই নারীর চেহারাটা বারবার তার চোখে ভেসে উঠছিল।
“ছি, তাকে খালি হাতে বিদায় করা ঠিক হয়নি।” কিছুটা অনুতাপ নিয়ে চারপাশে তাকালেন। কিন্তু সেই নারী যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
লাইন ধীরে ধীরে আগাচ্ছিল। লাল লুঙ্গি পরে ছেলেরা বেরোচ্ছিল। লতিফ আহমদ বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন। তখন পাঁচটা বাজে। স্থানীয় একজন বিখ্যাত সার্জন ডা. প্রকাশ তাকে ছয়টার মধ্যে নিজের পরিবারের বাচ্চাদের নিয়ে আসতে বলেছিলেন। এখনো বাড়ির কেউ আসছে না কেন?
রাজিয়া সকালেই সব ছেলেকে গোসল করিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে সামাদকে বেশি স্নেহ করে গোসল করিয়েছেন। গত ছয় বছর ধরে—সামাদ যখন পাঁচ বছর বয়সে পা দিয়েছে তখন থেকেই রাজিয়া বলে আসছে, “এবার খতনা করাও—দেখো না, কেমন রোগা হয়ে গেছে!”
রাজিয়া আশা করছিল খতনার পর ছেলেটির স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে। কিন্তু লতিফ আহমদ সাহস না পেয়ে বারবার পিছিয়ে গেছেন। অবশেষে সময় এসে এলো তবু যেন তার উদ্বেগ কমেনি।
অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে রাজিয়ার ভাইয়ারা এসেছেন। তার বোনরাও দূরদূরান্ত থেকে এসেছেন। বাড়ি ভর্তি অতিথি। বাচ্চারা নতুন জামাকাপড় পরে ঘুরছে। যাদের খতনা হবে তারা ভাব নিয়ে হাঁটছে।
পুরুষরা মসজিদে গেছেন সমবেত খতনার জন্য, নারীরা ও মেয়েরা লতিফ আহমদের বাড়িতে জড়ো হয়েছেন।
দুপুরের খাবারের পরে শেরওয়ানি, নেহরু কোট আর জরির টুপি পরা ছেলেদের একসঙ্গে বসানো হয়। তাদের গলায় পা পর্যন্ত লম্বা মালা, হাতে চন্দ্রমল্লিকা।
আত্মীয়রা এসে ছেলেদের কোলে নিয়ে আদর করছেন। কারো আঙুলে সোনার আংটি পরাচ্ছেন। কেউ গলায় সোনার চেইন দিচ্ছেন। পাঁচশো আর একশ টাকার নোট এতো যে গোনা যাচ্ছিল না।
বদনজর থেকে বাঁচাতে সবাই নানান কর্মকাণ্ড করছেন। পানপাতা, কলা, কারজি কায়ি সহ নানা খাবার বিলি হচ্ছে। কারো কথা বলার সময় নেই। বাড়ি যেন এক গণ্ডগোলের উৎসবে রূপ নিয়েছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে সেই নারীটি আবার হাজির হলেন লতিফ আহমদের সামনে। তিনি হাঁটুর ব্যথায় একটু বিশ্রামের জন্য কেবলই চেয়ার এনে বসেছেন। হাই তুলতে যাচ্ছিলেন—“আআআ…”— তখনই নারীটি সামনে এসে দাঁড়ালেন।
নারীটি রোগা, বুকে পুরনো ভেজা সোয়েটার। মাথায় বিবর্ণ ওড়না বাঁধা। মুখ ফ্যাকাশে। বুকে একটি কাপড়ের পুটলি আঁকড়ে ধরে আছেন।
“ভাইয়া! এটারও খতনা করে দিন…”
লতিফ আহমদ তাকিয়ে দেখলেন, কাপড়ের পুঁটলিতে হয়ত এক মাসেরও কম বয়সী একটি শিশু। তারপর নারীটির মুখের দিকে তাকালেন। তার মনে উদ্বেগ জাগে—যদি আশেপাশের ছেলেরা এসে কিছু বাজে মন্তব্য করে?
কথা না বলে তিনি পকেট থেকে একশো টাকার একটি নোট বের করে নারীটির হাতে গুঁজে দিলেন।
মুহূর্তে তার মনে হলো, রাজিয়াই যেন সামাদকে কোলে নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
নারীটি পেছনে একবারও না তাকিয়ে চলে গেলেন।
লতিফ আহমদ ভাবলেন, আগের নারীটিকেও যদি কিছু টাকা দিত পারতেন!
কিন্তু তখনই মনে হলো—একজনের পর আরেকজন আসবে… তারপর আরেকজন… এই তো চলতেই থাকবে… এর শেষ কোথায়?
খতনা হয়ে গেলে সবাইকে নিজ বাড়ি পাঠিয়ে লতিফ আহমদ একটু শান্ত হতে পারলেন। এবার নিজের পরিবারের ছেলেদের দেখাশোনার পালা।
সবাই রওনা হওয়ার জন্য তৈরি হও। ছয়টার মধ্যে ডা. প্রকাশের কাছে যেতে হবে। তিনি বলেছিলেন, “আমরা লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া দেব, ব্যথা টের পাবে না। একটা ভালো ঘুমের পর সকালে তারা একেবারে তরতাজা হয়ে উঠবে।”
ডা. প্রকাশের ক্লিনিকে সার্জারি কক্ষের বাইরে পুরো পরিবার জড়ো হয়েছিল। কয়েকজনের কান্নাকাটি ছাড়া অস্ত্রোপচার ভালোভাবে সম্পন্ন হয়।
বাড়ি ফিরে ফ্যান চলে এমন ঘরে ছেলেদের নরম তোশকে শুইয়ে দেওয়া হলো। তাদের সেবার জন্য একদল কাজের লোক ছিলো।
শুধু এক-দুটি ছেলে মাঝে মাঝে একটু কেঁদে উঠছিল। কিন্তু বাইরের ঘরে হাসি, কথাবার্তা আর উৎসবের আমেজে কোনো কমতি ছিল না।
প্রতি আট ঘণ্টা পরপর ছেলেদের বাটা কাজুবাদাম মেশানো দুধ ও ব্যথার ওষুধ খাইয়ে আবার শুইয়ে দেওয়া হচ্ছিল।
পরদিন সকালে প্রায় সবাই সুস্থ হয়ে উঠল। প্রচুর ভালো খাবার ছিল—দুধ, ঘি, কাজুবাদাম, খেজুর…
সকলের জন্য যথেষ্টই… এমনকি ফেলে দেওয়ার মতো অতিরিক্তও।
খতনার পঞ্চম দিনে উঠানে হঠাৎ হৈচৈ লেগে গেল। রাজিয়া নিচে নেমে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখেন আরিফ পেয়ারা গাছে চড়ে আধাপাকা সবুজ ফল ছিঁড়ছে। দুইজন কাজের লোক তাকে নামতে বলছে, কেউ কেউ চিৎকার করছে। গাছের নিচে আমিনা দাঁড়িয়ে কখনো কাজের লোকদের ওকে নামাতে মিনতি করছেন, কখনো ছেলেকে অনুরোধ করছেন। আয়েশ মতো পেয়ারা খেয়ে আরিফ ধীরে ধীরে গাছ থেকে নেমে আসে। নামতেই কাজের লোকরা তাকে ধরে ফেলে। ধরে রাজিয়ার কাছে নিয়ে আসলে সে পকেট থেকে অনায়াসে আরেকটা পেয়ারা বের করে কামড় দিল।
রাজিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোর তো খতনা হয়েছে, ঘা ভালো হয়ে গেল?”
“হ্যাঁ চিক্কাম্মা,” নির্লজ্জভাবে লুঙ্গি সরিয়ে আরিফ উত্তর দিল। রাজিয়া নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না— একটুও ব্যান্ডেজ নেই, কাটা জায়গা পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে, কোথাও পুঁজ নেই।
আর ওদিকে তার ছেলে সামাদের অবস্থা শোচনীয়। পা পর্যন্ত সোজা করতে পারছে না। অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো সত্ত্বেও ঘা পেকে গেছে। সকালে সে নিজে হেঁটে বাথরুমে যেতে পারেনি। দুজনে মিলে তাকে তুলে নিয়ে বসিয়ে দিতে হয়েছে। জখম যাতে না ভেজে সেজন্য স্টেরিলাইজড স্টিলের কাপ রাখা হয়েছে। গোসলের পর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। একজন নার্স এসে নতুন করে ব্যান্ডেজ করে ইনজেকশন দিয়েছে। আর এদিকে আরিফ গাছে উঠে বানরের মতো খেলছে!
রাজিয়া বিস্ময়ে প্রশ্ন করেন, “তুই কী ওষুধ খেয়েছিস রে, কী বড়ি?”
“আমি তো কোনো বড়ি খাইনি, চিক্কাম্মা। শুধু একটু ছাই মেখেছে…”
রাজিয়া ভাবতেই পারেননি গরিব বাচ্চাদের খতনা এত অনাড়ম্বরভাবে হয়। ছাই দিয়ে ঘা শুকানো! তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন—কোনো গরিব শিশু যদি এভাবে মারা যায় তাহলে!
উপরের ঘরে ঘুমিয়ে থাকা অন্য বাচ্চাদের খোঁজ নিয়ে তিনি সামাদের ঘরে গেলেন। সামাদ ঘুমাচ্ছিল। তার পাশের চায়ের টেবিল ভর্তি মিষ্টি, বিস্কুট, শুকনো ও পাকা ফল। রাজিয়া জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখেন আরিফ উঠানে আছে কি না। তাকে ডেকে কিছু বিস্কুট দিতে চায়। কিন্তু তিনি আরিফকে দেখতে পেলেন না। সামাদের গায়ে পাতলা চাদর দিয়ে তিনি রান্না তদারকি করতে নিচে রান্নাঘরে চলে গেলেন।
ছেলেদের জন্য চিকেন স্যুপ রান্না হচ্ছিল, অতিথিদের জন্য পোলাও-কোরমা। কিন্তু দশ মিনিট না যেতেই তার অস্থির লাগতে শুরু করল। তিনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। রান্না ফেলে দৌড়ে ওপরে গেলেন।
সামাদের ঘরের দরজা তিনি আগেই বন্ধ করে রেখেছিলেন যাতে সে নির্ঝঞ্ঝাটে ঘুমাতে পারে। দরজা খুলতেই চিৎকার করে উঠলেন তিনি। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এলো। বাড়ির লোকজন দৌড়ে আসে।
সামাদ রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। সে ঘুম থেকে উঠে মাকে খুঁজতে বেরিয়েছিল, কিন্তু দরজা পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে। মাথা দেয়ালে লেগে গেছে, রক্ত ঝরছে। খতনার ঘা আবার ফেটে গেছে, রক্ত পড়ছে। সামাদকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়।
খতনার ১১ দিনে, লতিফ আহমদের পরিবারের খতনাকৃত বাচ্চাদের গোসল করানো হয়। ওই দিনই সামাদ হাসপাতাল থেকে ফিরে আসে। সন্ধ্যায় বিশাল আয়োজন হয় বাড়িতে। গোটা শহর আমন্ত্রিত। কয়েকটা ছাগল কাটা হয়, বিরিয়ানি রান্নার সুবাস উঠানে ভাসছিল। সামনে ও ছাদে শামিয়ানা খাটানো হয়।
সামাদ তখনও খুব দুর্বল, রাজিয়া তাকে চোখের আড়াল হতে দিচ্ছেন না। তিনি সামাদের মাথা কোলে নিয়ে ডিভান থেকে অতিথিদের সম্ভাষণ জানাচ্ছিলেন।
এমন সময় তিনি দেখলেন কেউ একজন ড্রয়িং রুমে চুপি চুপি হেঁটে যাচ্ছে। “এই, কে রে? এদিকে আয়,” বলে ডাকলেন। ছায়ামূর্তিটি ফিরে এলো।
“আমি চিক্কাম্মা…”— আরিফ!
রাজিয়ার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। পুরোনো ছেঁড়া কলারের জামা পরেও তার মুখে স্বাস্থ্যের দীপ্তি। লাল লুঙ্গি ছেড়ে সে এখন প্যান্ট পরছে—মানে তার ক্ষত পুরোপুরি সেরে গেছে।
রাজিয়া সামাদের দিকে ফিরে তাকালেন, তার চোখে পানি, নিজে নিজেই বললেন, “ধনীর খোদা আছে, গরিবের পরওয়ারদিগার।”
তার দৃষ্টি গেল আরিফের প্যান্টের দিকে—হাঁটুর কাছে ফাটা, প্যান্টের পেছনে এবং জামায় দুটো বড় ছিদ্র।
“থাম, আরিফ,” বলে উঠে দাঁড়ালেন রাজিয়া। আলমারি খুলে পরিপাটি ভাঁজ করা কাপড়ের স্তূপে চোখ বোলালেন। সামাদকে উপহার হিসেবে দেওয়া প্রায় এক ডজন জামাকাপড় তখনও প্যাকেটেই ছিল। একটি ঢিলেঢালা প্যান্ট আর টি-শার্ট বের করে আরিফকে দিলেন।
“নে, এগুলো নিয়ে যা। পরে পরিস। খেতে এলে এগুলো পরেই আসবি, বুঝলি?”
আরিফের চোখ চকচক করতে লাগল। তার চোখে কৃতজ্ঞতার চেয়ে যেন ভক্তি স্পষ্ট। সে স্নেহভরে টি-শার্টটা ছুঁয়ে দেখল, রাজিয়া হেসে ফেললেন। সামাদ উঠে তার কাঁধে মাথা রাখল। রাজিয়ার দেওয়া জামাকাপড় বুকে জড়িয়ে ধরে আরিফ ধীরে ধীরে দরজার দিকে হাঁটল।