বানু মুশতাকের গল্প ‘শাইস্তা মহলের পাথর’  

আমি পালাতে চেয়েছিলাম।

কংক্রিটের জঙ্গল থেকে, আকাশের দিকে উঠে যাওয়া ম্যাচের বাক্সের মতো স্তূপীকৃত জাঁকজমকপূর্ণ অ্যাপার্টমেন্টগুলো থেকে। দিনরাত ধোঁয়া ছাড়তে থাকা, হর্ন-বাজানো যানবাহনগুলো থেকে আমি পালাতে চেয়েছিলাম যেগুলো অবিরাম ছুটছে, যেন বিরতিহীন ছুটে চলাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। এরপর আমি পালাতে চেয়েছি মানুষ, মানুষ, মানুষের কাছ থেকে। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসাহীন মানুষগুলোর কাছ থেকে, যাদের মধ্যে বিশ্বাস নেই, সম্প্রীতি নেই, এমনকি স্বীকৃতিদানের হাসিও নেই। আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম এইসব শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে। আর তাই মুজাহিদ যখন তার বদলির খবর নিয়ে এলো তখন আমি সত্যিই খুব খুশি হয়েছিলাম।   

আরে, আমি তো ভুলেই গেছি। মুজাহিদ সম্পর্কে তোমাদের সবকিছু জানানো দরকার, তাই না? মুজাহিদ আমার ঘরের মানুষ। ওহ। অদ্ভুত শোনাচ্ছে। সাধারণত স্ত্রী হয় সেইজন যে ঘরে থাকে, আর এটাই তাকে ঘরের মানুষ বানায়। তাহলে হয়ত মুজাহিদ আমার অফিসের মানুষ। ছে! আমি আবার ভুল করলাম। অফিসটা আসলে আমার না, কোনোভাবেই না। এছাড়া ব্যাপারটাকে আমি আর কীভাবে বলতে পারি? আমি যদি যাজমান শব্দটি ব্যবহার করি আর মুজাহিদকে মালিক বলি, তাহলে আমাকে দাসী হতে হবে, যেন আমি একটি পশু অথবা একটি কুকুর। আমি একটু শিক্ষিত আছি। একটা ডিগ্রি অর্জন করেছি। এই মালিক ও চাকর সম্পর্ক স্থাপন করা আমার পছন্দ না। তাহলে কি আমি স্বামীর জন্য ‘গন্ডা’ শব্দটা ব্যবহার করব? এটাও বেশি ভারী শব্দ, যেন গন্দনতারা, যেন এক বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে আমার জন্য। কিন্তু এত ঝামেলায় যেতে হবে কেন? তুমি হয়ত পরামর্শ দিতে পারো, স্বামীর জন্য আমি সুন্দর শব্দ ‘পতি’ ব্যবহার করতে পারি, কিন্তু সেখানেও তাহলে আবার কথা আছে, তোমার বাড়িতে আসা কোনো মেয়ে তার স্বামীকে ‘এই যে এটা আমার পতি’ বলে পরিচয় করিয়ে দেয় না, তাই না? পতি শব্দটা আমাদের সাধারণ আলাপচারিতার জন্য তেমন জনপ্রিয় না। এটা খুব বইয়ের শব্দ। কেউ যদি ‘পতি’ শব্দটি ব্যবহার করে, তাহলে সাধারণ রীতি অনুসারে শব্দটির সাথে দেবত্ব যোগ করার তাড়না আসে, যার ফলে স্বামীকে দেবতার সাথে তুলনা করা হবে। মুজাহিদকে আমি অতটা উঁচু মর্যাদা দিতে রাজি নই।    

আচ্ছা ব্যাপারটা একবার ভাবো তো, বলা হয় যে আমাদের মুসলমান নারীদের জন্য উপরে আল্লাহ ছাড়া পৃথিবীতে আমাদের খোদা হচ্ছে আমাদের পতি। ধরো, এমন একটি পরিস্থিতি এলো যখন স্বামীর শরীর ঘায়ে ভরে গেছে, ঘাগুলো থেকে পুঁজ ও রক্ত বের হচ্ছে, বলা হয়েছে স্ত্রী যদি তখন নিজের জিভ দিয়ে ক্ষত পরিষ্কার করে দেয় তবুও সে সম্পূর্ণভাবে স্বামীর ঋণ শোধ করতে পারবে না। স্বামী যদি মদ্যপ হয়, অথবা নারীবিদ্বেষী হয়, কিংবা যদি সে যৌতুকের জন্য প্রতিদিন তাকে অত্যাচার করে, এমনকি যদি এই সমস্ত ‘যদির’ সবগুলো সত্যিও হয়, তবুও সে স্বামী। যে ধর্মেরই হোক না কেন, এটা মেনে নেয়া হয়েছে যে স্ত্রী স্বামীর সবচেয়ে বাধ্য দাসী, স্ত্রী তার স্বামীর চাকর।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পেরেছ মুজাহিদের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক। একই সাথে, তুমি নিশ্চয়ই এটাও বুঝতে পেরেছ এই ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আমি কী ভাবি, কেমন মনোভাব পোষণ করি। এটা আমার দোষ না; আমার জীবনসঙ্গী মুজাহিদের যখন চাকরিতে বদলি হলো, তখন আমরা কৃষ্ণরাজ সাগর বাঁধ প্রকল্পের একটা সুন্দর কোয়ার্টারে চলে এলাম। এরপর সে আমাকে কাঁঠাল ও লেবু গাছ, সামনের উঠোনে ডালিয়া, জুঁই, চন্দ্রমল্লিকা ও গোলাপ গাছ আর পিছনের উঠোনে কারি পাতা, শিম গাছ ও করলা গাছের লতাপাতার কাছে ছেড়ে দিল। অন্যদিকে, সে, প্রতিদিন চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আঠাশ ঘন্টা ব্যস্ত থেকেছে, হয় অফিসে কাজ করে, নয়তো কর্ণাটক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ স্টেশনে গবেষণা করে।

এখনও অবস্থা একই রকম আছে। ঠান্ডা বাতাস আমার শরীর ও মনে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। যেহেতু আমার কথা বলার কেউ নেই, তাই আমি বাগানের মাঝখানে বসে তোমাদের সবার কাছে আমার এই তথাকথিত স্বামী সম্পর্কে অভিযোগ জানাচ্ছি। কিন্তু... আরে! এটা কী দেখছি? মুজাহিদের স্কুটার, তাও আবার এই সময়ে! আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। মাত্র পাঁচটা বাজে। আমার ভ্রু উঁচু হয়ে যাচ্ছে; আমি বসা থেকে উঠছি না। মুজাহিদ আমাকে তার দাঁত দেখাচ্ছে। আমার গুলো আমি ঠোঁটের পিছনে শক্ত করে আটকে রেখেছি। সে মাথা নিচু করে আমার মাথায় হেলমেট পরিয়ে দিল, আমাকে হাত ধরে টেনে তুলে বলল, ‘হুম, তাড়াতাড়ি! তোমাকে আট মিনিট সময় দিলাম। এর মধ্যে রেডি হয়ে বেরিয়ে আসতে হবে। যদি না পারো...’

আচ্ছা তোমরা এক মিনিট অপেক্ষা করো। তোমাদের আমি পুরো গল্পটাই বলি। আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে। স্পষ্টভাবে বললে, আমাদের বিয়ের দশ মাস তেরো দিন হয়েছে। মুজাহিদ এর আগেও বেশ কিছু আবেগী কৌশল প্রয়োগ করতে চেষ্টা করেছিল। একদিন, সে খুব চেষ্টা করে আমার চুলে বেণী করে দিল, বেণী আটকে রাখতে আমার মাথায় একশো আঠারোটি ক্লিপ লাগিয়েছিল। দেখতে খুব সুন্দর মনে হওয়ায় সন্তুষ্ট হয়ে এমনকি সেই বেণীর একটা ছবিও তুলে রাখল। আমাকে আসলে বানরের মতো দেখাচ্ছিল। আরেকদিন আমাকে সে প্যান্ট পরানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তার সবচেয়ে ঢোলা প্যান্টটিও আমার গায়ে ঢোকানোর চেষ্টা করতেই সেলাই থেকে ছিঁড়ে গেল, আমাকে প্যান্ট পরানোর চেষ্টা তাকে ছাড়তে হয়েছিল। তারপর সে চেষ্টা করল আমাকে সিগারেট খেতে উৎসাহিত করতে যাতে লোকজন তাকে খুবই সামাজিক, অত্যন্ত উদার মনের মানুষ ভাবে। সিগারেট আমার পছন্দ না। অন্যরা সিগারেট খেলে আমি বিরক্ত হই, আর তাই মুজাহিদ যখন আমাকে সিগারেট খাওয়ানোর চেষ্টা করছিল, তখন আমি সিগারেট থেকে ধোঁয়া বের করার পরিবর্তে ওটা মুখের সামনে ধরে ছিলাম আর এমন ভাব করেছি যেন কাশি থামাতে পারছি না আর আমার শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বেচারা। খুব বিরক্ত হয়েছিল। কিন্তু আমাদের বিয়ের তিন মাসের মধ্যেই সব বিপর্যয় কেটে গেছে, আর এখন আমরা খুবই ‘স্বাভাবিক’ দম্পতি।    

‘জিজ্ঞেস করতে পারি আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

‘হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করতে পারো। বেলাগোলা কারখানায় ইফতিখার আহমেদ নামে একটা লোক আছে। মাত্র আট দিন আগে তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। বেলাগলায় তার বাড়িতে আমাদের দাওয়াত করেছে। আজ যেতে বলেছেন।’ মুজাহিদ উত্তর দিল।

তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসতে আমার আট মিনিটও লাগল না। চেলুভা আমার পিছনে ছুটে এসে গেটের কাছে দাঁড়িয়েছে। ওকে যখন বললাম, ‘রাতের জন্য কিছু রান্না করো না, ফিরে এসে আমি নিজেই রাঁধব’, সে খুশি হয়ে গেল। 

মনে হচ্ছে মুজাহিদেরও মেজাজ ভালো। খুব ধীরে স্কুটার চালাচ্ছে। ওকে একটা হিন্দি গানের সুর গুনগুন করতে শুনে আমি ভাবছিলাম একটু সুড়সুড়ি দেব কিনা? কিন্তু ততক্ষণে দেখলাম আমরা বেলাগোলা চত্বরে পৌঁছে গেছি।

আমাদের স্কুটার যখন একটা বাড়ির সামনে এসে পৌঁছেছে, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি হেসে আমাদের জন্য গেটটা বড় করে খুলে দিল। স্কুটার থেকে নেমে আমি তাদের বাড়ির বাগান ধরে হাঁটতে লাগলাম। শুধু বাগানটাই আমাদের কোয়ার্টারগুলোর চেয়ে বড়। বাগানের আয়োজন আর সুযোগ-সুবিধাগুলো দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, আমরা কি কোনো বাড়ির বাগানে আছি নাকি পার্কে এসেছি। হাঁটার রাস্তার দুই পাশে একটি করে পেয়ারা গাছ দাঁড়িয়ে আছে যেগুলোর মোটা ডালে লোহার শিকল দিয়ে একটি করে দোলনা বাঁধা। দোলনাগুলোর চারপাশে জুঁই লতা ও বিভিন্ন ধরনের গোলাপ গাছে ফুল ফোটে আছে। আমি হতবাক হয়ে গেলাম।

অনুমান করলাম বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি নিশ্চয় ইফতিখার হবেন। ঠিক তখনই, বাড়ির মালকিন বেরিয়ে এসে সৌজন্য সালাম জানিয়ে তার বাড়িতে আমাদের স্বাগত জানাল। মাত্র আধ ঘন্টার মধ্যে ইফতিখার ভাই ও শাইস্তা ভাবি আমাদের সাথে এত ভালোভাবে মিশে গেলেন, আমি সত্যি আশ্চর্য হয়ে গেলাম! মুজাহিদকে বেশিরভাগ সময় শাইস্তা ভাবির সাথেই কথা বলতে দেখে আমি ভাবছিলাম একটু একা হলে এটা নিয়ে ওকে খোঁচা মারব। কিন্তু বুঝতে পারলাম ভদ্রমহিলা মুজাহিদের চেয়ে শুধু বয়সে অনেক বড়ই নন, বরং বোঝা যাচ্ছে তার মন খুব পবিত্র আর তার মনের মধ্যে কোনো গোপন উদ্দেশ্য নেই, তাই শাইস্তা ভাবিকে নিয়ে মজা করার কোনো ইচ্ছা অনুভব করলাম না আর। ভাবি খুবই সরল আর খোলা মনের মানুষ। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের ছয় সন্তানকে আমাদের সামনে হাজির করলেন। তিন মেয়ে, তিন ছেলে। সবার বড় আসিফা ছাড়া বাকিরা সবাই একেকটা লেজ ছাড়া বানর। যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছেন, শাইস্তা বললেন, “কী করব জিনাত, জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আমি কিছুই করিনি। কী ঘটেছে দেখার জন্য ঘুরে তাকানোর আগেই আমার ছয়টা বাচ্চা জন্মে গেছে। আর আমি কিছু বলতে গেলেই তোমার ভাই সাহেবও বাধা হয়ে দাঁড়ান” মাথা ঝুঁকিয়ে ইফতিখারের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “যখনই আমি অপারেশন করার কথা ভেবেছি, উনি রাজি হন না। সাত নাম্বরটার পরে আমি অবশ্যই অপারেশন করে ফেলব।”   

“কোনো দরকার নেই, শাইস্তা। আমিই তো ওদের দেখাশোনা করি। তুমি চিন্তা করছ কেন? খোদার রহমতে আমি যথেষ্ট রোজগার করি যাতে ওদের সবাইকে ভালোভাবে লালনপালন করা যায়” শাইস্তার কথার মাঝে ইফতিখার বললেন।

“ওহ! যথেষ্ট রোজগার করলেই হয়? আমার মিষ্টি মেয়ে আসিফাকে আমার জন্য লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়েছে। তুমি জানো এটা আমাকে কত কষ্ট দেয়?’

‘ব্যাপারটা এমন না। বরং আমি নিজেই ওর লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছি কারণ মেয়েদের খুব বেশি পড়াশোনার প্রয়োজন নেই, শুধু একটা উচ্চমাধ্যমিকের সার্টিফিকেট হলেই যথেষ্ট। কলেজে পড়ার জন্য ওর মাইসুরুতে ঘুরে বেড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। আগামী বছর আমরা ওর বিয়ে দিয়ে দিতে পারব” ইফতিখার উত্তর দিলেন।

“একদম না। বিশ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়েছিল। গত সতেরো বছরে আমি ছয় বাচ্চার মা হয়েছি। তুমি যদি এত তাড়াতাড়ি আমার মেয়েকে বিয়ে দাও...” কথাগুলো শাইস্তা এক দমে বলে ফেলল।

মুজাহিদ আর আমি চুপচাপ সব শুনছি। আসিফা, যে এই আলোচনার বিষয়বস্তু, ভাইকে কোলে নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আসিফার যৌবনের সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে আর ওর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পরিবারের সিদ্ধান্তের কথা শুনে আমার ভীষণ অস্থির লাগছে। ভেবে দেখলে, শাইস্তা দেখতে আমার থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। ইফতিখার এমনভাবে উঠে দাঁড়ালেন যেন কিছু একটা তার মাথায় এসেছে, বললেন, “এই শাইস্তা, তুমি আর জিনাত ভাবি বাইরে এসে এখানে বসো। আমি কিছু ফুল তুলব...”

শাইস্তা আর আমি বাইরে এলাম। আসিফা তার ভাইকে দুধের বোতল দিয়ে গায়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শাইস্তা একটা দোলনায় বসলেন, আর আমি অন্য দোলনায়। দোলনাটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে, দোলনায় আমি অনেক দ্রুত আর অনেক উঁচুতে উঠে যাচ্ছি। উপরে ওঠা আর তারপর আবার মাটিতে পা ছোঁয়ার সাথে সাথে লাথি ছোড়ার কী আনন্দ! দেখতে পেলাম ইফতিখার ভাই কোমরে প্লাস্টিকের ঝুড়ি বেঁধে ছোট ছোট জুঁই ফুলের কুঁড়ি ছিঁড়তে শুরু করেছেন। মুজাহিদ সামনের উঠোনে বাচ্চাদের সাথে খেলছে। কিছুক্ষণ পরে, ইফতিখার এসে তার স্ত্রীর হাতে প্লাস্টিকের ঝুড়িটা রেখে পেয়ারা গাছে উঠে গেল। শাইস্তা দোলনার উপর বসে ফুলগুলো দিয়ে মালা গাঁথতে আরম্ভ করল।

শাইস্তা ও আমার জন্য ইফতিখার পেয়ারা নিয়ে এসেছেন। স্ত্রীকে দোলনায় তার পাশে বসতে অনুরোধ করেন। মেয়েকে বললেন, “আসিফা, আমাদের জন্য চা বানিয়ে আনো, সোনা।” আসিফা তখনই মাত্র তার ভাইকে ঘুম পাড়িয়ে বাইরে এসেছিল। মেয়েটাকে একটু শান্ত ও দ্বিধাগ্রস্ত দেখাচ্ছে কারণ এখানে মুজাহিদও আছে। বাবার কথায় সে চা বানাতে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। আমরা এখানে আসার এক ঘন্টার মধ্যে এটা ইফতিখারের দশ নাম্বার চায়ের কাপ।

জুঁইয়ের কলিগুলো দুটো সমান অংশে ভাগ করে বানানো দুটো মালার একটি শাইস্তা আমাকে একটা দিল। অন্যটা সে তার নিজের চুলে লাগিয়ে দড়ির মতো ঝুলিয়ে রাখল। তার মোটা, লম্বা বেণিতে ফুলগুলো চমৎকার মানিয়েছে। আসিফা চায়ের কাপ নিয়ে এসে ইফতিখারকে দিল। শাইস্তা তার বড় হয়ে যাওয়া মেয়েটাকে উপেক্ষা করে এতগুলো ফুল দিয়ে নিজেকে সাজিয়েছে, এই ব্যাপারটা আমার কাছে ঠিক মনে হলো না।

“আসিফা, এখানে এসো।” মেয়েটাকে কাছে ডেকে আমার ভাগের ফুলগুলো ওকে দিতে চাইলাম।

সে নিল না। কিন্তু আমি ওকে আমার পাশে বসতে বাধ্য করলাম আর ওর চুলে ফুল লাগিয়ে দিলাম। মেয়েটির চোখে অশ্রু ছলছল করে ওঠে। ইফতিখারের খালি করা চায়ের কাপ ও পিরিচ হাতে নিয়ে আসিফা ঘরের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। 

অন্ধকার হয়ে আসছে। আমি যখন তাদের বাড়ি থেকে বিদায় নেয়ার কথা ভাবছি, তখনই ইফতিখার বললেন, “জিনাত ভাবি, দেখেন, শাইস্তার জন্য আমি এই পেয়ারা গাছটি লাগিয়েছি। এখানকার প্রতিটি গাছ ও ফুল ওর খুব পছন্দের। এই অনাব-ই-শাহী আঙুরের লতাটি আমি ওর জন্য লাগিয়েছি। এই দোলনাগুলো...এগুলো ওর খুব পছন্দ।”

“ইফতিখার ভাই, আপনাদের দুজনকে একসাথে দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে। মনে হচ্ছে আপনি ভাবির পছন্দ-অপছন্দের দিকে খুব খেয়াল রাখেন।”

“শুধু তাই না। আমি যদি সম্রাট হতাম, তাহলে আমি এমন একটি প্রাসাদ তৈরি করতাম যেটা তাজ মহলকেও লজ্জায় ফেলে দিত, আর আমি সেটার নাম রাখতাম শাইস্তা মহল”  

মুজাহিদ এতক্ষণে বাচ্চাদের সাথে খেলা থামিয়েছে। আমাদের কাছে এসে ইফতিখারকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বলল, “ওহ হো হো! থামেন ইফতিখার, আপনি জানেন না আপনি কী মারাত্মক ভুল করছেন। সম্রাট তাজমহল তৈরি করেছিলেন তার মৃত স্ত্রীর সমাধি হিসেবে। আল্লাহ ভাবিকে দীর্ঘজীবী করুন। ভাবি আপনার সামনেই বসে আছেন, আর আপনি শাইস্তা মহল তৈরির কথা বলছেন!”

মনে হলো ইফতিখার এক মিনিটের জন্য থমকে গেলেন। তারপর বললেন, “কিন্তু তাজমহলকে কেউ কবর মনে করে না। এটাকে সবাই মহব্বত-কি-নিশানি, ভালোবাসার প্রতীক বলে মনে করে। আমি সেই অর্থেই বলেছি।”

মুজাহিদ বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে দিল না, জবাব দিল “হ্যাঁ, হ্যাঁ, মৃত ভালোবাসার প্রতীক।”

“কিন্তু ভালোবাসা মরে না, মুজাহিদ।”

“হুম... তা মরে না। কিন্তু এটা সম্পূর্ণই সিনেম্যাটিক হয়ে যায়, ভাই। আপনার আম্মা যদি মারা যান, তাহলে তার মৃত্যুর সাথে আপনার জীবনে মায়ের ভালোবাসাও মরে যাবে, পৃথিবীতে আর কারো কাছে আপনি এই ভালোবাসা পাবেন না। হুহ। কিন্তু যদি কারো স্ত্রী মারা যায়, তাহলে সেটা একটা ভিন্ন ব্যাপার, কারণ যেকেউ তখন সহজেই আরেকটা স্ত্রী পেতে পারে, আর স্ত্রীর ভালোবাসাও।”

মুজাহিদের কথা শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম।

শাইস্তার মুখে একটা ছোট্ট হাসি ফুটে উঠল। তিনি লাফিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, আমার দাদি বলতেন, স্বামীর জন্য স্ত্রী মারা যাওয়া তার কনুইয়ে আচমকা একটা আঘাত পাওয়ার মতো। তুমি কি জানো জিনাত, কনুইতে আঘাত লাগলে এক মুহূর্তের জন্য এমন অসহ্য ব্যথা হয়, সেটাকে মৃত্যুর মতো অসহনীয় লাগে। কিন্তু এই ব্যথা মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়, পরে আর কিছুই অনুভব করা যায় না। কোনো ক্ষত নেই, কোনো রক্ত নেই, কোনো দাগ নেই, কোনো ব্যথা নেই...”

তাদের এই সমস্ত কথাবার্তা আমার পছন্দ হচ্ছিল না। কিন্তু একেবারেই অকস্মাৎ ইফতিখার ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি শাইস্তার হাত ধরে বললেন, “শাইস্তা, তুমি কী বলছ? আমার শরীরের প্রতিটি কোষ এখনো জীবিত আছে শুধু তোমার নামের শক্তিতে। আমার প্রতিটি হৃৎস্পন্দন ধুকধুক করে চলছে তোমার ভালোবাসা আর প্রাণশক্তির জোরেই। তুমি, তুমি এইমাত্র যা বললে, এই কথাগুলো কি তোমার হৃদয় থেকে এসেছে? তুমি কি এটাই বিশ্বাস করো?”

খুব কষ্ট করে হাসি চেপে রাখলাম আমি। আমার মনে আছে শাইস্তা বলেছিল ইফতিখার তার চেয়ে দশ বছরের বড়। পঞ্চাশের কাছাকাছি একজন পুরুষমানুষ কিশোরদের মতো নিজের প্রেমের অমরত্ব ঘোষণা করার চেষ্টা করছে, আর তার নারীটি রানির মতো বসে তার দিকে সদয়ভাবে তাকিয়ে আছে, যেন সে লোকটার প্রতিটি অপরাধ ক্ষমা করে দেবে, এমন দৃশ্য আমি জীবনে আবার কোনোদিন দেখতে পাবো সম্ভাবনা নেই। অবশেষে মুজাহিদ প্রচন্ড হাসিতে ফেটে পড়ল। শাইস্তা লজ্জায় হেসে ফেলল।

অল্প কিছুক্ষণ পরেই আমরা তাদের বাড়ি থেকে চলে এলাম।

যেহেতু আমরা শাইস্তার বাড়িতে অনেক খেয়ে এসেছি, তাই বাড়ি ফিরে মুজাহিদ বলল সে রাতে আর কিছু খেতে চায় না, শুধু এক গ্লাস দুধ খেল। আমারও একই রকম মনে হয়েছে, তাই রান্নার কথা ভাববার প্রয়োজন হলো না। মুজাহিদ একটা বই নিয়ে বসেছে। আর যদিও আমি ফেমিনা ম্যাগাজিনের একটি সংখ্যা উল্টাচ্ছিলাম, আমার সমস্ত ভাবনা ঘুরছিল আজ দুপুরে শাইস্তার বাড়িতে কাটানো কয়েক ঘন্টার অভিজ্ঞতা নিয়ে।  

“আমি জানি... তুমি শুধু ম্যাগাজিন পড়ার ভান করছ...”

“তাহলে বলো, আমি কী ভাবছি?”

“আমি বলব? তুমি শাইস্তার সবচেয়ে ছোট বাচ্চাটার কথা ভাবছ, যার চোখ দুটো গভীর কালো আর ফোলা ফোলা গাল,” মুজাহিদ উত্তর দিল।

“হয়তো। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভাবছি ওখানে তুমি যা বলেছিলে সেটা।”

“আমি জানতাম। আমি জানতাম তুমি এটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করবে। তোমাকে যদি স্পষ্ট করে বলি, জিনাত, তোমাকে বুঝতে হবে: যে সম্রাট প্রেমের জন্য জগৎ বিখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছিলেন তিনি কিন্তু তার স্ত্রীর সাথে মরে যাননি। তার হেরেমখানায় অসংখ্য নারী ছিল।”   

“আমি সম্রাটের ব্যাপারে ভাবছি না।”

“ঠিক আছে। আমি শাহজাহানের প্রসঙ্গ ছেড়ে দিচ্ছি। আমি কি তাহলে আমাদের আধুনিক প্রেমের বাদশাহকে নিয়ে বলব? মূলত, ইফতিখারের নারী সঙ্গ প্রয়োজন। শাইস্তার জন্য তার মনে একটা বিশেষ স্থান আছে কারণ তারা দুজন অনেক বছর ধরে খুব ভালো সম্পর্ক ধরে রেখেছে। ইফতিখার কোনো না কোনো নারীকে পাশে রাখতে চায়, আর সেটা শাইস্তা হোক বা নার্গিস অথবা মেহরুন।”

“যথেষ্ট হয়েছে। থামো। দশ জন্মেও তুমি আমাকে ওতো ভালোবাসতে পারবে না যতটা ইফতিখার শাইস্তাকে বাসে।”

“প্রথমত, আমাদের জন্য পুনর্জন্মের কোনো ব্যবস্থা নেই; এই ব্যাপারগুলোতে আমি বিশ্বাস করি না। দ্বিতীয়ত, ইফতিখার শাইস্তাকে যত ভালোবাসা বর্ষণ করে এই মুহূর্তে আমি তোমাকে তারচেয়ে শতগুণ বেশি ভালোবাসতে পারি...তুমি যতই প্রতিবাদ করো না কেন...”

কেমন চালাকি করে প্রসঙ্গত বদলে ফেলল তা উপলব্ধি করার সুযোগ পাবার আগেই, মুজাহিদ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে আর পাগলের মতো ভালোবাসায় ভিজিয়ে দিতে থাকল—একটা জন্তু!

***

সেদিন ছিল রবিবার, সকাল নয়টা। ইফতিখার যখন শাইস্তাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এলো, মুজাহিদ তখনও বিছানায় শুয়ে। আমি তাদের বললাম মুজাহিদ এখনও ঘুমাচ্ছে, তারা বসে আমার সাথে গল্প করতে থাকে। আমি তাদের জন্য গরম গরম শিঙাড়া নিয়ে এলাম, কিন্তু ইফতিখার একটাও খাননি। নিজের খাবারগুলো তিনি শাইস্তার প্লেটে ঢেলে দিলেন, শুধু এক কাপ চা খেলেন, আর বাজারে চলে গেলেন সবজি কিনতে।

ময়ূর রঙের শাড়ি আর অল্প কয়টা গয়না পরা শাইস্তাকে বিশেষ সুন্দর দেখাচ্ছিল। তার হাতে আমাদের বিয়ের অ্যালবামটা তুলে দিয়ে আমি ভিতরে চলে গেলাম। ফিরে আসার পরে দেখলাম একটা ছবির দিকে তাকিয়ে সে কিছু ভাবছে। এটা ছিল আমার গ্র্যাজুয়েশনের একটা ছবি যেখানে আমি একটা গাউন পরে ছিলাম। আমি পাশে বসতেই সে বলল, “জিনাত, আমার ইচ্ছা আসিফাকেও এমন একটা গাউন পরতে দেখি আর সে এই রকম একটা ছবি তুলবে। এক চেষ্টাতেই আমার মেয়েটা দশম পরীক্ষা পাশ করে গেছে। আমরা ওকে লেখাপড়া করতে দেইনি কারণ বাড়ি আর বাচ্চাদের দেখাশোনা করার কেউ নেই।”   

“ভাবি, সাহায্য করার জন্য বেতন দিয়ে একটা লোক নিয়ে নেন।”

“একজন ছিল। মেয়েটা বাড়িতে বেড়াতে যাবার কথা বলে চলে গেল, তারপর আর ফিরে আসেনি। মনে হচ্ছে কোনো এজেন্ট তাকে দাম্মামে পাঠিয়ে দিয়েছে। কাউকে পাইনি এরপর আর।”

“এমনিতেই আসিফা এই বছর আর কলেজে যেতে পারবে না। আগামী বছর থেকে অন্তত তাকে কলেজে যেতে দিন।”

“সেটা আমি করব। আমাদের সুবিধার জন্য ওই বেচারির উপর নির্যাতন করব কেন? এইরে, জিনাত, আমি জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছি, বাচ্চা জন্মানো বন্ধ করার অপারেশন করা কি বিপজ্জনক?”

“এতে বিপদের কী আছে ভাবি? আমার বড় দুই বোন আর আমার দুই ভাবি তাদের দুটো তিনটি করে বাচ্চা হবার পর নিজেদের অপারেশন করিয়েছে। তারা সবাই ভালো আছে, সুস্থ আছে।”

“তাই নাকি? তাহলে এবারে আমি একটা অপারেশন করিয়ে নেব। তুমি যদি আমার সাথে আসতে পারো, তাহলে আমার মনের মধ্যে সামান্য যে ভয় আছে তাও চলে যাবে।”  

“ভাবি, আপনাকে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে! এই জিনাতকেও আপনার মতো চমৎকার করে পোশাক পরা শেখাবেন প্লিজ,” মুজাহিদ মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসে শাইস্তার পাশে বসার জন্য একটা চেয়ার টেনে নিয়ে কথাটা বলল।

“চুপ! পাজি ছেলে! ভাগো এখান থেকে, একটা অলস কোথাকার!” শাইস্তা বলে, মুজাহিদের পিঠে সে মজা করে হালকা থাপ্পড় দিল।

দুপুরে আমাদের সাথে খেয়ে যাবার জন্য তাদের দুজনকে জোর করলাম। তারা রাজি হলো আর বেলাগোলায় ফিরে গেল সন্ধ্যার দিকে। এই পরিবারটি থাকায় কেআরএস-এ আমার সময় এখন আর আগের মতো নিঃসঙ্গ লাগে না। যখনই ইচ্ছা হয়, আমি শাইস্তার বাড়িতে চলে যাই। তার বাচ্চাদের সাথে খেলতে গেলে আমার সময় কোথায় উড়ে যায়। শাইস্তার জন্যেও ঘটনা একই রকম। সে তার বাচ্চাগুলোকে ভালো করে লেখাপড়া করাতে চায়, বিশেষ করে আসিফা যেন ঘরের কাজ থেকে মুক্তি পায় আর একটা ডিগ্রি অর্জন করতে পারে। এ ছাড়া তার আর কোনো চাহিদা নেই। শাইস্তাকে দেখতে বরাবর সুস্থ ও প্রাণবন্তই লাগে; মুখটা ঝলমলে উজ্জ্বল দেখায়।

***

সেদিন শাইস্তাকে পরীক্ষা করে মহিলা ডাক্তার বলেছিল তার প্রসবের আরো পনেরো-বিশ দিন বাকি আছে। এই কারণে সেই রবিবার সবাইকে আমাদের বাড়িতে দাওয়াত করেছিলাম, জোর দিয়ে বলেছিলাম তারা যেন আসিফাকেও সাথে নিয়ে আসে। দিনটি আনন্দের ছিল; আমার অনেক কাজ ছিল, এক মুহূর্তও বিশ্রাম ছিল না। বাড়িতে পরিবেশ যথারীতি একই রকম: শাইস্তা আর মুজাহিদ একে অন্যকে টিজ করে যাচ্ছে; ইফতিখার শাইস্তাকে তার অমর ভালোবাসার গভীরতা বোঝানোর চেষ্টা করছে; হৈচৈ করতে থাকা বাচ্চাগুলো; আসিফার নীরবতা আর ওর একাকীত্ব—এইসবের মধ্যে আমরা যখন একটি বিশাল ভোজ সম্পন্ন করে তাদের বিদায় জানিয়েছি, তখন রাত নয়টা পার হয়ে গেছে।

যদিও ভোর পাঁচটার দিকে অ্যালার্ম বেজে ওঠায় আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, তবুও মনে হচ্ছিল কম্বলটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে আমি আরও কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকি। এমন সময় বাড়ির দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল। আর কোনো উপায় না থাকায়, আমি বিছানা থেকে নামলাম, নিজের চারপাশে শক্ত করে একটা শাল পেঁচিয়ে নিয়ে বাইরে এসে দেখি, ইফতিখার দাঁড়িয়ে আছেন।

“আরে, ইফতিখার ভাই! আসেন আসেন, এত সকালে আপনি?”

“ঘরে ঢোকার ও বসার সময় নেই, ভাবি। আপনাদের বাড়ি থেকে যাবার পর, রাতে শাইস্তার প্রসবব্যথা শুরু হয়, রাত একটা দিকে। তক্ষুনি আমি কারখানার জিপে করে ওকে মাইসুরু নিয়ে গেছি। এখন সে শিল্পা ম্যাটারনিটি হোমে আছে। রাত তিনটার সময় বাচ্চা হয়েছে। ছেলে।” আমি অনুভব করলাম এই কথাটি বলার সময় ইফতিখার একটু লজ্জা পেলেন।  

বাচ্চা হবার খবর শুনে আমি খুব খুশি হলাম। ওহ! সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া নতুন বাচ্চা আর বাচ্চা জন্মানোর সাথে সম্পর্কিত উৎসবগুলোতে আমি শেষ যুক্ত থাকতে পেরেছিলাম আরো কয়েক বছর আগে। ইফতিখারকে দরজার সামনে সেখানেই দাঁড় করিয়ে রেখে আমি ছুটে গেলাম ঘরের ভিতরে মুজাহিদের কাছে, ঘুমন্ত কুম্ভকর্ণ। গা থেকে কম্বল টেনে নিয়ে ওকে জাগানোর চেষ্টা করলাম। “এই ওঠো-ওঠো জলদি, প্লিজ—শাইস্তার একটা ছেলে হয়েছে। তুমি এখনও ঘুমাচ্ছ!” মুজাহিদ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, বিড়বিড় করে বলল, “আমি কথা দিচ্ছি জিনাত, তোমার ছেলে হোক বা মেয়ে, অবশ্যই আমি সারা রাত ঘুমাব না। বসে বসে শুধু তোমার বাচ্চার দিকে তাকিয়ে থাকব।”  

“থু, কী নিলাজ তুমি। ইফতিখার ভাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। ওঠো, তার সাথে গিয়ে কথা বলো।” আমি যখন এক কাপ চা নিয়ে এলাম, ইফতিখার ততক্ষণে চার পাঁচটা সিগারেট খেয়েছেন। চায়ের কাপটা তার হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “শাইস্তা ভাবির শরীর ভালো আছে, আশা করি?”  

“হুম। এখন ঠিক আছে। কিন্তু কিছু সমস্যা হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিল রক্ত ​​দিতে হতে পারে। পরে আর লাগেনি। শাইস্তা খুব দুর্বল যদিও। আমি এখন উঠব,” কাপটা নামিয়ে রেখে ইফতিখার বললেন, অলস মুজাহিদ বেরিয়ে আসার আগেই তিনি চলে গেলেন। 

মুজাহিদ আর আমি মাইসুরুর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সারা পথ মুজাহিদ আমাকে জ্বালাতন করতে থাকল, বলতে লাগল, এটা যদি আমার বাচ্চা হতো তাহলে সে এই করত সেই করত, বাচ্চাটাকে সে নিজেই লালন-পালন করত, ইত্যাদি ইত্যাদি বাকোয়াজ কথাবার্তা।

আমরা যখন নার্সিংহোমে পৌঁছলাম, দেখলাম ইফতিখারের পুরো পরিবার সেখানে জড়ো হয়েছে। আসিফা সবগুলো বাচ্চা বাইরে নিয়ে গেছে, কারণ তারা ভিতরে শব্দ করছিল। আমাদের দেখে শাইস্তা হাসলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনাকে এত খুশি দেখাচ্ছে কেন?” তিনি উত্তর দিলেন, “বাচ্চাটা খুব সুন্দর, ভাবি। ওকে দেখলে তুমিও খুব খুশি হবে।”  

বাচ্চাটা সত্যিই খুব সুন্দর, নরম আর গোলাপের মতো গোলাপি। শক্ত করে চোখ বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। শাইস্তার ঠোঁটের রঙ হারিয়ে গেছে, আর সে মৃদু হাসছিল। আমি তার পাশে বসে বাচ্চাকে কোলে নিলাম। “শাইস্তা ভাবি, বাচ্চাটা হয়তো কারো বদ-নজরে পড়বে। এত সুন্দর বাচ্চা আপনি কীভাবে বানালেন?” একটু মজা করে বললাম আমি।

“চিন্তা করো না। মুজাহিদকে বললে তোমার কোলে সে এর চেয়েও সুন্দর বাচ্চা দেবে” তিনি উত্তর দিলেন।

ঠিক এই সময় মুজাহিদ ইফতিখারকে নিয়ে ভিতরে এলো। আমার কাছ থেকে সে নতুন বাচ্চাকে তুলে নিল, এক সেকেন্ডের জন্য বাচ্চার দিকে তাকিয়ে থেকে বুকে জড়িয়ে ধরল। মুজাহিদ বলল, “ভাবি, আমি যদি বাচ্চাটা চুরি করে নিয়ে পালিয়ে যাই, তাহলে আপনি কী করবেন?” শাইস্তা কথাটা মোটেই হাত ছাড়া করল না।

“কেমন পুরুষ তুমি, অন্যের বাচ্চা চুরি করতে চাও? আগে তোমার নিজের সেনাবাহিনী প্রস্তুত করো, তখন দেখা যাবে” মুজাহিদকে তিনি টিজ করে বললেন। ইফতিখার জোরে হেসে উঠলেন।

হাসপাতালে আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকলাম। যখন চলে আসার জন্য জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম, তখন আমি শাইস্তার সাথে কথা বললাম। “সবগুলো বাচ্চা দেখাশোনা করা আর ম্যাটারনিটি হোমে আপনার জন্য খাবার পাঠানো আসিফার জন্য কঠিন হয়ে যাবে। আপনি বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত আমি কি সাল্লু, ইম্মু, নবীন আর কামালকে আমার বাড়িতে নিয়ে রাখব?”

“অসুবিধা নেই জিনাত। দরকার হবে না। আসিফা আমার মেয়ে না, ও আমার মায়ের মতো। শুধু এখন না, স্কুল ছেড়ে দেয়ার পর থেকেই সে ঘরের সব কাজ সামলাচ্ছে, সবগুলো বাচ্চার দেখাশোনা করে। এখানে আমি বেশি দিন থাকব না। পরশু বাড়ি চলে যাব” শাইস্তা বলল।    

“তারপর... অপারেশন কবে করাবেন?”

“এখন একটু দুর্বল আছি। ডাক্তার আমাকে পনেরো দিন পর আবার আসতে বলেছে। তখন অপারেশন করব।”

“আচ্ছা এখন তাহলে আমি যাই, পরে আবার আসব।”

***

শাইস্তা ক্লিনিক থেকে বাড়ি ফেরার পর কয়েকবার আমি তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে গিয়ে এক রবিবার যখন আমি আর মুজাহিদ মাইসুরু যাচ্ছিলাম, তখন আমরা একটা জিনিস দেখলাম।

সেদিন আমরা ট্রেনে করে যাচ্ছিলাম কারণ আমাদের বাড়ির জন্য কিছু বাজার করতে হয়েছিল। ট্রেনটি বেলাগোলায় থেমেছিল। দেখে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেলাম: শাইস্তা স্টেশন প্ল্যাটফর্মে ইফতিখারের সাথে দাঁড়িয়ে আছে, তার মাথায় স্কার্ফ আর গায়ে একটা ফুলহাতা সোয়েটার। মুজাহিদ বগির দরজায় দাঁড়িয়ে তাদের দিকে হাত নাড়তেই তারা দুজন দ্রুত আমাদের বগিতে উঠে এলো।

বোকার মতো আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ভাবি এই সময় আপনি মাইসুরু যাচ্ছেন?” এই কয়দিনে শাইস্তা তার পুরনো প্রাণশক্তি ফিরে পেয়েছে। সন্তান প্রসবের পরে মাত্র পনেরো দিন বিশ্রাম নেয়া! যার কোনো কিছুরই অভাব নেই, যে একটি সহজ সাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপন করছে, তাকে কি সত্যি কাজকর্ম দেখাশোনা করতে নিজেই মাইসুরু যেতে হবে? শাইস্তা যেন আমার মন পড়ে ফেলল, বলল, “ওহ, আমি কখনও পনেরো দিনের বেশি বিশ্রামে থাকিনি। ঘরের বাইরে যাবার সময় আমি শুধু পর্যাপ্ত কাপড়ে শরীরটাকে গরম রাখি, এটুকুই, আর তাছাড়া আমি সাথে না থাকলে, তোমার ভাই খুব মন খারাপ করে। আমি সুস্থ আছি জিনাত। কেন শুধু শুধু সারাক্ষণ খাটে শুয়ে থাকব? এমনকি আমার প্রথম মেয়ের জন্মের সময়ও আমি মাত্র পনেরো দিন বিছানায় ছিলাম।”

এরপর আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না। আমি আমার বড় বোন আর ভাবিদের সন্তান প্রসবের পরে বিশ্রামে যেতে দেখেছি। প্রসবের পর তিন মাস ধরে তারা বিছানা থেকে নামেনি। তাদের ঠান্ডা পানি স্পর্শ করতে দেয়া হতো না। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আমার আম্মা তাদের গায়ে বড় বড় তিন বালতি পানি ঢেলে দিতেন, এরপর সাথে সাথেই আবার তাদের বিছানায় শুইয়ে দেয়া হতো, দশটা কম্বল দিয়ে তাদের শরীর ঢেকে দেয়া হতো। একসময় আমার আম্মার মনে হতো যে দশটি কম্বলও যথেষ্ট না, তখন নতুন মা হওয়া প্রতিটি মেয়ের উপর একটি করে পুরো গদি বিছিয়ে দেয়া হতো। পনের মিনিট পর নতুন মায়েরা প্রচুর ঘামতে শুরু করত। আমার আম্মা তখন উঠতে বলতেন, তাদের শরীর থেকে ঘাম মুছে দিতেন যেটাকে আম্মা খারাপ পানি বলতেন। এরপর নতুন মাকে বাছুরের হার্ট অথবা বাছুরের পায়ের স্যুপ খেতে দিতেন। তারপর নতুন মাকে সুগন্ধি সাঁব্রানি ধোঁয়া দিয়ে চুল শুকাতে বলতেন, তাকে শুইয়ে রাখতেন, আমার আম্মা তাদের প্রসব পরবর্তী থলথলে পেটের চামড়ার ভাঁজগুলো হাতের মধ্যে মুঠো করে ধরতেন আর তাদের কোমরের চারপাশে একটা বড় ভয়েল শাড়ি শক্ত করে পাকিয়ে বেঁধে দিতেন যাতে পেটটা সমতল থাকে। এতসব শেষ হবার পরে আমার আম্মা নতুন মাকে এক থালা ঘি দিয়ে মাখানো মেথির গুঁড়ো খেতে দিতেন...কিন্তু যেহেতু তাদের স্বামীরা তাদের ঘি খেতে না করেছে ও ওজন বাড়াতে নিষেধ করেছে, তাই তারা আম্মাকে লুকিয়ে থালাগুলো বিছানার নিচে ঠেলে দিত।

পরে, বাচ্চাকে খাইয়ে, বিশ্রামে বন্দি মা দুপুর একটার দিকে ঘুম থেকে উঠত। ঘুম থেকে ওঠার সাথে সাথে তার জন্য ভাত, গোলমরিচের সারু আর মরিচ দিয়ে ভাজা চার টুকরো নরম মাংস প্রস্তুত থাকত। নতুন মা শুধু ফোটানো পানি খেতে পারত। সন্ধ্যায় প্রচুর পরিমাণে ঘি, বাদাম ও এলাচ দিয়ে তৈরি শাভিগে, অথবা যেকোনো একটা মিষ্টি খাবার থাকত, আর রাতে, পাউরুটি অথবা গমের রুটির সাথে মাংসের মেলোগারা ঝোল। এই কঠোর ডায়েটের চল্লিশ দিন পরে, নতুন মা কিছু গয়না ও একটি নতুন শাড়ি পরত; তখন তাকে দেখতে ঠিক একটা বিয়ের কনের মতো দেখাত।

এই বিশ্রামের বন্দিকালে আমার ভাই দুলাভাই যদি তাদের স্ত্রীদের সাথে খুব বেশি সময় কাটাত, তাহলে আম্মা অসন্তুষ্ট হতেন, বিড়বিড় করে বলতেন, “কী নির্লজ্জতা! এদের স্বামী-স্ত্রীকে আমি যদি একটুখানি একসাথে থাকতে দেই তাহলে...তারা শুধু সুযোগ খোঁজে...আমার কী...তোমরা যদি শরীরে আস্ত থাকো, তাহলে তোমাদের স্বামীরা তোমাদের সাথে থাকবে...আর তোমরা যদি তোমাদের অল্পবয়সী শরীরগুলো নষ্ট করে ফেল, তাহলে তোমরাই কষ্ট পাবে...ব্রামব্রা, শেঠত্রু মেয়েদের দেখো! সন্তান জন্ম দেয়ার পাঁচ মাস পরেও তারা বিশ্রামে বন্দি থাকে। তারা যা যা করে আমরা কি সেগুলো করতে পারি? আমরা কি সেভাবে নিজের যত্ন নিতে পারি? এই কারণেই তারা সবাই এত শক্তিশালী ও সুস্থ।”

আমার আম্মা এই ধরণের কথাবার্তা বলতেন। নতুন মায়েরা উঠে বসলে বলতেন তাদের কোমরে খারাপ পানি ঢুকে যাবে, আর তারা যদি উঠে দাঁড়াত, তাহলে তিনি তাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করতেন, বলতেন তারা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে, বসা অথবা দাঁড়ানোর চাইতে তিনি বরং তাদের শুয়ে থাকতে পরামর্শ দিতেন। আমার আম্মা বলতেন, “জন্মের পর চল্লিশ দিন পর্যন্ত নবজাতক ও নতুন মায়ের জন্য চল্লিশটি কবর মুখ খোলা রাখে। একেকটি দিন পার হবার সাথে সাথে একটি করে কবর মুখ বন্ধ করে। একটি দেহ থেকে একটি নতুন জীবনের জন্ম নেয়া কি সামান্য বিষয়? এটা যেন একটি মায়ের নতুন করে জীবন পাওয়া।”

আমার মনে হলো, আম্মার কথা বিশ্বাস করলে, শাইস্তার জন্য এখনও পঁচিশটি কবর খোলা মুখে অপেক্ষা করছে। আর এখনই সে এমনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে! মুহূর্তের মধ্যে এই সব চিন্তা আমার মনে ভেসে উঠল।

কিন্তু শাইস্তার পঁচিশটি কবরের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। বাচ্চা জন্মের পর চল্লিশ দিনের সমাপ্তিতে শাইস্তার বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান হলো। আমি ছেলের জন্য রুপার নূপুর আর একটা বাবা স্যুট, শাইস্তার জন্য একটা ব্লাউজ পিস নিয়ে অনুষ্ঠানে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। আর ঠিক তখনই একটা টেলিগ্রাম এলো।

“মায়ের অবস্থা গুরুতর। এক্ষুনি আসো।” মুজাহিদ আর আমি বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে কী করব। একটা স্যুটকেসে হাতের নাগালের মধ্যে থাকা কিছু কাপড় ভরে নিয়ে তৎক্ষণাৎ মাইসুরু চলে গেলাম। সেখান থেকে আমরা আমাদের গ্রামের দিকে রওনা দিলাম। আমরা যখন বাড়ি পৌঁছেছি তখন আম্মার অবস্থা মোটেই ভালো না।

একটা বড়সর হার্ট অ্যাটাকের পর আমার আম্মা খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। আর বেশিদিন বাঁচবেন না বুঝতে পেরে তিনি তার সব সন্তানদের পাশে পাবার জন্য আকুল হয়েছেন। আমি ছিলাম সবচেয়ে ছোট আর সবার শেষে বাড়ি পৌঁছানো ব্যক্তি। তৃতীয় দিন, আম্মা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, দেখে মনে হচ্ছিল তিনি যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমার মা। যিনি আমাকে বড় করেছেন আর আমাকে ভালোবাসতেন, যিনি আমাকে জড়িয়ে ধরতেন, তিনি আমার চোখের সামনে একটা কাঠের গুঁড়ির মতো পড়েছিলেন, আমি জানি না এই দৃশ্য আমি কীভাবে সহ্য করেছিলাম।

আম্মার শেষকৃত্য সম্পন্ন হলো। নিজেকে আমার অসাড় মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমরা যদি কেআরএস-এ ফিরে যাই, তাহলে আমি খুব একা হয়ে যাব এবং আরো গভীর বিষাদে ডুবে যাব। মুজাহিদ এক মাসের ছুটি নিয়ে আমার সাথে বাড়িতেই থাকল। আম্মার চল্লিশার অনুষ্ঠানের চার-পাঁচ দিন পর, আমরা কেআরএস ফিরে এলাম।

সেদিন, আমি বাড়িতে বসতে বা দাঁড়াতে পারছিলাম না। বুকের মধ্যে একধরনের কষ্ট ও যন্ত্রণা হচ্ছিল। আমি ভাবলাম, হয়ত এতদিন আমি একটা মানুষে ভরা বাড়িতে ছিলাম আর এখন এখানে এসে হঠাৎ একটা একা বাড়িতে পড়ে যাওয়ায় নিজেকে নিঃসঙ্গ অনুভব করছি। যেহেতু মুজাহিদ এখনও কাজ থেকে ছুটিতে আছে, তাই আমরা দুজনেই শাইস্তাকে দেখতে যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম; সাথে তার আর তার বাচ্চার জন্য কেনা উপহারগুলোও নিলাম।

আমরা যখন তাদের বাড়িতে পৌঁছলাম, আমাদের মনে হলো বাগানের পরিচর্যা হচ্ছে না। বাড়িতে বাচ্চাদের উপস্থিতির কোনো চিহ্ন নেই। বারান্দার একটা চেয়ারে বসে আমি চারপাশে তাকালাম; দেখতে পেলাম শাইস্তার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। মুজাহিদ একটা চেয়ারে বসে পড়ল, কী করবে বুঝতে না পেরে খবরের কাগজটা হাতে তুলে নিয়েছে। আমি শাইস্তার দরজায় শব্দ করে ধাক্কা দিলাম। ভাবছি, বিকাল চারটা পর্যন্ত সে কেমন ঘুম ঘুমাচ্ছে।

“ভাবি... শাইস্তা ভাবি... আমি জিনাত। দুই মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে আসেন। নইলে আমি দরজা ভেঙে ফেলব!”

এরপর দরজা খোলার শব্দ পেলাম। শব্দের সাথে ঘরের ভিতর থেকে ইফতিখার বেরিয়ে এলেন। আমি ধরে নিয়েছিলাম এই সময় তিনি নিশ্চয় কারখানায় থাকবেন। একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম। দরজা থেকে কয়েক পা পিছিয়ে এলাম। ইফতিখার মুজাহিদের দিকে এগিয়ে গেল। আমি ঘরে ঢুকলাম। ব্যস এইটুকুই! আমার মাথা ঘুরতে আরম্ভ করেছে। ঘরের সব জানালা দরজা বন্ধ। ঘরের ভিতরে বেড-ল্যাম্পের মৃদু আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা ময়ূর-নীল শাড়ি পরা মহিলাটি অবশ্যই শাইস্তা নন। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা, হাতে-পায়ে নতুন মেহেদির নকশা আঁকা, মাথায় পুরো ঘোমটা দেয়া আর দুই হাতে সবুজ-ও-লাল চুড়ি পরা মেয়েটার বয়স আঠারোর বেশি বলে মনে হচ্ছে না, আর অবশ্যই সে আমাদের শাইস্তা না। চোখের জল গাল গড়িয়ে পড়ার আগেই আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম, ইফতিখারকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার শাইস্তা ভাবি কোথায়?”

“সে আর নেই। আমরা বুঝে ওঠার আগেই আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেছে।”

“এটা কে?” নির্মমভাবে প্রশ্ন করলাম আমি।

“শাইস্তার চল্লিশ দিনের ফাতিহা শেষ হবার পরদিনই আমি ওকে বিয়ে করেছি। একটা গরিব পরিবারের মেয়ে। আমার বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য কাউকে দরকার, আসলে এটাই বিয়ের কারণ।”  

“ওহ, অবশ্যই...সে...সে বাচ্চাদের ভালোভাবেই দেখাশোনা করছে, এটা তো খুবই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। ইফতিখার ভাই, আপনি যা-ই করেন না কেন, সব ঠিক আছে। কিন্তু শাইস্তা ভাবির কাছে আপনি যে ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করেছিলেন, এই মেয়েটার কাছে সেটার পুনরাবৃত্তি করবেন না। আপনি যদি একটা শাইস্তা মহল তৈরি না করেন, অথবা ভাবির কবরের চারপাশে পাথরের স্ল্যাব বসানোর ব্যবস্থা না করেন, তাহলেও ঠিক আছে...কিন্তু এক সময় আপনি ভাবির সামনে গলা ফাটিয়ে যে অনন্ত ও তীব্র ভালোবাসার কসম কেটেছিলেন সেটা যদি ভাবির কাছে পৌঁছায়, যেখানে সে আছে, আর যদি সে জেগে উঠে সেখান থেকে ফিরে আসে, তাহলে কিন্তু আপনি সমস্যায় পড়বেন।”  

আরো কী সব বলে ফেলতে পারি এই ভয়ে আমি জলদি করে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম আসিফা তার সব ভাইবোনদের স্কুল থেকে নিয়ে এসে বাগানে বসিয়ে রেখেছে, হয়ত ঘরে ঢুকে বাবাকে বিরক্ত করতে চায়নি। আসিফাকে দেখে আমি এক সেকেন্ডের জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম।

“জিনাত আন্টি!” মুহূর্তের মধ্যে সবগুলো বাচ্চা আমাকে ঘিরে ধরল। আসিফা এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে, ওর চারপাশে কতগুলো ছোট ছোট বাচ্চার দল, ওর কোলে দুই মাস বয়সী একটি শিশু। দেখলাম আসিফার দুই চোখে অশ্রু ছলছল করছে। মনে হলো দূরে কোথাও শাইস্তা হয়ত ফিসফিস করে বলছে, “ও আমার মেয়ে না, ও আমার মা...”