মিছিলের মতো এগিয়ে আসছিলাম : আসাদ চৌধুরী

গণহত্যার ছবি
২৫ মার্চ রাতে আমি ঢাকায় ছিলাম না। ওইদিন বিকেলে আমি আর মাহবুবুল আলম জিনু চলে গিয়েছিলাম মুন্সিগঞ্জের কোটগাঁও। জিনু আখতারুজ্জামন ইলিয়াসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। কোটগাঁও গিয়েছিলাম জিনুদেরই বাসায়। তো ওখানে গিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে বসে দেখা হয় সুনির্মল, প্রশান্ত, মোজাম্মেলদের (মারা গেছেন, সাংবাদিক ছিলেন) সঙ্গে। বিকালে অনেক আড্ডা মেরে রাতে ফিরলাম। মধ্যরাতে, আড়াইটা তিনটার দিকে শুনি খুব চিৎকার চেচামেচি। ঢাকার পূর্ব দিকে দেখতে পাই অনেক আগুন। আমরা সবাই মিলে তখন কোটগাঁও থেকে নদীর ধারে গেলাম। গিয়ে দেখি সত্যি সত্যি ঢাকা নারায়ণগঞ্জের ওই দিকটা লাল হয়ে আছে একেবারে। তখন নদীর পাড়ে শুধুমাত্র আমরা কয়েকজন না, একটা মিছিলের মতো এগিয়ে আসছিলাম এদিকটায়। বিরাট অংশের মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অসহায়ত্ব দেখছিল মানুষের। পরদিন থেকে লোকজন খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে মুন্সিগঞ্জে আসছে যাচ্ছে। এসব মানুষ অধিকাংশ ঢাকা থেকে আসছিল। তাদের প্রায় সবারই মুন্সিগঞ্জে বাড়ি। ওদের মধ্যে আমি আমার কিছু বন্ধু-বান্ধবকে দেখলাম। শশাঙ্ক গোপালকে দেখি শরীরে অনেক ব্যান্ডেজ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
আমি ভাবছি, যে পাকিস্তান আর্মি কোরান ও পতাকা ছুঁয়ে কসম খেয়েছে—দেশের জনগণকে রক্ষা করবে, জনগণের সম্পত্তির নিরাপত্তা দেবে এবং সীমানা রক্ষা করা যার পবিত্র দায়িত্ব—তারাই কিনা আমাদের টাকায় বেতন খেয়ে সেই প্রতিজ্ঞা ভুলে এভাবে মানুষ মারবে, বাঙালি মারবে, আমার কল্পনার বাইরে ছিল সেসব।
বাঙালি তো নিজের থেকে চিরকাল কোনো উদ্যোগ নেয় না, আঘাত পেলে পর সিরিয়াস হয়। জিন্নাহ যখন চিৎকার করে বললেন, রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে তখনই তো আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা করলাম। বাংলা ভাষাকে নিয়ে অহঙ্কার, বাঙালি শক্তি নিয়ে অহঙ্কার এ তো আমাদের বরাবরই ছিল।
২৫ মার্চের ওই ঘটনার পর শত্রুদের তথা অত্যাচারী শাসকের দূর করতেই এরকম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। এ প্রতিজ্ঞা তখন আমার এমন তীব্র যে, সেই তীব্রতা আমার এখনও কানে বাজে। বঙ্গবন্ধুর সেই কথা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ বারবার আন্দোলিত করে আমাকে। বলা যায়, সেই মুক্তির সংগ্রামে আমি এখনো লেগে আছি।
আমাকে এখনো সেদিনের ঢাকার সেই আগুন, সেই রঙ, সেই লাল, সেই আর্তনাদ—এসব কিছু আমাকে কিছু একটা ভূমিকা রাখতেও উদ্বুদ্ধ করেছিল।
পরের দিন অনু, সজল নামে দুটি ছেলে (আমি জানি না, এখন ওরা কোথায় আছে?) এবং বঙ্গবন্ধুর সেক্রেটারি মানে বডিগার্ডের মতো ছিলেন মহিউদ্দিন(তার বাড়িও কোটগাঁতে) এরা মুন্সিগঞ্জ থেকে অস্ত্র নিল, নারায়ণগঞ্জের ডিটেলস বর্ণনা দিল। নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকায় কী কী হয়েছে, কীভাবে তারা মেরেছে এসব। ঢাকা থেকে বহু মানুষ মুন্সিগঞ্জে আসছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে কী হচ্ছে সব শুনলাম। আর যেহেতু জিনু চাকরি করতেন বিআইডিসিতে, উনি পুনরায় ফিরে গিয়ে চাকরি করবেন কিনা এ নিয়েও আলাপ হচ্ছিল।
জিনুর পুরো নাম জিন্নাহ। ওনার আব্বার নাম লিয়াকত। বাবা মুসলিম লিগার। সেই বাড়িতে দুপুরবেলা লোকজন আসছে, ভাত খাচ্ছে। মানে প্রস্তুতিটা ভেতরে ভেতরে তখন হচ্ছেই। তখন কলেজ বা স্কুলের মাঠে বিরাট মিটিং হল। সেখানে ক্যাপ্টেন রউফ (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি) বোধহয় তিনি এসেছিলেন। সেখানে তারা প্রতিশ্রুতি নিচ্ছিলেন যে, আমরা এর জবাব দিবোই। দেশকে শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করার যে আগ্রহ, তা ওখানে গিয়েই আমরা অনুভব করেছিলাম তীব্রভাবে।
শ্রুতি লিখন : মিলন আশরাফ