নজরুল-চর্চার স্বরূপ ও ঢাকায় উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য-আলোচনা




noname

সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য-তত্ত্ব আলোচনার ক্ষেত্রে কিছুটা আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেই আগ্রহের অধিকাংশ যে তথ্য ও তত্ত্ব কেন্দ্রিক এবং জ্ঞানকাণ্ডিক ঔপনিবেশিকতার মধ্যে সীমায়িত, তা একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারা যায়। সেদিক দিয়ে প্রণালীগতভাবে এই চিন্তার ধরনও অনেকটা ঔপনিবেশিক প্রপঞ্চেরই অংশ বলা যায়। দুনিয়ার সকল শোষিত একই যন্ত্রণার অংশিদার হলেও যখন শুধু ইতিহাসের কিংবা কালের প্রতীকায়ন হিসাবে তা হাজির করা হয় তখন স্থানিক ও কালিক বঞ্চনা যে আরো প্রকট হয়ে ওঠে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ঢাকায় উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যের তত্ত্ব নিয়ে মূলত আলোচনার সূত্রপাত গত শতাব্দির আশির দশকে এ বিষয়ে দুই একটি বিদেশি বই অনুবাদের মাধ্যমে; বিশেষ করে এডওয়ার্ড সাঈদের প্রাচ্যতত্ত্বকে কেন্দ্র করে। যদিও সে আলোচনার আগ্রহের মধ্যেও একটি বিশেষ মানসিকতার প্রকাশ লক্ষ্য করা গেছে; তবু আখেরে এটি বাঙালি-চিন্তার জগতে একটি নতুন সংযোজন আকারে হাজির হয়েছে। তবে উত্তর-উপনিবেশতত্ত্ব ও নেগ্রিচুড আন্দোলনের গুরু এইমে সিজায়ের মৃত্যুর পর ২০০৮ সালে এ আলোচনা আরেকটু জোরে-শোরে শুরু হয়। এর আগে তাঁর শিষ্য ফ্রান্জ ফাঁনোর দু’একটি বই বাংলাতে অনুবাদ হলেও খুব একটা সরবতা লক্ষ্য করা যায়নি। সিজায়েরের চেয়ে ফ্রান্জ ফাঁনো এ দেশে একটু আগে পৌঁছানোর কারণ হয়তো মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে উপনিবেশ-বিরোধী এই মনো-চিকিৎসকের মৃত্যু। তাছাড়া এখন পর্যন্ত যেহেতু আমাদের বৈশ্বিক জ্ঞান কিছুটা অনুবাদ নির্ভর, সেহেতু যে সকল গ্রন্থ এখনো অনুবাদ হয়নি, তা নিয়ে বেশি লোকের কথা বলা একেবারে সম্ভব নয়।

পাশাপাশি উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য-চর্চার ক্ষেত্রে আরো একটা বিষয় লক্ষ্য করা গেছে যে, এই আন্দোলনের দাবিদার মূলত আফ্রো-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ লেখককুল ও চিন্তকগণ। যাদের পূর্বপুরুষ একটি সময় আফ্রিকা থেকে শুধু উৎপাদনের যন্ত্র হিসাবে মার্কিন মুলুকে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন; কিংবা আফ্রিকার যে সব এলাকায় ফরাসি উপনিবেশ ছিল বা তাদেরই ডায়াসপোরা লেখকগণ এই চেতনার ধারক। কিন্তু তার মানে এই নয়, এশিয়া কিংবা অন্য অঞ্চলের লেখকগণ এই তত্ত্বায়নের অন্তর্ভুক্ত হননি। বিশেষ করে ল্যাতিন আমেরিকার উননিবেশিত লেখককুলের মধ্যে এই চেতনা অন্যভাবে বিকশিত হয়েছে। তাছাড়া তত্ত্বের কোনো কাল নেই, এটি প্রবণতার দ্বারাই চিহ্নিত।

কিন্তু যে বিষয়টি তথ্যজ্ঞ-মহলকে ব্যথিত করে তুলতে পারে তা হলো, এই আলোচনায় পদ্ধতিগতভাবে নজরুলের নাম খুব একটা উচ্চারিত হয় না। এসব আলোচনা যদি কেবল তত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো তাহলে এ আলোচনার দরকার হতো না। কারণ, উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যতত্ত্বের আলোচনা কেবল নির্বিষ তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের পর্যায় হিসাবে দেখা দিয়েছে। বিদেশি শোষকের চরিত্র বিশ্লেষণেও এ তত্ত্ব দারুন ক্রিয়া করে থাকে। আর সেই আলোচনায় নজরুল হাজির না থাকার অর্থ জ্ঞানের নব-উপনিবেশিকতা এখনো ক্রিয়াশীল।

যে সব উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিকের কথা এখানে উচ্চারিত হয়েছে, তাদের প্রায় সকলের জন্ম নজরুলের সাহিত্যিক পরিপক্কতা অর্জনের পর। যেমন নজরুল-জন্মের তের বছর পরে এইমে সিজায়ের, ছাব্বিশ বছর পর ফ্রান্জ ফাঁনো এবং আটত্রিশ বছর পর এডওয়ার্ড সাঈদের জন্ম। কেবল তা-ই নয়, এ ধারার উল্লেখযোগ্য সকল লেখক কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ। এখানে একটি কথা আমাদের মাথায় রাখা জরুরি, লেখক গুরুত্ব ও স্বীকৃতির দিক দিয়েও এই ধারার লেখকগণ কখনো নজরুলকে ছেড়ে যেতে কিংবা প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। যদিও তাদের কাজের ক্ষেত্র এক রকম নয়, তবু তাদের বিষয়-প্রবণতায় রয়েছে মিল। উপনিবেশ-ব্যবসায় কিভাবে অধিকৃত বাসিন্দারা শোষিত ও লাঞ্ছিত হয়েছে- তারই রকম-ফের তুলে ধরা ছিল এই লেখকগণের উদ্দিষ্ট।

উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য আলোচনার ক্ষেত্রে যারা আগ্রহ দেখিয়ে থাকেন, তাদের যে ধরনের মানসিক পক্ষপাত লক্ষ্য করা যায়, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য দ্রোহ; যা শোষিতকে শোষকের বিরুদ্ধে ন্যয়সঙ্গত আন্দোলনে সদা সক্রিয় রাখে। তাছাড়া এই তত্ত্ব সাম্রাজ্যবাদি চিন্তার ধরণ বুঝতে সহায়তা করে। পাশাপাশি এই চিন্তার লেখকগণের সাহিত্য-কর্মে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদিদের সাম্রাজ্য বিস্তারের ধরন; এবং ভূমিপুত্রদের দ্বারা প্রতিরোধেরও একটি বয়ান পাওয়া যায়। উপনিবেশ গড়ে তোলা এবং তা টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে তাদের নির্মমতার চিত্র এসব সাহিত্যে পাওয়া যায়।

তাছাড়া উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তার পুরোধাদের মধ্যে একটি মার্কসীয় চিন্তার পারম্পর্য লক্ষ্য করা যায়। আবার এদের অধিকাংশই দীক্ষিত মার্কসবাদী নন। জীবনের কোনো পর্যায়ে মার্কসবাদী থাকলেও তারা পরিণামে জাতীয়তাবাদি, অবশ্য সাম্রাজ্যবাদি অর্থে জাতীয়তাবাদের ঘোর বিরোধীও ছিলেন তারা। মার্কস তাদের কাছে এই জন্যই হাজির থেকেছেন যে, সামাজিক ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদি সমাজ ব্যবস্থা যে ধরনের বাধা সৃষ্টি করে তারই একটি তাত্ত্বিক প্যারাডাইম আকারে। তাছাড়া মার্কসের বাইরে থেকে এই চিন্তার তাত্ত্বিক সূত্র খোঁজাও বড় দুষ্কর। ১৮৫৩ সালে কার্ল মার্কস লিখিত ‘অন কলোনিয়ালিজম’ গ্রন্থটিই এ ধরনের কাজের মূল অনুপ্রেরণা হিসাবে ক্রিয়া করে থাকে। ভারতের ব্রিটিশ শাসন নিয়ে তিনি যে সব প্রবন্ধ লিখেছিলেন তার ঔপনিবেশিক চরিত্র বোঝার জন্য এটি অমূল্য সম্পদ। এই রচনার প্রায় একশত বছর পর ১৯৫০ সালে এইমে সিজায়ের ফরাসি ভাষায় লেখেন ডিসকাস অন কলোনিয়ালিজম (ডিসকাস সুর লা কলোনিয়ালিজম)। মার্কস তার কলোনিয়ালিজম গ্রন্থে ব্রিটিশ উপনিবেশের অপকারি দিক ও শোষণ নিয়ে আলোচনা করলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্রিটিশের উন্নত চরিত্রের প্রশংসা করেন। তাছাড়া সমাজ বিকাশের ধারার এটি একটি পর্যায় হিসাবেও বিবেচনা করেন।

কিন্তু এইমে সিজায়ের উপনিবেশের মানবিক দিকগুলো মেনে নিতে পারেননি। তার ধারণায় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উপনিবেশবাদিদের কোনো মহৎ উদ্দেশ্য থাকতেই পারে না। তারা কেবল বাজার দখল, কাঁচামাল সংগ্রহ ও মুনাফালাভের জন্য এমন কোনো দুষ্কর্ম নাই, যা তারা করতে পারে না। সিজায়েরের পক্ষে এ কথা বলা হয়তো এই জন্য সম্ভব হচ্ছে যে, তার দেশ মার্টিনিক ছিল ফরাসি উপনিবেশ এবং পরে স্বয়াত্ত শাসন পেলেও ফ্রান্স তা চিরতরে আত্তীকরণ করেছে। কিন্তু মার্কসের চেতনার স্বচ্ছতা ও যুক্তির বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিগতভাবে ইউরোপীয় চিন্তার উত্তরাধিকারীত্ব থেকে মুক্ত হতে পারেননি বলে সিজায়ের সমালোচনা করেছেন।

এইমে সিজায়ের একজন কবি ও তাত্ত্বিক; পাশাপাশি নেগ্রিচুড আন্দোলনের নেতা। তার দেশও ফরাসি উপনিবেশের অধীনে ছিল। এসব বিবেচনায় একমাত্র নজরুলের সঙ্গে তার মনের ও কর্মের ঐক্য পাওয়া যায়। আর এ জন্য এই আলোচনার শুরুতে একটু বেশি ভূমিকা করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। উত্তর-উপনিবেশ সাহিত্যের পুরোধা সিজায়েরের পঁচানব্বই বছর বেঁচে থাকলেও তার রচনার পরিধি খুব একটা বিস্তৃত নয়; তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কাহির দু রি তু অ্যাপে নেতাল’ প্রকাশি হচ্ছে ১৯৩৯ সালে, তত দিনে কাজী নজরুল ইসলাম তার সকল কর্ম প্রায় সাঙ্গ করে ফেলছেন; এবং এই সময় পর্যন্ত নজরুল এমন একজন লেখক হিসাবে পরিগণিত হয়েছেন; কেবল দেশে নন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রায় সর্বত্র তার বাণী আন্দোলিত হয়েছে। তার প্রমাণ আমরা নজরুল জীবনের শুরুতেই পেয়েছি। ১৯২২ সালে অক্টোবর মাসে নজরুলের যুগপৎ কবিতা ও প্রবন্ধের দুটি গ্রন্থ প্রকাশি হচ্ছে, যা একই সময় বাংলা সাহিত্যের নিঃস্তরঙ্গ প্রবাহকে খানিকটা অন্দোলিত করেছিল এবং ঔপনিবেশিক শাসনের বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছিল। দুটি গ্রন্থই বৃটিশ সরকারের নজরে আসে এবং নিজ দেশে মত প্রকাশের ধারকগণ গ্রন্থ দুটি বাজেয়াপ্তের তালিকায় নিয়ে আসে।

‘অগ্নিবীণা’ সরাসরি বাজেয়াপ্ত না হলেও তার প্রচার প্রকাশনার প্রতি নজর রাখা হয়, এবং এই কাব্যগ্রন্থের পাঠক ও বাহকদের প্রতি পুলিশ নজরদারি অব্যাহত রাখে। কিন্তু ‘যুগবাণী’ প্রকাশের পরপরই তৎকালীন বঙ্গীয় সরকার গ্রন্থখানি বাজেয়াপ্ত করেন এবং ১৯৪৭ সালের আগে পর্যন্ত এই নিষিদ্ধ পরোয়ানা জারি থাকে। ফলে বৃটিশ বিদায়ের আগ পর্যন্ত গ্রন্থখানি দ্বিতীয় মুদ্রণের মুখ দেখেনি। মাত্র বিশ বছর বয়সের একজন তরুণ কবি কি লিখেছিলেন এই গ্রন্থে- যা সরকারের এমন নিবর্তন আইনের শিকার হয়েছিল?

নজরুল এই গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেননা, ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশ বিদেশিদের অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার সম্পূর্ণ থাকবে ভারতের হাতে। তাতে কোনো বিদেশি মোড়লীর অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে এ দেশকে শ্মশান ভূমিতে পরিণত করেছেন, তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোচকা পুটলি বেঁধে সাগর পাড়ে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তারা শুনবে না। তাদের সবটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদের এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকু দূর করতে হবে।’

নজরুলের আগে পৃথিবীর আর কোনো কবি প্রবল পরাক্রমশালী বৃটিশ রাজকে এভাবে ধমক দিতে পারেননি। এমনকি এ দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যেও কেউ তখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে ভারতবর্ষের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দাবি করেননি। কংগ্রেস, খেলাফত ও মুসলিমলীগের বাঘাবাঘা নেতারা তখন পর্যন্ত হোমরুল নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। তার মাত্র কয়েক মাস আগে আরেকজন উর্দু কবি হসরৎ মোহানি আহমেদাবাদের কংগ্রেস সভায় পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দাবি করে সরকার ও দলীয় নেতৃবৃন্দের রোষানলের পতিত হন। নজরুলের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা কোনো প্রক্ষিপ্ত বিষয় ছিল না; কারণ বয়সে তরুণ হলেও একটি রাজনৈতিক সংশ্লেষের মধ্য দিয়েই তার বিকাশ হয়েছিল।

১৯২০ সাল থেকে রাজনৈতিক সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ এ লিখিত সম্পাদকীয় নিবন্ধগুলোই ‘যুগবাণী’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তাছাড়া নজরুলও অন্যান্য উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যবেত্তাদের মতো রাজনৈতিকভাবে মার্কসীয় সাম্যবাদে অনুরক্ত ছিলেন। সেই আকাঙ্ক্ষা থেকে ১৯২৫ সালে যে ‘কৃষক-শ্রমিক স্বরাজ পার্টি’ গঠিত হয়, নজরুল ছিলেন তার অন্যতম সভ্য; এমনকি তার মুখপত্র ‘লাঙল’ ও ‘গণবাণী’ পত্রিকার সম্পাদক হিসাবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই মনে হয় পৃথিবীর প্রথম কবি যার কাব্যগ্রন্থের নাম ‘সাম্যবাদী’ যেটি প্রকাশিত হয় অন্যতম উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তক ফ্রান্জ ফাঁনোর জন্মের এক বছর আগে ১৯২৫ সালে। এই পার্টির জন্য তিনি যে সঙ্গীত রচনা করেন তার নাম দেন ‘অন্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীত’— সেখানে তিনি বলেন, ‘জাগো অনশন-বন্দী ওঠ রে যত/ জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত।’

পোস্ট কলোনিয়াল তত্ত্বের যেহেতু একটি আন্তর্জাতিকতাবাদ রয়েছে সেহেতু নজরুলের কণ্ঠস্বর কেবল তার সময় ও কালের মধ্যে সীমায়িত থাকেনি। যেখানেই ক্ষুধা ও বঞ্চনা, শোষণ ও অত্যাচার সেখানেই নজরুল-সাহিত্য সক্রিয় থেকেছে। আর বৃটিশ ভারতে জন্মগ্রহণের ফলে নজরুল-সাহিত্য কেবল ভারতীয় ভৌগোলিক সীমানায় তখনো সীমাবদ্ধ ছিল না; তাহলে নজরুলকে এই তত্ত্বের গুরু হিসাবে পালনের কার্পণ্য কোথায় সেটিও তলিয়ে দেখা দরকার।

নজরুল তাঁর সক্রিয় সাহিত্য জীবনে যত প্রকার গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন তার প্রায় অধিকাংশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে কিংবা তাদের দুষ্ট শাসনের ফলে সামাজিক যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল তার বিরুদ্ধে জনগণকে সজাগ করে তোলা। পাশাপাশি উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য তত্ত্বের পুরোধাদের সাহিত্যের মান বিবেচনাতেও নজরুলের অবস্থানটি এখন পর্যন্ত উর্ধ্বে ও অনড়। যেমন এইমে সিজায়ের একজন কবি ও নাট্যকার হিসাবে মৌল প্রতিভার তেমন পরিচয় রাখতে সক্ষম হননি; তিনি সাহিত্যের সামাজিক ব্যাখ্যাকার হিসাবে তার নতুন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। যেমন তিনি শেক্সপিয়ারের ‘দ্য টেম্পেস্ট’ নাটকের অনুকরণে ‘উনে টেমপেত’ নামে একটি নাটক রচনা করেন, যেখানে তিনি শেক্সপিয়ারের সৃষ্ট অর্ধ মানবসুলভ চরিত্র ক্যালিবান ও এরিয়েলদের ইউরোপীয় অধিকৃত ভূখণ্ডের আদিবাসি কিংবা আফ্রিকা থেকে ধরে আনা দাস হিসাবে চিহ্নিত করছেন। শত শত বছর ধরে যে ক্যালিবন এবং এরিয়েল শেক্সপিয়ারের নাট্য দর্শকের কাছে অর্ধ-মানব হিসেবে পরিচিত ছিল; সিজায়ের তাকে প্রথম মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন। বললেন, ওই ক্যালিবানই আসলে এই দ্বীপের প্রকৃত মালিক; আদিবাসী রেডইন্ডিয়ান বা যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এরিয়েল আফ্রিকা বা অন্য কোনো ভূখণ্ড থেকে ধরে আনা জনমদুখী দাস।
‘কাহিয়ের দু রিতু অ্যা পে নাতাল’ অর্থাৎ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন নামে সিজায়ের একটি কাব্য লিখেন। তখন তার বয়স ২৩ বছর। যদিও সেটি পুরোপুরী ছাপা হতে লেগেছিল ১৯৪৭ সাল। এই কবিতার বিষয় ছিল, তাঁর আফ্রিকান এবং ক্যারিবীয় পূর্বপুরুষদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। এই কাব্যে সিজায়ের লেখেন—
আমার কৃষ্ণতা একটি পাথর কিংবা
দিনের কোলাহলের মধ্যে ছুঁড়ে দেয়া
বধিরতা নয়
কিংবা পৃথিবীর মৃত চোখের ওপর
সরে যাওয়া পানির শাদা দাগ নয়
আমার কৃষ্ণতা সুউচ্চ প্রাসাদ কিংবা
পাদরির আসন নয়
এটি মাটির লাল মাংসের ভেতর গেঁথে গেছে
এটি আকাশের নিঃসীমতায় মিশে গেছে
আমার কৃষ্ণতা গহ্বরের কুজ্ঝটিকা এবং
তার অসীম ধৈর্যের গভীর অসুখ।

এই কবিতাটি রচিত হচ্ছে মূলত নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ রচনার সিকি শতাব্দি পরে। আর চরিত্রের দিক দিয়েও বিদ্রোহীর আত্ম-উদ্বোধনের সঙ্গে মিল রয়েছে। নিজেকে জাগানোর যে প্রচেষ্টা উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তকগণ শুরু করেন, তার গভীর রূপ নজরুলের হাতে আগেই সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকি সিজায়েরের যে কৃষ্ণতার সমস্যা তাও নজরুল তার আগে ব্যক্ত করেছিলেন তার কবিতায়। যেমন :

‘শ্বেত, পীত কালো করিয়া সৃজিলে মানব, সে তব সাধ
আমরা যে কালো তুমি ভালো জানো, নহে তাহা অপরাধ।
তুমি বল নাই শুধু শ্বেত দ্বীপে
জোগাইবে আলো রবি-শশী-দীপে
শাদা রবে সবাকার টুটি টিপে, এ নহে তব বিধান।
সন্তান তব করিতেছে আজ তোমার অসম্মান!
ভগবান ভগবান!’

নজরুলের সাথে এইমে সিজায়েরর জীবন ও সাহিত্য-কর্মের বেশ কিছুটা মিল দেখা যায়। তাহলো উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তকগণ কেবল সাহিত্যের রস সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত থাকেননি; তারা মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির জন্য সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন, বা নেয়ার কথা বলেছেন। সিজায়ের মার্টিনিকের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ফরাসি সরকার তার নামে সেখানকার বিমান বন্দরের নাম করেছে। নজরুল ইসলামও সক্রিয় রাজনীতি ও নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু সিজায়েরের চেয়ে তিনি আরো খারাপ সময়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন; যখন ঔপনিবেশিক প্রভুদের ক্ষমতা মধ্য-গগনে এবং এদেশের মানুষের অবস্থা আরো শোচনীয়; ফলে নজরুলের ব্যক্তিগত প্রাপ্তি কখনো নিজের এবং জনসেবার পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। তাছাড়া নজরুলের আপোষহীন চরিত্র পরবর্তীকালের উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিকদের চেয়ে অনেক বেশি অনমনীয় ছিল। তিনি কোনো কালেই বিদেশি শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেননি; কিংবা তাদের বিরুদ্ধে কলম বিরত রাখেননি। এমনকি লেখক জীবনের শুরুতে পল্টন থেকে ফিরে আসার পর সাব-রেজিস্টারের লোভনীয় চাকুরিকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। নজরুল দারিদ্র্য বরণ করেছেন, তবু ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে আপোষ করেননি।

ইদানীং অনেক নজরুল ভক্তকে বলতে শোনা যায়, নজরুলকে ‘বিদ্রোহী’ কবি বলা তার মর্যাদার জন্য সুখকর নয়। কিন্তু নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার প্রায় তিরিশ বছর পরে উত্তর-উপনিবেশিক তত্ত্বের আরেকজন উদ্গাতা ফ্রান্জ ফাঁনো ১৯৫২ সালে তার ‘ব্লাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক’ গ্রন্থে বলেন- একজন ভূমিপুত্র ঔপনিবেশিক প্রভুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার মাধ্যমে প্রথম নিজ ভূমির দাবি প্রতিষ্ঠা করেন। এমনকি তিনি এও বলেন, নিজ ভূমিতে কোনো ভূমিপুত্র কলোনাইজারদের কাউকে গুলি করে মারার মধ্য দিয়ে সে প্রথম নিজ ভূমিতে দাঁড়ানোর আস্বাদ পান। ফলে নজরুলের বিদ্রোহী-সত্তা সর্বদা উত্তর-ঔপনিবেশিক-সত্তার সমান্তরাল।

এখন প্রশ্ন ঢাকার সাহিত্যাঙ্গনে উত্তর-ঔপনিবেশিক চর্চার ক্ষেত্রে নজরুল কেন প্রায় আলোচনার বাইরে থেকে যান? অনেক তরুণ ও তাত্ত্বিককে গর্ব করে এইমে সিজায়ের, ফ্রান্জ ফাঁনো কিংবা এডওয়ার্ড সাঈদের নাম নিতে দেখা যায়। এমনকি তারা তাদের বিদ্রোহী সত্তার বিকাশের রূপকার হিসাবে উপর্যুক্ত ব্যক্তিদের বিবেচনা করে থাকেন। তারা তাদের পঠন ও কর্মের বিশ্বাসকে একটি উর্ধ্বলোকে তুলে ধরতে চেষ্টা করেন; এবং চারিপাশ্বের বন্ধুদের সঙ্গে নিজের জ্ঞানতাত্ত্বিক উচ্চবর্গীয় ধারণা পোষণ করেন, যা নজরুলীয় ভূমিচেতনার বাইরে। বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রিক তাত্ত্বিক প্যারাডাইমে নজরুলকে অঙ্গিভূত করা মধ্যে কিছুটা বুদ্ধিবৃত্তিক ঝুঁকি রয়েছে। তার চেতনার স্বীকৃতি মানে সর্বদা নজরুলের মতো বিরুদ্ধ স্রোতে থাকা; রাজানুগ্রহ কিংবা প্রাতিষ্ঠানিকতার স্বীকৃতি তার জন্য অবারিত নয়। (পুনঃমুদ্রিত)