একটা বহু পুরনো নেই

Arito-ok-ok

১.

লেখা আসছে, কিন্তু লিখছি না অনেকদিন—

এই সূত্রপাতে অনেকে মারা গিয়েছেন। মাথায় কাগজ জমে।

তোমরা সালভাদোরের মৃত্যু মনে কর,

ফুসফুসে রঙ জমে একটা স্মিত হাসির রসিকতা বিষিয়ে

সে কী অপূর্ব পুঁজ... যেন সূর্যের শ্লেষ্মা
বা রামকিঙ্কর...

শেষদিকে তো নিজের হাসির মধ্যে দিয়ে

বেরিয়ে আসত গাঁইতির ধার,

সেই মতই তো উনি মারা গেলেন, কেউ জানে না।

 

আসলে এত গভীর থেকে নারীশরীর ছুঁতে গেলে

একটি ধীর রুধিরপাতের দৃশ্য চোখে পড়ে।

একটা ভাঙা স্তুপে কাজ করছিল একটি নগ্ন পরিচয় মেয়ে।

হাত বাড়িয়ে তার তরাই পিঠ ছুঁতেই

ফরফর শব্দে ছিঁড়ে গেল এই দৃশ্যটুকুর আগুপিছু নাট্যের আয়োজন।

এই যে লম্বা বিকৃত গ্রানাইট ঢেলাটি পড়ে আছে—

তা একটি রক্তক্ষরণের ভাস্কর্য। চিন্তামণি বুঝতেন

 

২.

তোমার চোখের ওপর চোখ আঁকা হয়েছিল।

হাসির ওপর হাসি গড়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং চিন্তামণি—

এখন সে স্মিত হাসির মাজন-শুভ্র ভার সইবে কোন জীবন?

 

দীর্ঘতম রোদের সকাল আজ—

গুলমোহর জুড়ে একটা ফেরিওয়ালা

কত কী পুরনো জিনিস চেয়ে বেড়াচ্ছে—

আমার একটা চোখের ওপর আঁকা চোখ

আর আছে কষ্টি পাথরে ঠেকানো খাঁটি হাসি—

আমার একটা বহু পুরনো নেই আছে

আমি ডেকে বললাম—

 

বাতাসে শুধু নেই ত্রসরেণু উড়ে বেড়াচ্ছে

তোমার চোখের অম্ল গাল বেয়ে জামার ওপর এমন—

যে মনে হয় কবে কার রক্তের দাগ—

কবে একটা যুদ্ধ হয়ে গিয়েছে

                          সবাই চুপ করে থেকেছে।

আপনি ওবেলায় আসুন

 

৩.

আমাদের সময়ে একটা জড়বস্তুর মানে ছিল আরেকটা জড়বস্তু।

একখণ্ড পাথরের নিকটতম মানে ছিল রেলপথ

আর একটুকরো রুমালের মানে সামান্য একাকীত্ব

এই সূত্রে দেখা যাচ্ছে সমগ্র বনানীর মানে হয়ত

এঁটে যাচ্ছে একটা মানুষে।

এভাবেই শব্দহীন, আমার বস্তুজীবন সাজানো—

এর মধ্যে তুমি দুঃখ পাও— কথাটির মানে এককথায় অযথা—

এর মধ্যে তুমি ফিরে আসো দূর পাল্লার দরজায়,

তখন চাঁদ উঠেছে একটা টনটনে ব্যথার টিলার ওপরে

এ সময় আমি তোমাকে কী কী ভাবে ফাঁকা করে দিই

গভীর রাত অব্দি—

                       পোস্তাবাজারে—  

                                         কচ্ছপদের মধ্যে থেকে—

তারপর সারারাত খোলের মধ্যে করতাল চলে—

এই জগৎসংসারের সমস্ত কণায়

জেগে আছেন বানরদেবতা— তাঁর হৃদয় ফুঁড়ে

একটুকরো বনবাস আমি রেখেছি তোমার জন্য

বাসিগন্ধ কাটাতে কাপড়ের গায়ে লেগে আছে

আকুতিময় ফার্ণপাতা

একখণ্ড শরীর ভরে দিয়েছি বাড়ির বিরহ দিকে

দেখো এখন আমার চারটে পা কাঠের—

দেখো আমার এক পায়ের মানে অন্য পা— আর

অন্য পায়ের মানে— বাকি দুটো পা—

 

আমি কোথাও যেতে পারব না আর

 

৪.

আজ বুঝি যাকে একদিন ভাগ্যরেখা ভাবতুম, তা আসলে মামুলি দস্তানা ছাড়া কিছু নয়। কে জানে কবে কোন ঋতুর প্রকোপে কে পরিয়ে দিয়েছিল। তুমি জানোও না, অথচ দিনের পর দিন, এঁটেল মাটি পদ্মা পাড়ে, বাবলাতলার ভ্যান থেকে ঝরে পড়া নদী-পেরোনোর বীজ— এই আর্দ্র প্রকৃতির স্মৃতিই আমরা বহন করে চলেছি ঈশানী। নিজের কতটা ভিতরে থেকে গিয়েছি দিনের পর দিন। তুমি জানো এই দীঘলতা, সন্ধিবয়স-টয়স সব পেরিয়ে মূল তুমিও কিন্তু মাত্র একটা ফ্রকের। এখনও কোথাও খেলছ, নিজের অন্ধকারে। তখনও তোমার ঠিকঠাক হৃদয়ই গঠিত হয়নি; ভাবা যায়!

 

৫.

মনে করো ইহগুল্মলতার ঝোপঝাড়, এসব পেরিয়ে কেউ আসেনি ঠিকই, কিন্তু এলেই অনেক ছক ছবি পালটে যায়। তান্নষবি’র মত একটা শব্দ উলম্বভাবে বুঝতেই মুনি ঋষিরা বাবলা গাছ খুঁজতে বেরোলেন। খুঁজে উলটে ঝুলে থাকা। যে দুঃখ বেরিয়ে গিয়েছে, নাড়ি নিয়ন্ত্রণ করে তাকে আবার  শরীরে ফিরিয়ে আনা— সাধনা বলতে এই। আজ নক্ষত্রলোক থেকে কল্পনা মেয়েটি ফিরে এলো আদি মাটিতে, তেমনই আর কী! তোমায় হারানোর মহাশূন্যতায় আমি দেখলাম বেতার তরঙ্গ এসেছিলো একদিন। অসীম দ্বিপ্রহরে যেন ভিন্ন সংসার থেকে ভেসে আসছে অনুরোধের আসর, তারামণ্ডলের। এর পর থেকে অন্যমনস্ক হতেই আমার অক্সিজেন লাগে, বদলে গিয়েছিল ঈশ্বরচেতনাও... ওজনশূন্য আমি শ্রদ্ধানন্দ পার্কের পাশে আবিষ্কার করলাম বাবার শেষতম লাইন। মানে, ওই স্ট্রিটল্যাম্পের আলোটুকু, ভেসে আছে।


আরও পড়ুন—