শ্রীলঙ্কার কথাসাহিত্য : আলো ও আঁধারে

noname

শ্রীলঙ্কার সাহিত্য সম্পর্কে যে প্রচলিত ধারণা সাধারণ মানুষের মনে তার সঙ্গে নানান বিষয় জড়িয়ে রয়েছে; বিশেষত শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ধর্মীয় ও সামাজিক ইতিহাস এর সঙ্গে নিবীড়ভাবে সম্পৃক্ত। যে বৈচিত্র্যপূর্ণ ধর্মীয় রাজনৈতিক ও জাতিগত চেতনাপ্রবাহ এর সামগ্রিক জীবনধারাকে সময়ের সঙ্গে বার বার পরিবর্তন করেছে বা নতুন চেতনার জন্ম দিয়েছে—সে বিষয় বিবেচনা করলে শ্রীলঙ্কার সাহিত্য পৃথিবীর অন্যতম সেরা ধ্রুপদ ভঙ্গির সাহিত্য হিসেবে পরিণত হবার কথা। বাস্তবতা হলো এদেশের সাহিত্য গভীর অর্থে বৈচিত্র্যময় ও শিল্পসফল সাহিত্য হয়ে ওঠার সমস্ত কাঠামো বা উপাদানগত সংযোগ পেলেও কাঙ্ক্ষিত মানের সাহিত্য হয়ে ওঠেনি। এর অর্থ এই নয় যে, এদেশের সাহিত্য প্রচল ধারার চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বরং আমার ধারণা যে রকমটা হয়ে ওঠার কথা ছিল সেটা হয়ে ওঠেনি। এর কারণ ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন এবং বিষয়টি তর্কসাপেক্ষ। ধরে নেওয়া হয়ে থাকে যে খ্রিস্টের জন্মের আগে অর্থাৎ মহামতি গৌতমের বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তনের সময় থেকে এখানে সাহিত্যের  সূত্রপাত। গৌতমের জীবন বা তার পূর্বজীবনের জাতকের কাহিনি, সম্রাট অশোকের পুত্রের রাজ্যগঠন এবং নতুন রাজ্যগঠন ও জনসমাজ-সংস্কৃতি গঠনের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যধারার সূত্রপাত হয়। তবে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার দীপ্রচেতনার অভাব রয়ে যায় বরাবরই; সম্ভবত সে কারণেই সাহিত্যেও মৌল ও ধ্রুপদীধারা লক্ষ করা যায় না সেভাবে। এমনকি ১৯৪৮ সালে বিনাযুদ্ধে স্বাধীন হবার পর প্রায় পাঁচ দশক ব্রিটিশ ডমিনিয়ন শাসন থেকে যায় এখানে। তার অর্থ ইংরেজি ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির বলয় থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পেয়ে সত্যিকার অর্থে তা গ্রহণ করতে পারেননি শ্রীলঙ্কানরা। তারপরও বৈচিত্র্যময় জীবনধারা তাদের সাহিত্যে যে প্রণোদনা দিয়েছে তার জন্য এদেশের সাহিত্য বেশ উন্নত হয়ে উঠেছে বলে মনে করা হয়।

শ্রীলঙ্কার সাহিত্য সম্পর্কে মৌলিক ধারণা পেতে হলে কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। প্রথমত, এর দীর্ঘ রাজনৈতিক  ধর্মীয় ও জাতিগত ইতিহাস। দ্বিতীয়ত, এর ওপর অন্য রাষ্ট্রের আগ্রাসন এবং তার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। পর্তুগিজ, ডাচ, ইংরেজ জাতির দখলদারিত্ব। তৃতীয়ত, সাহিত্যে লোকসমাজের প্রভাব। চতুর্থত, ভারতীয় সাহিত্যের প্রভাব। এর বাইরে রয়েছে শ্রীলঙ্কার  দীর্ঘদিনের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ঘটনাক্রম। খ্রিস্টপূর্বকাল (৫৪৩) থেকে শ্রীলঙ্কার যে ইতিহাস পাওয়া যায় তা লক্ষ করলে দেখা যাবে জাতি হিসেবে শ্রীলঙ্কানরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। আদিপর্ব (খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩-৩৭৭) থেকে প্রাচীন অনুরাধাপুরা পর্ব (খ্রিস্টপূর্ব ৩৭৭ -১০১৭ খ্রিস্টাব্দ) এবং পোলোনোরুয়া কাল থেকে বিভিন্ন কিংডম (জাফনা, ডাম্বাডোনিয়া, গামবোলা, কোটে ও সিটাওয়াকা) এর কথা বিবেচনায় নিলে শ্রীলঙ্কায় রয়েছে বিশাল ও ব্যাপক রাজ্যশাসনের পালাক্রম। ক্যান্ডি শাসনামলের পরে (১৫৯৪-১৮১৫) আসে ইংরেজ। তার আগে অবশ্য ডাচ ও ওলন্দাজেরা এদেশে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। মূলত তারা ক্যান্ডি শাসকদের সঙ্গে নানা যুক্তির সাহায্যে রাজ্য শাসন করতে থাকে। ইংরেজরা ১৮১৫ সালে রাজ্য পুরোপুরি দখল করে নেয়। ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হলেও শ্রীলঙ্কায় কোনো  প্রতিরোধ আন্দোলন হয়নি। বিনাযুদ্ধেই ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ সরকার তাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়। তারা ভারতের আন্দোলনে ভীতু হয়েই একাজ করেছিল বলে অনেকে মনে করেন। আশ্চর্যের বিষয় সাধীনতা পেয়েও তারা স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ থেকে বিরত থাকে অর্থাৎ আরো পাঁচদশক তারা ব্রিটিশ ডমিনিয়নের অর্ন্তভুক্ত থাকে। অর্থাৎ ১৯৭২ সালে তারা কার্যত নিজেদের হাতে দেশের সার্বিক শাসন ক্ষমতা তুলে নেয়। ১৮১৫ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে ইংরেজি ভাষার ব্যাপক আধিপত্যের কারণে ইংরেজি ভাষা এদের জাতীয় ভাষার মর্যাদা পায়। ইংরেজি ভাষার প্রভাবে সিংহলি ও তামিল ভাষার সাহিত্যের গুরুত্ব কমে যায়। ফলত ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনার প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে থাকে যা আজো প্রবহমান।

যারা অপেক্ষাকৃত শক্তিমান লেখক তারা প্রায়  সবাই কোনো না কোনোভাবে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। সিংহলিতে প্রথমে লিখে পরে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন অথবা প্রথমে সিংহলি বা তামিলে লিখেছেন। এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিত দেশ হিসেবে পরিচিত শ্রীলঙ্কান সাহিত্য সবার চেয়ে সেরা সে দাবি করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ তারা একক মাতৃভাষায় সমৃদ্ধ সাহিত্য রচনা করার তাগিদ কখনো  অনুভব করেনি। এখনো ইংরেজি ভাষায় রচিত বা অনূদিত সাহিত্যই তাদের প্রধান ধারা হিসেবে পরিচিত।

গত সত্তর বছরে ইংরেজি ভাষায় অজস্র সাহিত্য রচিত হয়েছে এবং  সেসব বিভিন্ন সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। দেশের বাইরে বিখ্যাত প্রকাশনী থেকে এসব সংকলন বের হয়েছে। ১৯৯৬ সালে ভারতের পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত হয়েছে নিউ রাইটিং ইন শ্রীলঙ্কা এবং মডার্ন শ্রীলঙ্কান স্টোরিজ। জেমস গুনেবর্ধনের ওয়ান ম্যাড বিড ফর ফ্রিডম (১৯৯০) এবং দ্য ট্রাইবাল হ্যাঙ্গওভার (১৯৯৫) বইটি এসময় প্রকাশিত হয়। কার্ল ম্যুলারের অনেকগুলি কথাসাহিত্যের গ্রন্থ আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো; জ্যাম ফ্রুট ট্রি (১৯৯৩), ইয়াকাডা ইয়াকা (১৯৯৪), ওয়ান্স আপন আ টেন্ডার টাইম (১৯৯৫), আ ফানি থিং হ্যাপেন্ড ওন দ্য ওয়ে টু দ্য সিমেট্রি (১৯৯৫), কলম্বো (১৯৯৫), চিলড্রেন অব দ্য লায়ন (১৯৯৭)। জ্য আরাসানাইয়াঙ্গাম লিখেছেন অল ইজ বার্নিং (১৯৯৫), এবং ইন দ্য গার্ডেন সেকরেটলি এন্ড আদার স্টোরিজ (২০০০)। অশোক ফেরির বইয়ের নাম ম্যানি রোডস টু প্যারাডাইস (২০১৫)। সব বইগুলো ভারতে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। তবে সবচেয়ে আলোড়িত গ্রন্থের  লেখক হলেন সিহান করুনাতিলকা। তাঁর ফিকশন চিনাম্যান : দ্য লিজেন্ড অব প্রদীপ ম্যাথিউ ২০১২ সালে কমনওয়েলথ রাইর্টাস পুরস্কার পায়। এটি ভারত ও ব্রিটেন থেকে এক যোগে ছাপা হয় এবং বহুল পরিমাণে বিক্রিও হয়।

কলোনিয়াল সময়ে ইংরেজিতে বেশি লেখা হয়েছে। লুসিয়েন দ্য জিলওয়া এসময় লেখেন দ্য ডাইস অব দ্য গড (১৯১৭)।  এটিই ছিল শ্রীলঙ্কানদের লেখা প্রথম ইংরেজি ভাষায় উপন্যাস। পরে তিনি ১৯১৯ সালে লেখেন দ্য চান্ডালা উইম্যান। প্রথম নারী ঔপন্যাসিক রোজাল্যান্ড মেন্ডিস লেখেন তার প্রথম উপন্যাস দ্য ট্র্যাজেডি অব মিস্ট্রি; আ সিলন স্টোরি। উপন্যাসটি বের হয় লন্ডন থেকে ১৯২৮ সালে। এস জে কে ক্রোথারের সামাজিক বিদ্রূপাত্মক নভেল দ্য নাইট এরান্ট প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে। জিনাদাসা  বিজয়াতুঙ্গার উপন্যাস গ্রাস ফর মাই ফিট বের হয় লন্ডন থেকে ১৯৩৫ সালে। তাকে কেউ কেউ মার্ক টোয়েনের সঙ্গে তুলনা করেন।

ভারতীয় জাতীয়  স্বাধীনতা আন্দোলন ও সাহিত্য আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে শ্রীলঙ্কান সাহিত্যে। সোজা কথায় এদেশীয় লেখকেরা ভারতীয় জীবন ও সাহিত্যধারা দ্বারা প্রভাবিত  হতে থাকেন। বিশেষ করে কয়েকজন বিখ্যাত লেখক শ্রীলঙ্কান লেখকদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠেন। ১৯৩০ ও ১৯৪০ দশকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সরোজিনী নাইডু ও আর কে নারায়ন  ইউরোপে খ্যাতি পেতে শুরু করলে ক্যান্ডি লেক পোয়েটরা এদের দ্বারা ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হন। জিনদাসা বিজয়াতুঙ্গা গভীরভাবে প্রভাবিত হন।  এস ডব্লিউ আর ডি বান্দারনায়কে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কবির শাপমোচন নাটকে অভিনয় করেন।

এসময়ের শ্রীলঙ্কার একজন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার হলেন এডিরিবিরা শরচচন্দ্র (১৯১৪-১৯৯৬)। তিনি সিংহলি ও ইংরেজি ভাষার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক। তাকে বিংশ শতাব্দির সেরা লেখকও মনে করা হয়। তিনি বিশ-ত্রিশের দশকে যখন কলেজে পড়তেন তখন রবীন্দ্রনাথের গল্প পড়েন। গীতাঞ্জলির মরমীভাব শরচচন্দ্রের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। রবী ঠাকুরের লেখা, তার প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন  এবং এর লেখাপড়ার ধরন শরচচন্দ্রকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে। কলেজে তিনি রবী ঠাকুরের নৃত্যনাটক দেখার সুযোগ পান। এর কিছু দিন পরে তিনি প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের নাচ দেখার সুযোগ পান। তিনি বাংলা গান ও নাচের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। এবং মনে করেন এটিই তার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। তিনি  এর পাঠ নেবার জন্য শান্তি নিকেতনে চলে যান। আর যখন ফিরে আসেন তখন তিনি অন্য মানুষ। ইউরোপীয় পোশাক ত্যাগ করে তিনি ভারতীয় কুর্তা পরা শুরু করেন। তার বিখ্যাত রচনাগুলো হলো; কারফিউ এন্ড দ্য ফুল মুন (১৯৭৮), উইথ দ্য বেগিং বাউল (১৯৮৬), ফোম  আপন দ্য স্ট্রিম (১৯৮৭), অব আ কুইন এন্ড আ কোর্টেসান (১৯৭০), দ্য ডেথ অব আ ফ্রেন্ড  (১৯৮১)। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তার কথাসাহিত্যের জন্য। তার অনুবাদকে সমালোচকেরা মৌলিক রচনা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। নিজের রচনা নিজেই ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। র‍্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার তার জন্য বিরল সম্মান বয়ে আনে। নোবেল পুরস্কারের তালিকায় তার নাম ছিল বলে কোনো কোনো সমালোচক বলেছেন। আমরা লক্ষ করবো যে শরচচন্দ্র তার সারা জীবনে অজস্র রচনার মধ্য দিয়ে তার নিজস্ব দর্শন  ও বোধজাত অধীরতা প্রকাশ করেছেন। তিনি পরবর্তীকালে দেশের সবচেয়ে খ্যাতিমান সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

ইংরেজ শিক্ষক ও লেখকদের মধ্যে ভাষা নিয়ে যে শুদ্ধবোধ ছিল তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেননি তারা। ১৯৩০ ও ১৯৪০ দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ই এফ সি লুডয়ুক ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে শুদ্ধতা ও মান নিয়ে যে প্রত্যাশা করতেন সে হিসেবে একজন লেখকের নাম উল্লেখ করা যায়। তিনি হলেন প্যাট্রিক ফারনান্দো। তিনি মাত্র একটি বই লিখেছিলেন গদ্যে। এর নাম দ্য রিটার্ন অব ইউলিসিস। একটি বিষয় এখানে মনে রাখা  প্রয়োজন যে ইংরেজি শিক্ষিত ও শহুরে লেখকগণ গল্প বা উপন্যাস লেখার সময় বিষয়বস্তু হিসেবে নিয়েছেন গ্রামীণ জীবন ধারা ও সংস্কৃতি এবং সত্যিকার অর্থে শ্রীলঙ্কার মাটির গন্ধ পাওয়া গেছে তাদের লেখায়। আমরা এ প্রসঙ্গে জেমস গুনেবর্ধনে ও পুনিয়াকান্তে বিজেনায়কের কথা স্মরণ করতে পারি। পুনিয়াকান্তে বিজেনায়কে বরং আরও নিবীড়ভাবে তার লেখায় সাধারণ মানুষ ও তাদের জীবনধারা ও সংস্কৃতিকে উপজীব্য করেছেন। উদাহরণ হিসেবে তার গল্পগ্রন্থ দ্য থার্ড উইমান (১৯৬৩) এবং প্রথম উপন্যাস দ্য ওয়েটিং আর্থ (১৯৬৬) এর কথা উল্লেখ করা যায়।  আবার রোজালিন্ড মেন্ডিস তার গল্পগ্রন্থ মাই সান লিয়া (১৯৭৫) তে গ্রামীণ নারীর ব্যক্তিজীবন, প্রেক্ষাপট, পরিবেশ ও গ্রামীণ জীবনের পারস্পারিক সম্পর্কসূত্রকে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন।

রাজনৈতিক অস্থিরতা, অভ্যুত্থানের বিষয়ও আমরা বিভিন্ন কথাসাহিত্যিকের লক্ষ করি। শরচচন্দ্র তার কারফিউ এন্ড আ ফুল মুন (১৯৭৮)  এবং রাজা প্রকটর  এর উপন্যাস ওয়েটিং ফর সুরাবিয়েল ( ১৯৮১) এ সব বিষয়ে গভীরভাবে বর্ণনা করেছেন। সামাজিক জীবনের অদ্ভুত ধরনের কিছু চিত্র  পাওয়া যায় আলাগু সুবরামানিয়ামের গল্পে। তার প্রফেশনাল মোরর্নাস (১৯৬৪) গল্পের বইয়ে ঐতিহ্যবাহী একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার  বর্ণনা দেয়া হয়েছে যেখানে একদল লোক যারা পেশা হিসেবে কোনো বড় লোকের বাড়িতে কেউ মারা গেলে কান্না করে। জাফনায় তামিলদের মধ্যে নিম্ন শ্রেণির লোকদের মধ্যে এই পেশা প্রচলিত আছে। লেখক তামিলদের মধ্যে অমানবিক জাত-পাত প্রথা  নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ তার গল্পে উপস্থাপন করেছেন। সিটা কুলাতুঙ্গার দ্য হাই চেয়ার ও চিত্রা ফার্নান্দোর অব ব্রেড এন্ড পাওয়ার গ্রন্থে সামাজিক অসমতার গভীর ছবি আমরা দেখতে পাব। 

জাতিগত দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ শ্রীলঙ্কার কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। সুভিমালী করুনারত্নার উপন্যাস লেক-মার্শ ( ১৯৯৩) এ আমরা এরকম চিত্র পাই। কীভাবে জাতিগত বিভেদ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে এবং তা কী রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে তার চিত্র দেখা যায় এই উপন্যাসে। ফরস্টার যেমন তার উপন্যাস আ প্যাসাজ টু ইন্ডিয়াতে মারাবার কেভসের কথা বলেছেন তেমনি করুনারত্না বলেছেন ক্যান্ডি লেকের কথা। অন্যদিকে  জেভিপি এল টি টি ই-র অমানবিক কার্যকলাপ নিয়েও সম্প্রতিকালে তাৎপর্যপূর্ণ উপন্যাস রচিত হয়েছে। পদ্মা এডরিসিংহে দ্য কার্স উপন্যাসে (১৯৯৮) এই সব জঙ্গিবাদী বা উগ্রবাদী সংঘটনের ইতিহাস কার্যাবলী এবং এদের দ্বারা মানবতা বিপর্যয়ের চিত্র এঁকেছেন। তিনি পোস্টমর্ডানিস্ট থিওরির আশ্রয়ে অনেকটা সালমান রুশদি বা গুন্টার গ্রাসের মতো করে এসময়ের প্রেক্ষিত ও জীবনাচরণকে রূপকের সাহায্যে তুলে ধরেছেন।

ইংরেজিতে ফিকশন লিখলেও এরা অনেকেই বাইলিঙ্গুয়াল। তারা মাতৃভাষা ও ইংরেজিতে লিখে চলেছেন। ইংরেজির প্রচার প্রসার ও অন্যান্য সুযোগ-সম্ভাবনা বেশি। সে কারণেই বোধ হয় সব বড় লেখকরাই ইংরেজিতে লিখতে চান। যাহোক, অনেক দ্বিভাষিক লেখককে আমরা পাব এই ধারায় যারা সুনাম অর্জন করেছেন ইংরেজি ও  সিংহলি ভাষায় কথাসাহিত্য রচনা করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, এডিরিবিরা শরচচন্দ্র,পদ্মা এডিরিসিংহে, তিসা আবেসিকারা ও দয়া দিসানায়েকে।

পৃথিবী গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হওয়ার কারণে এই লেখকগণ তাদের লেখায় বহুমুখী বিষয় ও প্রকরণ যুক্ত করেছেন। যান্ত্রিক জীবন, প্রযুক্তিগত সংস্রব, ঐতিহ্যবাহী জীবনধারা  সমানতালে ব্যবহৃত হয়েছে এদের রচনায়। এর পাশাপাশি রচনার মধ্যে নানা ধরনের নিরীক্ষাধর্মিতাও লক্ষ করা গেছে অনেক সময়। এই ধারার কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যায়। তামিল লেখক এ শানথান ও নীল ফারনান্দোপুলে; মুসলিমদের মধ্যে আছেন আসগর হুসেন ও আমেনা হুসেন। আর রামাইয়া  চামেলি জিরাসিংহে ও দয়া দিসানায়কে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে অসামান্য সফলতা পেয়েছেন।

শ্রীলঙ্কার জীবনধারা, ইতিহাস, রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ধারাবাহিক পটপরিবর্তনের কথা বিবেচনা করলে এর সাহিত্য বিশেষত এর কথাসাহিত্যের চরিত্র অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠার কথা। আমরা অজস্র উপন্যাসে এই বহভঙ্গিম জীবনাচরণ লক্ষ করেছি। তবে আরো গভীরভাবে ও বিস্তৃতভাবে এই চিত্র কথাসাহিত্যে উপস্থাপিত হবার সুযোগ ছিল।