ভারতীয় সমকালীন সাহিত্য

noname

ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে যে কয়টি দেশ সাহিত্যাঙ্গনে দাপটের সঙ্গে বিশ্ব দরবারে পাঠকপ্রিয়তাসহ রাজত্ব করছে ভারত তার মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য পড়াতে গিয়ে ভারতের সাহিত্যিকদেরকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতেও ভারতীয় সাহিত্যের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। এমনকি ‘ভারতীয় সাহিত্য’ নামেও কোর্স পড়ানো হয়। এ সবকিছুর পিছনে অন্যতম কারণ হলো ভারত সাহিত্যাঙ্গনে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে যা এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ এখনো পারেনি। দেশটি এমন কিছু লেখক পেয়েছে যারা চমৎকার সাহিত্য রচনা করে ভারতীয় সাহিত্য তো বটেই, বিশ্ব সাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করছে। ভারতের উর্বর ভূমিতে অসাধারণ সাহিত্যিকদের জন্ম হয়েছে। যারা অবিরাম তাদের কৃষ্টি ও সভ্যতাকে তুলে ধরছে বিশ্ব দরবারে তাদের সাহিত্য কর্মের মাধ্যমে। ঊনত্রিশটি স্টেট এবং ১৩০ কোটির ওপরে জনসংখ্যা নিয়ে ভারত এগিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। বহু ভাষা ও বিচিত্র সংস্কৃতির দেশ ভারত। এখানে ইংরেজি ভাষায় যারা লিখে তারাই বিশ্ব দরবারে সবচেয়ে পরিচিত মুখ। কিন্তু অন্যান্য ভাষায়ও অনেক বিখ্যাত ও জনপ্রিয় লেখক রয়েছে যাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ অনূদিত হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। এ লেখাটিতে ইংরেজি ভাষার লেখক ছাড়াও অন্যান্য ভাষার লেখকদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে উপস্থাপন করা হবে।

এ উপমহাদেশে ঔপনিবেশিকতার বীজ রোপিত হয়েছিল ১৭৫৭ সালে। আর ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের মাধ্যমে তার সমাপ্তি ঘটে। ঔপনিবেশিকতার যাঁতাকলে থাকা অবস্থায় অনেকেই লেখালেখি করেছে। কিন্তু সে ইতিহাস অন্যরকম। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরে ভারতে যে সব সাহিত্যিক তাদের শক্তিশালী লেখনীর মাধ্যমে সমাজে ও মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করেছে তাদেরকে নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। কিন্তু গত দশ-বিশ বছর যারা লিখছে তাদের সাহিত্য কর্মই আলোচনায় প্রাধান্য পাবে। যে সব লেখক পাঠক হৃদয়ে চিরস্থায়ী অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে এবং জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতেও যাদের অবস্থান ওপরের দিকে তাদের মধ্যে সালমান রুশদি, অমিতাভ ঘোষ, অনিতা দেশাই, মুলক রাজ আনন্দ, আর. কে. নারায়ণ, অরুন্ধতি রায়, খুশবন্ত সিং, বিক্রম শেঠ, নীরদ চৌধুরী, অমিত চৌধুরী, রোহিন্তন মিস্ত্রে প্রমুখ। আমি বলছি ইংরেজি ভাষায় যারা লেখালেখি করেন তাদের কথা। এদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা অবশ্যই বলতে হবে। যদিও তিনি বাংলা ভাষার কবি ও লেখক হিসেবে অধিক পঠিত ও সমাদৃত, তিনি ইংরেজি ভাষায়ও লিখেছেন অনেক অসাধারণ সাহিত্য। তিনি ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। রবীন্দ্রনাথ একমাত্র ভারতীয় সাহিত্যিক যিনি নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন। তাছাড়া মহাত্মা গান্ধীও রচনা করেছেন কিছু অসাধারণ সাহিত্য।

কবিতার ক্ষেত্রেও ভারতীয়দের অবস্থান বিশ্ব সাহিত্যে শক্তিশালী। যে সব কবি তাদের নাম ছড়িয়েছেন আলোর মতো, যারা সমৃদ্ধ করেছে ভারতীয় কাব্যিক ঐতিহ্যকে তাদের মধ্যে যার নাম প্রথমেই বলতে হয় তিনি নিসিম ইজেকিয়েল। ভারতীয় ইংরেজি কবিতার জগতে আধুনিকতার প্রবক্তা বলা হয় তাকে। তার আগে ভারতীয় কবিতায় রোমান্টিক ও মিস্টিক ধারার কবিতার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তী সময়ের কবিরা নিসিমের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রচনা করেছে অনবদ্য আধুনিক কবিতা। আর যে সব কবিদের নাম উল্লেখযোগ্য তারা হলো এ. কে. রামানুজন, কমলা দাস, ডম মোরায়েস, জয়ন্ত মহাপাত্র, কেকি এন. দারুওয়ালা, অরুণ কোলাতকার, তরু দত্ত, ইউনিস দে সোজা, সুদীপ সেন, জিৎ থাইল সহ আরো অনেকে। তারা সবাই ইংরেজিতে লেখেন।

উপরে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, উপন্যাস, গল্প ও কবিতার ক্ষেত্রে—তারা সবাই ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন। তাদের ছাড়াও ভারতের অন্যান্য অনেক ভাষায় অনেকেই অনন্য অসাধারণ সাহিত্য রচনা করেছেন। তার মধ্যে বাইশটি তালিকাভুক্ত ভাষার মধ্যে অন্যতম হলো আসামিজ, বাংলা, উর্দু, গুজরাটি, হিন্দি, মালায়লাম, মনিপুরি, পাঞ্জাবি, তামিল ও তেলেগু অন্যতম।

ইংরেজি ভাষায় যারা উপন্যাস রচনা করে বিশ্ববরেণ্য হয়েছেন তাদের মধ্যে সালমান রুশদি অন্যতম। তিনি তার অনবদ্য সাহিত্য কর্ম মিডনাইট’স চিলড্রেন এর জন্য ম্যানবুকার পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৮১ সালে। তাছাড়া এ উপন্যাসটি বিশ্ব সাহিত্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। পাঠক প্রিয়তা ও সমালোচনা উভয় ক্ষেত্রে তার লেখা উঁচু অবস্থানে রয়েছে। তার স্যাটানিক ভার্সেস নিষিদ্ধ হয়েছে এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি, লিখে যাচ্ছেন সমান তালে। তার অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে শেইম, ফিউরি, দি ইন চ্যানট্রেস অব ফ্লোরেন্স, দ্য গোল্ডেন হাউস অন্যতম।

অমিতাভ ঘোষ রচনা করেছেন অসাধারণ কিছু উপন্যাস, দ্য শ্যাডু লাইন্স তার সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস। এ উপন্যাসটি দেশ বিভাগের ওপর ভিত্তি করে লেখা। বাংলাদেশের প্রসঙ্গও এসেছে উপন্যাসটিতে। তাছাড়া দ্য সার্কল অব রিজন, দ্য ক্যালকাটা ক্রমোজম (১৯৯৫) ও রিভার অব স্মোক (২০১১) তার অনন্য কাজ। আর. কে. নারায়ণ আর একজন অসাধারণ কথাসাহিত্যিক। তার সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাসটির নাম দ্য গাইড (১৯৫৮)। তাছাড়া দ্য ইংলিশ টিচার (১৯৪৫), ওয়েটিং ফর দ্য মাহাত্মা (১৯৫৫), ও দ্য ম্যান-ইটার অব মালগুদি (১৯৬১) তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।

বিক্রম শেঠ একাধারে একজন কবি ও কথাসাহিত্যিক। তার সাড়া জাগানো উপন্যাস হলো এ সুটেবল বয় (১৯৯৩)। এটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৩৪৯। তাছাড়া তার দ্য গোন্ডেন গেট (১৯৮৬) একটা অসাধারণ উপন্যাস। যারা ইংরেজি লেখালেখি করে সুখ্যাতি অর্জন করেছে তাদের মধ্যে অরুন্ধতি রায়ের কথা বলা আবশ্যক। একজন মানবতাবাদী লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট রয় দ্য গড অব স্মল থিংস (১৯৯৭) লেখার মাধ্যমে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৭ সালে প্রকাশ করেন তার দ্বিতীয় উপন্যাস দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস।

রহিন্তন মিস্ত্রি একজন স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক যার সাচ এ লং জার্নি (১৯৯১) নামক উপন্যাসটি একটি সাড়া জাগানো উপন্যাস। তাছাড়া এ ফাইন ব্যালেন্স (১৯৯৫) ও একটি বিখ্যাত উপন্যাস। ঝুম্পা লাহিড়ি আমেরিকায় বসবাসরত একজন অভিবাসী লেখক যিনি ইতিমধ্যে অর্জন করেছেন খ্যাতি ও পাঠকের ভালোবাসা। তিনি পুলিৎজার প্রাইজ থেকে শুরু করে অন্যান্য অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। দ্য নেইমসেক (২০০৩) ও দ্য লোল্যান্ড (২০১৩) তার অসাধারণ দুটি উপন্যাস। এছাড়া ইন্টার প্রিটার অব ম্যালাডিজ (১৯৯৯) ও আন এ্যাকাস্টমড্ আর্থ (২০০৮) তার গল্পের বই। অনিতা দেশাই ভারতীয় সমকালীন সাহিত্যিকদের মধ্যে একটি উজ্জ্বল নাম। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো ফাস্টিং, ফির্স্টিং (১৯৯৯), জার্নি টু ইথাকা (১৯৯৫), ইন কাস্টডি (১৯৮৪) ও ক্লিয়ার লাইট অব ডে (১৯৮০)। এছাড়া ম্যান বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক কিরণ দেশাইয়ের দি ইনহেরিট্যান্স অভ লস (২০০৬) একটি অসাধারণ উপন্যাস। খুশবন্ত সিং এর লেখা কয়েকটি পাঠক প্রিয় উপন্যাস রয়েছে। কিন্তু তার ট্রেন টু পাকিস্তান (১৯৫৬) একটি অনবদ্য ও কালজয়ী উপন্যাস যেটা দেশ বিভাগকে উপজীব্য করে লেখা।

কবিদের মধ্যে যাদের নাম প্রথম সারিতে রয়েছে তাদের মধ্যে নিসিম ইজেকিয়েল, এ কে রামানুজন, কমলা দাস, কে কি এন দারুওয়ালা, জয়ন্ত মহাপাত্র, ডম মোরায়েস, অরুন কোলাতকরে, তরু দত্ত, ইউনিস দো সুজা, সুদীপ সেন, জিৎ থাইল, রবিন অঙ্গোম, শান্তা আচার্য, নবিনা দাস, ভিনিতা আগ্রাওয়াল অন্যতম। নিসিম ইজেকিয়েল কে ভারতীয় ইংরেজি কবিতায় আধুনিকতার প্রবর্তক হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। তার আগে কবিতায় রোমান্টিকতা ও মিস্টিসিজম এর প্রাধান্য ছিল। নিসিমের সমসাময়িক কবিরা তথা তার পরবর্তী সময়ে যত কবি এসেছে তারা সবাই আধুনিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে কবিতা রচনা করেছেন।

তাদের কবিতায় ও যাপিত জীবনে আধুনিকতার ছাপ ছিল। নারীদের মধ্যে কমলা দাস সাহসী কবিতা লিখে তার অনুজদের মাঝে দীপ্তি ছড়িয়েছেন। বর্তমানে অনেক কবি আছেন যারা ভালো কবিতা লিখছেন এবং বিশ্ব দরবারে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছেন।

অাসামিজ লেখক ও কবিদের মধ্যে যারা আলো ছড়াচ্ছেন তাদের মধ্যে অর্ণব জান দেকা, হোমেন বর্গোহান, মিত্র ফুকান ও ইন্দিরা গোস্বামী অন্যতম। গোস্বামীর লেখায় মানবতার কথা ফুটে উঠেছে। তিনি সাধারণ মানুষের কথা বলেছেন তার লেখায় । মিত্র ফুকান আসামের হলেও তিনি ইংরেজিতে লেখালেখি করেন। হোমেন পেশায় একজন সাংবাদিক হলেও তার সাহিত্য, বিশেষ করে ছোট গল্প, তাকে এনে দিয়েছে বিরল খ্যাতি।

বাংলা ভাষায় যারা বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও মধুসূদন দত্ত, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী অন্যতম। বর্তমানে নবনীতা দেব সেন, সঙ্গীতা বন্দোপাধ্যায় ভালো লিখছেন।

হিন্দি ভাষায় রচিত সাহিত্য ভারতীয় সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। হিন্দি সাহিত্য প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রাজত্ব করে চলেছে। এ ভাষার অনেক ক্ল্যাসিক লেখা হয়েছে। যেসব নাম হিন্দি সাহিত্যে উজ্জ্বলতর তাদের মধ্যে বিদ্যাপতি, কবির, মিরাবাই, তুলসি দাস, গঙ্গা দাস, নরেশ মেহতা, বিবেক রয়, রাগুবির সাহা, নরেন্দ্র কোহলি, মোহন রানা অন্যতম। কবিতায় বর্তমানে যাদের নাম উল্লেখযোগ্য তারা হলেন গুলজার, গীত চতুর্বেদি, অশোক চক্রদার ও আম্বারিশ শ্রীবাস্তব।

তামিল ও তেলেগু ভাষায় রচিত সাহিত্যও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তামিল ও তেলেগু সাহিত্যিকদের মধ্যে যারা সুখ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অনেকের প্রধান ও অন্যতম কাজগুলো অন্যান্য ভাষাতে অনূদিত হচ্ছে। এছাড়া মনিপুরি, পাঞ্জাবি, মালায়লামসহ অন্যান্য অনেক ভাষায় প্রচুর ভালো বই লেখা হচ্ছে এবং তাদের অনুবাদ ও প্রকাশিত হচ্ছে।

ভারতীয় সাহিত্য সত্যিই একটা ঈর্ষণীয়, উঁচু স্থান দখল করে আছে। একটা উন্নত রাষ্ট্রের সাহিত্যিক অবস্থান এমনটাই হওয়া বাঞ্ছনীয়। পাঠক প্রিয়তা ও সমালোচনা উভয় মাপকাঠিতে ভারতীয় সমকালীন সাহিত্য একটা অনন্য জায়গায় রয়েছে। তুলনামূলক সাহিত্যেও ভারতীয় সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, সারা পৃথিবীতে ভারতীয় সাহিত্য প্রধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে এবং বর্তমান লেখক ও কবিরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনে।