স্বপ্ন ও শবযাত্রা

করোনায় আমরা ভীত নই। বরং মোকাবেলা করছি গৃহে অন্তরীণ থেকে। এতে হয়ত কিছুটা বাড়তেও পারে মানসিক চাপ। তাই আসুন, খুলে দেই মনঘরের জানালা। নিজেকে চালিত করি সৃজনশীলতায়। আপনি নিয়মিত লিখছেন, বা এটাই হতে পারে আপনার প্রথম গল্প। লিখুন ফেসবুকে। চটজলদি ৫০০ শব্দের গল্প, বাংলা ট্রিবিউনের জন্য। একইসঙ্গে নমিনেট করুন আপনার পছন্দের আরো ১০ জন লেখককে। সেরা ১০ জন লেখক পাচ্ছেন কাগজ প্রকাশনের বই। আর অবশ্যই হ্যাশট্যাগ দিন #বাংলাট্রিবিউনসাহিত্য

noname

কয়েকদিন ধরেই রাতে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছে ইকতিয়ার। এক শবমিছিল যাচ্ছে। রাস্তার দু’পাশে বিশাল অট্টালিকা, ঠিক প্রাচীন গ্রিসের শহরে যেমন দেখা যেত। বহু মানুষ ধীর পায়ে অনুসরণ করছে শবযাত্রীদের। তাদের সবার গায়ে আজানুলম্ব সাদা কাপড়। বিস্ময়ের ব্যাপার হল, মিছিলটি যখন কবরস্থানে এসে পৌঁছাল, দেখা গেল, জায়গাটি ইকতিয়ারদের শহরে। মৃতের খাটিয়া কবরে নামানো হলে গভীর আতঙ্কের সাথে ইকতিয়ার লক্ষ্য করে, শবদেহের মুখ অবিকল ওর মা তাহেরা বানুর মতো। যিনি এখনো জীবিত রয়েছেন।
শবযাত্রী। তাহেরা বানুর মৃতমুখ। এটা কিসের ইঙ্গিত? ইকতিয়ার ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। বহু ভেবেও এ স্বপ্নের কোনো অর্থ বের করতে পারে না। বন্ধুবান্ধবরা শুনে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে পরামর্শ দিয়েছে, ফকির-মিসকিন খাইয়ে দিতে। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই ইকতিয়ারকে স্বপ্নের কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারে না। কোনো সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যাবে কি না সেটি নিয়েও ভাবতে থাকে। তবে উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখা নিয়ে ইকতিয়ারের কখনো মাথাব‌্যথা ছিল না। কিন্তু স্বপ্নে দেখা মৃতদেহটি মায়ের হওয়ায় মনে মনে বিচলিত হয়ে ওঠে সে।
সেই অদ্ভুত স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি আজ রাতেও ঘটে। সেই শবমিছিল। দূর্বোধ্য সঙ্গীত মুখে অভিব্যক্তিহীন সাদা কাপড় পরা শবযাত্রী। এবং তাহেরা বানুর মৃতমুখ। আজ নতুন আরেকটি বিষয় যোগ হয়।
তাহেরা বানু তাকিয়ে রয়েছেন ইকতিয়ারের দিকে। তার বুকের ওপর বসে আছে একটা শকুনসদৃশ পাখি। বিকট ভঙ্গিতে পাখা মেলে আছে। চিৎকার করে ডেকে পাখিটিকে সরাতে যায় ইকতিয়ার। ঘুম ভেঙে যায় ওর। পাশের ঘরে তাহেরা বানুর সাড়া পাওয়া যায়। ঘরে এসে ঢোকেন তিনি। তার পেছন পেছন ছোটবোন সালমাও আসে। তাহেরা বানু উদ্বিগ্ন চোখে ছেলের কাছে এসে দাঁড়ান। বলেন, কিরে, খারাপ স্বপ্ন দেখছস?
ইকতিয়ার ততক্ষণে বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা নাড়ে। বড় করে নিশ্বাস ফেলতে থাকে সে। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। তাহেরা বানু সুরা পড়ে ইকতিয়ারের মাথায়-শরীরে ফুঁ দিতে থাকেন। সেদিনের পর থেকে হঠাৎ দুঃস্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়ে যায়। কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে ইকতিয়ারের। তবে কয়েকদিন অফিসে আসা হয়নি। টেবিলে ফাইলের স্তুপ। আজ তাই অফিসে এসে কোনো দিকে না তাকিয়ে মুখ গুঁজে ফাইলের কাজ সারে। পিয়নকে ডেকে চা দিতে বলে। তারপর শরীর কিছুটা এলিয়ে দেয় চেয়ারে।
পিয়ন এসে চা দিয়ে যায়। ইকতিয়ার চায়ে চুমুক দিয়ে আবার ফাইলের কাজে মন দিতেই মোবাইল বেজে ওঠে। বড় মামার ফোন। মাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। গুরুতর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। এখন আইসিউতে। তাহেরা বানুর অ‌্যাজমার সমস‌্যা অনেক আগের। কিন্তু মাঝেমাঝেই ইনহেলার নিতে অবহেলা করেন। তবে সকালেও মাকে ভালো দেখে এসেছে ইকতিয়ার।

হাসপাতালে আইসিউর দরজার কাছে ছোট্ট জটলা। বুকের ভেতর ধক করে ওঠে ইকতিয়ারের। ভীড়ের মাঝে বড় মামাকে দেখতে পায়। ইকতিয়ারকে দেখে সালমা ছুটে আসে। সালমার চোখমুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ওর কাঁধে একটা হাত রেখে সামনে এগোয় ইকতিয়ার। লোকজন জায়গা ছেড়ে দিল ওকে। আইসিউর ভেতরে ঢুকে ইকতিয়ার দেখতে পায় তাহেরা বানু স্ট্রেচারে। চোখ নিষ্পন্দ।

আজিমপুর গোরস্তানে আসতে আসতে ইকতিয়ার টের পায় সে কাঁদতে পারছে না। ঘুরে ফিরে ভাবছে সেই স্বপ্নের কথা। মাকে কবরে নামানোর সময় ইকতিয়ার হঠাৎ খেয়াল করে, তাহেরা বানুর মুখ থেকে কাফনের কাপড় সরে গেছে। মুখের কাছে তাহেরা বানু নয়। সেখানে ইকতিয়ারের মুখ। ইকতিয়ারের চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়। মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগে ইকতিয়ার শুনতে পায় কেউ বলছে, ‘পোলাডারে ধর, মায়েরে হারায়া কেমুন কষ্টটাই না পাইতাছে।’