ঘাস পাতার জীবন

করোনায় আমরা ভীত নই। বরং মোকাবেলা করছি গৃহে অন্তরীণ থেকে। এতে হয়ত কিছুটা বাড়তেও পারে মানসিক চাপ। তাই আসুন, খুলে দেই মনঘরের জানালা। নিজেকে চালিত করি সৃজনশীলতায়। আপনি নিয়মিত লিখছেন, বা এটাই হতে পারে আপনার প্রথম গল্প। লিখুন ফেসবুকে। চটজলদি ৫০০ শব্দের গল্প, বাংলা ট্রিবিউনের জন্য। একইসঙ্গে নমিনেট করুন আপনার পছন্দের আরও ১০ জন লেখককে। সেরা ১০ জন লেখক পাচ্ছেন কাগজ প্রকাশনের বই। আর অবশ্যই হ্যাশট্যাগ দিন #বাংলাট্রিবিউনসাহিত্যnonameদুড়দাড় করে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে হাঁটছে কেরামত আলী। রাস্তাটা নিরাপদ। জনমনিষ্যি নাই। বুকের মানিকডারে বুকের মধ্যে জড়ায়ে দৌড়াচ্ছে। নিজের শীতল গা দিয়ে মাইয়াটার তপ্ত শরীরটা ঠান্ডা করতে করতে। সদ্য মা মরা মাইয়া। জন্ম যেদিন হয় সেদিন বাজারের পথ দিয়ে আসতে আসতে দেখে জলার কাছটায় থোক কাশফুল। ভাদ্র মাসের আকাশ। উপরে চোখ দিয়াই মনে হইছিল সাদা পানিতে কেউ নীল গোলায়ে হাত দিয়া নাড়তাছে আর তা নানান কিসিমে ছড়াইতেছে। বাড়িত আইসা এক্কেরে কাশফুলের মতন মাইয়া দেইখা তো তাজ্জব, এরপর ঢোক গিলতে নামটা মাথায় আইল‘কাশফিয়া’।

গ্রামের লোকজনে হাসল নাম শুইনা। কইল মডার্ন নাম। ‘মাইয়া তো তোরে ভাত দিব না দুইদিন পরে।’ শুইনা কেরামতের মুখের হাসি ফুরাইত না। মাইয়াটা মডার্ন হইলে ক্যামনে চ্যাংব্যাং কইরা ইংরাজিতে বাপরে বকব ভাইবা মাঝরাইতেও স্বপ্নে খুটখুট করে হাসত। মলিনা জামাইরে ধাক্কা দিয়া কইত, ‘পাশ ফিরা শোও, বোবায় ধরছে? এমুন শব্দ করো ক্যান?’

কেরামত আলী সুখে চক্ষু বন্ধ করত। বেশি হাসি ভালো না, মুরব্বিরা কয় দেইখাই কী দিনরাতের হাসি চোখে লাইগা গেছে? কে জানে! কেরামত আলী মনে করতে চেষ্টা করল, এই আচমকা হাসি কয়দিন আগে হাসছে? তা তো প্রায় দুই বছর আগে মনে হয়। যতদিন হাসছে তখন তো কিছু হয় নাই। মানুষ সুখে থাকুক আর কষ্টে—এক তো আর সারাজীবন থাকতে পারে না। তাই কারণ ছাড়াই যে হাসি আইত, কারণ ছাড়াই তা বন্ধ হইয়া গেল। যা বাকি রইল, তা কেবল স্বপ্ন। মলিনার স্বপ্নও ছিল মাইয়াটারে নিয়া। দুইজনে মেম সাজাইয়া রাখত আর কপালে দিত জাম্বুরার সমান কালা টিপ যাতে নজরে না লাগে।

কেরামত এইবার হাঁপাতে থাকে। অনেকক্ষণ হাঁইটা আসছে। এইবার বইতে হইব। কেরামত আলী এইবার এক গাছের ছায়ায় বসে। মাইয়ারে কালা টিপ দিয়া রাখছিল, সংসারটারে তো রাখে নাই। বদনজর তাই সংসারেই আইল। কই থিকা আচমকা এক জ্বরে মলিনা পুইড়া যাইতে থাকল। সারারাত মাথায় পানি দেয়ার পরদিন থিকা এমুন সর্দি লাগল যে বুকের ঘড়ঘড় শব্দ শোনা গেল। কেরামত ডাক্তার ডাকানির আগেই দেখল মলিনার হাপড়পাড়া বুকটা উঠতেছে আর নামতেছে। চোখ দুইটা ঠিকড়ায় বাইর হয়। আট বছরের কাশফিয়া আর তার সারারাত জাগানির পরেও সকাল দশটার মধ্যেই মলিনা মইরা গেল। অল্প কয়েকজনরে ডাইকা জানাজা পড়ায়ে মাটি দিয়া ঘরে ঢুইকাই দেখে কাশফিয়া পুইড়া যাইতেছে জ্বরে।

মাইয়াটারে বুকে জড়ায়ে দৌড়াইয়া ফকির আলীর বাড়িত গিয়া ডাকতেই ফকির আলীর চোখ ঠিকড়ায়ে বাইর হইল। কইল, ‘কেরামত আর আহিস না কাছে, এইডা করন্না হইছে। বাইর হ, ভাই তুই।’

কইয়াই হাঁকডাক শুরু করল, ‘ওই বাড়ির চারপাশ ব্লিচিং ছিটা, ব্লিচিং ছিটা; হায় হায় রে, আইজ কী অলুক্ষণেই জানাজায় গেছিলাম রে।’কেরামত আলীর অবাক চোখের সামনে দাঁড়ায়ে এইবার ধমকের স্বরে বলে, ‘গেলি না তুই হারামজাদা। আমারে নির্বংশ করবি?’ চেনারে অচেনা লাগা ফকির আলীর দিকে তাকায়ে মেয়েটারে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। হাসপাতাল ম্যালা দূর। রাত পার হইলেই রওনা দেয়ার কথা ভাবতে ভাবতে ছমছমে বাড়ির পাশটায় কেমন জানি এক অদৃশ্য ছায়া টের পায়। হঠাৎই আবিষ্কার করে পেছনের চালায় কী জানি এক পড়ল। শব্দে পেছনের জানালা দিয়ে উঁকি মারতেই দেখে একের পর এক চ্যালাকাঠের আগুন এসে পড়ছে বাড়িটার ওপরে। সম্বিৎ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বোঝে, বাড়িতে আগুন। কাশফিয়ারে পাখির মতো ছোবল দিয়ে বুকে জড়ায়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে আসে। ডোবার কাছটায় ফাঁকা পেয়ে দেয় দৌড়, একবার পেছনে তাকিয়ে দেখে কুমড়ায় হ্যালানো চালাটায় হলুদের নাচানাচি। আলোয় কুমড়াটার সোনার রং।

জঙ্গলের গাছপাড়ে বসে মেয়েটার মুখটারে একবার কোলের ওপর নিয়ে দেখে। ধক করে উঠে বুক। কাশফিয়ার বুকটা অনেকক্ষণ কানের কাছে ধরা। ওঠানামা নাই। শব্দও নাই। পলকা দেহটা তবু কেরামত আলী কাঁধে নেয়। জঙ্গল দিয়া দুড়দাড় করে অচেনা গন্তব্যে হাঁটতে হাঁটতে খালি ভাবে, ‘চোখ ভাইসা যাওয়ার পরেও মুখখানা দিয়া শব্দ ক্যান আহে না, খুটখুট হাসির শব্দ তো হাজার চেষ্টা কইরাও আটকানো যাইত না!’