প্রথম ও শেষ চিঠি

করোনায় আমরা ভীত নই। বরং মোকাবেলা করছি গৃহে অন্তরীণ থেকে। এতে হয়ত কিছুটা বাড়তেও পারে মানসিক চাপ। তাই আসুন, খুলে দেই মনঘরের জানালা। নিজেকে চালিত করি সৃজনশীলতায়। আপনি নিয়মিত লিখছেন, বা এটাই হতে পারে আপনার প্রথম গল্প। লিখুন ফেসবুকে। চটজলদি ৫০০ শব্দের গল্প, বাংলা ট্রিবিউনের জন্য। একইসঙ্গে নমিনেট করুন আপনার পছন্দের আরও ১০ জন লেখককে। সেরা ১০ জন লেখক পাচ্ছেন কাগজ প্রকাশনের বই। আর অবশ্যই হ্যাশট্যাগ দিন #বাংলাট্রিবিউনসাহিত্যnonameপ্রিয়তমা মেহুল,
গত বুধবারে সর্বশেষ আমি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চিকিৎসা দিতে গিয়েছিলাম। তখনও এদিকে মহামারি, মহামারি রূপ নেয়নি। সরকার থেকে আমাদের জন্য অতিরিক্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা করার পরেও আমরা ভয়ে ভয়েই চিকিৎসা দিচ্ছিলাম। কারণ, এদিকের মানুষের মধ্যে সতর্কতার বালাই নেই। এদিকে দেশ লকডাউন হয়ে যাওয়ায় আশেপাশের সকল প্রকার দোকানপাট বন্ধ হওয়ায় খাবারের কষ্ট হচ্ছিল খুব। একদিনতো ক্যাম্প থেকে ফিরতে রাত হয়ে যাওয়ায় কোনো খাবার পাইনি। হোটেলের আশেপাশের সবকিছু বন্ধ ছিল। ব্যাগে একটা নাটি বিস্কুটের প্যাকেটে তিনটা বিস্কুট ছিল। তাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শেষবার আসার সময় তুমি আগে থেকেই সতর্ক করে দিয়েছিলে যেন বেশি করে কিছু শুকনো খাবার কিনে রাখি। আমি কয়েক প্যাকেট বেনসন সিগারেট ছাড়া আর কিছুই কিনিনি। ওইবার বাসায় থেকে তোমার কথামতো চাকরিটা ছেড়ে দিলেই ভালো হতো। কিন্তু আরও কিছুদিন ডিউটি করে এতগুলো নগদ টাকা পাওয়ার লোভটা ছাড়তে চাচ্ছিলাম না। এই টাকার অর্ধেক দিয়ে গাড়ির শেষ লোনটাও শোধ হয়ে যেত। দেখেছ, তখন তোমার কথা শুনিনি আর এখন আফসোস করছি। এটা সবসমই হয়। এ জন্যই তুমি জিতে যাও, আর আমি হেরে যাই।

সবকিছু ঠিকই ছিল মেহুল। বুধবারে সারাদিন ক্যাম্পে ছিলাম। তখন ক্যাম্পের আশেপাশে খুবই সীমিতসংখ্যক ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ছিল। আমরা ডাক্তাররাও বেশ সতর্কভাবেই থেকেছি। বৃহস্পতিবার আমি ক্যাম্পে যাবনা, ভেবেছি স্যালারিটা পেয়ে গেলেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিব। আমার গাড়িতে ‘জরুরি প্রয়োজনে’ স্টিকার লাগানো আছে। তাই লকডাউনের জন্য রাস্তায় আর্মি বা পুলিশ আটকাবে না। এরপরও এক সহকর্মীর ফোন পেয়ে ক্যাম্পে গেলাম। কিছু কাজ করলাম। একটা সেকশনে ভাইরাসের উপসর্গবাহিতদের স্যাম্পল সংগ্রহ করা হচ্ছিল। ডাক্তার রাফিদেরও আমার সঙ্গে বাসায় ফেরার কথা ছিল। দেখলাম সতর্কতাবশত সেও স্যাম্পল দিচ্ছে। রাফিদ আমাকে দেখে বলল, ‘যেহেতু বাসায় পরিবারের কাছে যাচ্ছি আমাদের উচিত পরীক্ষা করিয়ে নেয়া।’ আমিও ভেবে দেখলাম ব্যাপারটা।

ঘণ্টা দুয়েক পর হোটেলের রুমে এসে কাপড়গুলো গোছাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম এবার বাসায় ফিরে তোমাকে মাঝরাতে সবুজ রঙের সুজি রান্না করে খাওয়াব। তখন রাফিদ ফোন দিয়ে ভয়াবহ দুঃসংবাদটা দিল। আমি কীকরব বুঝতে পারছিলাম না। শুধু মনে হচ্ছিল, ভাগ্যিস তোমাকে আগে থেকে ফোন করে বলিনি যে আমি আজ আসব। আমি আসব বলে আসিনি এমনতো কোনোদিন হয়নি! তাই না আসার খবরে তোমার কাছে কোনো অজুহাত দিয়েই পার পেতাম না। তুমি দুশ্চিন্তায় বিচলিত হয়ে আমাকে নিংড়ে সত্যিটা বের করতেই।

চিঠি লেখার মতো সাহিত্যিক প্রেমতো আমার মাঝে কখনোই ছিলনা। তোমাকে দেখতাম মাঝেমধ্যে লেখার জন্য কিছু ওষুধ কোম্পানির প্যাড লুকিয়ে রাখতে। খুঁজে যেন না পাই এজন্য চালাকি করে আমারই লকারের পুরনো কাপড়গুলোর নিচে রাখতে। তুমি রাতে ঘুমালে বা গোসলে গেলে আমিও একটু একটু করে পড়ে তোমার মতো করেই রেখে দিতাম।

এসব কথা বাদ দেই। তুমি বারবার ফোন দিচ্ছ। তোমার সঙ্গে কথা বলব। চিঠি আর দীর্ঘ করব না। এখন একটু মন দিয়ে শোনো, দ্বিতীয় চিঠিতে আমি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছি। ওগুলো তোমার জানা দরকার। মন দিয়ে পড়বে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কথামতো কাজ করবে। আপাতত এত নিউজ চ্যানেল আর খবরের কাগজ পড়ে বিচলিত হবেনা। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় এই জিনিসগুলো বাচ্চাদের জন্য ক্ষতিকর।

আমি হাতে গ্লাভস পরে চিঠিটা লিখছি। এরপর গত কয়েকদিনের অব্যবহৃত একটি শার্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাফিদের কাছে দিয়ে দেব। এরপরও তুমি কাপড়ে স্যাভলন লাগিয়ে হালকা মুছে নিও। প্রথম ও শেষ চিঠি রেখে দিও।

প্রিয়তমা মেহুল, হয়তো তুমি পৌঁছে গেছ চিঠির শেষ লাইনে। এখন হয়তো পড়ন্ত বিকেল। তুমি বারান্দায় বসে তোমার প্রিয় সবুজ রঙের সুজি খাচ্ছ। তোমার পৃথিবীতে এখন আমি নেই। তুমি এখন কাঁদতে পারো।